মধ্যরাতের বৃষ্টি পর্ব – ৫

0
779

গল্প- মধ্যরাতের বৃষ্টি
লেখক- নাইমুল হাসান নিলয়
পর্ব- ৫

– বাবা আজকে এত দেরি কেন?
– আর বলিস না৷ অফিসে কাজের এত চাপ। এই বয়সে এত কাজ করা যায় বল?
– ও আচ্ছা। তোমার দেরি দেখে আমি রান্না করে খেয়ে ফেলেছি। হাত মুখ ধুঁয়ে খেয়ে নাও।
– খেতে ইচ্ছে করছে না রে।

বাবার অদ্ভুত সব আচরণের সাথে আমি আগে থেকেই পরিচিত কিন্তু ইদানিংকার আচরণ আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। আমি কেন জানি ব্যাপার গুলো নিতে পারছিলাম না। মনের মধ্যে উলটা পালটা সব চিন্তাভাবনা উঁকি মারছে আজকাল৷ আমি ভাবতেই শুরু করে দিলাম যে বাবা হয়ত নতুন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে আর সেটা আমার কাছে লুকাচ্ছে। নতুন সম্পর্কে যাওয়া দোষের কিছু না। একটা পুরুষ সারাজীবন একা থাকতে পারে না৷ তার নারীর সংস্পর্শ লাগে৷ নিজের বলে থাকার মত একান্ত এবং ব্যক্তিগত একটা মানুষ লাগে কিন্তু তাও কেন জানি আমি ব্যাপার গুলো সহজ ভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি বাবাকে ফলো করা শুরু করে দিলাম। বাবা কোথায় যায় কি করে সব কিছুতেই আমি বাবাকে ফলো করতে লাগলাম৷ বাবা প্রায়ই অফিস শেষে একটা ডাক্তারের চেম্বারে যায়। এরপর একটা মহিলার সাথে বের হয়৷ মহিলাটা ওই চেম্বারের ডাক্তার। মাঝে মাঝে এপ্রোন খুলতে ভুলে যায়। সেই সুবাদে নিশ্চিত হলাম মহিলাটা ডাক্তার৷ গায়ের রঙ শ্যামলা। সবসময় শাড়ী পরে। গোলগাল ধরনের চেহারা। দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে সবসময় ছোট একটা টিপ থাকে৷ তাই মাঝে মাঝে এই মহিলাকে অপ্সরির মত দেখায়৷ মাঝে মাঝে মনে হয় এই মহিলাকে মা হিসেবে মেনে নিতে আমার কোনো সমস্যা হবে না। মায়ের বয়েসি মহিলা। দেখতেও মায়া মায়া লাগে। কিন্তু পরোক্ষণেই মায়ের চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর এই মহিলাকে মনে হয় মায়ের সতিন।

বাবার এসব কান্ডে আমি বেশ বিরক্ত। ঠিক করলাম ওই মহিলার সাথে কথা বলে তাকে সোজাসাপ্টা বলে দিব যে আমি তাকে মা হিসেবে মেনে নিতে পারবো না৷ কিন্তু এটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না৷ বাবার সাথেও এই ব্যাপার নিয়ে আমি কথা বলতে পারবো না৷ তাই সোজা ওই মহিলার চেম্বারে চলে গেলাম৷ প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর আমার সিরিয়াল আসলো। আমি রুমে ঢুকতেই হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বললো। উনি আমার দিকে না তাকিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ” সাথে কেউ আসেনি? ” আমার মুখ থেকে কোন উত্তর না পাওয়ায় মহিলা তার ফাইলের খাতা থেকে মুখ সরিয়ে আমার দিকে তাকালো৷ এরপর আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।

– কি সমস্যা বলো?
– সমস্যা আপনি!
আমার মুখে এমন অদ্ভুত উত্তর শুনে মহিলা হকচকিয়ে গেল।

– বুঝলাম না। তোমার কি সমস্যা?
– আমার সমস্যা হচ্ছেন আপনি!
– আমি কিভাবে তোমার সমস্যা হলাম?
– আমি ইসমাইল সাহেবের ছেলে।

কথাটা শুনে ডাক্তার মহিলা কেমন যেন চুপসে গেল। এরপর ক্ষীণস্বরে বললো,

– ইসমাইল তোমাকে তাহলে সব কিছু বলে দিয়েছে?
– জ্বি না আমাকে উনি কিছুই বলেননি। আমিই সব বের করেছি।
– কি বের করেছো তুমি?
– কি বের করেছি বুঝতে পারছেন না? আমি সবই জানি৷ আমার সহজ সরল বাবাটাকে পেয়ে আপনি তার সুযোগ নিচ্ছেন? আচ্ছা আপনার কি জামাই নেই? বাচ্চাকাচ্চা নেই?
– দেখো তোমার বাবা একটা সময় আমার ক্লাসমেট ছিল। সেই সুবাদে তোমার বাবা আমার কাছে একটা সাহায্য চায়৷ আমি শুধু সেই সাহায্যটা করি। এর বাইরে আর কিছুই না। আমার জামাইও আছে আর তোমার মত বড় একটা মেয়েও আছে।
– কি সাহায্য করেছেন বলেন? আমিও ঠিক একই সাহায্য আপনাকে করি। এরপর সাহায্যে সাহায্যে কাটাকাটি। আপনি আমার বাবার রাস্তা থেকে সরে যাবেন৷

আমি কথা শেষ করতে না করতেই ডাক্তার আন্টি আমার বাম গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ সাথে সাথে আমি তবদা মেরে গেলাম।

– সত্যিটা ইসমাইলকে আজ হলেও বলতে হবে আর কাল হলেও বলতে হবে। ওর হয়ে না হয় আমিই বলি৷
– কি সত্যি?
– অনেক আগে ইসমাইল একদিন আমার কাছে আসে। এসে তোমার মায়ের এক্সিডেন্টের কথা বলে। তোমার মায়ের এক্সিডেন্টের সময় অনেক টাকা খরচ হয়। তোমার বাবা তখন অনেক ধারদেনার মধ্যে পড়ে যায়। তার উপর প্রত্যেক মাসে একবার করে ডাক্তারের চেক-আপ। বেতনের অর্ধেকের চেয়েও বেশি তোমার মায়ের ওষুধ আর ডাক্তারের পেছনে খরচ হতো। এইদিকে দেনাদারদের দেনা পরিশোধ করার চাপ। এই সব চাপ সামলাতে না পেরে তোমার বাবা সিদ্ধান্ত নেয় সে তার একটা কিডনি বিক্রি করে দেনা পরিশোধ আর তোমার মায়ের চিকিৎসা করাবে। আমি তাকে অনেক বুঝাই, টাকা দেই কিন্তু সে কিছুতেই বুঝেনি৷ তাই আর কোন রাস্তা না পেয়ে তোমার বাবা তার একটা কিডনি বিক্রি করে তোমার মায়ের চিকিৎসা করায়৷ তোমরা কেউই এই ব্যাপারটা জানো না৷ তোমার মা নিজেও জানতো না৷ ব্যাপারটা সে এতদিন কিভাবে লুকিয়ে রেখেছিল সেটা এখনো আমার কাছে রহস্যের মত মনে হয়।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো বা আমার কি বলা উচিৎ। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ডাক্তার আন্টি আমার বাক সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দিয়ে বললো,

– তোমার বাবা বেশিদিন আর দুনিয়াতে নেই। তার একটা কিডনি আগে থেকেই নেই। যেটা ছিল সেটাও প্রায় ড্যামেজ হয়ে গেছে৷ তাকে এখন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকা উচিৎ। কিন্তু সে এখনো অফিস করে। ইসমাইল আমাকে এসব বলতে নিষেধ করেছে। কারণ সে জানে তুমি একদিন না একদিন আমার কাছে আসবে৷ কিন্তু তাও আমি বলেছি কারণ তোমার এগুলো জানা উচিৎ। এখন তোমার বাবাকে তোমার বেশ প্রয়োজন। তার সাথে যত পারো ভালো সময় কাটাও, যত পারো তাকে খুশী রাখো৷ জীবনে অনেক কষ্ট করেছে সে। অন্তত শেষ সময়টায় তাকে সুখী রাখো।

চোখের কোণো এক সমুদ্র জল নিয়ে আমি চেম্বার থেকে বের হলাম। ভালোবাসার মানে কি আসলে? এ জীবনে বহু মানুষ বহু ভাবে এর ব্যাখ্যা করে গেছেন। কিন্তু আমার বাবা তার নিজের মত করে বলে গেলেন যে ভালোবাসার মানে হলো স্যাক্রিফাইস। আমি ভালো থাকি আর না থাকি কিন্তু যে কোন মূল্যেই হোক আমার ভালোবাসার ভালো থাকা চাই৷ বাবা তার স্যাক্রিফাইসের মাধ্যমে আমাদের প্রতি তার ভালোবাসা জানান দিয়ে গেছেন প্রতিনিয়তই কিন্তু হতভাগা আমরা সেটা বুঝতে পারিনি৷

বাবা বাসায় আসার অনেক আগেই আমি বাসায় আসি৷ বাবার প্রিয় গরুর মাংস ভাজা,বুটের ডাল আর ডিম ভুনা রান্না করি৷ খেতে এসে বাবা অবাক হয়েই বললো,

– তুই কিভাবে বুঝলি আজ আমার মাংস খেতে ইচ্ছে করছে?
– তোমার জন্য রান্না করেছি নাকি? আমার খেতে ইচ্ছে করছে তাই রান্না করেছি।
– দিলি তো মনটা খারাপ করে। মিথ্যা মিথ্যাই বলে দিতি যে আমার জন্য রান্না করেছিস। তাহলে তো আমি খুশী হয়ে যেতাম।
– মিথ্যা মিথ্যা কেন বলবো? আর তুমি কি যে খুশী হয়েছো সেটা তোমার জিভ দেখেই বুঝতে পারছি। মাংস দেখেই একেবারে জিভেজল চলে এসেছে। যতই জল আসুক দুই পিসের বেশি মাংস খেতে পারবে না। মাংস খেয়ে পরে প্রেশার বাড়াবা আর অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবা৷
– আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু তুই মাংস কেনার টাকা কই পেলি?
– টিউশনির টাকা পেয়েছি।
– কিন্তু এখন তো মাসের মাঝখানের সময়৷ এখন টাকা দিলো কেন?
– জানি না কেন দিয়েছে। হয়ত তারাও বুঝতে পেরেছে তোমার আজ মাংস খেতে ইচ্ছে করছে।

কথাটা শুনে বাবা হাহা করে হেসে উঠলো। মনে দাগ কেটে যাওয়া সেই পুরোনো হাসি। আমরা বাপ ব্যাটা মিলে বেশ আয়েশ করে রাতের খাবার খেলাম।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে