#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২২
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
মিহি কথা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই হবে বাসায় ছোটো একটা মেয়েও আসবে। ভাবতেই মিহির খুব ভালো লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে মিহি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। অহনার সাথে দেখা হবে ভেবে আরো ভালোলাগার রেশ বয়ে যাচ্ছে হৃদয়ে। সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়া দরকার বলে মনে হয়েছিল মিহির।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে ঘরে এসে মিতুকে সুমি বললো,
” এদিকে আয় তোকে রেডি কইরা দেই।”
ছোট্ট মিতু কৌতুহল নিয়ে মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে শুধালো,
” ক্যান মা? আমরা কই যামু?”
সুমি সব জামাকাপড় আলনা থেকে সরিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। মিতুকে কাছে টেনে চুলগুলো পরিপাটি করে বেনী করে দিচ্ছে।
” এই বাড়ির মাইয়ার শ্বশুর বাড়ি যামু। শুনছি হেয় একলা থাকে।”
” তুমি লগে থাকলে আমার সব জায়গা সমান আম্মা।”
মেয়ের কথায় সুমি হেসে জড়িয়ে ধরে তাকে।
চেম্বারের এক কোণে চেয়ারে বসে আছে মিহি। শরীফ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রর পাশে,রুদ্র রোগী দেখছে। আজকের রোগীর চাপ বেশি থাকায় দেরি হচ্ছে খাওয়াদাওয়ায়। রুদ্র একটু সময় পর পর মিহির দিকে তাকিয়ে দেখছে। মিহি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে।
” শরীফ আর কেউ আছে? ”
” নাহ ভাইয়া আপাতত কেউ নেই, বিকেলে আসবে হয়তো। ”
” মিহি চলো আজ হসপিটালের ক্যান্টিনে গিয়ে খাবো। ”
” কেনো? বাসায় গেলে হয় না? ”
মিহি ফোনের উপর থেকে নজর সরিয়ে বললো। রুদ্র ততক্ষণে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
” এত সময় হবে না। চলো তারচে তিনজন একসাথে এখানেই লাঞ্চ করি। ক্যান্টিনে কিন্তু ভালো ভালো খাবার পাওয়া যায়। ”
” আচ্ছা চলুন তাহলে। ”
ক্যান্টিনে বসে তিনজনে একসাথে খাবার খাচ্ছে। মিহি রুদ্রকে বলে ওর বাবার বাড়ি অলরেডি একজন আছেন, যার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শরীফকে পাঠিয়ে দিলেই সে চলে আসবে।
” তাহলে খাওয়া শেষ হলে তুমি চলে যাও শরীফ। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া।”
খাওয়াদাওয়া শেষে শরীফ মিহির বাবার বাড়ি চলে যায়। আসরের আজান দিয়েছে। রাহি নামাজ শেষে রান্নাঘরে সবার জন্য চা তৈরি করতে ঢুকেছে। শরীফ বসার ঘরে সোফায় বসে আছে একাই। সালমান খুরশিদও এরমধ্যে নিচে চলে এলেন। শরীফের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। রাহি চা তৈরি করার পরে সুমিকে গিয়ে রেডি হতে বলে। কিন্তু সুমি আর মিতু আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকায় রাহির সাথেই বসার ঘরে এলো। শরীফ তখন চা খাচ্ছিলো।
” শরীফ ভাই এই হলো সুমি আর এই মিতু ওর মেয়ে। আর সুমি তোমরা উনার সাথে নিশ্চিন্তে যেতে পারো।”
শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সুমির হৃদকম্পন যেনো কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুমি। শরীফ নিজেও বরফের মতো জমে গেছে। এটা স্বপ্ন না-কি সত্যি বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তটা আর এগোবে না,সবকিছু কেমন ঘোরলাগা হয়ে গেছে। রাহি সুমির নিস্তব্ধতা দেখে ফের বলে উঠলো,
” সুমি? ”
রাহির ডাকে হুঁশ ফিরলো সুমির। চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। আশেপাশে লোকজন আছে বলেই হয়তো চোখের জল সংবরণ করলো সে।
” ঠিক আছে ভাবি। চাচা আমরা গেলাম, কোনো ভুল করলে মাফ কইরা দিয়েন আর চাচিরেও কইয়েন। ”
” আরে কীসের ভুল পাগলি? তাছাড়া যাচ্ছো তো আমার মেয়ের বাসায়, দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ”
“আচ্চা।”
সুমি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতেও কেমন যেনো আঁটকে যাচ্ছে বারবার। মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এই অনুভূতি বলে বোঝনো সম্ভব নয়। শরীফ এখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে আছে সুমির দিকে। হাতে থাকা চায়ের কাপের চা ঠান্ডা হয়ে গেছে কখন সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সালমান খুরশিদের কথায় টনক নড়ে উঠলো শরীফের। কোনো প্রকার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছুলো শরীফ। সুমি পিছনে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মিতু গাড়ির দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। শরীফ এক নজর তাকালো সুমির দিকে তারপর গাড়ির দরজা খুলে ইশারায় ভেতরে বসতে বললো। সুমি বিনবাক্যে মিতুকে নিয়ে
গাড়ির ভেতর বসলো। শরীফ ড্রাইভিং সিটে বসেছে কিন্তু গাড়ি স্টার্ট না করে গাড়ি থেকে নেমে সুমির ও মিতুর সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। সুমি আর চোখের জল সংবরণ করতে পারলোনা। নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়ালো। তবে মিতু কিংবা শরীফ কেউ সেটা খেয়াল করেনি। শরীফকে দেখে মিতুর মনে হচ্ছে তাকে দেখে কোনো হেলদোল নেই শরীফের। এসব ভেবেই কেনো যেনো সুমির কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়ছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এত বছর পর দেখা তবুও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। মানুষ দূরে থেকেও মনের দিক থেকে কাছাকাছি থাকতে পারে যেমন তেমনই পাশাপাশি থেকেও মন থেকে অনেক দূরে থাকতে পারে। লোকটা নিশ্চয়ই এতদিনে বিয়ে-শাদি করে সুন্দরভাবে সংসার করছে! এসব ভেবে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে সুমি।
” মা আর কতক্ষণ লাগবো?”
” রাস্তায় জ্যাম আছে, ঘন্টাখানেক তো লাগবেই। তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? ”
মিতুর প্রশ্নের উত্তর শরীফ দিলো। সুমি কিছু বললো না। মিতু শরীফের সাথে আরো টুকটাক কথা বলতে লাগলো। সুমি বাইরের তাকিয়ে রইলো বাকি সময়।
সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় পৌঁছালো সুমি,শরীফ ও মিতু। মিহি ওদের জন্য অপেক্ষা করেই বসে ছিলো। তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতেই দরজা খুলে দেয় মিহি। সুমি আর মিতুকে পৌঁছে দিয়ে শরীফ গাড়ি নিয়ে রুদ্রর হসপিটালের দিকে রওনা দিলো।
” আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো তোমাদের? ”
সুমি ও মিতুকে দোতলায় ঘর দেখিয়ে দিয়েছে মিহি। বিছানায় বসে আছে মিতু,সুমি দাঁড়িয়ে।
” না আপা।”
” আচ্ছা শোনো আমি তোমাদের তুমি করে ডাকবো,তোমরাও তাই ডেকো।”
” আচ্চা আপা।”
” তোমার কি শরীর ঠিক আছে সুমি? না-কি এভাবেই কম কথা বলো তুমি? ”
সুমির কথাবার্তা কেমন অদ্ভুত ঠেকলো মিহির কাছে এজন্যই জিজ্ঞেস করলো। আসলে শরীফের আচরণে খুব খারাপ লেগেছে সুমির। বেশি কিছু তো আশা করেনি সে,অন্তত “কেমন আছো ” জিজ্ঞেস করতে পারতো!
” আসলে আপা মাতা ব্যাথা করতাছে একটু এইজন্য আরকি।”
” ওহ আচ্ছা। তুমি বরং রেস্ট করো,আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি। সেগুলো খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবে। আর তোমার মেয়েকেও কিছু খাইয়ে দিও। ”
মিহির আন্তরিকতায় সুমি অবাক হলো। এতটা ভালো কীভাবে কেউ হয়!
” না আপা কিচ্ছু লাগবো না এহন। রাইতে খাইয়া ঔষধ খামু লাগলে।”
” ঔষধ না খেলেও কিছু খেতে পারো। ডাইনিং টেবিলের উপর ফলের ঝুড়ি রাখা আছে, সেখান থেকে না হয় কিছু ফল দিও ওকে।”
মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো মিহি। সুমি উত্তর করলোনা। মিহি নিজের ঘরে পড়তে চলে গেলো।
চেম্বার থেকে বের হয়েছে রুদ্র ও শরীফ। শরীফের চোখমুখ কেমন শুকনো লাগছে রুদ্রর। এতক্ষণ চেম্বারে অনেক রোগীর ভীড় থাকায় কথা বলার সুযোগ পায়নি সে। কিন্তু হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসা মাত্রই শরীফকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে?
” কিছু হয়নি ভাইয়া।”
শরীফ গাড়ি চালাচ্ছে, রুদ্র পাশের সিটে বসেছে আজ। শরীফ এমনিতে রুদ্রর থেকে কখনো কিছু লুকায় না।
” শরীফ আমি তোমার চোখ পড়তে পারি,কী হয়েছে বলো।”
” ভাইয়া সুমিকে দেখলাম আজ কতগুলো বছর পর। ”
” কোথায়!”
” তোমাদের বাসায় দিয়ে এলাম,ওই বাড়ি থেকে যাকে আনতে গিয়েছিলাম সেই সুমি।”
” ও মাই গড! তারপর কী হলো? কথা বললে?”
” নাহ। ওর একটা মেয়ে আছে পাঁচ / ছয় বছর হবে। ”
” তারজন্য কথা বলোনি?”
রুদ্রর এই প্রশ্নে শরীফ উত্তর দিলো না। নিজেকে নিজেই বুঝতে পারছেনা রুদ্রকে কী বলবে? রুদ্র ফের শুধালো,
” কী হলো বলো? এত বছর পর দেখা হলো অথচ সে কেমন আছে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না?”
” জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল না ভাইয়া,ওর চোখমুখ বলে দিচ্ছিলো ও ভালো নেই। চোখের নিচের কালো দাগ বলে দিচ্ছিলো এক আকাশ চিন্তা নিয়ে কতো রাত নির্ঘুম কেটেছে তার।”
” এখনও এতো ভালোবাসো?”
” আপনি কী ভুলতে পেরেছেন ভাইয়া? তাছাড়া সুমি আমাকে ঠকায়নি। ও এখনো আমাকে ভালোবাসে, চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।”
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শরীফের কাঁধে হাত রাখলো।
চলবে,
#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৩
(কঠোরভাবে মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
আপনি কী ভুলতে পেরেছেন ভাইয়া? তাছাড়া সুমি আমাকে ঠকায়নি। ও এখনো আমাকে ভালোবাসে, চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।”
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শরীফের কাঁধে হাত রাখলো।
” তোমার কথা ঠিক আছে কিন্তু অতীতকে আঁকড়ে আমি আর বর্তমানকে নষ্ট করবোনা। মিহি যথেষ্ট এগোচ্ছে সম্পর্কে আমি অহেতুক নবনীর স্মৃতি নিয়ে বসে থাকবো কেনো? তা-ও যদি সে আমাকে ভালোবাসতো! ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আমিও এটাই বলেছিলাম, ভাবি যথেষ্ট ভালো মনের মানুষ। আপনারা সুখে হলে আমার দেখেও শান্তি লাগবে। ”
” তাহলে সুমির সাথে কথা বলবে কখন? এখনই চলো আমার সাথে। ”
শরীফ গাড়ি থামিয়েছে। বাসার সামনে চলে এসেছে রুদ্র।
” না একটু সময় লাগবে আমার। ”
” ভালোবাসা কী মনস্তাত্ত্বিক না-কি শরীরবৃত্তীয়? ”
রুদ্রর এরকম প্রশ্নের হেতু বুঝতে সময় লাগে না শরীফের। তবুও দোনোমোনো করে বললো,
” দুটোই দরকার ভাইয়া।”
” হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে। মন ও শরীর দুই প্রয়োজন কিন্তু মন যদি না থাকে সেখানে কী ভালোবাসা হয়?”
” না।”
” অথচ শরীর না ছুঁয়ে কিন্তু আমরা ভালোবাসি। দেহ হলো নদীর পানির মতো। কতকিছুই তো সেই পানিতে মিশে সাগরে যায় তাতে কী পানি নষ্ট হয়ে যায় শরীফ? তুমি যদি সত্যি মন থেকে সুমিকে ভালোবাসো তাহলে ওর ছেলেমেয়ে থাকাটা কোনো বিষয় হওয়ার কথা নয়।”
” কিন্তু এই সমাজ! ”
” এসব নিয়ে কাল কথা বলবো। তুমি নিজেকে আগে জিজ্ঞেস করো কী চাও! পরে সমাজের কথা ভেবো,আসছি।”
শরীফ কোনো কথা বললো না আর। রুদ্র বাসায় ঢুকলো। গ্যারেজে গাড়ি রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো শরীফ। রুদ্রর বাসা থেকে পনেরো মিনিট হাঁটলেই তার বাড়ি। তবে নিজের নয়,ভাড়া।
ডাইনিং টেবিলে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছিল মিহি,সুমি ও রহমান চাচা। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দিয়েছেন রহিম চাচা। মিতু সোফায় বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে। রুদ্র মিহির দিকে এক নজর তাকিয়ে নিজের রুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য গেলো।
” আপা ভাই আসছে আপনি গেলেন না?”
” উনি এসেছে, ফ্রেশ হয়ে খেতে আসবেন। আমি গিয়ে কী করবো সুমি?”
” সোয়ামি কামকাজ থেইকা ফিরলে বউয়ের যাওয়া দরকার। ”
সুমির কথাটা একটু মনে ধরলো মিহির। সেদিন রাতের পর থেকে রুদ্রর জন্য খুব মায়া হয় মিহির। পৃথিবীতে আপম বলতে কেউ নেই লোকটার অথচ কত সুন্দর করে সবাইকে খুশি রাখতে চায়! সুমিকে বসিয়ে রেখে মিহি রুমে চলে যায়। এদিকে রহমান চাচা রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করছেন। আজকে কারো খাওয়া হয়নি, সবাই একসাথেই খেতে পারবে। এমনিতে মিহি একা খেয়ে নেয় তারপর রহমান চাচা বাসায় চলে যান । রুদ্র এসে রাতে একা একা খাবার খায়।
” কী ব্যাপার কিছু লাগবে? ”
মিহিকে রুমে ঢুকতে দেখে রুদ্র বললো। রুদ্র বাইরের পোশাক নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে এগোলো,হাতে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট।
” না,আপনার কিছু লাগলে বলবেন। আমি রুমে আছি।”
” পারলে আমার সাথে ভেতরে চলো।”
“কী! অসভ্য লোক একটা। ”
মিহি ঠোঁট উল্টে বললো। রুদ্র হাসছে। ওয়াশরুমের দরজার বাইরে মাথা বের করে রেখেছে সে। মিহি তা দেখে রাগে কটমট করতে করতে আবারও বলে,
” সব সময় শুধু শয়তানি বুদ্ধি। ”
” আরে বাবা আমার পিঠে একটু সাবান দিয়ে দেওয়ার জন্য ডেকেছিলাম, নিজে নিজে কী ভালো করে দেওয়া যায় বলো?”
” দিতে হবে না সাবান। তাড়াতাড়ি গোসল করে নিচে খেতে আসুন আমি যাচ্ছি। ”
মিহি হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রুদ্র ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। মিতুকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে সুমি। সব সময় একা খেতে পারে না মেয়েটা। কিন্তু সুমির শরীরও বিশেষ ভালো নেই। পেটে কেমন যেনো ব্যথা করে ইদানীং। বাচ্চাটা ঠিকঠাক আছে কি-না এই নিয়েও চিন্তায় থাকে সুমি।
সোফায় বসে ল্যাপটপে মাথা গুঁজে কাজ করছে আদ্রিয়ান। রাহি মশারী টাঙিয়ে বিছানায় শুয়েছে । আদ্রিয়ানের সেলফোন রাহির হাতে, রাহির ফোনের ব্যাটারিতে সমস্যা হওয়াতে বারবার ফোন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই আদ্রিয়ানের ফোন দিয়ে বাবার বাড়ি কল দিয়ে কথা বললো রাহি।
” আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? ”
” কেনো খুব মিস করছো না-কি? ”
” সামনেই তো বসে আছো মিস করার কী আছে মিস্টার? ”
” আদর মিস করছো মনে হয়, আজকে হবে? ”
আদ্রিয়ানের লাগামহীন কথায় রাহি লজ্জা পেলো। ঠোঁট টিপে মুচকি হেসে মেকি রাগ দেখালো।
” ধ্যাৎ! এসব কথা বলবা না…”
রাহির কথা শেষ হওয়ার আগেই আদ্রিয়ানের ফোনের আওয়াজ ভেসে এলো কর্ণকুহরে। রাহি ফোন হাতে নিতেই দেখলো স্ক্রিনে তোশার নাম ভেসে উঠেছে। রাত এগারোটার সময় তোশার কল দেওয়ার কারণ বুঝতে পারছে না রাহি। স্ত্রী’র হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া খেয়াল করে আদ্রিয়ান প্রশ্নতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” কে কল দিলো?”
” তোশা।”
তোশা! কিন্তু কীসের জন্য কল দিয়েছে সে? ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানায় রাহির পাশে বসলো আদ্রিয়ান।
” কল ধরে দেখো কী বলে।”
” তোমার ফোন আমি কেনো রিসিভ করবো।”
” আমি আর তুমি আলাদা নই।”
রাহি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরলো।
” হ্যালো ভাইয়া, কেমন আছো তোমরা?”
তোশার মুখে ভাইয়া সম্মোধন শুনে চারশো বিশ ভোল্টের শক খেলো রাহি। এ যে ভুতের মুখে রামনাম!
” আমি ভাবি বলছি।”
” বাহ ভালো হয়েছে তুমি রিসিভ করছো। আচ্ছা শোনো, সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে। বাবা কালকে বাসার সবাইকে দাওয়াত করে আসবে। তোমরা কিন্তু কাল-পরশুর মধ্যে চলে আসবা। ”
আদ্রিয়ান দুজনের কথোপকথন বুঝতে পারছিলো না বলে স্পীকার অন করতে বললো। রাহি তোশার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।
” অভিনন্দন তোশা। আমারা অবশ্যই যাবো।”
” ধন্যবাদ ভাবি,শুভ রাত্রি। শীঘ্রই দেখা হচ্ছে। ”
” ইনশাআল্লাহ। ”
তোশা অপরপ্রান্ত থেকে কল কাটা মাত্রই আদ্রিয়ান রাহির চোখাচোখি হলো।
“কী ব্যাপার বলো তো! এতো পরিবর্তন? ”
আদ্রিয়ানের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। সত্যি বলতে রাহি নিজেও বেশ অবাক হয়েছে। তবুও সবকিছুর জন্য শুকরিয়া আদায় করে সে।
” সে যাইহোক অবশেষে তোশা বিয়ে করে নিবে।”
” হ্যাঁ সেটাই। ”
আদ্রিয়ান আর কাজকর্মে মন দিতে পারলোনা। তোশাকে ছোটো থেকে চেনে আদ্রিয়ান, এই মেয়ে এতো সহজে দমে যেতে পারে না। মনটা কেমন অস্থির লাগছে। কী জানি বিয়েতে কী হয়!
অসময়ে বৃষ্টি একদম ভালো লাগে না মিহির। এই ডিসেম্বর মাসেও বৃষ্টি হতে হবে? শীতের মধ্যে বৃষ্টি হলে শীত বেড়ে তিনগুণ হয়। তবুও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে সে। ঠান্ডা বাতাসে মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে তার শরীর। রুদ্র এখনো রুমে আসেনি। কে জানে সুমির সাথে তার কীসের এত কথা! দরজা ভেজানো ছিল, রুদ্র প্রবেশ করাতে টের পেলো মিহি। কিন্তু আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো সে। রুদ্র আস্তে পা টিপে টিপে মিহির একদম পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
” কিছু বলবেন? ”
” তুমি বুঝলে কীভাবে আমি তোমার পিছনে? ”
মিহি রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো।
” দরজা খোলার আওয়াজে বুঝতে পেরেছি আপনি এসেছেন। তারপর আপনার পায়ের আওয়াজেও বুঝতে পেরেছি। ”
” বাব্বাহ! তোমার কানের শ্রবনশক্তি খুব প্রখর তো।”
” আমার সব ইন্দ্রিয়ই প্রখর। তা এতক্ষণ কী কথা হচ্ছিলো? ”
” তেমন কিছু না। সুমির বাড়ি কোথায়, কেনো শহরে এসেছে এইসব। ”
” উমম.…চলুন। ”
” কোথায়? ”
” কোথায় আবার? ঘুমুতে। ”
রুদ্র হাসলো,মিহির হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে সে-ও পাশে বসলো।
” এমনভাবে বললে মনে হচ্ছিলো অন্য কিছু। ”
মিহি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,
” কী মনে হচ্ছিলো?”
” ভেবেছিলাম ছাঁদে যাবে বৃষ্টিতে ভিজতে। ”
” মাথা খারাপ না-কি! এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর আসবে।”
” কিচ্ছু হবে না আমার। তবে তোমার হলে আলাদা বিষয়। ”
মিহি কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো। একবার ইচ্ছে করছে রুদ্রর সাথে ছাঁদে গিয়ে ভিজে একাকার হতে আবার পরক্ষণেই নবনীর কথা মনে পড়তেই আর ইচ্ছে করছে না। মিহি বেশ বুঝতে পারে রুদ্র সব সময় কেমন একটা দূরত্ব বজায় রাখে। যদিও বন্ধুর মতো সারাক্ষণ পাশে থাকে কিন্তু সেটা কেবলই দায়িত্ব, ভালোবাসে নয়। মিহিকে চুপ করে থাকতে দেখে রুদ্র আবারও কথার খেই ধরলো।
” বুঝতে পেরেছি, ভাবছো বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে যদি অঘটন ঘটে যায়। ”
” এ্যা! কীসের অঘটন? ”
” যদি কোলে তুলে ছাঁদে হাঁটি কিংবা রোমান্টিক হয়ে যাই তখন?”
” সেসব আপনি করবেন না আমি জানি। নবনী ম্যাডামের সাথে তাহলে অবিচার হয়ে যাবে না!”
রুদ্র মিহির চোখের দিকে তাকালো। হালকা অভিমান ফুটে উঠেছে সেই চোখের মাঝে। রুদ্র মিহির হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
” তাহলে চাইছো আমি ওসব করি?”
রুদ্রর এমন প্রশ্নে মিহি থতমত খেয়ে গেছে। প্রশ্নটা করার সময় রুদ্রর চোখেমুখে কেমন একটা দুষ্টমি খেলা করছিলো। তারজন্যই মিহি আর রুদ্রর দিকে তাকাতে পারছেনা। রুদ্রও আর কিছু বললো না। মিহির হাত ধরে সোজা সিড়ি বেয়ে ছাঁদে পৌঁছুলো। বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে লাগতেই ঠান্ডায় কেঁপে উঠলো মিহি। ছাঁদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে মিহির হাত ছেড়ে দিয়ে, দু-হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো রুদ্র। মিহির শরীর কাঁপছে কিন্তু রুদ্রকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। মিনিট পাঁচেক পরে রুদ্র মিহির দিকে তাকালো। মিহির তখন রীতিমতো শীতে জুবুথুবু অবস্থা। রুদ্র বুঝতে পেরে বুকে জায়গা দিলো তাকে। শীতের মধ্যেও অন্য কোনো অনুভূতিতে সাড়া শরীর শিহরিত হলো। মিহি কোনো বাক্যব্যয় না করে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুদ্রকে। মিহির শরীরের অবস্থা বুঝে রুদ্র তাকে কোলে তুলে নিয়ে ছাঁদ থেকে রুমে নিয়ে এলো। মিহির ভেজা ঠোঁটের দিকে তাকাতেই রুদ্র নিজেকে সামলাতে পারলোনা। কিছু সময়ের ব্যবধানে দুজনের ওষ্ঠাধর মিলিত হলো। মিহির চোখ তখন বন্ধ করা ছিলো। মিহির তেমন রেসপন্স না পেয়ে রুদ্র মিহিকে বিছানায় শোয়ালো। মিহির জ্ঞান নেই! রুদ্র ভড়কে গেলো খুব। কী হলো মেয়েটার? রুদ্র দ্রুত সুমির ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এলো। সুমি গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলো। হঠাৎ দরজায় করাঘাত পড়তেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার।
” সুমি তুমি একটু মিহির জামাকাপড় পালটে দাও,আমিও চেইঞ্জ করে আসছি।”
” আপনি থাকতে আমারে ডাকলেন ক্যান ভাই? ”
” কথা পরে বলো আগে পাল্টে দাও প্লিজ,ঠান্ডা লেগেছে খুব ওর। আমারই ভুল ড্যাম ইট!”
রুদ্র নিজের উপর রেগে গেছে খুব। কেনো যে তখন বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার কথা বললো!
চলবে,