ভুল সত্য
১৫
আমি সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। মুকুল বোধ হয় ক্লান্ত ছিল, বিছানায় পড়তেই ঘুমিয়ে গেল। ফোনটা বালিশের পাশেই রাখা। আমি চাইলেই নিয়ে দেখতে পারি। সিকোয়েন্স এমন কিছু কঠিন হবার কথা নয়। ও তো এমন কোন জটিল মানুষ নয়। অবশ্য বলা যায় না; আর যেটা ঘটছে মনে হচ্ছে মুকুল অসম্ভব ভালো অভিনেতা; হয়তো আসলে ওর ভেতরটা অনেক জটিল। কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আমি আনমনে একবার ওর কপালটা ছুঁয়ে দিলাম। কি গভীর ঘুমিয়ে আচ্ছন্ন। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ওকে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
ব্যাপারটা অন্যায় জেনেও আমি ওর ফোনটা তুলে নিলাম। এক দুইবার চেষ্টা করতেই ফোনটা আনলক হয়ে গেল। এবং তার পরপরই আমি বুঝলাম যে ওকে বুঝতে আমি কতটা ভুল করেছি। ফোনের সিকোয়েন্স ‘এস’। এস দিয়ে তো শাওন হয়। এই অবস্থা! আর আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। চকিতে আমি একবার ওর দিকে তাকালাম। নাহ! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি চ্যাট লিস্টে মনোযোগ দিলাম। বেশ বড় চ্যাট লিস্ট। বোঝা যায় দীর্ঘ দিনের আলাপ। কথাবার্তার ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর কলিগ। কি আশ্চর্য! কলিগের সাথে এত সম্পর্ক তাহলে আমাকে বিয়ে করার কি দরকার ছিল। কিছুদূর পড়েই অবশ্য বুঝতে পারলাম বিষয়টা কি। কথাবার্তার ধরন মোটামুটি এইরকম
প্যকিং করেছ? সুইমিং কস্টিউম নিও কিন্তু।। ওখানে একটা ইনফিনিটি পুল আছে। উই উইল হ্যভ লট অফ ফান টুগেদার
এইটুকু আমি কাল রাতেই দেখেছি , যখন মুকুল ওয়াশ রুমে ছিল। পরেরটুকু দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। আমি স্ক্রল করে দেখতে লাগলাম মুকুল লিখেছে
আরে কিসের প্যাকিং। যাইতে ইচ্ছা করছে না
কেন? বউকে মিস করবা নাকি?
সে আর বলতে
সমস্যা নাই। পুষিয়ে দেব।
ও মনে হয় মন খারাপ করবে
আরে ধুর! ৩ দিনের তো ব্যাপার
হ্যাঁ সেটা ঠিক। আমি অবশ্য ম্যানেজ করে নিয়েছি ওকে।
কি? মালয়েশিয়া ট্রিপ দিয়ে? তবু ভালো তোমার জন ম্যনেজ হয়।
এত সোজা? মেলা সময় লাগসে। তবে ম্যনেজ হইসে
তাহলে আর সমস্যা কি? লেটস এনজয়।
এইটুকু পড়ে আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম। আমার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমার ধারণা ছিল আমি খুব শক্ত ধরনের মেয়ে। আজ বুঝলাম ধারণাটা কতটা ভুল। গালে কি যেন সুরসুরি দিচ্ছে। হাত দিয়ে বুঝলাম আমার গাল ভেজা। কাঁদছি নাকি আমি? কি অদ্ভুত! আমি কাঁদতেও জানি?
নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। এমনটাই তো হবার কথা ছিল, তাহলে এমন লাগছে কেন এখন? দুই হাতে মাথা চেপে ধরে অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। ঘুমাতে গেলাম শেষ রাতের দিকে। যথারীতি সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। ঘুম ভেঙ্গে দেখি মুকুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে। আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল
গুড মর্নিং
এত দেরি হয়ে গেছে আমাকে ডাকেন নি কেন
তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাকিনি
আমি বেশি কথা বাড়ালাম না শুধু ও যাওয়ার আগে বললাম যে আমি আজই মার ওখানে চলে যাব। ও একটু অবাক হলো তবে মানা করল না। বলল গাড়ি নিয়ে যেতে। এমনিতেও কনফারেন্স এর আগে খুব ব্যস্ত থাকবে আমি শুধু শুধু বোর হব ওখানে থাকাটাই ভালো। নানান যুক্তি দিল আমার যাওয়ার ব্যাপারে। আমি সবই বুঝলাম, কেন আমাকে বিদায় করতে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, ও ওর মত ইনজয় করুক।
মুকুল যাবার পর আমি ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম। ওর দেয়া কোন জিনিসই আমি নিলাম না শুধু টু্কটুকিকে সঙ্গে নিলাম। ইচ্ছে করেই বেশি জিনিসপত্র নিলাম না। বড় ব্যাগ দেখে বাবা-মা আবার নানান প্রশ্ন শুরু করে দেবে। কোন কিছু ছেড়ে যাওয়ার সময় শুধু শুধুই মানুষ জিনিসপত্র নিয়ে মাতামাতি করে। জিনিসপত্র দিয়ে কি হবে? এসব তো চাইলে আবারো কেনা যাবে। মানুষই যেখানে নিজের থাকলো না।
আমি ব্যাগ হাতে আমার ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে একবার দাঁড়ালাম। শেষবারের মতন। এই আয়নাটার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রতিদিন কাজে যাবার আগে মুকুল অনেক সময় নিয়ে তৈরি হয়।। যত্ন করে চুল ঠিক করে, পারফিউম মাখে, একটার পর একটা টাই পাল্টায়; শেষমেষ আমাকে বলে
দেখতো কোনটা পরব।
আমি ওর কান্ড দেখে হাসি। সব টালবাহানা। আমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকি তাই কাছে টানার ফন্দি। আমি টাই নিয়ে কাছে এলে বলে
বউ, আজকে একটা জিনিস খেতে খুব ইচ্ছা করছে
আপনি আমাকে এমন গ্রামের লোকের মতন বউ বলছেন কেন?
বউকে বউ বলবো না? তাছাড়া তুমিও তো গ্রামের বউদের মতন আমাকে আপনি বল
আমি কিছু বলি না। হাসতে হাসতে জানতে চাই কি খেতে ইচ্ছা করছে
চিতই পিঠা
চিতই পিঠার সঙ্গে কি?
তুমি যা দেবে তাই খেতে ভালো লাগবে
ও আচ্ছা, তাই? তাহলে করলার চাটনি করব
মুকুল আঁতকে উঠে বলে
সেটা কি জিনিস?
করলা আর চিরতা একসঙ্গে বেটে বানাতে হয়। দারুন খেতে
তুমি বিষ দিলে তাও খাব বউ
আমি হাসতে হাসতে ওর উপর ঢলে পড়ি।
সেই সময় বুঝতে পারিনি এইসব কথা ছিল আসলে আমাকে ম্যানেজ করার জন্য। শেষ অবধি ওর মুখোশটাও খুলল। এটাতো হবারই ছিল তবু কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সেই প্রথম দিন থেকেই তো আমি এটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম।
দুপুরের আগেই আমি আমার শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম। উনার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝলাম না রাগ হয়েছে না খুশি হয়েছে।
শাশুড়ির ঘর থেকে বেরোতেই দেখলাম নাজু আপা তার বিশাল শরীর নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমাকে দেখে বলল
ভাবি আপনি বলে বাড়িত যাইতাছেন?
হু
আয়হায়! তাইলে আমার কি হইব?
কেন?
ভাবসিলাম আপ্নের কাছে ইংরেজি শিখুম
কি শিখবেন?
ইংরেজি। খালাম্মার লগে নেটফিলিক্স এ মুবি দেহি। কিছুই বুজি না
এই ফ্যমিলির সবাই এক একটা পিস। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
আমার কাছে শেখার কি আছে? কত অনলাইন কোর্স আছে। একটাতে ভর্তি হয়ে যান
হইসি তো
তাহলে তো হলই। শিখতে থাকেন
কেমনে শিখমু ওই বেটার কথা তো কিছুই বুঝিনা
কোন ব্যাটা?
অনলাইন ইংরেজি কেলাসে ভর্তি হইসি। ৩০০ ট্যকা দিয়া। ব্যটার কথা কিছুই বুজি না।
আমি একটু কৌতুহলি হয়ে বললাম
কেন কি বলে সে?
প্রথম দিন কইলো মাতৃভাষা হইলো মায়ের মতন পাঁচ বছর এর দরকার লাগে আর ইংরেজি হইল বউ এর মতন মরন পর্যন্ত কামে লাগে। এমুন কি মরনের সময় ও লাগে।
মরনের সময় ইংরেজি দিয়ে কি হবে? আজরাইল কি এসে জিজ্ঞেস করবে
এক্সকিউজ মি, উড ইউ মাইন্ড ইফ আই কিল ইউ নাও ওর ইউ নিড ফিউ মোর মিনিটস
নাজু আপা তার জলহস্তীর মত শরীর দাপিয়ে বলল
হায় আল্লাহ! ভাবী আপনে এত সুন্দর ইংরেজি কন। আগে জানলে তো আপনের থেকাই শিখতাম। হুদাই ৩০০ টাকা লস দিলাম।
রাগে আমার ইচ্ছা হল এই মহিলাকে ধাক্কা মেরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দেই। বহু কষ্টে এই অতিকায় হস্তিনীকে পাশ কাটিয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম।
মা আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হল। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নানান পদের রান্না শুরু করে দিল। আমি একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম সেটা আর হল না।
পরদিন জোর করেই মা কে স্কুলে পাঠালাম। দুদিন মোটামটি ঘর বন্ধ করে পড়ে রইলাম। মুকুল দিনে ফোন দিলে ধরিনি। রাতে ফোন দিয়ে দুটো কথা বলেই ও ঘুমিয়ে পড়েছে। এত ঘুমকাতুরে ছেলেটা। বলে কিনা সব কথা নাকি মালয়েশিয়া গিয়ে বলবে। অনেক নাকি সারপ্রাইজ আছে। বেকুব একটা। আমি ওর সঙ্গে মালয়েশিয়া গেলে তো। কোথাও যাবো না। সব ঠিক করে ফেলেছি কি করব।
আমাকে ঠকানোর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। কঠিন শাস্তি।
চলবে………