##মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৬
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
রাহি হাসিমুখে গাড়িতে উঠে আদ্রিয়ানের পাশে বসলো আর বেলুনগুলো পিছনের সিটে রাখলো। ভালোবাসা আসলেই সুন্দর। ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনো রাখঢাক রেখে কিছু চাওয়া লাগে না। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। আদ্রিয়ান এক হাতে গাড়ি চালাচ্ছে অন্য হাতে রাহির হাত ধরে আছে।
সালমান খুরশিদের বাসায় আজ আনন্দের ঢল নেমেছে। সবাই খুব খুশি। বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে বহু বছর পর। রিনা বেগমও নাতিনাতনি আসার সুসংবাদে পুত্রবধূকে আরো বেশি আদর যত্ন করতে শুরু করেছেন।
” রাহি তুমি আজ থেকে আর কোনো কাজকর্ম করবে না। যা দরকার আমি নিজে করবো।”
বসার ঘরে সোফায় বসে কথাগুলো বললেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ, আদ্রিয়ান, রাহি সবাই এখানে উপস্থিত। মায়ের কথার প্রতুত্তরে আদ্রিয়ান বললো,
” আমি কাজকর্ম করার জন্য একজন লোক রেখে দিবো মা। এই বয়সে তোমাকে সব কাজ করতে হবে না। ”
” হ্যাঁ মা আপনার ছেলে ঠিক বলেছে। আপনি আমার সাথে গল্প করবেন,আপনার যা ভালো লাগে তাই করবেন।”
” লোক রাখলেও আমি রান্নাবান্না দেখে নিবো সব। নিজের সংসারের কাজকর্ম বাইরের লোক দিয়ে করালে ঠিক শান্তি আসে না রাহি।”
” আচ্ছা মা আপনার যেমন ইচ্ছে। ”
” তোমার সাথে এমনিতেই গল্প করবো। ”
রিনা বেগমের কথায় রাহি মুচকি হাসলো। সালমান খুরশিদ আদ্রিয়ানের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। দুই দিন পর মিহিদের পরিবারের সবাইকে ডেকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করবে। পরিবারের সবাই একসাথে নতুন অতিথি আসার সংবাদ পাওয়ার আনন্দে একত্রিত হবে। রাহি আনমনে একবার শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। সময় সবকিছু কেমন করে বদলে দেয় তাই না? একটা সময় রিনা বেগম রাহিকে চোখে দেখতে পারতো না আর আজ!
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে মিহিকে কল করে রাহি। রাহি বিছানায় বসে আছে আর আদ্রিয়ান রাহির কোলে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে।
“হ্যালো মিহি,কেমন আছো তোমরা?”
” এইতো ভালো ভাবি, তোমরা কেমন আছো? ”
” আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো আছি। তোমাকে একটা খবর দেওয়ার জন্য কল দিলাম। ”
” হ্যাঁ বলো,সবকিছু ঠিক আছে তো ভাবি?”
মিহির কন্ঠে ব্যতিব্যস্ততা অনুভব করে রাহি আর হেয়ালি না করে সরাসরি বললো,
” তুমি ফুপি হতে যাচ্ছো।”
” কী বললে? সত্যি ভাবি? দিনে বললে না কেনো? আমি আসতাম তখনই। ”
” আরে পাগলি শান্ত হও। বাবা রুদ্রকে কল দিয়ে দাওয়াত করবেন, পরশু এসো সবাইকে নিয়ে। ”
” ঠিক আছে ভাবিইইই। আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো লাগছে। ”
” এখন রাখছি পরে কথা হবে। ”
মিহি উত্তেজনায় বিছানায় বসা থেকে উঠে দৌড়ে রুদ্রকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। রুদ্র ল্যাপটপে একটা জটিল রোগ সম্পর্কে কিছু আর্টিকেল পড়ছিল। মিহির হঠাৎ এরকম কান্ডে বেশ অবাক হলো। সেদিনের পর থেকে মিহি বেশ দূরে দূরে থেকেছে। কিছুতেই ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। রুদ্রকে বলেছে কয়েকদিন সময় লাগবে তার। তাই রুদ্র নিজে থেকেও কোনো প্রকার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি।
” কী হয়েছে মিহির দানা? এত এক্সাইটেড কেনো? ”
মিহি রুদ্রকে ছেড়ে সামনের একটা চেয়ারে হাসি হাসি মুখ করে বসলো।
” আমি ফুপি হতে যাচ্ছি ডাক্তার সাহেব! ”
” ওহ খুব ভালো নিউজ তো। ”
” ইয়েস। অলরেডি রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, নইলে এখুনি যেতাম ভাবির কাছে। ”
” নিজের তো মুরোদ নেই তাই ভাবির বেবির খবর শুনেই আনন্দ করো আরকি। সুমিরও বেবি হবে জানো তো?”
মিহি ঠোঁট উল্টে বললো,
” হুম জানি কিন্তু আমার মুরোদ নেই কে বললো আপনাকে? ”
” আছে বলছো?”
” আলবাত আছে। সেদিন না বললেন আমি এখনো ছোটো, ওইসব করার বয়স হয়নি। ”
রুদ্র ল্যাপটপ বন্ধ করে রেখে মিহির হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,
” আমার বউ যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। এখন থেকেই বাচ্চাকাচ্চা নেওয়া শুরু না করলে ভবিষ্যতে ক্রিকেট টিম কীভাবে গঠন করবো বলো তো?”
” এই শুরু হয়েছে আপনার বদমাইশি। ”
রুদ্র মিহির হাতদুটো টান দিয়ে মিহিকে নিজের দিকে টানলো আরেকটু। কিন্তু মিহি ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। কিন্তু রুদ্র ধরে নিজের কোলে বসালো। মিহি বেশ অপ্রস্তুত হলো তাতে।
” ডু ইউ লাভ মি মিহির দানা? ”
” উমম…ভেবে বলবো। ”
” অপেক্ষায় রইলাম তাহলে। তবে ভালো না বাসলেও চলবে। শুধু আমার সন্তানের মা হবে তাতেই চলবে। ”
” কী বাজে লোক! ”
রুদ্র মিহিকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। রুদ্রর প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের আওয়াজে মিহির মনের মধ্যে কেমন যেনো অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে লোকটাকে আপন করে নিতে। আসলে মিহি যতোই রুদ্রকে নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করে, দিনশেষে সেই অচেনা লোকটার স্পর্শ তাকে রুদ্রর স্পর্শ পেতে কোথাও যেনো আঁটকে ফেলে। কিন্তু আজ মিহি মনস্থির করেছে রুদ্রকে তার অধিকার দিবে। সেই স্পর্শ যতই ভাবাক তাকে সেটা পরপুরুষের, কিন্তু রুদ্র তার স্বামী। মিহির নিরবতা রুদ্রকে ভাবাচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেখা চিন্তিত স্বরে শুধালো,
” তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে মিহির দানা? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে! ”
” ঠিক আছি আমি। আপনার বুকের ধুকপুকানি শুনছিলাম। ”
” তা কী শুনলে? কী বলে হৃদয়? ”
” বলছে, আজ মিহির দানাকে খুব করে কাছাকাছি চাচ্ছে সে।”
” বাব্বাহ! সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছিলো? ”
মিহি রুদ্রর বুকে আলতো করে আদুরে ঘুষি মারলো কয়েকটা। রুদ্র মিহির ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুলগুলো এক পাশে সরালো। নিমিষেই মিহির শরীর জুড়ে কেমন একটা অজানা অনুভূতি বয়ে গেলো। কন্ঠে ব্যাকুলতা নিয়ে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে চেয়ে মিহি। রুদ্র ততক্ষণে ঘাড় থেকে মুখ সরিয়ে মিহির আঁখি যুগলের পানে দৃষ্টিপাত করেছে।
” এভাবে লাজলজ্জা সবকিছু কেড়ে নিলে আপনার সামনে আসতে পারবোনা আর আমি। ”
” আমি তোমার স্বামী। সারাজীবন আমার সামনেই আসতে হবে বুঝলে?”
” ইশশ! ”
” বিছানায় কী হেঁটে যাবে না-কি কোলে তুলে নিবো?”
” আরামে যেতে পারলে কে কষ্ট করে বলুন।”
রুদ্র মুচকি হেসে মিহিকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে মিহির পাশে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” জানো আমার মায়ের চেহারার সাথে তোমার চেহারার একটু একটু সাদৃশ্য খুঁজে পাই আমি। ”
মানুষটার মায়ের কথা মনে পড়েছে। মিহি বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজে থেকেই রুদ্রকে জড়িয়ে ধরলো।
” পৃথিবীতে অনেকের সাথে অনেকের চেহারার মিল থাকে। মায়ের কথা যখন খুব মনে পড়বে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়ে মায়ের জন্য দোয়া করবেন। মন শান্ত হবে।”
” আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তোমার মতো একজন জীবন সঙ্গী দিয়েছেন। ”
” আমিও শুকরিয়া আদায় করি। ”
স্ত্রী’র ললাটে চুম্বন এঁকে গভীর আলিঙ্গনে চোখ বন্ধ করলো রুদ্র। ভালোবাসার মানুষদেরকে বক্ষে জড়ানোতে যে তৃপ্তি কিংবা শান্তি তা আরকিছুতে নেই। সেটা হতে পারে মা,বাবা কিংবা স্বামী – স্ত্রী।
সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে সুমি ও শরীফ। বাড়ির বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলো শরীফ। রাত বাড়তেই সুমির আসার কথা ছিলো। দিনে এক ফাঁকে দেখা করার কথা বলেছিলো শরীফ। যতই পরস্ত্রী হোকনা কেনো সুমি শরীফের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারেনি। তাই মিতু ঘুমানো মাত্রই গুটিগুটি পায়ে দরজা খুলে বাইরে চলে এসেছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরে দু’জন দাঁড়িয়ে অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই। এতদিন অনেক দ্বিধায় ছিলো শরীফ। যতবার ভেবেছে সুমিকে আপন করে নিবে ততবারই সমাজের কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার। এই সমাজ কখনোই একজন অবিবাহিত পুরুষের জীবনে, একজন ডিভোর্সি সন্তানসহ নারীকে গ্রহণ করাকে ভালো চোখে দেখবে না। তার উপর মিতুও যথেষ্ট বোঝে এখন। সাথে সুমির অনাগত সন্তানের কথাও ভাবতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সুমির ডিভোর্স হয়নি এখনও। আদৌও সুমি তার সাথে থাকতে চায় কি-না তা-ও জানে না শরীফ। এতো এতো সমস্যা নিয়ে কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলো না শরীফ। কিন্তু আজ সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ধুয়েমুছে সুমির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শরীফ।
” কেমন আচেন? ”
নীরবতা ভেঙে সুমি নিজেই প্রশ্ন করলো। শরীফ নড়েচড়ে উঠলো। আকাশে অগুনিত তারা,চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। ডিসেম্বরের ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে দু’জনের সর্বাঙ্গে।
” তুমি ভালো নেই সুমি এটা জানার পর একটা মুহুর্ত আমি ভালো নেই। ”
” কিচু করার নাই। তকদিরে যা ছিলো তাই হইছে। আফনে বিয়াশাদী করলেন না ক্যান?”
” তাহলে তোমার কী হতো সুমি?”
শরীফের কথায় সুমি চমকালো। কী বলতে চাচ্ছে লোকটা? করুণা করছে না-কি ভালোবাসা!
” আমার যা হওয়ার তাই হইবো। ”
” সুমি,ভালোবাসো এখনও? ”
” সময়ের যাঁতাকলে ভালোবাসা ভুইলা দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করছি ঠিক। তয় মনের মইধ্যে ঠিক সুপ্ত ভালোবাসা রইয়া গেছে। ”
” একবার তোমার হাত ধরবো?”
” না, আমি এহনো পরস্ত্রী। ”
সুমির এই কথাটা বুকের ভেতর কেমন তীরের মতো বিঁধলো শরীফের। এত বছর পরেও উপেক্ষা? শুধু একটু হাত ছুঁয়ে দেখতেই তো চেয়েছিল। শরীফ কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকে নিজেকে সামলে নিতে।
” ঠিক আছে। তুমি কি তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চাও?”
সুমি নিজের পেটের উপর হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” না চাইলেও যাইতে হইবো। তয় জানি না হেয় আমারে ঘরে তুলবো কি-না। ”
” তাহলে কেনো যাবে তুমি? ”
” এইখানে থাইকা কী হইবো? মিতু একলা থাকলেও একটা কথা হইতো। আরেকজন যে আইতাছে সে?”
” আমি যদি তাকে নিজের সন্তানের পরিচয় দেই সুমি? মিতুকে তুমি বোঝাতে পারবেনা? ”
সুমির বিস্ময় কাটে না শরীফের কথা শুনে। আসলেই সত্যি না-কি সবকিছুই কল্পনা কিংবা স্বপ্ন? সুমির চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। এরকম তো না হলেও হতো। শরীফের সাথে থাকলে কী বিধাতার খুব ক্ষতি হতো? মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তীব্র অভিমান করে সুমি। সুমির নীরবতা দেখে শরীফ আবারও বলে,
” সুমি? আমি তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চাই। তবু কি ফিরিয়ে দিবে আমাকে? ”
শরীফের কন্ঠে এতটা আকুলতা সুমির আর দ্বিধা রইলো না সিন্ধান্ত নিতে।
” আফনে মিতুর বাপের সাথে তালাকের ব্যবস্থা করেন, আমি মিতুরে বুঝামু।”
” আমি কালকেই এ বিষয় রুদ্র ভাইয়াকে বলবো। উনার সাথে আমি সব কথা শেয়ার করি,তোমার বিষয়ও জানে।”
” আইচ্ছা। এহন যাই, ম্যালা রাইত হইছে। আফনেও যান ঠান্ডা লাগবো।”
” আচ্ছা সাবধানে যেও, আসছি।”
শরীফ যতক্ষণ দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিলো সুমি দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর দৃষ্টির আড়াল হতেই দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে নিজের রুমে চলে গিয়েছে।
চলবে,
#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৭
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
শরীফ যতক্ষণ দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিলো সুমি দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর দৃষ্টির আড়াল হতেই দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। মিতু পাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সুমি আস্তে করে মেয়ের পাশে শুয়ে ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো। মিতু ছোটো থেকে মায়ের কষ্ট বোঝে। বাবার অত্যাচার দিন দিন দেখতে দেখতে বাবা নামক মানুষটাকে ঘৃণা করে এখন। কিন্তু সেই বাবার জায়গায় অন্য কোনো মানুষকে কি মেনে নিবে সে? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে বারবার ঘুরছে সুমির। মিতুর অমতে কিছুতেই শরীফকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারবেনা।
সকালের মিঠে রোদ্দুর জানালা ভেদ করে চেম্বারে প্রবেশ করছে। শহুরে মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিক। সকাল সকাল তেমন রোগীর ভীড় না থাকলেও জনাকয়েক রোগী আছে বটে। রুদ্র এক এক করে সবাইকে দেখে বিদায় দিতেই শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। আসলে সকাল থেকেই রুদ্র শরীফের অস্থিরতা খেয়াল করেছে। তাই সুযোগ হতেই কথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিলো রুদ্র।
” শরীফ,সামনের চেয়ারে এসে বসো তো।”
শরীফ রুদ্রর কথা দ্বিমত পোষণ না করে চেয়ারে এসে বসলো। দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো শরীফ। গতরাতে যেভাবে বিষয়টা বলবে ভেবেছিলো এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা ততো সহজ না। পরস্ত্রী’কে বিয়ে করার ইচ্ছে বড়ো ভাই সমতুল্য লোকটাকে অকপটে বলার সাহস হচ্ছে না তার।
” এখন বলো এক্সাক্টলি কী হয়েছে? ”
শরীফকে চুপ থাকতে দেখে ফের রুদ্র প্রশ্ন করলো। শরীফ দোনোমোনো করতে করতে বললো,
” ভাই কাল সুমির সাথে কথা হয়েছিলো।”
” তারপর? কী বললো?”
রুদ্র বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শরীফের চেহারার দিকে। শরীফ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
” ওর স্বামীর থেকে ডিভোর্স আনতে হবে ভাই। কীভাবে কী করবেন আপনি জানেন। আপনি ছাড়া এসব দেখা কিংবা বোঝার মতো আর কোনো মানুষ নেই আমার। ”
” আমার যতদূর মনে হয় ওর হাসবেন্ড এমনি ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে। কারণ এতদিন গেলো অথচ স্ত্রী’র কোনো খোঁজ নিতে আসেনি। অবশ্য কোথায় এসেছে সেসব তো জানেও না সে।”
” সুমির কাছে যতটা শুনেছি খুব অত্যাচার করতো লোকটা। ”
” আমি উকিল আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আজই ডিভোর্স পেপার তৈরি করার কার্যক্রম শুরু করতে বলছি। তারপর যদি সাইন না করে দেখা যাবে। তবে সুমি এক তরফাও ডিভোর্স দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে সবুজের কিছু করার নেই। দেশে নারীদের পক্ষে আইনের সুবিধা একটু বেশিই। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া। কিন্তু কতদিন লাগবে কাগজ আসতে? ”
” আমার ভাইয়ের কী বিয়ের জন্য আর তর সইছে না?”
রুদ্র মজা করেছে বুঝতে পেরে শরীফ বেশ লজ্জা পেলো।
” ভাইয়া!”
” হয়ে যাবে। অপেক্ষা করো কিছুদিন। আমি নিজে যাবো সবুজের সাইন নিয়ে আসতে। ”
” আচ্ছা ভাইয়া।”
পরিবারে নতুন সদস্য আসার জন্য আজ সালমান খুরশিদের বাড়ি ভোজ উৎসব। মিহি,রুদ্র, রহমান, সুমি,মিতু ও শরীফ সবাই এসেছে। তোশাদের পরিবারের সবাইকে বলেছিলো যদিও কিন্তু তোশা নতুন সংসার ফেলে আসতে পারেনি। আর ওর বাবা-মাও তাদের নিজস্ব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে বলে জানিয়েছে। রান্নার জন্য আলাদা লোক রাখা হয়েছে। মর্জিনা নামে মাঝ বয়সী একজন মহিলা এখন বাসার সব কাজ করে। রিনা বেগম অবশ্য রান্নার সময় উপস্থিত থাকেন। যোহরের আজান দিয়েছে। রান্নাবান্নাও শেষের পথে। সবাই নিজেদের মধ্যে যার যার পছন্দ সহিত বিষয় নিয়ে কথা বলছে। মিহি রাহির সাথে বেডরুমে এসেছে অনেকক্ষণ।
” তারপর? ভালোবাসা হলো তো দুজনের মধ্যে? ”
রাহি মিহিকে জিজ্ঞেস করলো। মিহি হেসে বললো,
” তা হয়েছে। পাগল লোক একটা! ”
” তাই বুঝি? ননদী আমার ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে যে! এতো লজ্জাবতী হলে কবে থেকে? ”
” ভাবি! ভালো হবে না বলছি। আমি বুঝি বেশরম? ”
” তা হবে কেনো? আমি বললাম বিয়ের পরে লজ্জা আরো বেড়ে গেছে। লোকে অবশ্য বলে,বিয়ের পরে না-কি লজ্জাশরম কমে যায়। ”
” লোকের সব কথা যে সঠিক হয় না তা তো প্রমাণ পেলেই! তোমার শরীর কেমন আছে এখন?”
” আলহামদুলিল্লাহ। বাড়ির সবাই এত খেয়াল রাখছে ভালো না থেকে উপায় আছে বলো?”
” যাক মা যে তোমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পেরেছে এটাই শুকরিয়া। ”
” হ্যাঁ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসা দিলে ঠিক ভালোবাসা মিলে। তবে সময় লাগে, কষ্ট সহ্য করতে হয়। আর এরপরেও যদি কেউ ভালো না বাসে তার ভালোবাসার দরকার নেই। কারণ সব সময় সবাইকে ভালোবাসলেও ভালোবাসা মিলে না।”
” তা ঠিক বলেছো। নিচে চলো,দেখি রান্না কতদূর হলো। আজকে মা চিংড়ী মাছের মালাইকারি রান্না হচ্ছে শুনে ক্ষিদে পেয়ে গেছে। ”
” হাহাহা! চলো তাহলে। ”
মিতুকে বাগানে খেলতে পাঠিয়ে দিয়ে রুদ্র, শরীফ ও সুমির বিষয় সবকিছু খুলে বলেছে। যেহেতু সুমি প্রথমে এই বাড়িতেই এসেছিলো তাই তাদের সবার জানার অধিকার আছে এ বিষয়। রিনা বেগম স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা মন থেকে মানতে পারছেন না। তাই বসার ঘর থেকে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একটা মেয়ে আছে আবার আরেকটা পেটে! এই অবস্থায় অন্য একটা পুরুষের সাথে কীভাবে বিয়ের কথা ভাবতে পারে মেয়েটা? নাহ মিহির বরের কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। মনে মনে এরকম অনেক কথাই ভাবতে লাগলেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ সবকিছু শুনে চুপ করে আছেন। সুমি আর শরীফ ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র সোফায় বসা।
” দেখো সুমি তোমার স্বামী তোমার উপর যেসব অত্যাচার করেছে সেসব আমি সমর্থন করি না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তোমার জীবন তোমার সিন্ধান্ত। বাবা-মা সব সময় সন্তানের মঙ্গল চাইলেও আদতে সর্বদা মঙ্গল হয় না। যেমনটা তোমার সাথে হয়েছিল। তাই এবার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে করে দেখো তকদীরে কী আছে। আর শরীফকে আমি যতটুকু দেখেছি, ছেলেটা তোমাকে অযত্নে রাখবে না। তোমার সন্তানরা-ও ভালো থাকবে। ”
বেশ লম্বা কথা বললেন সালমান খুরশিদ। সবাই সেগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। সুমি সালমান খুরশিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। যদিও তিনি এরকম সালাম করা পছন্দ করেননা তবুও সুমিকে কিছু বললেন না। বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিঞ্চিৎ।
” দোয়া করবেন চাচা।”
” আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সাথে আছে। ”
” কী ব্যাপার সবার মুখ এত সিরিয়াস মনে হচ্ছে কেনো? ডাক্তার সাহেব! কিছু হয়েছে? ”
সুমি ও সালমান খুরশিদের কথোপকথনের মধ্যে রাহি ও মিহি এসে উপস্থিত হয়েছে বসার ঘরে। রুদ্র মুচকি হেসে বললো,
” তেমন কিছু হয়নি। বাড়ি গিয়ে সবকিছু বলবো তোমাকে। ”
” আচ্ছা তোমরা বসো সবাই আমি গিয়ে দেখে আসি রান্না কতদূর। ”
রাহি রান্নাঘরের দিকে গেলো। মিহি বাবার পাশের সোফায় বসলো। এদিকে রান্না শেষে মর্জিনা আর রিনা বেগম খাবার ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাহিকে দেখেই রিনা বেগম বললেন,
” শুনেছো কিছু? ”
” কী শুনবো মা?”
” ওই ড্রাইভার শরীফের সাথে না-কি সুমির বিয়ে হবে। কী অনাচার! ”
বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগলো রাহির। তাহলে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তখন। কিন্তু মিহি মনে হয় কিছু জানে না এইসব বিষয়।
” মা যার জীবন সে যেভাবে ইচ্ছে চালনা করুক। তাতে আমাদের কী? আমরা বরং আমাদের নিজেদের কথা ভাবি?”
পুত্রবধূর কথা বিশেষ ভালো লাগেনি রিনা বেগমের। তবুও ম্লান হাসলেন তিনি।
” তুমি গিয়ে সবাইকে খাওয়ার টেবিলে আসতে বলো। আমরা খাবার নিয়ে আসছি। ”
” হ্যাঁ আসুন। মিহিকে আজকে বেশি চিংড়ীর মালাইকারি দিবেন মা। আপনার হাতের রান্না খায়নি অনেক দিন। ”
মেয়ের কথা শুনে প্রানখুলে হাসলেন রিনা। আহ্লাদী কন্ঠে বললেন,
” পাগল মেয়ে আমার। ”
দুপুরে সবাই গল্প করতে করতে খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। রুদ্র হসপিটাল থেকে একদিনের ছুটি নিয়েছে। আজকে এই বাড়িতে থাকবে। কাল সকালে শরীফ রুদ্রকে পৌঁছে দিয়ে পরে মিহি আর সুমিদের বাসায় নিয়ে যাবে।
দুপুরের রোদের তেজ কমে এসেছে। ডিসেম্বরের হালকা হিমেল বাতাসে গ্রামের শীত ভালোই পড়েছে। মাটির রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় একটা ছোটো দোকান। সেখানেই বসে সিগারেট ফুঁকছে সবুজ। পাশে আরো লোকজন বসে চা-সিগারেট খাচ্ছে।
” কী রে সবুজ তোর বউ তো আর ফিইরা আইলো না! কার লগে পলাইয়া গেলো রে?”
দোকানী রুহুল কবিরের কাছ থেকে সুমির বিষয় এসব কথা শুনে কোনো প্রকার হেলদোল নেই সবুজের। সিগারেটের ছাই পাশে ফেলে আরেকটা সুখটান দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলে,
” গেছে ভালা হইছে। ওই গ্যারামের কুলসুম আছে না? হেয় আমারে খুব পছন্দ করে। ওরে বিয়া করমু ভাবতেছি।”
দোকানী রুহুল কবির সবুজের কথায় হাসে। সবুজ বোঝে এরা বিদ্রুপের হাসি। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে সবুজের। কিছুটা রাগ সংবরণ করে ফের বলে সবুজ,
” দাঁত বাইর কইরা হাসেন ক্যান মিয়া?”
” বিয়া যে করবি তা খাওয়াবি কী হুনি? থাহোস তো অর্ধেক দিন বাংলা মদ খাইয়া।”
সবুজ সিগারেটের বাকি অংশ না শেষ করেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো সেটা। রুহুল কবিরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঠিক কিন্তু কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো সে।
চলবে,