গল্প- মধ্যরাতের বৃষ্টি
লেখক- নাইমুল হাসান নিলয়
পর্ব – ২
বাবা সাধারণ একটা সরকারি চাকরি করে। তাই বেতনও সাধারণ। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা বাড়ে। আমাদেরও বেড়েছে কিন্তু তাও বাবা তার এই স্বল্প আয়ের চাকরি দিয়েও আমাদের সব চাহিদাই পূরণ করে ফেলে ঠিক সময়মত। বাবা সবসময় বলে ” যে মানুষটা হক এবং হালাল পথে উপার্জন করে সে মানুষটা দিন শেষে আর যা-ই হোক খালি পেটে থাকে না ” আল্লাহ হয়ত বাবার হালাল উপার্জনের উছিলায় আমাদের দিন গুলো এত সুন্দর ভাবে পার করে দিচ্ছে৷
ধীরে ধীরে আমি বড় হলাম। বাবার সংসারে অভাব বাড়লো। সাথে মায়ের অসুখ। ইউনিফর্ম ছাড়া বাবাকে ভালো কোনো পোশাকে দেখিনা বছরখানেক হলো। সেই এক জোড়াতালি দেয়া শার্ট। মায়ের শাড়িটারও আঁচল ছিড়ে গেছে। আজকাল মায়ের রুমে ঢুকলে মা শাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমি বাবা মায়ের মধ্যে কখনো ঝগড়া দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে বাবা মায়ের সাথে রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তখন বাবার বার্তা বাহক হই আমি। বাবার রাগ করার পেছনের কারণ হচ্ছে ” দ্বিতীয় বিয়ে” মায়ের কথা হচ্ছে আর কতদিন এই পঙ্গুর সাথে সংসার করবে বাবা। তারও জীবন আছে। নতুন সংসার করার বয়স আছে। কেনো শুধু শুধু মায়ের পিছনে সময় নষ্ট করবে মানুষটা কিন্তু বাবার সাফ কথা এই ব্যাপারে মা কোনো কথা তুললে মায়ের সাথে দুই ঘন্টা কথা বলা বন্ধ। বাবা খুব ভালো করেই জানে মা তাকে ছাড়া দুই মুহূর্তও টিকতে পারে না। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তারা৷ দেনমোহরে মা শুধু বাবার কাছে একটা জিনিসই চেয়েছে আর সেটা হলো তার স্বামী যাতে পুরো জীবনটা তার সাথেই কাটায়। বাবাও সেদিন তার গোটা জীবনটা মায়ের নামে উৎসর্গ করে দিয়েছে। আসলে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে স্থান,কাল, পাত্র বেদে ভালোবাসতে পারে না৷ কাউকে একবার মন থেকে ভালোবেসে ফেললে সেই ভালোবাসা একজীবনে বিলীন হয়ে যায় না। তাই তো বলা হয় ভালোবাসা স্বর্গীয় যা স্রষ্টা কতৃক প্রদত্ত।
কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ফজরের আজানের সময় হয়ে গেলো টেরই পেলাম না৷ আজানের শব্দ কানে আসার সাথে সাথেই বাবা উঠে গেলো৷ রান্না ঘর থেকে শব্দ আসছে। বাবা মায়ের জন্য গরম পানি করছে। এইদিকে মা বলেই যাচ্ছে তার গরম পানি লাগবে না সে ঠান্ডা পানি দিয়েই অজু করতে পারবে কিন্তু বাবার কোনো প্রতিউত্তর পেলাম না৷ এখন বাবা চুপচাপ পানি গরম করবে৷ পানি গরম করে মা-কে অজু করিয়ে নামাজে বসিয়ে আমার রুমে আসবে। আমি বাবার প্রথম ডাকে সাড়া দিলাম না৷ দুই তিন বার ডাকার পর উঠলাম। এরপর বাপ ব্যাটা মিলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লাম৷ শীতের প্রতিটা সকালই সুন্দর হয়। আজও তার ব্যতিক্রম না। মসজিদ থেকে বের হয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে একটা জায়গায় বসলাম আমরা।
– রাতে ঘুমাসনি কেনো?
– তুমি কিভাবে জানলে?
– আমি তোর বাপ। আমি সব জানি।
– তোমাদের প্রেমের ইতিহাস মনে করার চেষ্টা করছিলাম। সব কিছু তো আমাকে বলোনি যেটুক বলেছিলো সেটুকও ভুলে গেছি। বাবা আরেকবার বলো না। শুনতে খুব ভালো লাগে। যখনই মনে হয় মা কোনো এক সময় হাঁটতে পারতো তখনই মনটা কেমন জানি আনন্দে ভরে যায়।
– তোর মা তখন হাঁটতে পারতো, দৌড়াতে পারতো আর অনেক বেশি হাসতেও পারতো।
– বাবা বলো না। আমার খুব ইচ্ছে করছে শুনতে৷
– আমি তখন মেট্রিক পরিক্ষা দিচ্ছি। অজপাড়া গাঁয়ের ছাত্র ছিলাম। তাই কারো কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না আমাকে নিয়ে৷ তবে হ্যাঁ আমিই এক মাত্র ব্যক্তি ছিলাম যে কি না আমার বংসের আর আমার এলাকার প্রথম মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মানুষের আমাকে নিয়ে মাতামাতি তখন শুরু হয় যখন পরিক্ষার ফলাফল দেয়। অজপাড়া গাঁয়ের কোন এক ছেলে মেট্রিক পরিক্ষায় কুমিল্লা বোর্ডে দ্বিতীয় হয়েছে তাও আবার পাঁচ বিষয় লেটার মার্ক নিয়ে। পুরো গ্রামে একটা হৈচৈ পড়ে যায়। এরপর গ্রামের সব থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিটি আমাকে তার বাড়ি নিয়ে যায় লজিং মাস্টার হিসেবে। তার দুই ছেলে আর এক মেয়েকে পড়ানোর জন্য। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমার বাড়িতে পড়ার আর থাকার মত ভালো কোনো ঘর ছিলো না। সেখানে ভালো ঘর পেলাম, ভালো ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ পেলাম আর সুযোগ পেলাম নিজের পড়টা চালিয়ে যাবার।
বাকি গল্প পরে কাল করবো৷ এখন বাসায় চল তোর মা বাসায় একা৷ তোদের জন্য নাস্তা বানিয়ে আমার আবার অফিসে যেতে হবে৷
– বাবা!
– বল?
– তুমি হাঁপিয়ে যাও না?
আমার প্রশ্নটা শুনে বাবা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,
– কখনো কাউকে ভালোবেসেছিস?
– না।
– কাউকে একবার ভালোবেসেই দেখিস। ভালোবাসার মানুষটার জন্য যা-ই করবি তা-ই ভালো লাগবে। যত কষ্টই হোক দিন শেষে মানুষটার মুখের একটা কথা বা একটা হাসিই তোর সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবে।
– মা-কে তুমি অনেক ভালোবাসো তাই না বাবা?
এই প্রশ্নটায় বাবার চোখে হাল্কা জলের আবির্ভাব হলো,
– হ্যাঁ তোর মা-কে আমি অনেক ভালোবাসি কিন্তু তোর মা আমাকে ভালোবাসে না।
– ওমা কেনো?
– দেখিস না খালি আরেকটা বিয়ে করতে বলে।
কথাটা বলেই বাবা তার চোখের পানি উধাও করে ঠোঁটের কোণো হাসি নিয়ে আনলো।
– তুমি আরেকটা বিয়ে করলে কিন্তু ভালোই হতো। অন্তত রোজ রোজ তোমার হাতের আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি খেতে হতো না।
কথাটা শুনার পর বাবার হাসি আরও গাঢ় হলো। আমিও বাবার হাসিতে যোগ দিলাম।
যার সাথে যে সুখ পায় তার পাশেই তার ঠাঁই হোক। মায়ের পাশেই বাবা সুখ পায় কিন্তু বিধাতা হয়ত চায় না একজীবনে বাবা এতটাও সুখী হোক। তাই তো বিধাতা মা-কে তার কাছে নিয়ে গেলেন আর বাবাকে করে ফেললেন নিঃস্ব। এখন মা-কে লুকিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার ভয় নেই। রাতদুপুরে চা খাওয়ার কোনো তাগাদা নেই। শীতের ভোরে গরম পানি করার কোনো ঝামেলা নেই৷ বার্তি একটা মানুষের জন্য রান্না করারও কোনো জ্বালা নেই কিন্তু তাও বাবাকে আমি সুখী দেখলাম না৷ যে লোকটা আমাকে সুখে থাকার মূলমন্ত্র শিখিয়েছিলো সেই লোকটাই আজ দুঃখের সাগরে ভাসছে৷ আমাদের দুইদিনের সুখের জীবন মুহুর্তেই চার টুকরো হয়ে গভীর জলে ভেসে গেলো৷ একটুকরো আমার হাতে আরেকটুকরো বাবার হাতে৷ বাকি দুই টুকরো অজানা গন্তব্যে মায়ের সাথে মিশে গেলো৷
চলবে…..