মনেরও গোপনে পর্ব-১৮+১৯

0
450

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৮
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

এরকম করে কাউকে ভালোবাসার কথা শুনলেও হয়তো রুদ্র হাসতো! কিছু কথা অজানা থাকাই ভালো, নিজের সব কথা বলতে নেই। এমনকি খুব ভালো বন্ধু কিংবা ভালোবাসার মানুষকেও না। কারণ মানুষ বদলায়, বদলায় সম্পর্ক।

ছবির মতো সুন্দর গ্রামের ছোটো একটা টিনের দোতলা ঘরের জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে সকালের মৃদু রোদ এসে গায়ে লেগেছে মিতুর।
রোদের আলো মুখময় খেলা করার কারণে ঘুমটা কেমন আলগা হয়ে গেলো তার। কিন্তু হঠাৎ করে
মায়ের কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো মিতুর। বিছানা থেকে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ছয় বছর বয়সী মেয়েটা বয়সের তুলনায় অনেক কিছু ভালো বুঝতে পারে। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে মায়ের ঘরে দৌড়ে চলে গেলো মিতু। যা ভেবেছিলো তাই! মিতুর বাবা তার মা’কে মেরেছে। সুমি মাটিতে পড়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে আর সবুজ এখনো গালমন্দ করে চলেছে। মিতু ভয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো। যতক্ষণ সবুজ ঘর থেকে বেরিয়ে না যাবে ততক্ষণ এরকমই দাঁড়িয়ে থাকবে মিতু।
” কতবার বলছি তোরে বাপের বাড়ি গিয়া কিছু টাহাপয়সা নিয়া আয়,তা তো যাবিনা। তাইলে পইড়া মাইর খা আরকি।”
সবুজ আরেকবার লাথি দিলো সুমিকে। সুমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলো।
” পিঠে আর লাথি দিও না,আমার আর সহ্য হইতেছে না। ”
মায়ের কান্নাজড়িত কথাগুলো মিতুর কলিজায় বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধছে। ইচ্ছে করছে বাবা নামক মানুষটাকে বটি দিয়ে এক কোপে ঘাড় নামিয়ে দিতে। কিন্তু ছোটো বলে মারা তো দূর কোনো কথা অবধি বলতে পারে না সে। একদিন অবশ্য মায়ের হয়ে কথা বলেছিল মিতু। কিন্তু সেদিন ছোটো মিতুকেও বাবার থাপ্পড় খেতে হয়েছিল।
” সহ্য না হইলে বাপের বাড়ি যা, নইলে শহরে গিয়া বড়ো গাড়ির নিচে পইড়া মর।”
সবুজ আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো। বাবা প্রস্থান করা মাত্রই মিতু মায়ের পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সুমি মৃদু হাসার চেষ্টা করে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,
” কাঁদিস না মা, আমরা অনেক দূরে চইলা যামু। ”
” কই যামু মা? বাবা কী আমাদের যাইতে দিবে?”
মেয়ের হাত ধরে আস্তে করে উঠে বসে সুমি। দু-চোখ মুছে সবকিছু বিবেচনা করে চোখেমুখ শক্ত করে বলে,
” কাইলকা যামু আমরা, দরকার হইলে মা-মেয়ে গাড়ির নিচে পইড়া সত্যি মরমু তা-ও এই জালিমের হাতে মাইর খামু না। ”
মিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে। মায়ের কষ্ট সহ্য হয় না তার। সুমি মেয়ের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই বয়সে কোথায় স্কুলে যাবে,খেলাধুলা করবে কিন্তু সেসবের কিছু মিতুর কপালে নেই।

এলার্ম ঘড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মিহির। চোখ খুলে সবার আগে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। আজ ক্লাস আছে ভার্সিটিতে। বিছানা ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রুদ্র আগেই হসপিটালে চলে গেছে। মিহি নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠে না কিন্তু রুদ্রর নয়টার মধ্যে হসপিটালে যেতে হয় বলে আগেভাগে চলে যায় সে। রহমান চাচা সকালে এসেই নাস্তা তৈরি করে দিয়ে চলে যান। তবে মাঝে মধ্যে মিহির সাথে গল্প করার জন্য থেকে যান। দুপুরের দিকে আবার বাসায় যান। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি একটা বাসন্তী রঙের থ্রিপিস পরে মিহি,হাতে ব্রেসলেট, কানে ছোটো দুল। চুলগুলো বরাবরই খোলা রাখে মিহি আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেলো মিহি। আজকাল ঘুমটা একটু বেশি হচ্ছে মিহির সেই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। রুদ্রর বাসা থেকে মিহির ভার্সিটি কাছে হওয়াতে বেশি সময় লাগলো না পৌঁছুতে। ক্যাম্পাসে গিয়ে দাঁড়িয়ে অহনাকে ডাক দিলো।
” অহনা! ”
অহনা মিহিকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে এসেছে।
” কেমন আছিস?”
” ভালোই, ক্লাস করবি না?”
” আজ স্যার নেই, অবশ্য অন্য কোনো স্যারকে বললে নিশ্চিত ক্লাস নিবেন। কিন্তু ইচ্ছে করছে না রে।”
” এটা কোনো কথা! আমি আরো কত তাড়াহুড়ো করে এলাম।”
” খেয়ে এসেছিস তো?”
” উঁহু খাইনি। ”
” চল ক্যান্টিনে গিয়ে খাবি।”
” আরে এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
অহনা ও মিহিকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে রউফ এগিয়ে এলো। রউফ ওদের ক্লাসমেট তবে ডিপার্টমেন্ট আলাদা।
” কী খবর তোদের? মিহির তো বিয়ের পর দেখা মেলা দুষ্কর হয়ে গেছে। ”
” ধ্যাৎ কী যে বলিস! আমি তো ভালো আছি,অহনা কেমন আছে তা জানি না। ”
” হ্যাঁ আমিও ভালো। রউফ চল ক্যান্টিনে যাই মিহি না খেয়ে এসেছে। ”
মিহি অহনার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো। একদিন সকালে নাস্তা করেনি সেটা কি জনে জনে বলতে হবে! কিন্তু কিছু বললো না মিহি। তিনজনে একসাথে ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো। মিহি একটা স্যান্ডউইচ খেলো কেবল। রউফ যদিও খেয়ে এসেছিলো তবুও আবারও একবার নাস্তা সেড়ে নিলো। অহনা চুপচাপ ওদের খাওয়া দেখছিলো।
” যখন ক্লাস হবে না তখন আর বসে কী করবি? তারচেয়ে বাসায় চলে যা বরং।”
রউফ মিহিকে বললো কিন্তু মিহি বাসায় যাবে না বললো। অহনার মাথায় তখন দুষ্ট বুদ্ধি ঘুরছিলো। হুট করেই বলে উঠলো,
” আচ্ছা শোন না আমার সাথে একটু হসপিটালে যাবি?”
” সেকি হসপিটালে কেনো?”
রউফ আবারও দুজনের কথার মধ্যে নাক গলানোতে অহনা বিরক্তি নিয়ে বললো,
” তোর বউয়ের বাচ্চা হয়েছে সেটা দেখতে। ”
” হুঁশ বিয়ে করলাম না আবার বউ,বাচ্চা। বুঝতে পেরেছি অহনা আপার মেজাজ চটে যাচ্ছে। মিহি আমি গেলাম। ”
” ঠিক আছে যা।”
রউফ চলে যেতে মিহি আর অহনা ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সোজা রিকশায় চড়ে বসলো।
” কোন হসপিটালে যাবি? ”
” সামনেই।”
” কেনো যাবি তা তো বললি না তখন।”
” তোর স্বামীকে দেখতে যাবো।”
” স্বামী! ”
” তাহলে কী ভাসুর? ”
” অসভ্য মেয়ে কোথাকার। ”
বিয়ে হয়েছে দু’মাস হয়ে গেছে মিহি ও রুদ্রর। তবুও এতদিনেও স্বামী কথাটা কেমন অচেনা ঠেকলো মিহির। তবে রুদ্র স্বামী হিসেবে খারাপ না। মানুষটার অতীত থাকলেও মিহির প্রতি সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময় মিহির সাথে খুনসুটি করে লোকটা। এতে অবশ্য মাঝে মধ্যে মিহির বিরক্ত লাগে কিন্তু তবুও রুদ্র চুপ থাকে না। এইতো গতকালই মিহি সন্ধ্যায় বিরিয়ানি রান্না করেছিল। কিন্তু লবনে একটু বেশি হওয়ায় রুদ্র যতক্ষণ জেগে ছিলো ততক্ষণই ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করে গেছিলো।
রিকশা থামলো সানরাইজ হসপিটালের সামনে। মজার কথা এতদিনেও মিহি জানে না তার স্বামী কোন হসপিটালে চাকরি করে। অহনা রিকশাওয়ালা মামাকে ভাড়া মিটিয়ে অহনা ও মিহি হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করলো। অহনা রিসিপশনের সামনে গিয়ে মিহিকে বললো,
” তুই একটু ওইদিকে গিয়ে দাঁড়া আমি আসছি।”
” ঠিক আছে। ”
মিহি রিসিপশনের বিপরীত দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়েছে। অহনা রিসিপশনের মেয়েটিকে রুদ্রর চেম্বারের কথা জিজ্ঞেস করলে সেই মেয়েটি বলে আগে থেকে সিরিয়াল না রাখলে হুট করে এসে রুদ্র চৌধুরীর চেম্বারে যাওয়া যায় না। সব রোগী দেখা শেষ হলপ তবেই যাওয়া যাবে।
” সবই বুঝলাম কিন্তু আপনি ডাক্তার সাহেবকে কল দিয়ে বলুন উনার স্ত্রী মিহি এসেছে তাহলেই হবে। ”
অহনার মুখে স্ত্রী কথাটা শুনে মেয়েটি হেসে বললো,
” ম্যাডাম আপনি এসেছেন আগে বললেই হতো। সোজা গিয়ে ডান দিকে স্যারের রুম।”
” ঠিক আছে ধন্যবাদ। ”
রিসিপশন থেকে মিহির কাছে গিয়ে মিহিকে নিয়ে রুদ্রর রুমের দিকে এগোতে লাগলো অহনা। কপাল ভালো আজকে তেমন রোগী নেই চেম্বারের সামনে। মিহি তখনও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিলো। রাহি কিছু ছবি পাঠিয়েছে সেগুলো দেখছিলো।
” মিহি ভেতরে আয়।”
মিহি আশেপাশে না তাকিয়ে চেম্বারের ভেতরে ঢুকলো। রুদ্র মিহিকে দেখেই হকচকিয়ে গেলো। শরীফ হেসে সালাম দিতেই মিহি চমকালো।
” আসসালামু আলাইকুম ভাবী।”
” তুমি! ”
” তুমি চেম্বারে এসেছো কেনো? শরীর ঠিক আছে তো!”
রুদ্র চেয়ার থেকে উঠে এসে মিহির সামনে এসে বললো। মিহি ঘটনার আকস্মিকতায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একবার অহনার দিকে তাকিয়ে ফের রুদ্রর দিকে দৃষ্টিপাত করলো মিহি।
” আমার কিছু হয়নি আমার বান্ধবীর মনে হয় বুকে ব্যাথা।”
” আরে না আমি ঠিক আছি। আসলে দুলাভাইয়ের থেকে ট্রিট নিতে এসেছি। ”
” ওহ আচ্ছা তা কী ট্রিট লাগবে শালিকা?”
মিহি মনে মনে খুব রেগে গেছে অহনার উপর। কিন্তু এখানে বসে কিছু বললো না। রুদ্র নিজের চেয়ারে বসে অহনাকেও বসতে বললো। মিহি বসলো না, শরীফ আর মিহি দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৯
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
মিহি মনে মনে খুব রেগে গেছে অহনার উপর। কিন্তু এখানে বসে কিছু বললো না। রুদ্র নিজের চেয়ারে বসে অহনাকেও বসতে বললো। মিহি বসলো না, শরীফ আর মিহি দাঁড়িয়ে আছে।
” আপাতত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ালেই হবে। ”
” ব্যস এতটুকুই! বেশ চলো দুই বান্ধবীকে ফুচকা খাওয়াবো।”
অহনা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠে দাঁড়াতেই মিহি গম্ভীর স্বরে বললো,
” ওকে নিয়ে খাইয়ে আসুন আমি শরীফ ভাইয়ের সাথে এখানেই বসছি।”
মিহির গম্ভীরতা দেখে অহনা আর কিছু বলার সাহস পেলো না। কিন্তু রুদ্র হেসে বললো,
” এত রাগ করার কি হয়েছে মিহির দানা? অহনা তোমার স্বামীর চেম্বারেই নিয়ে এসেছে,পরপুরুষের কাছে তো না।”
” আপনি চুপ করুন! আবারও মিহির দানা, অসহ্য। ”
মিহির রাগ দেখে শরীফ মুখ টিপে টিপে মিটিমিটি হাসছে। অহনা তো ভয়ে জড়সড়ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। রুদ্র কিছু বললো না, উঠে মিহির হাত ধরে অহনাকে ও শরীফকেও পিছু পিছু আসতে বললো। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটু সামনে হেঁটে যেতেই রাস্তার পাশে ফুচকাওয়ালার দেখা মিললো। মিহি বারবার রুদ্রর থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলেও শক্তিতে পেরে উঠেনি বলে চুপ করে গেছে।
” মামা চার প্লেট ফুচকা দিন তো।”
” ঝাল বেশি না-কি নরমাল? ”
রুদ্র অহনা ও মিহির দিকে তাকালো একবার। মিহি কিছু বললো না কিন্তু অহনা বলে মিহি ঝাল বেশি খায় আর সে কম খায়। খাওয়া শেষে শরীফকে মিহিকে বাসায় দিয়ে আসতে বললো রুদ্র। অহনাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে রুদ্র হসপিটালে চলে যায়।

দুপুরের তপ্ত রোদে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছে ছোটো মেয়েটির। মিতুকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছে সুমি। সুমির শরীরও বিশেষ ভালো না। এই অবস্থায় প্রতিদিন মারধর এবং পৈশাচিক অত্যাচার সহ্য করতে পারে না শরীর। শহরের রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ অচেনা সুমির কাছে তবুও লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে কাঙ্খিত ঠিকানায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে সে। আশেপাশের বড়ো বড়ো দালানকোঠা দেখে মিতুর ছোট্ট মন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
” কী রে দাঁড়ালি কেন?”
” মা দেহো কত্ত বড়ো বড়ো দালান!”
” এগুলান দেইখা দাঁড়াইয়া থাকলে কী কাম হইবো? তাড়াতাড়ি পা চালা,লোকটা তো কইলো সামনেই এই ঠিকানা। ”
” আইচ্ছা মা আমরা কই যাইতাছি?।”
মেয়ের প্রশ্নে সুমির চোখমুখ মলিন হয়ে গেলো। সত্যি বলতে যেখানে যাচ্ছে সেখানে আদৌও তাদের জায়গা হবে কি-না জানে না সে।
” যামু একজন ভালো মানুষের বাড়ি। কথা বলিস না চল। ”
সুমির কথামতো মিতু আর কোনো প্রশ্ন করলো না মা’কে। মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বড়ো একটা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো। সুমি আঁচলের ডগার পুটলি খুলে গেট দারোয়ানকে একটা কার্ড দেখাতে দারোয়ান গেট খুলে দিলো। মনে মনে যদিও ভয়ে ছিলো কার্ড দেখালেও ভেতরে প্রবেশ করতে দিবে কি-না ভেবে। লোহার গেইট পেরিয়ে বাড়ির দরজার সামনে এসে দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করলো সুমি। কিন্তু অনেকক্ষণ টোকা দেওয়ার পরেও যখন কেউ দরজা খুললো না তখন করুন স্বরে মিতুকে বললো,
” মা রে আমাগো কপাল মনে হয় একেবারেই পোড়া। কত্তবার ধাক্কা দিলাম কেউ তো খুললো না দরজা। ”
” মা দরজার পাশে ওইডা কী?”
কলিংবেলের সুইচবোর্ডের দিকে তাকিয়ে বললো মিতু। মেয়ের কথায় সুমিও সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো। ভালো করে তাকিয়ে জিনিসটা কী বোঝার চেষ্টা করছে সুমি। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতেই সুইচটা উঁচু নিচু হতেই শব্দ হওয়াতে চমকালো দু’জন। কিয়ৎক্ষণ বাদেই সুমি বুঝতে পারলো এটা দিয়ে বাড়ির লোকজনকে সংকেত পাঠানো হয়। তাই আরো একবার সুইচ টিপে মিতুর দিকে তাকালো সে। এরমধ্যেই একজন সুন্দরী নারী দরজা খুলে দিলো। সুমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী সুন্দর ফর্সা তার চেহারা, ঠোঁটে লিপস্টিক,চুলগুলো খোলা! গ্রামে কেউ এমন করে সাজেনি কখনো। সুমির ভাবনায় ছেদ ঘটলো সুন্দরী নারীর মিষ্টি কন্ঠে।
” কাকে চাই? ”
” সালমান চাচায় আছেন? আমি পুবালিপুর গেরাম থেইকা আইছি,উনার সাথে আগে কথা হইছিল আমার। ”
” বাবার পরিচিত, আচ্ছা ভেতরে আসুন।”
সুমি রাহির কথামতো বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো মিতুকে নিয়ে।
” আপনি এখানে বসুন আমি বাবাকে ডেকে নিয়ে আসছি।
সোফার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো সুমি। এত সুন্দর জায়গায় সে বসবে! কিন্তু মিতু বলা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে সোফায় বসে পড়েছে। ততক্ষণে রাহি দোতলায় চলে গেছে সালমান খুরশিদকে ডাকতে। রান্নাঘর থেকে রিনা বেগম রাহিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কে এসেছে? কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে রিনা বেগম নিজেই বসার ঘরে এলেন। সুমি আর মিতুকে ভালো করে দেখলেন তিনি। দেখে চিনতে পারলেন না,মনে হয় না কখনো দেখেছেন বলে।
” তোমরা কারা! কী করতে এসেছো?”
রিনা বেগমের কথায় ভরকে গেল সুমি। মিতু আপনমনে সোফায় বসে পুরো ঘর দেখছে।
” আ..আ.আমি সুমি।”
” সেটা তো বুঝলাম কিন্তু কোথা থেকে এসেছো আর কেনো?”
রিনার প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যে সালমান খুরশিদ সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসেছেন। পিছন পিছন রাহিও এসেছে। সুমিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। সুমি এখনও রিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।
” কে তুমি? আমার সাথে দেখা করতে এসেছো?”
সালমান খুরশিদের প্রশ্নে ঘুরে তাকালো সুমি। ভদ্রলোককে দেখে ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তার।
” চাচা আমি সুমি,ওই পুবালিপুর গেছিলেন আট বছর আগে? ”
এতক্ষণে খেয়াল করলো সালমান খুরশিদ। সেই চঞ্চল কিশোরী মেয়েটির চেহারার আজ কী দশা হয়েছে! চোখমুখ কেমন মলিন,চোখের নিচে কালো দাগগুলো চিন্তিত আর নির্ঘুম রাতের সাক্ষী।
” হ্যাঁ মনে পড়েছে। বসো,রাহি ওঁকে কিছু নাস্তা দাও।”
রাহি শ্বশুরের কথামতো রান্নাঘরের দিকে গেলো। সুমি সোফায় না বসে ফ্লোরে বসলো। কিন্তু রিনা বেগমও যখন সোফায় বসতে বললো তখন মিতুর পাশেই বসলো। সালমান খুরশিদও বসলেন বিপরীত পাশের সোফায়। রাহি এরমধ্যে কিছু ফল আর শরবত নিয়ে এসেছে। সুমি কিছু খেলো না, মিতুকে খেতে বললো রাহি। রিনা বেগমও কিছু জানেন না বলে বসে রইলেন ঘটনা কী সেটা জানার জন্য। কিন্তু চুলোয় রান্না চাপানো থাকার জন্য রাহিকে রান্নাঘরে যেতে হলো।
” এখন বলো তো এত বছর পর হঠাৎ আমার কাছে এলে! তা-ও এই জীর্ণশীর্ণ অবস্থায়। ”
সুমি বিয়ের পর থেকে সবুজের করা সব অত্যাচারের কথাই বললো সংক্ষিপ্ত আকারে। শুধুমাত্র স্বামী স্ত্রীর একান্ত সময়ের অত্যাচারের কথা বলতে পারেনি। সবকিছু শুনে রিনা বেগম ও সালমান খুরশিদ দুজনেই করুন দৃষ্টিতে তাকালো সুমির দিকে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা। ফুলের মতো একটা মেয়ের জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই সালমান খুরশিদের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
” ওর কথা তো সবই শুনলাম মিহির বাবা,এক কাজ করো ওঁরা এখানেই থাকুক। আমাদের কাজে সাহায্য করবে।”
” হ্যাঁ সেটাই বলতাম আমিও। তবে ওর শরীর ভালো না তাই সব কাজ ওকে করতে দিও না। আর মিতুকে আমি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো।”
বাড়িতে জায়গা দিলেও পরের মেয়েকে স্কুলে দেওয়ার কথা শুনে রিনার চোখমুখ কুঁচকে গেলো। সুমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। সত্যি সত্যি এত সুখ ছিল তার কপালে?
” না না চাচা ওরে ভর্তি করা লাগবো না, আমগো শুধু একটু মাথা গুঁজবার জন্য জায়গা দিলেই হয়।”
” সুমি যখন চাচ্ছে না তাহলে ওর মেয়েকে ভর্তি করার দরকার নেই। ”
” সেটা আমি বুঝে নিবো রিনা। বাঁচবো কয়দিন আর বলো? পরপারে যাওয়ার আগে তো ভালো কাজকর্ম করে যেতে হবে তাই না?”
রিনা বেগম আরকিছু বললেন না। সুমি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো।
রাতের আকাশে কালো মেঘেরা ছোটাছুটি করছে। মাঝে মধ্যে চাঁদ ঢাকা পড়ছে মেঘের আড়ালে। মিহি ছাঁদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে রাতে চাঁদ দেখা হয়নি আর,আজকেই প্রথম। আজকে যখন রুদ্র মিহির হাত ধরেছিলো কেনো জানি মিহির বারবার মনে হচ্ছিল এই স্পর্শ মিহির পরিচিত। কিন্তু রুদ্র এ-র আগে কখনো ছোঁয়নি তাকে। ডিসেম্বরের রাতে ঠান্ডা বাতাসে শরীর কেঁপে উঠলো মিহির। পাতলা চাদরের মধ্যে থেকেও কাজ হচ্ছে না। সন্ধ্যায় আবার বৃষ্টি হয়েছিল তাই ঠান্ডা বেড়ে গেছে একটু।
” আজকে কী এখানেই ঘুমানোর প্ল্যান করলে না-কি মিহির দানা? ”
মিহি পিছনে ঘুরলো না। কারণ এ বাড়িতে রুদ্র ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই। আকাশের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো সে।
” ঠান্ডায় জমে মরার শখ নেই আমার। ”
” উমম বুঝলাম। আজকে ওমন রাগ দেখালে কেনো? বেচারি তোমার বান্ধবী কী ভয়টা না পেয়েছিলো।”
” ও ঢং করে বলেছিলো ডাক্তার দেখাতে যাবে। সরাসরি বললেই তো হতো ওর ট্রিট চাই আপনার থেকে। ”
” আহা তেমন কিছু তো ডিমান্ড করেনি জাস্ট মজা করার জন্য করেছে মেয়েটা।”
” হুম কচুর মজা।”
” ছি অশ্লীল কথা। ”
রুদ্রর এমন কথায় মিহি চোখ বড়সড় করে তার দিকে তাকালো। রুদ্র ঠোঁট টিপে হাসছে। মিহি বুঝতে পেরেছে লোকটা তাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে নির্ঘাত।
চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে