#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৫
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রাহিকে ফোনে কথা বলতে দেখলো আদ্রিয়ান। কিন্তু সেদিকে বিশেষ খেয়াল না করে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার উদ্দেশ্য এগোলো। অদ্ভুত বিষয় রাহি তবুও ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে, মোটেই আদ্রিয়ানের সাথে গেলো না! আদ্রিয়ান একবার ভাবলো রাহিকে জিজ্ঞেস করবে কী হয়েছে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো অযথা কথা বলার দরকার নেই। এমনিতেই ঘাড় থেকে নামলে বাঁচি!
আদ্রিয়ান রুম থেকে বের হতেই ফাঁকে মিহি এসে ঢুকলো রাহির ঘরে।
” ভাবি কিছু বললো ভাইয়া?”
রাহি এতক্ষণ বিছানায় বসে উসখুস করছিল। মিহিকে দেখে একটু স্বস্তি পেয়েছে।
” নাহ কিছু বলেনি কিন্তু কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে বটে, ওর চেহারার হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল সেটা। ”
” এক কাজ করো, আমি একটা ফেইক আইডি খুলেছি ফেইসবুকে। তুমি মেসেঞ্জারে আমার সাথে কথা বলবে বারোটা পর্যন্ত। ভাইয়া যদি উঁকিঝুঁকি দেয় তাহলে যেন বোঝে কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে কথা বলছো।”
” কিন্তু ও যদি ভুল বোঝে? ”
” সঠিকটা বোঝাতে যদি এইটুকু ভুল বোঝে তাহলে বুঝতে দাও। এরকম এক সপ্তাহ চালিয়ে তারপর বাবার বাড়ি চলে যাবা। ”
” ঠিক আছে মিহি,তোমার ভাই তুমি যাও এখন এসে পড়বে এখুনি। ”
” ওকে ভাবি কথা হবে রাতে। ”
মিহি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু যাওয়ার সময় করিডোরের মাঝখানে আদ্রিয়ানের সাথে দেখা হলো।
” কি খবর তোর? লেখাপড়া চলে তো ঠিকঠাক? ”
” হ্যাঁ ভাইয়া। তুমি একা খেয়ে এলে! ভাবি খেয়েছে? ”
” প্রতিদিন তো অপেক্ষা করে, আজকে তো দেখলাম ঘরে বসে আছে। কিছু বললো না তো।”
” ও ভাবি তো খেয়েছে একটু আগে। আমার খেয়াল ছিল না। আচ্ছা ভাইয়া শুভ রাত্রি। ”
” হুম। ”
মিহি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। আদ্রিয়ান এখনও করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে।
দেখতে দেখতে পাঁচ দিন কেটে গেলো এরকম করেই। রাহি এখন আদ্রিয়ানের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা এক রাহি। হুট করে যে এতটা বদল কীভাবে ঘটলো মাঝে মধ্যে ভাবে আদ্রিয়ান। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এটা ভেবে খুশি হয়ে যায় মেয়েটা আগের মতো পাগলামি করে না। ডিভোর্সের কথাটা এখন বলাই ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ! এরমধ্যেই ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে দিয়েছিল আদ্রিয়ান। আজকে দুপুরে সেটা নিয়ে বাসায় ফিরলো। রাহি প্রতিদিনের মতো সালমান খুরশিদকে খাবার পরিবেশন করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। এখন আর আদ্রিয়ান বাসায় লাঞ্চ করে না দুপুরে। সকালে বেরোয় আবার দেরি করে রাতে ফেরে। রাহি কিছু না বলাতে আদ্রিয়ান আরো লাগামছাড়া হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে তোশা আসে অফিসে তবে সেটা দুপুরের খাওয়ার সময়। প্রথম প্রথম আদ্রিয়ান তোশাকে এড়িয়ে চললেও এখন স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে। তোশা যে আদ্রিয়ানকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছে সেটা ভালোই বুঝতে পারে আদ্রিয়ান। স্ত্রী’র সাথে দূরত্ব গড়েছে অনেক মাস। তোশার সাথে কথাবার্তা বলার সময় মাঝে মধ্যে দূর্বল হয়ে যায় আদ্রিয়ান। কিন্তু বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার মতো সাহসও হয় না ঠিক। আজকে হঠাৎ দুপুরে আদ্রিয়ানের বাসায় ফেরার পিছনে যে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে রাহি। তাই শ্বশুরের খাওয়া শেষে তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে গেলো রাহি। কিন্তু রুমে ঢুকে দেখলো আদ্রিয়ান ঘরে নেই। নিসন্দেহে ওয়াশরুমে গেছে। রাহি বিছানায় বসে সামনের টেবিলের উপর আদ্রিয়ানের ফোন রাখা দেখতে পেলো। আগে প্রায় ফোন চেক করতো রাহি ভাবতেই হাসি পেলো তার। মিথ্যা মিথ্যা দূরত্ব গড়তে গিয়ে আজকাল সত্যি দূরে সরে গেছে মেয়েটা। আদ্রিয়ানের অবহেলা আগের মতো আর কষ্ট দেয় না তাঁকে। তবুও কী ভেবে রাহি বসা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে চাইলেই তার নজর আঁটকে গেলো ফোনের নিচে রাখা একটা কাগজের দিকে। রাহির মনে খচখচ করছে, ফোনের নিচে কীসের কাগজ! আদ্রিয়ানের অনুপস্থিতিতেই ফোনের নিচে রাখা কাগজটা খুলে দেখতে লাগলো রাহি। প্রথমে একটা ধাক্কা লাগলো বুকে কিন্তু তারপর মনকে বুঝালো রাহি। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটালেও চোখের কোণে টলমল করছে জল। অবশেষে বিচ্ছেদ! মিহি তো বলেছিল আদ্রিয়ান তার মূল্য বুঝবে,কিন্তু তা আর হলো কই! দরজার শব্দে চোখের জল লুকিয়ে ফেললো রাহি। আদ্রিয়ানকে কিছুতেই বুঝতে দিবে না তার সাথে বিচ্ছেদ হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে রাহির। তড়িৎ গতিতে রাহি মেইন দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করার ভান করলো। যেনো মাত্র ঘরে ঢুকেছে সে। রাহিকে দেখে আদ্রিয়ান নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করলো,
” ভালো হয়েছে তুমি এসেছো। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য বাসায় এসেছি। ”
“হ্যাঁ বলো।”
আদ্রিয়ান ফোনের নিচ থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে রাহির হাতে দিয়ে বললো,
” আমাদের ডিভোর্স পেপার। আশা করি কোনো ঝামেলা ছাড়া সবকিছু মিটে যাবে। ”
রাহি ভাবলেশহীনভাবে বললো,
” ভালোই করছো আমিও কাল বিকেলে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছি। সবকিছু চুকিয়ে গেলে আমারও ভালো হয়।”
কাঙ্খিত জিনিস পাবে শুনেও ভেতর ভেতর কেমন জানি খুশি হতে পারলো না আদ্রিয়ান। রাহিও ডিভোর্স চাচ্ছিলো!
” ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে ভালো থেকো তাহলে। সাইন করে পাঠিয়ে দিও না হয়।”
” হ্যাঁ বাসায় গিয়ে সাইন করবো,বাবা-মায়ের সামনে। নইলে উনারা বিশ্বাস করবেন না আমি আর তোমার সাথে সত্যি থাকতে চাই না। ”
আদ্রিয়ানের ফের অস্বস্তি হচ্ছে। রাহি তাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছিলো! আদ্রিয়ান তো নিজেই ডিভোর্স দিবে বলে ভেবেছিলো।
” ঠিক আছে। খেয়েছো না হলে এসো শেষ বারের মতো একসাথে খাবো।”
” ধন্যবাদ আদ্রিয়ান। সেটার দরকার নেই আমি ইতিমধ্যে খেয়ে নিয়েছি। তুমি বরং খেয়ে নাও, খাবার ঢেকে রাখা আছে। ”
আদ্রিয়ান মাথা নেড়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাহি ফ্লোরে বসে পড়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে বুকের ভেতর। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে।
ভোরের আলো ফুটেছে। হেমন্তে বিদায় নেয়নি এখনও তবুও প্রকৃতিতে এরমধ্যেই হালকা শীতের আমেজ এসে গেছে। গ্রামাঞ্চলে মোটামুটি ভালোই ঠান্ডা লাগে। বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলে। কিন্তু ঢাকা শহরে কোনো পরিবর্তন নেই। মজার কথা শীতের সময়ও ঢাকায় তেমন শীত পড়ে না। কিন্তু তবুও রহিম চাচা খুব স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। এখনই তিনি চাদর, টুপি ও মোজা ব্যবহার করেন। তবে বিষয়টা শুধু নিজে পরা নিয়ে নয়, তিনি রুদ্রকেও শীতের পোশাক পরার জন্য বলেন। তাতেই বাঁধে যত বিপত্তি। রুদ্র মোটেই এসব ভারী পোশাক পরতে পছন্দ করে না।
” চাচা কতবার বলবো আপনার মতো ঠান্ডা আমার লাগে না। আর এখনও শীতের পোশাক পরার মতো ঠান্ডা আসেনি।”
ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে বললো রুদ্র। পরনে তার কালো শার্ট। বারবার চুল কাটাতে অসহ্য লাগে বলে চুলগুলো যতটা সম্ভব ছোটো করে ছেঁটেছে গতকাল। রহিম চাচা নিজের চিন্তা ভাবনা সঠিক প্রমাণ করার জন্য বললো,
” তোমারে কে কইছে ঠান্ডা পড়েনাই? পাশের বাসার সাদাতও তো জ্যাকেট পরে ঘোরে। ”
” সাদাত পরে কারণ ওর শীত লাগে বলে আমার তো লাগে না চাচা! আমার সময় নেই তর্ক করার আসছি আমি। ”
রুদ্র অর্ধেক খাবার ফেলে রেখেই হসপিটালের দিকে ছুটলো।
রাহি বাবার বাড়ি চলে গেছে সপ্তাখানেক হবে। মিহির এজন্য খুব মন খারাপ লাগে। যদিও ফোনে প্রায় কথাবার্তা হয় তবুও মিস করে। আদ্রিয়ানের দিনকাল ভালো কাটার কথা থাকলেও যেমনটা চেয়েছিল তেমন ভালো কাটছে না। তোশার সাথে এরমধ্যে একবার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দরজা বন্ধ করতেই কেনো জানি রাহির হাসি হাসি মুখের অবয়ব ভেসে উঠেছিল তার চোখের সামনে। ব্যাস সেখান থেকে বেরিয়ে যায় আদ্রিয়ান। ফলে তোশা আদ্রিয়ানের উপর আরো রেগে গেছে। রাহিকে যে কারণে অসহ্য লাগতো তোশার সাথে মেশার পরে বুঝেছে তোশা তারচে বেশি অসহ্য। আসলে মানুষ চাইলেও সুখী হতে পারে না যদি না সৃষ্টিকর্তা চান।
চলবে,