ভুলতে পারব না তোকে পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
1737

#ভুলতে_পারব_না_তোকে
Last Part
#Writer:Unknown Writer

সাগর হঠাৎই নদীর আরো কাছে আসতে লাগল। নদী এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেল। নদী সাগরকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–স্যার আ আ আপনি আমার কাছে একদম আসবেন না?
নদীর কথা শুনে সাগর মুচকি হেসে বলল
–এখন তোমার কাছে আসতে বাঁধা নেই নদী। এখন থেকে তো তুমি আমার বিয়ে করা বউ। একটু আগেই তো নিজে থেকে তুমি আমাকে বিয়ে করেছো।
–কি! আমি আবার কখন আপনাকে বিয়ে করলাম?
–একটু আগে যেই পেপারটায় সাইন করলে সেটাতো তোমার আর আমার বিয়ের রেজিস্টি পেপার ছিল। এখন থেকে তুমি আমার বউ। শুধু মাত্র আমার কিউট বউ।
–স্যার আপনি এমন কেন করলেন?
–কেমন আবার করলাম? আমি যা চাই তাতো পেয়েই ছাড়ি বউ।
নদী ভাবতেও পারছে না সাগর চালাকি করে নদীকে বিয়ে করেছে৷ নদী পিছাতে একদম বিছানার কিনারায় চলে এসেছে। যেই নদী বিছানা থেকে নামতে নিবে ওমনি সাগর নদীর হাতটা খপ করে ধরে ফেলে নদীকে বিছানার সাথে চেপে ধরে। সাগর নদীর গালে আলতো করে হাত দিতে লাগল। আর নদী চোখ বড়বড় করে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল। সাগর মুচকি হেসে বলল
–সবসময় তো আমার কাছ থেকে এতো পালাই পালাই করো। এবার নিজের বিয়ে করা স্বামীকে কি করে এড়িয়ে চলবে বউ?
–স্যার আমার ভয় লাগছে। আমাকে যেতে দিন।
–এখন তো আমি তোমার স্বামী। আমার কিউট বউ। তাহলে আমাকে এতো ভয় পাচ্ছো কেন?
সাগর নদীর ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যায় আর নদী চোখ বন্ধ করে ফেলে ঠিক এমন সময় সাগরের ফোনটা বেজে উঠে। সাগর এতে চরম বিরক্ত হয় কিন্তু তাও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে সাগরের বাবা সাজ্জাত সাহেব ফোন করেছে। সাগর না চাইতেও কল রিসিভ করার সাথে সাথে অপর পাশ থেকে সাজ্জাত সাহেব বলে উঠলেন
–হ্যালো সাগর তুই এখন কোথায়? তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয় উর্মি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল।
–হোয়াট!! বাবা তুমি এসব কি বলছো? উর্মি আত্মহত্যা করার চেষ্টা কেন করেছিল?
–উর্মি যখন স্নেহাকে নিয়ে শপিং থেকে বাসায় ফিরে তখন যখন জানতে পারে তুই নদীকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিস তাই এমন একটা কান্ড বাঁধিয়েছে। উর্মি ফাঁসি দিতে চেয়েছিল আমরা অনেক কষ্টে দরজা ভেঙে উর্মিকে বাঁচাই।
–উফফ এই মেয়েটাও না একদম অসহ্য।
–প্লিজ সাগর তুই বাসায় ফিরে আয় নাহলে ওকে সামলানো যাচ্ছে না।
–আচ্ছা ঠিক আছে বাবা আমি আসছি।
নদী চিন্তিত হয়ে সাগরকে বলল
–স্যার উর্মি ম্যাডাম এখন ঠিক আছেন তো?
–সেটা আমি কি করে জানব নদী? চল এখন বাড়ি চল। নাহলে ঝামেলাটা আবার অঘটন ঘটাবে। দেখি ওটাকে ওটার নিজের বাসায় পাঠাতে পারি কিনা।
.
.
.
সাগর ও নদী বাসায় গেল। গিয়ে দেখল উর্মি বিছানায় শুয়ে আছে। আশেপাশে সাগরের মা, বাবা, বোন ও ডক্টর আছেন। ডক্টর উর্মিকে চেকআপ করে কিছু ঔষধ পত্র লিখে দিয়ে চলে গেলেন।
রহিমা বেগম উর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
–উর্মি মা চোখ খুলে তাকা, দেখ তোর সাগর ভাইয়া এসেছে। উর্মি চোখ খুলে তাকিয়ে সাগরকে দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে শুয়া থেকে উঠে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে সাগরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
–কোথায় গিয়েছিলে তুমি সাগর ভাইয়া? তুমি জানো না তোমাকে আমি কত ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
উর্মি সাগরকে জড়িয়ে ধরাতে সাগরের অসস্থি হতে লাগল। সাগর নদীর দিকে তাকিয়ে দেখে নদী মুখ গুমরা করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সাগর রেগে গিয়ে উর্মিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে উর্মির গালে কষিয়ে ঠাসস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। উর্মি গালে হাত দিয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল
–সাগর ভাইয়া তুমি আমাকে মারতে পারলে? আজ পর্যন্ত আমার গায়ে কেউ হাত তুলে নি। তুমি আমাকে মারলে?
সাগর রেগে দাঁতে দাঁত চেপে উর্মিকে বলল
–হ্যা হ্যা হ্যা মারতে পারলাম। বেহায়া মেয়ে তুই সুইসাইড করতে গিয়েছিলি কেন? তুই জানিস না আমি নদীকে ভালোবাসি! আর এখন তো নদী আমার বিয়ে করা বউ। তাই আমার জন্য এসব পাগলামি করা বন্ধ কর।
নদী সাগরের বউ শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। রহিমা বেগম সাগরকে বলল
–সাগর তুই এই ফকিন্নির বাচ্চাটাকে বিয়ে করেছিস?
সাগর এবার আরো রেগে গেল। পাশে থাকা টেবিলটায় লাথি দিয়ে বলল
–খবরদার মা তুমি নদীকে ফকিন্নির বাচ্চা বলবে না। হ্যা নদীকে আমি একটু আগে বিয়ে করেছি। কেন তোমাদের এতো অসুবিধা হয় কেন? যদি আমি নদীকে ভালোবসে বিয়ে করি তোমাদের এতো গায়ে লাগছে কেন?
উর্মি মাথা নিচু করে কান্না করছে। সাজ্জাত সাহেব সাগরকে বলল
–সাগর তুমি আমাদের একমাত্র ছেলে তুমি কিন্তু ভুলে যাচ্ছ আমার যাবতীয় সম্পত্তি আছে তা সব তোমার নামে লেখা। এই মেয়েটা টাকার লোভে তোমাকে বিয়ে করেছে সেটা আমরা ভালো করে বুঝতে পারছি।
–তোমাদের সম্পত্তি তোমাদের কাছেই রাখো বাবা। আমি চাই না তোমাদের সম্পত্তি। আর তুমি কি বললে নদী আমাকে টাকার লোভে বিয়ে করেছে? নদী তো জানতোই না আমি ওকে বিয়ের রেজিস্টি পেপারে সাইন করিয়ে বিয়ে করেছি।
সাজ্জাত সাহেব গম্ভীর গলায় সাগরকে বলল
–সাগর তুই এতো নিচে নামতে পারলি? তুই এভাবে নদীকে কিছু না জানিয়ে কৌশল করে বিয়ে করতে পারলি?
–হ্যা বাবা ভালোবাসার জন্য আমি সব পারি। তোমরা যদি নদীকে মেনে না নও তাহলে আমি নদীকে নিয়ে এই বাড়ি কেন! এই দেশ ত্যাগ করে নদীকে নিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হবো।
স্নেহা রহিমা বেগমকে ফিসফিস করে বলল
–দেখলে মা দেখলে। তোমার ছেলের মাথাটা এই মেয়ে পুরো খেয়ে ফেলেছে। এখন আমাদের কারো কথাই ভাইয়ার কানে যাচ্ছে না। নদীটা কি করে কৌশলে ভাইয়াকে বিয়েও করে ফেলল।
সাগর দেখল স্নেহা ফিসফিস করে রহিমা বেগমকে কি যেন বলছে। সাগর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে স্নেহাকে বলল
–যত পারিস মায়ের কানে কুমন্ত্রণা দে বোন। তোর কুমন্ত্রণায় আমার কিছু যায় আসে না।
সাগর নদীর হাত ধরে বলল
–চলো নদী আর একমুহূর্তেও আমার এ বাড়িতে থাকব না।
সাগর চলে যেতে নিলে সাজ্জাত সাহেব সাগরকে বলল
–দাঁড়া সাগর।
সাগর পেছনে ফিরে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমাকে আটকাচ্ছো কেন বাবা?
সাজ্জাত সাহেব সাগরের কাছে এসে সাগরের কাঁধে হাত রেখে বললেন
–তোর খুশিতেই আমরা খুশি। আমরা নদীকে তোর স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি সাগর।
সাগর নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। সাগর খুশি হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
–সত্যি বাবা! তুমি আমাকে আর নদীকে মেনে নিয়েছো?
–হ্যা মেনে নিয়েছি। যেখানে তুই নদীকে নিয়ে খুশি থাকবি সেখানে আমরা আর কি বলব। ছোটবেলায় নদীকে আমি নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম কিন্তু রহিমার কথা শুনে আমি নদীকে হয়তো ভুল বুঝেছিলাম। তোদের এই সম্পর্কটা আমরা মেনে নিয়েছি।
রহিমা বেগম সাজ্জাত সাহেবের কাছে এসে রাগী গলায় বলল
–ওগো তুমি এসব কি বলছো? তুমি এই মেয়েকে মেনে নিয়েছো মানে কি? এই মেয়ের জন্য সাগর আমাদের কত অপমান করে কথা বলেছে আর তুমি সেই মেয়েকেই মেনে নিচ্ছো!
–আহ্ রহিমা আর বাড়াবাড়ি করো নাতো নদীকে এবার তোমার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নাও।
–আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যেহেতু মেনে নিয়েছো আমার আর আপত্তি নেই।
নদীও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, সাগরের পরিবার নদীকে মেনে নিয়েছে। নদী খুশিতে চোখের জল ফেলছে।
সাগর নদীকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে নদীকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সাগর নদীর পাশে বসেই নদীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এক সময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে। নদী এতক্ষণ ঘুমের অভিনয় করে ছিল। নদী চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে সাগর নদীর পাশেই মাটিতে বসা অবস্থায় বিছানায় মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সাগরকে ঘুমন্ত অবস্থায়ও কত সুন্দর লাগে নদী আজ তা ভালো করে দেখল। নদী শুয়া থেকে উঠে বসে সাগরের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। নদী একটা মুচকি হাসি দিয়ে মনে মনে বলল
–আমাকে আপনি এতো ভালোবাসেন স্যার তা আমি আগে জানতাম না। আমার প্রতি আপনার এই ভালোবাসার পাগলামি আমাকে বাধ্য করেছে আপনাকে ভালোবাসতে। চাই নি আমি আপনার জীবনে এসে আপনার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিতে কিন্তু আপনি তো আর আমার কোনো কথা শুনলেন না। সেই আমাকে আপনার ভালোবাসায়, আপনার জীবনে জড়ালেন। আপনার যত্ন, আপনার ভালোবাসা, আপনার এই পাগলামি আমাকে সবসময় আপনার কথা ভাবাতো। আমি আপনাকে প্রথম দিন থেকেই খুব পছন্দ করতাম কিন্তু তা কখনো মুখে প্রকাশ করতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার সেই ভালো লাগাটা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমি জানি আপনিও আমাকে শুরু থেকে বাজে কথা বলতে চান নি কিন্তু পরিবারের মন রাখতে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে আপনি বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকতে পারেন নি। আমি ভাবতেও পারি নি আপনার বাসার একটা সামান্য কাজের মেয়েকে আপনি নিজের মনে জায়গা দিবেন। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি হয়তো দয়া দেখিয়ে আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু যখন আপনি সেদিন সত্যি ছাঁদ থেকে পড়ে আমার জন্য নিজের জীবন দিতে গিয়েছিলেন তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসেন। জীবনে মা- বাবার ভালোবাসাও তেমন পাই নি। টাকার লোভে তারা আমাকে বুঝা মনে করে বিক্রি করে দিয়েছিল। জীবনে অনেক কষ্ট, অনেক অত্যাচার আমি সহ্য করেছি কিন্তু আপনার দেওয়া ভালোবাসা, আদর, যত্ন, স্নেহ পেয়ে আমি তা সব ভুলে গেছি।
আমি আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি স্যার৷ খুব ভালোবেসে ফেলেছি।
নদী সাগরের কপালে আলতো করে চুমু দেয়। তারপর বিছানা থেকে নেমে সাগরের পাশে বসে সাগরের হাত নিজের হাতের মধ্যে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

সকাল বেলা সাগর ঘুম থেকে উঠে দেখে নদী সাগরের পাশেই মাটিতে বসে ঘুমিয়ে আছে। সাগর অনেক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে নদীর গালে চুমু দেয়। নদীর ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে যায়৷
নদী লজ্জা পেয়ে সাগরের হাত ছেড়ে উঠে যেতে নিলে সাগর নদীর হাত চেপে ধরে। সাগর নদীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কোথায় যাচ্ছো বউ?
–স্যার আমার বাসায় কাজ আছে। আমার হাতটা ছেড়ে দিন।
–তোমার এতো কিসের কাজ বউ! আর হ্যা তুমি এভাবে আমাকে স্যার ডাকা বন্ধ করবে প্লিজ। আমার এসব স্যার ডাকা আর ভালো লাগছে না।
–আচ্ছা ঠিক আছে আপনাকে স্যার বলে ডাকব না। এবার তো আমাকে যেতে দিন।
সাগর নদীর হাত ছাড়তে চাইছিল না কিন্তু নদীর জোরাজুরিতে ছাড়তে বাধ্য হলো। নদী নিচে চলে গেল। সাগর মুচকি হেসে বলল
–আজ আমি আমার বউটার জন্য কিছু শাড়ি, গয়না কিনে নিয়ে আসব। আমার বউটাকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে দিব। আমার মনের রানীকে সেই সাজে আমি দু চোখ ভরে দেখব।
.
.
.
কিছুক্ষণ পর সাগর নিচে নেমে বাড়ি থেকে বের হতে নিলে সাগরের মা প্রস্ন করলে সাগর বাইরে যাচ্ছি বলে চলে গেল। সাগরের মা আর কিছু বলল না। নদী রান্না করছিল তখনই রহিমা বেগম বলল
–এই যে নবাবের বেটি। তো আমার ছেলের বউ হয়েছিস দেখে কি কাপড়গুলোও কি ধুয়ে দিবি না নাকি?
নদী কাঁপা কাঁপা গলায় রহিমা বেগমকে বলল
–এ এই তো বড় ম্যাডাম কাপড় ধুতে যাচ্ছি।
রহিমা বেগম আর কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। নদী অনেকগুলো কাপড় ধুয়ে ছাঁদে গেল কাপড় মেলতে। উর্মি দেখল নদী ছাঁদে গিয়েছে তাই সেই সুযোগে উর্মিও লুকিয়ে লুকিয়ে ছাঁদে গেল। উর্মি দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল
–তোর জন্য আমার সাগর ভাইয়া আমাকে মেনে নেয় না। তোর জন্য সাগর ভাইয়া আমার গায়ে হাত তুলেছে। তুই মরে গেলে সাগর ভাইয়া আর আমার মাঝে কেউ থাকবে না। তোকে মরতে হবে নদী। তাহলেই আমার সাগর ভাইয়া আমাকে ভালোবাসবে। কিন্তু কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। কাজটা আমাকে একাই খুব সাবধানে করতে হবে। এমনকি আংকেল, আন্টি, স্নেহা এই কথাটা জানলেও আমার বিপদ হতে পারে। কেউ যেনে গেলে তো পরে আমি আমার সাগর ভাইয়াকে পাবো না। নদীকে এই পৃথিবী থেকেই আমি বিদায় করে দিব। নদী বেঁচে থাকলে সাগর ভাইয়া কোনোদিনও আমাকে ভালোবাসবে না।
নদী কাপড় মেলতে মেলতে ছাঁদের একদম কিনারায় চলে যায়। ছাঁদের এক পাশে রেলিং নেই তাই পুরোটাই ফাঁকা। নদী পেছনে খেয়াল করে নি কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। একসময় উর্মি নদীর একদম কাছে এসে ধাক্কা দিয়ে নদীকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। নদী ছাঁদ থেকে পড়েই চিৎকার করে নিচে পড়ে। সাথে সাথে নদী মাটিতে পড়ে নদীর শরীর থেকে রক্তে ভেসে যেতে থাকে। ইতিমধ্যে রাস্তায় লোকজড়ো হয়ে যায়। সাগরের বাসায় অনেকগুলো লোক এসে সাজ্জাত সাহেবকে বলল একটা মেয়ে ছাঁদ থেকে পড়ে গেছে এবং তার অবস্থা খুব খারাপ। সাজ্জাত সাহেব, রহিমা বেগম, স্নেহা গিয়ে দেখল মেয়েটা আর কেউ নয় নদী। সাগর শপিং মল থেকে নদীর জন্য অনেকগুলো শাড়ি গয়না নিয়ে এসে দেখল সাগরের বাড়ির পাশে লোকজড়ো হয়ে আছে। সাগর বুঝল না কি হয়েছে তাই সাগর ভীর ঠেলে সামনে গিয়ে দেখে নদীর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে পড়ে আছে। সাগরের মুহুর্তেই মাথা ঘুরতে লাগল। সাগরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সাগরের শরীর কাঁপতে লাগল। সাগর হাতে থাকা সব শপিং ব্যাগ ঠাস করে নিচে পড়ে গেল। সাগর দৌড়ে নদীকে মাটি থেকে তুলে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে গালে হাত দিয়ে অনবরত ডাকতে লাগল
–নদী! এই নদী! চোখ খুলো সোনা৷ আমার বউয়ের কি হয়েছে! এই নদী চোখ খুলো। দেখো আমি এসে পড়েছি। তোমার কিছু হবে না নদী। এই বউ কথা বলো?
আশেপাশের অনেক চেনাজানা লোকেরা সাগরের মুখে নদীকে বউ বলে ডাকাতে বুঝে যায় সাগর নদীকে বিয়ে করেছে। তারা একে অপরের সাথে বলাবলি করতে থাকে শেষে কিনা বিদেশে পড়ুয়া স্মার্ট হেন্ডসাম ছেলে কিনা একটা কাজের মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু সাগরের কানে এসব কিছু যাচ্ছে না। সাগর নদীকে পাগলের মতো ডাকতে থাকে। সাগরকে এখন পাগলের মতো লাগছে। সাগরের মা, বাবা, বোন এখন সাগর ও নদীর এই অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলে। উর্মি দূর থেকে দাঁড়িয়ে থেকে মজা নিচ্ছে। নদী একটু চোখ খুলে তাকিয়ে রক্তমাখা হাতে সাগরের গালে হাত দিয়ে বলল
–সাগর আপনাকে আমি খুব ভালোবাসি। এ জীবনে আপনার আর আমার মিল হলো না। হয়তো পরকালেই আমি আপনাকে পাবো। ভালো থা…
নদী আর বলতে পারল না। নদীর চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। সাগর নদীকে পাগলের মতো ডাকতে লাগল কিন্তু নদীর কোনো সাড়া শব্দ নেই। সাগর নদীর নাকে হাত দিয়ে দেখল নদী নিশ্বাস ফেলছে না। সাগর অনবরত চোখের জল ফেলতে লাগল। সাগর চিৎকার করে নদীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। সাগরের কান্না দেখে সকলের চোখেই পানি চলে আসল। একসময় সাগর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সাজ্জাত সাহেব সাগর ও নদীকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার নদীকে মৃত ঘোষণা করেন। আর ডাক্তার এটাও বলেন সাগর নিজের স্ত্রীর মৃত্যুটা মেনে নিতে পারে নি তাই সাগর অজ্ঞান হয়েছে।
.
.
.
বেশ কিছুদিন চলে গেল। নদী মারা যাবার পর থেকেই সাগর পাগল হয়ে যায়। সাগর নিজেকে অনেকবারই শেষ করে দিতে চায় কিন্তু সাগরের মা-বাবার জন্য পারে না। সাগর একদম অনুভূতি শূন্য হয়ে যায়। সাগর প্রতিদিন নিজেকে সারাদিন ঘরের মধ্যে বন্ধী করে রাখল। প্রতিদিন মদ, সিগারেট খেয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করতে লাগল। রহিমা বেগম, স্নেহা, সাজ্জাত সাহেবও এখন নদীর জন্য চোখের জল ফেলেন। তারা নদীর প্রতি অত্যাচার করে এখন অনুতপ্তের আগুনে জ্বলছেন। উর্মি সাগরকে অনেকবার বুঝায় নদীকে ভুলে যেতে কিন্তু সাগর যে উর্মির গালে কতবার থাপ্পড় দেয় তার হিসেব নেই। সাগরের একই কথা সে কখনো নদীকে ভুলতে পারবে না৷
এভাবে কেটে গেল আরও কয়েক মাস। সাগরের এখন সব কিছুতেই কেমন বিরক্ত লাগে। সাগর হঠাৎ ঘরের দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে পাগলের মতো হাসতে লাগল। সাগর হাসতে হাসতেই মাটিতে বসে বলতে লাগল
–ভেবেছিলাম আমার জীবন থেকে তোকে কখনো দূরে যেতে দিব না নদী। কিন্তু তুই কি করলি পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলি! আরে একটুও কি বুঝলি না তোকে ছাড়া আমি কি করে বেঁচে থাকব! পারব না আমি তোকে ছাড়া বেঁচে থাকতে। মা-বাবা সবসময় বলে নদীকে যেন ভুলে যাই। নতুন করে যেন জীবন শুরু করি। আরে ভুলব কি করে! নদী যে আমার আত্মার সাথে, আমার মনের মাঝে মিশে আছে। চাইলেই কি ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া যায়! বাকিরা হয়তো পারবে কিন্তু আমি যে পারব না। খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আমি নদীকে। নদী আমি কিছুতেই #ভুলতে পারব না তোকে। তাই আমার এই জীবন রাখারও কোনো মানেই হয় না। নদী ছাড়া সাগরের জীবন যে মূল্যহীন। সাগর নদীকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না৷
সাগর বসা থেকে উঠে ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বের করে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলল
–মা-বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাদের ছেলে যে নদীকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। নদীকে ছাড়া বেঁচে থাকার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই অনেক ভালো। আমার যে বুকের ভিতর বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও মা-বাবা।
সাগর কাঁদতে কাঁদতেই আবারো একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলল
–নদী আমি তোর কাছে আসছি। তোকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি যে ভুলতে পারব না তোকে তাই আমি তোর কাছে আসছি নদী। আমি তোকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না।
সাগর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একটা গুলি করে মাটিতে পড়ে গেল। গুলির শব্দে সাগরের মা-বাবা চমকে উঠল। তারা সাগরের ঘরের কাছে এসে দরজা ধাক্কাতে থাকল। একসময় সাগরের বাবা দরজা ভেঙে ফেলে। ভিতরে ঢুকে সাগরের মা, বাবা, বোন, উর্মি অবাক। কারণ সাগরের মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সাজ্জাত সাহেব ও রহিমা বেগম সাগরের কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগল। রহিমা বেগম পাগলের মতো সাগরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ঠিক সেই মুহুর্তেই উর্মি পাগলের মতো বলতে লাগল
–আমি আমার সাগর ভাইয়াকে মেরে ফেললাম! হ্যা হ্যা হ্যা আমি সাগর ভাইয়ার জীবন থেকে নদীকে সরিয়েছিলাম। আমি নদীকে সেদিন ধাক্কা দিয়ে ছাঁদ থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম না সাগর ভাইয়া নদীর জন্য নিজেকে এভাবে শেষ করে ফেলবে। আমার সাগর ভাইয়া মরে গেল! আমি আমার সাগর ভাইয়াকে মেরে ফেললাম! আমি তো আমার সাগর ভাইয়ার মৃত্যু চাই নি। আমি তো ভেবেছিলাম নদী মরে গেলে সাগর ভাইয়া আমাকে আপন করে নিবে। কিন্তু তাতো হলো না।
সাজ্জাত সাহেব কাঁদতে কাঁদতে রাগী গলায় উর্মিকে বলল
–তারমানে তুমি ঐদিন নদীকে ধাক্কা দিয়ে ছাঁদ থেকে ফেলেছিলে। ছিহ্ উর্মি তোমার জন্য আমি আমার সন্তান, বৌমাকে হারালাম। তোমাকে আমি পুলিশে দিব।
সাজ্জাত সাহেবের কথা শুনে উর্মির হুস ফেরে। উর্মি এবার বুঝেছে ও কি বলে ফেলেছে। তাই উর্মি ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে নিলে স্নেহা সামনে দাঁড়িয়ে উর্মির গালে ঠাসস করে থাপ্পড় মারে। স্নেহা উর্মির চুলের মুঠি ধরে বলল
–তোর জন্য আমি আমার ভাইয়া, আমার ভাবীকে হারিয়েছি। তোকে আমি নিজের বড় বোনের মতো ভালোবাসতাম কিন্তু তুই কি করলি! তুই আমার ভাই, ভাবীকে মেরে ফেলেছিস। তোকে তো পালাতে দেওয়া যাবে না।
উর্মি কাঁদতে কাঁদতে স্নেহাকে বলল
–স্নেহা আমাকে ছেড়ে দে বোন। আমি তোদের জীবনে আর কোনোদিনও আসব না।
–তোকে ছাড়ার তো প্রস্নই উঠে না। তোকে ছাড়লে আমার ভাই, আমার ভাবীর সাথে অন্যায় করা হবে। জীবনে অনেক পাপ করেছি কিন্তু আর নয়। তোকে ছেড়ে দিব কিন্তু একটা শর্তে। ফিরিয়ে দে আমার ভাই, ভাবিকে। কি হলো এখন চুপ করে আছিস কেন?
উর্মির মুখে কোনো কথা নেই।
সাজ্জাত সাহেব পুলিশের কাছে ফোন করে। পুলিশ এসে উর্মির হাতে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যায়। সাগরের ঘরে সিসি ক্যামেরা থাকার কারণে উর্মির বলা কথাগুলো পুলিশের কাছে জমা হয়। কিছুদিন পর কোর্টের রায় অনুযায়ী উর্মির ফাঁসি হয়। সাজ্জাত সাহেব তার মেয়েকে ভালো ঘরের একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। স্নেহা আজও নদীর সাথে আগে অন্যায় করা ঘটনা নিয়ে কাঁদে এবং কাঁদে তার ভাইয়ের জন্য। ঐদিকে সাজ্জাত সাহেব ও রহিমা বেগমও সাগর ও নদীর ছবির দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন চোখের জল ফেলেন। সাগর ও নদীর ভালোবাসাটা কেউ শেষ করতে পারে নি। তারা মরে গেলেও তাদের ভালোবাসাটা বেঁচে থাকবে আজীবন।




~[ সমাপ্তি ]~
[ কিছু কিছু ভালোবাসা মৃত্যুর পরেও আজীবন বেঁচে থাকে । গল্পটা কেমন লাগল সবাই জানাবেন বন্ধুরা ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে