#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২০
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
” হুম কচুর মজা।”
” ছি অশ্লীল কথা। ”
রুদ্রর এমন কথায় মিহি চোখ বড়সড় করে তার দিকে তাকালো। রুদ্র ঠোঁট টিপে হাসছে। মিহি বুঝতে পেরেছে লোকটা তাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে নির্ঘাত।
” কোনটা অশ্লীল কথা? ”
” এই যে কচু বললে সেটাই। ”
” কেনো কচু খাননা? না-কি অ্যালার্জি! ”
রুদ্র এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। জোরে হাসতে হাসতে ছাদের এক পাশ থেকে অন্য পাশে গেলো। মিহি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রুদ্রর কান্ডকারখানা দেখছে। লোকটা যে এরকম আধপাগল হবে বুঝলে বাবার কথামতো বিয়ে করতোনা মিহি।
” হাসাহাসি বন্ধ করুন তো,গা জ্বলে যাচ্ছে। ”
” ফায়ারসার্ভিসে কল দিবো না-কি? ”
” আমি পাবনা সিট বুকিং করে দিচ্ছি। আপনি কাইন্ডলি সেখানে চলে যান।”
” কিন্তু কেনো বলো তো?”
“কারণ আপনি ওখানকার বাসিন্দা।
” পাগল তো সেই কবেই হয়েছি মিহি,মানুষটা যখন ঠকালো! ছোটো থেকে একা একা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যখন বড়ো হলাম, তখন নবনীকে পেয়ে জীবনে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছিল। ”
হঠাৎ রুদ্রর চোখমুখ কেমন শক্ত হয়ে গেছে। মিহি খেয়াল করলো এই প্রথম রুদ্র মিহিকে মিহিরদানা না ডেকে শুধু মিহি বলে ডাকলো। রুদ্র নিজের জীবনের কথা মিহির সাথে বলতে চাইছে ভেবে মিহি সাহস সঞ্চার করে বললো,
” আজকের রাতটা চলুন গল্প করে কাটাই তবে হ্যাঁ এই খোলা ছাদের নিচে না।”
” ঠিক আছে রুমে চলো।”
রুদ্র ও মিহি ছাদ ত্যাগ করে তাদের রুমে ঢুকে মুখোমুখি বসলো। রুদ্রর চেহারা স্বাভাবিক না,দেখে মনে হচ্ছে নীলচে ব্যথারা বুকের মধ্যে তীব্র গতিতে ছোটাছুটি করছে।
” কী হয়েছিল আন্টি-আঙ্কেলের?
” বলছি..”
রুদ্রর বয়স তখন সবে ছয় বছর, ডাক্তার হঠাৎ করে একদিন বললেন রুদ্রর মা ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। বড়োজোর কয়েকদিন বাঁচতে পারে। রুদ্র তখন অতকিছু না বুঝলেও নানার মুখ দেখে ঠিক বুঝেছিলো বাবার মতো মা’কেও আর দেখতে পারবে না হয়তো। জন্মের পরে বাবাকে দেখেনি ছেলেটা। মায়ের মুখে শুনেছিল রুদ্র গর্ভে থাকতেই একটা গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। এমনিতেই প্রেমের বিয়ে ছিল পারিবারিক অশান্তি ছিল রুদ্রর দাদার বাড়ি থেকে। তাই রুদ্রর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মাকে সবাই তাড়িয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। তারপর থেকে নানাবাড়ি বড়ো হয়েছে রুদ্র। রুদ্রর মা ছিলো পরিবারের একমাত্র সন্তান। মা মারা যাওয়ার পরে একেবারে এতিম হয়ে গেলো রুদ্র। নানা বড়ো করে তুলেছিলো ছেলেটাকে। নানী পরপারে গেছিলো অনেক আগে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ যখন তখনই আলাপ হয় নবনীর সাথে। নবনী তখন কলেজে ভর্তি হয়েছিল মাত্র। দেখতে দেখতে সময় গড়ায়,দুজনের সম্পর্ক গভীর হয়। রুদ্রর ইন্টারমিডিয়েট শেষ হওয়ার পরে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও নবনীর জন্য রাজি হয় না। নানা অনেক বোঝায় কিন্তু রুদ্র কিছুতেই নবনীর মায়া কাটিয়ে দূরে যেতে পারছিলো না। নানার সাথে এ নিয়ে একটু মনোমালিন্য হয় বটে। তবুও জেদ করে স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতেই মেডিকেল শেষ করে। তবে রুদ্র দেখিয়ে দিয়েছিলো লেখাপড়ার ইচ্ছে থাকলে সব জায়গায় বসেই ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। কিন্তু আরো ভালো করার জন্য পিএইচডি করতে ঢাকা যেতেই হতো। তাই একদিন দুপুরে নবনীর সাথে দেখা করতে গিয়ে নিজেরই এক বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পায় নবনীকে। ব্যস!সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। নবনী নিজেই রুদ্রকে স্পষ্ট জানায় সে তার বন্ধুকে চায় তাকে না। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি রুদ্র। সেদিনই ঢাকা চলে আসে।
ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেছে। মিহি ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছেনা। তার জীবনে এরকম কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। অথচ রুদ্র ছোটো থেকেই সব হারিয়ে বেঁচে আছে। রুদ্রর চোখ কেমন লাল হয়ে গেছে। কেবল মাত্র পুরুষ মানুষ বলেই হয়তো হাউমাউ করে কাঁদতে পারছেনা। মিহি হুট করে রুদ্রর হাত ধরে। রুদ্র কিঞ্চিৎ চমকায়।
” কী হয়েছে? ”
” এই হাত দিয়ে নবনীকে ছুঁয়েছেন? ”
মিহির এরকম প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রুদ্র। কিছুটা থতমত খেয়ে বললো,
” তুমি কী কখনো প্রেম করোনি?”
” নাহ,আমি এসবে জড়াইনি। ”
” খারাপভাবে কখনো স্পর্শ করিনি তবে.. ”
” তবে? ”
” সে আমার জীবনে প্রথম নারী, একসাথে হাত ধরে অনেকটা পথ চলেছি। সেই চলার পথে মাঝে মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিলাম হারিয়ে ফেলার ভয়।”
” হয়েছে হয়েছে। নিজের বউয়ের জন্য অপেক্ষা না করে পরনারীর সাথে লটরপটর করেছেন বলেই হারিয়েছেন। ”
মিহির কথায় রুদ্রর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। এ যে ভুতের মুখে রামনাম!
” কীসব বলছো? তোমার শরীর ঠিক আছে মিহির দানা? আর লটরপটর কেমন শব্দ? ”
মিহি রুদ্রর হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো। রাত প্রায় শেষের দিকে। ঘরের বাতি বন্ধ করে রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। রুদ্র আগের মতোই ঠাঁয় বসে রইলো। মেয়েটা কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করলো আজ। তবে কী সম্পর্কে এগোতে চাইছে সে? কিন্তু রুদ্র যে কেবল তাকে বন্ধুর মতো আগলে রেখেছে। মিহির বাবাকে দেওয়া কথার কারণে সব সময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছে,তার বেশি কিছু হওয়ার নয়। নবনী ঠকালেও রুদ্র আজও মনে মনে স্রেফ নবনীর।
ভোরের আলো ফুটতেই রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে সুমি। মিতু অবশ্য এখনো ঘুমোচ্ছে। এঁটো থালাগুলো জড়ো করে সেগুলো ধুয়ে নাস্তা তৈরি করার জন্য ভাবছে। কালকে রাতে রাহির থেকে মোটামুটি রান্নাঘরের কোথায় কী আছে দেখে নিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এত তাড়াতাড়ি শেখা সম্ভব হবে না সুমির। তাছাড়া শহুরে খাবারদাবারও তৈরি করতে জানে না সে। গ্রামে থাকতে তো সকালে পান্তাভাত খেতো। অন্য খাবার বলতে মাঝে মধ্যে পিঠে তৈরি করতো আর নুডলস। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা সময় গড়িয়ে গেলো। আচ্ছা সবুজ কী তাকে খুঁজেছে একবারও? নাহ ওই মানুষটার কথা মোটেও ভাবতে চায় না সুমি। কিন্তু যাইহোক ওই লোকটাই সুমির সন্তানদের বাবা।
” এত সকালে তুমি রান্নাঘরে কী করছো?”
হঠাৎ রাহির প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিড়ে গেলো। স্নিগ্ধ মুখখানায় হাসি ফুটিয়ে সুমি বললো,
” আসলে ভাবি নাস্তা বানাইতে আইছিলাম কিন্তু এই মেশিনগুলা দিয়ে কেমনে কী করে তা তো জানি না।”
সুমির কথায় হাসলো রাহি। পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। টোস্টার মেশিনের ওপর হাত রেখে বললো,
” এটা দিয়ে টোস্ট তৈরি করে, আর এটা দিয়ে মশলা গুড়ো করা হয়। তবে চাইলে অনেককিছুই ভাঙা যায়। আর এটা হচ্ছে জুস তৈরি করার মেশিন।”
রাহি একটা একটা করে রান্নাঘরের সব যন্ত্রপাতি সুমিকে দেখালো এবং কার্যকারিতা বললো। কিন্তু সব কথা সুমি বুঝলো কিনা সেটা বোঝা গেলোনা।
” আচ্ছা ভাবি এহন কী তৈরি করবেন খাওয়ার জন্য? ”
” উমম…সেদ্ধ ডিম, জুস, কিছু ফল সাথে সান্ডউইচ। ”
” আচ্ছা আমি তাইলে ডিম সেদ্ধ করতাছি আপনি উইস বানান।”
” ওটা সান্ডউইচ হবে সুমি।”
সুমি গ্যাস অন করে একটা পাতিলে পানি দিয়ে চুলোয় বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে সেদ্ধ দিলো। এগুলো শিখে নিয়েছে আগেই।
” ওই হইলো ভাবি। তা ভাবি একখানা কথা কমু?”
রাহি ফ্রিজ থেকে কিছু আপেল আর কমলা বের করে সেগুলো খোসা ছাড়িয়ে রাখতে রাখতে বললো,
” হ্যাঁ বলো।”
” আপনার বাচ্চাকাচ্চা নাই? ”
” থাকলে তো দেখতে তাই না? তবে হয়ে যাবে ব্যাপার না। ”
রাহি একটু লজ্জাই পেলো মনে হয়। মনে মনে ভাবলো এবার হয়তো সত্যি একটা বাচ্চা দরকার সংসারে। আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে রাতে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। আজকে বিকেলেই বাসায় ফিরে এসেছে সে। মিহি ঘুমোচ্ছে রুমে। গতকাল রাতের পর থেকে মিহির আচরণে কেমন বদল এসেছে। রুদ্র বিষয়টা খেয়াল করলেও মিহিকে কিছু বললো না। সকালে রুদ্রর আগে উঠেই নাস্তা করার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছিলো মিহি। দুপুরে কলেজ থেকে সরাসরি চেম্বারে চলে গিয়েছিল। সবকিছুই কি দয়া করছে মিহি? কেউ নেই বলে এই করুণা? রুদ্রর ভাবনার অতলে ডুবে যাচ্ছে বারবার। ভালোই তো দুষ্টমিষ্টি সম্পর্ক ছিলো দুজনার। অতীতের কথা না বললে হয়তো মিহি এরকম করুণা করতো না তাকে। রুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নানার কথা ভাবে।
” কেনো আমাকে রেখে চলে গেলে নানা? সবাই কি পণ করেছিলে আমাকে একা রেখে চলে যাওয়ার? ”
আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রুদ্র। সে জানে কোনো উত্তর আসবে না এই প্রশ্নের তবুও মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। আজ পর্যন্ত কেউ থাকেনি রুদ্রর জীবনে, তাই নতুন করে মিহিকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। হুট করে কাছে এসে ভালোবেসে আবার বদলে গেলে খুব কষ্ট হয়। তারচে মানুষের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
চলবে,
#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২১
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
আজ পর্যন্ত কেউ থাকেনি রুদ্রর জীবনে, তাই নতুন করে মিহিকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। হুট করে কাছে এসে ভালোবেসে আবার বদলে গেলে খুব কষ্ট হয়। তারচে মানুষের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
” আজকে তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?”
হঠাৎ মিহির কথায় নড়েচড়ে উঠলো রুদ্র। এরমধ্যেই ঘুম ভেঙে গেলো মেয়েটার? রুদ্র চোখমুখ স্বাভাবিক করে মিহির দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললো,
” কেনো আগেভাগে আসলো সমস্যা? ”
” আমার আবার কীসের সমস্যা? আরো ভালো হয়েছে, সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকা লাগে। ”
” রহমান চাচা তো মাঝে মধ্যে থাকেন।”
” মাঝে মধ্যে সব সময় তো থাকেন না।”
” তা সব সময় থাকার জন্য কাউকে লাগবে? ”
রুদ্র ঠিক কী বললো বুঝতে পারলোনা মিহি। কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো। তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
” খবরদার যদি আমার আশেপাশে আসেন। এহহ শখ কতো!”
” কী আশ্চর্য কথাবার্তা বলতেছো! তোমার কাছাকাছি কেনো যাবো আমি? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? ”
” মানে? আপনি কি বাইরে মেয়েদের সাথে ইটিসপিটিস করেন?”
” কি পিটিস করি? এসব কোথা থেকে শিখছো তুমি মিহির দানা? ”
” বন্ধুরা বলে।”
” তাই তো বলি! যাইহোক তুমি বরং রাহি ভাবি কিংবা আম্মাকে কল দিয়ে বলো একজন মহিলাকে ঠিক করে দিতে। কোনো কাজকর্ম করতে হবে না শুধু তোমার সাথে থাকবে। ”
” ঠিক আছে বলবো। আপনি দাঁড়ান আমি কফি নিয়ে আসছি।”
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। একাকীত্ব অভিশাপ না-কি আর্শীবাদ? মানুষ যখন বাজেভাবে ঠকে যায় তখন মনে করে একাকীত্ব সুন্দর। কারো সাথে থেকে কষ্ট পাওয়ার থেকে একা থেকে নিজের মতো বাঁচা ঢের ভালো। আবার যখন প্রিয় মানুষটা দূরে থাকে অথচ ব্যস্ততার জন্য কথা বলতেও তেমন সময় হয় না তখন একাকীত্ব অভিশাপ।
সারাদিন শেষে রাতে মা-মেয়ে বসেছে নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য। এ বাড়ির লোকজন খুব ভালো বলেই অতিথিদের জন্য যে রুম বরাদ্দ সেখানেই থাকে মিতু ও সুমি। বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে দু’জন। সবুজের কথা ভেবে সুমির একটুআধটু খারাপ লাগছে। কিন্তু মিতুও মোটেও বাবাকে মিস করছে না। ছোট্ট মিতুর মনে বাবার প্রতিদিনের অন্যায় কর্মকাণ্ড তার প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্ম দিয়েছে।
” মিতু তুই কী আমার লগে রাগ করছিস?”
” না তো মা। তোমার লগে রাগ করমু কেন?”
” তোর বাপের থেইকা দূরে নিয়া আইলাম তোরে এইজন্যে।”
মিতু আরেকটু গভীরভাবে মা’কে জড়িয়ে ধরে। সুমি মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
” তুমি যা করবা তাতেই আমার স্বায় থাকবো মা।”
” আমার সোনাচান।”
সুমি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে। মিতুও মায়ের আলিঙ্গনে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। শোয়ারঘর ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে রাহি। কিন্তু কীসের জন্য সেটা বুঝতে পারছেনা আদ্রিয়ান। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে রাহি বলেছে কিছুক্ষণ অপেক্ষার করতে। সেই জন্য ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা! হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আদ্রিয়ান। দরজা খুলে দিয়েছে রাহি। আদ্রিয়ান কৌতুহল নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখলো সারা ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির বদলে মোমবাতি জ্বলছে। আদ্রিয়ানের মনে পড়ে গেলো প্রথম বিবাহবার্ষিকীর কথা। সেদিন রাতে ঠিক এরকমভাবে ঘর সাজিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছিল রাহিকে। আজ বুঝি তার উল্টো হলো। আদ্রিয়ান এবার বিছানার দিকে তাকাতে দেখলো রাহি সেজেগুজে বসে আছে। চোখেমুখে তার লাজুক হাসি লেপ্টে আছে। আদ্রিয়ানের প্রিয় কালো রঙের শাড়ি পরেছে সে। সাথে হাতে কালো চুড়ি, কপালে ছোট্ট কালো টিপ,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল। আদ্রিয়ান ঘরের দরজা আঁটকে ধীরে ধীরে গিয়ে রাহির পাশে বসলো।
” কী ব্যাপার বলো তো এতো সাজগোছ! আজ তো আমাদের বিবাহবার্ষিকীও নয়।”
” তাতে কী হয়েছে? এমনি একটু সারপ্রাইজ দিলাম।”
” তা ঠিক আছে,নতুন করে আরেকবার ফুলসজ্জা করে নিবো। কী বলো?”
আদ্রিয়ান রাহির হাতে হাত রেখে হেসে বললো। রাহি মাথা নিচু করে ফেললো কিছুটা।
” শোনো না একটা কথা বলবো?”
” হ্যাঁ বলো। বিয়ে হলো কত বছর এখনো এত লজ্জা কীভাবে পাও তুমি? ”
” ধ্যাৎ! সুমি বলছিলো আমাদের কোনো বাচ্চা নেই কেনো।”
আদ্রিয়ান হেসে রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। রাহি কোনো কথা না বলে চুপচাপ প্রিয়তমের বুকের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনছে।
” তাহলে এই কথা? তাহলে নতুন অতিথি আসুক?”
রাহি মুখে কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো কেবল। আদ্রিয়ান বিছানা থেকে উঠে ঘরের সমস্ত মোমবাতি নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে ফের রাহির পাশে এসে বসলো।
” ওগুলো নিভালে কেনো?”
” ম্যাডাম আমরা তো এখন আর আমাদের মধ্যে থাকবো না,মহাকাশ ভ্রমণে যাবো। তাই তখন তো এই পৃথিবীর কোনো খেয়াল থাকবে না। কোনো দূর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য বুঝলেন? ”
” ভাবছি তুমি বিজ্ঞানী হলে না কেনো?”
” আমি না হলেও আমার ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য চেষ্টা করবো ঠিক আছে। ”
রাহি আদ্রিয়ানের কথায় হাসলো কেবল। আদ্রিয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। কী সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানা তার! হাসিতে যেনো প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। আদ্রিয়ান রাহিকে জড়িয়ে কপালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিলো। রাহিও আদ্রিয়ানের গালে,নাকের ডগায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।
” রাহি।”
” হ্যাঁ বলো।”
” একটা গান শোনাবে?”
” এখন?”
” হুম। ”
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি
আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সুরে বাজে মনে অকারনে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
ভোলা দিনের কাঁদন
কাঁদন হাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি!!
সকাল সকাল মেয়ের নম্বর থেকে কল আসায় কিছুটা চিন্তায় নিমজ্জিত হলেন রিনা বেগম। ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন তিনি। রাহি আর সুমি সকালের নাস্তা পরিবেশন করছে। রিনা বেগম কল রিসিভ করলেন।
” সবকিছু ঠিক আছে মিহি? সকাল সকাল কল দিলি!”
” ঠিক না থাকার কী আছে বলো তো? বাসায় আমি আর সে,ঝামেলা হবে কার সাথে? ”
” তাহলে ঠিক আছে। কেমন আছিস তোরা?”
” আলহামদুলিল্লাহ, তোমরা কেমন আছো? ”
” হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ। নাস্তা খেয়েছিস?”
” হ্যাঁ। আচ্ছা মা একজন মহিলাকে ঠিক করো তো,আমার সাথে থাকবে সারাদিন। সকালে আসবে সন্ধ্যায় যাবে বাসায় এরকম। কোনো কাজকর্ম করা লাগবে না, সেসব রহমান চাচা করেন।”
” তাই? ভালোই হবে তাহলে আমাদের বাসায় তোর বাবার পূর্ব পরিচিত গ্রাম থেকে একটি মেয়ে এসেছে। ওর একটা ছয় বছরের মেয়েও আছে সাথে, আমাদের এখানেই থাকবে। আমি বরং ওকে তোর ওখানে পাঠিয়ে দিবো,দিন-রাত সব সময় থাকবে।”
” আরে বাহ! তাহলে আজকেই পাঠিয়ে দিও। ভাইয়ার সমস্যা থাকলে শরীফ ভাই গিয়ে নিয়ে আসবে।”
” আদ্রিয়ান তো সকাল সকাল না খেয়ে বেরিয়ে গেলো। অফিসে না-কি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। ”
” ওকে তাহলে আমি উনাকে বলে শরীফ ভাইকে পাঠিয়ে দিবো বিকেলে, এখন তো কলেজে যাবো। ”
” ঠিক আছে। ”
” আচ্ছা ভালো থেকো।”
” তুইও নিজের খেয়াল রাখিস সাথে সংসারেরও।”
ফোন কেটে নাস্তার দিকে মনোযোগ দিলো রিনা বেগম। রাহি অবশ্য বুঝতে পেরেছে সুমিকে নিয়ে কিছু বলেছে।
” সুমি!”
সুমি রান্নাঘরে ছিলো,রিনা বেগমের ডাকে দ্রুত পা চালিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো।
” হ্যাঁ ম্যাডাম।”
” বিকেলে তোমাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাবে আমার মেয়ে। খুব ভালো মানুষ আমার মেয়ে, ওর শ্বশুর বাড়িতে কেউ নেই। সারাদিন একা থাকে বলে একজন লোক খুঁজতে বলছিলো। তুমি আর মিতু যখন আছো বাইরে লোক কেনো খুঁজবো বলো?”
সুমি রাহির দিকে একপলক তাকালো। রাহি মুচকি হাসলো সুমির দিকে তাকিয়ে। সময় কম হলেও এরমধ্যেই রাহিকে ভরসা করতে শুরু করেছে সুমি।
” ঠিক আছে। আমরা যাবো।”
রিনা বেগম খুশি মনে খাবার খেতে শুরু করলেন।
মিহি কথা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই হবে বাসায় ছোটো একটা মেয়েও আসবে। ভাবতেই মিহির খুব ভালো লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে মিহি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
চলবে,