মধ্যরাতের বৃষ্টি পর্ব – ৪

0
773

গল্প – মধ্যরাতের বৃষ্টি
লেখা – নাইমুল হাসান নিলয়
পর্ব- ৪

আমার প্রথম সমুদ্র বিলাসের জন্য আমরা রওয়ানা হলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। বাবা সবসময় সব কিছু আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখে। কখন কি করবে, না করবে। কিন্তু এবারই প্রথম দেখলাম বাবার পরিকল্পনায় অবেহেলা। বাবা চট্টগ্রামের বাসের টিকেট কাটতেই ভুলে গেছে। টিকেট না পাওয়ায় আমরা লোকাল বাসে করে ফেনী গেলাম। এরপর সকালের নাস্তা সেরে বাপ ব্যাটা মিলে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম। আমি বসলাম জানালার পাশে। বাসের জানালা খুলে দিয়ে আমি বাসের ছুটে যাওয়া দেখলাম। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অনুভূতি। পাহাড় শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাসের ছুটে চলা শেষ হচ্ছে না। বাবা কিছুক্ষণ পরপরই পানি খায় যার কারণে কিছুক্ষণ পরপরই প্রস্রাবের বেগ আসে। ফেনী পর্যন্ত অনেক কষ্টে চেপে রাখতে পারলেও চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে তিনবার বাস থামানো লেগেছে। বাস ড্রাইভার বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে বাবাকে একটা বোতল দিয়ে বললো, ” নেন স্যার! এরপর চাপলে এইটার মইধ্যে কাম সারাইয়েন। চলতি গাড়ি এতবার থামাইলে মুড খারাপ হইয়া যায় আর ডেরাইবারের মুড খারাপ হইলে আপনাগোই বিপদ ”
বাবা বললো, ” না ভাইজান আর সমস্যা হবে না। আপনি নিশ্চিন্তমনে গাড়ি চালান। ”

চট্টগ্রাম থেকে আমরা টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম৷ টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন।টেকনাফ যেতে যেতে আমাদের বেশ দেরি হয়ে যায়। যার জন্য টিকেট নিতেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। জাহাজ ছেড়ে দেয়ার দু’মিনিট আগে আমরা জাহাজে উঠি। শুরু হয় আমাদের সমুদ্রের যাত্রাপথ।

সাধারণত আমার মানুষের ভিড় পছন্দ না। পছন্দ না কোলাহল কিন্তু এই সব অপছন্দকে এক পাশে রেখে মানুষের ভিড় আর ঠেলাঠেলির মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু হলো আমার সমুদ্র বিলাসের। যেহেতু ঠিক করে রেখেছি অনেক কিছু লিখবো সেহেতু আমি ভেবেই নিয়েছিলাম সমুদ্রের পাড়ে বসে লিখে ফেলবো অনেক কিছু। হয়ত অসমাপ্ত ডায়েরিটাও শেষ করে ফেলবো কিন্তু সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে আমি আমাকে হারিয়ে ফেললাম। ভুলে গেলাম অক্ষরজ্ঞান। একটা শব্দও লিখতে পারিনি আমি আমার সমুদ্র বিলাস সময়কালে। সমুদ্রের প্রত্যেকটা ঢেউ যেন আমার মনে এসে তীরের মত আঘাত করছিলো আর প্রশ্ন করছিলো ” কেন এত দেরি করলে তুমি? ” জবাবে আমি কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি।

ভরা পূর্ণিমা ছিল তখন৷ চাঁদটা যখন ঠিক মাথার উপরে এসে তার আলোতে পুরো ধরণী আলোকিত করে ঠিক তখন আমি আর বাবা সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে হেঁটেছিলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। এই হেঁটে যাওয়াতে কোনো অলসতা ছিল না, ছিল না কোন ক্লান্তি, শুধু ছিল এক চিলতে আক্ষেপ কিন্তু তাও এক অপরিচিত সুখ এসে সমুদ্রের ঢেউয়ের হিমশীতল বাতাসের মতই আমাকে সুখী করছিলো। মা’য়ের কথা বারবার মনে পড়ছিল তখন৷ বাবা সিগারেট খায় না কিন্তু হঠাৎ পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন৷ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন,
– তোর মা’কে বিয়ের আগে ওয়াদা করেছিলাম সিগারেট খাবো কখনো।
– তাহলে খাচ্ছো কেন?
– তোর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।
– বাবা! মা সবসময়ই আমাদের আসে পাশে থা….
কথাটা শেষ করার আগেই বাবা হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিলো। বাবার কান্ড দেখে আমি থমকে গেলাম। বাবা ভেবেই নিয়েছিলো মা আমাদের আসে পাশে আছে৷ একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কিভাবে এতটা ভালোবাসতে পারে আমার জানা নেই। এতটা শ্রদ্ধা এতটা ভক্তি আরেকটা মানুষের জন্য কিভাবে আসে সেটাও আমি জানিনা। আমি কখনো প্রেমিক দেখিনি কিন্তু আমি আমার বাবাকে দেখেছি।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা এতটাই দূরে চলে এসেছি যে টেরই পেলাম না৷ সমুদ্রের কিনারে কিছু অস্থায়ী চা’য়ের দোকান পাওয়া যায়। যে গুলো সারারাতই খোলা থাকে৷ আমরা একটা দোকান থেকে রঙ চা খেলাম। আমি এই চা’য়ের নাম দিয়েছি জোছনা চা। জোছনার আলো গায়ে মেখে যে চা খাওয়া হয় তাকে জোছনা চা বলে।

এই সময়টার প্রত্যেকটা মুহূর্তই আমি আমার মত করে সুখী ছিলাম। চাঁদের আলোকে হটিয়ে সূর্য মামা যখন সমুদ্রের বুকে তার জন্মগ্রহণ ঘটায় তখনকার মুহূর্ত মুখে বা লিখে ব্যাখ্যা করার মত না৷ বিধাতার এমন নিখুঁত সৃষ্টি দেখে হয়ত বিধাতাও আনন্দিত হন মাঝে মাঝে। আমার প্রথম সমুদ্র বিলাসে আমি সুখী ছিলাম। এসব সুখের মুহূর্ত গুলো গুনতে গেলে হয়ত পৃথিবীর সমস্ত ক্যালকুলেটর হার মানবে। তাই ধরণীর সব যন্ত্রণা ভুলে বালি আর নোনাপানির বুকে লুটিয়ে পড়ার আগে আমি আমার অভিযোগ বাক্সকে মুক্ত করে দিলাম। এরপর আকাশের দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বিধাতাকে বললাম, ” আমার মা’কে তুমি যেখানেই রাখো তুমি তোমার হেফাজতে রেখো ”

বাবার সাথে সমুদ্রের নোনাজলে ডুব ডুব খেলা খেললাম। বালি ছোড়াছুড়ি করলাম। এরপর দু’জন দু’জনের কাঁধে হাত রেখে সূর্য ডুবা দেখলাম।

গল্পের এই পর্যায়ে এসে পাঠক হয়ত চাইবে আমার সমুদ্র বিলাসের সময়কাল আরও দীর্ঘ হোক কিন্তু সমুদ্র বিলাসের পর্ব এখানেই ইতি টানতে হচ্ছে আমাকে। কারণ বাবার অফিস আছে আরও নানান কাজ।

ইদানীং বাবা নিজেকে ঘড়ির কাটার সাথে বেঁধে ফেলেছে। সব কিছুই ঠিকঠাক সময় মত করতে হবে। বয়সের কারণে ধৈর্য্যচুতিও লক্ষ করেছি বাবার মধ্যে। সব কিছুতেই কেমন যেন কপাল কুঞ্চিত স্বভাব হয়ে গেছে কিন্তু কেন জানি আমার সামনে আসলেই বাবার সমস্ত অভিনয় ধরা পড়ে যায়। বাবা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– তোরা মা ছেলে আমাকে কখনো সিরিয়াস হতে দিলি না।
– তোমাকে সিরিয়াস চেহারায় জোকারের মত লাগে বাবা।
বাবা তখন হাহা করে হেসে ওঠে। এরপর মাজায় হাত রেখে সোফায় বসে। বাবার এই হাসিটা আমার মনে দাগ কেটে যাবে আজীবন।

ইদানীং বাবা মাঝে মাঝেই অফিস থেকে দেরি করে আসে। কোথায় যায় বা কিসের জন্য দেরি হয় সেটার কিছুই বলে না। জিজ্ঞেস করলে একটাই উত্তর। অফিসে কাজের চাপ বেশি। কিন্তু আমি বাবার দেরি দেখে তার কিছু কলিগকে বেশ কয়েকদিন ফোন করেছিলাম। বাবা ঠিক সময়েই অফিস থেকে বের হয়।

গল্পের এই পর্যায়ে এসেও আমার কোন টুইস্ট রাখতে ইচ্ছে করেনি। বাবা ছেলের খুনসুটি আমার কাছে কেন জানি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তবে হ্যাঁ! বিশাল একটা টুইস্ট পাবেন আগামী পর্বে। যার জন্য আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে