#ভালো_লাগে_ভালোবাসতে
#পর্ব-১৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
কষ্টগুলো যখন অবাধ হয়ে যায় তখন বোধশক্তিও আর সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না।
নিদ্রর দেওয়া তীব্র কষ্টের আঘাতে আমারও বুদ্ধি লোপ পেল।টিকতে পারলাম না আর সেই বাড়িতে।সেই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম।উদ্দেশ্য যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাব তবুও সেই বাড়িতে বসে বসে নিদ্রর বিয়ে দেখতে পারবো না।পারবো না তাকে ডিভোর্স দিতে,সবকিছুই তো শেষ হয়ে যাচ্ছে।অন্তত তার স্ত্রীর পরিচয়টা তো থাক আমার।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাথা নিচু করে হেঁটে বাড়ির গেট পেড়িয়ে একটু সামনে এগোতেই পথে লম্বা কোনো কিছুর সাথে মৃদু ধাক্কা খেয়ে বাঁধা পেলাম।ল্যাম্প পোস্টের হালকা আলোয় চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সামনে নিদ্র বৃষ্টিতে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।থমথমে গলায় সে বলল,’কোথায় যাচ্ছো?’
আমি চোখের পানি মুছে অভিমানী গলায় বললাম,
-‘যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছি তাতে আপনার কি!আপনি তো আরেকটা বিয়ে করছেনই।এখন আমার আল্লাহর উপর খুব অভিমান হচ্ছে জানেন!ঐ রিপোর্ট টা কেনো সত্যি হলো না,সব ঝামেলা চুকে যেত।আমি মরে যে….
কথাটি সম্পূর্ণ শেষ করতে না দিয়েই ঠাস করে তিনি আমার গালে একটা চড় মারলেন।আমি গালে হাত দিয়ে তার দিকে তাকাতেই শক্ত হাতে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
-‘আমাকে মেরে ফেলতে চাস তাই না!খুব ভালো লাগে আমাকে জ্বালাতে!’
তার ভেজা শার্টের সামনের অংশ খামছে ধরে আমি ডুকরে কেঁদে উঠে আধো ভাঙা গলায় বলতে লাগলাম,
-‘মেরে তো এখন আপনি ফেলছেন আমাকে।প্লিজ নিদ্র আমাকে এত বড় শাস্তি দিবেন না।আমি সহ্য করতে পারবো না।’
তার বুকের বা পাশে হাত রেখে গভীর ভালোবাসায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে প্রবল বৃষ্টিতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম।তিনি হাতের মুঠ শক্ত করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।তার চোখেও অশ্রু সাথে রাগও।
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও আমি পারছি না।কান্নার জন্য কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
-‘আমি পারবো না নিদ্র,পা…রবো….না।আমি আপনাকে ভালোবাসি…খুব খুব ভালোবাসি।আমাকে…মাফ করে দিন।খুব কষ্ট…হচ্ছে….আমার।খুব….!’
তিনি আমাকে ছাড়িয়ে হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
-‘কষ্ট হচ্ছে?বুঝতে পারছো এই কষ্ট কি?আমি যেই কষ্ট পেয়েছি তার কাছে তোমার কষ্ট কিছুই না।যন্ত্রণায় ছিঁড়ে গেছে ভেতরটা প্রতিটা মুহুর্তে।প্রতিটা মুহুর্তে তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা আমার হৃদয়কে কাঁপিয়ে তুলতো।এক একটা কেটে যাওয়া দিন আমাকে প্রতিনিয়ত খুন করতো।তোমার কোনো ধারণাও নেই সেই যন্ত্রণার গভীরতা কতটুকু।তাই তোমাকে পারতেই হবে।নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব আয়োজন করে আমার বিয়ে দেবে।বিয়ের প্রথম সাক্ষী দেবে।’
আমি মুখ শক্ত করে চোখের পানি মুছে আবার পিছু হাঁটা দিতে লাগলাম।তিনি পেছন থেকে হেঁচকা টানে আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘কোথায় যাচ্ছো?’
-‘আপনি বললেই হলো!আমি আপনাকে ডিভোর্স দেবো না।আমি থাকবোই না এখানে।’
আমার ভেতর এই মুহুর্তে একটা জেদ চেপে বসেছে এই বাড়ি থেকে চলে যাবার।মনে হচ্ছে দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক তবুও কিছুতেই আমি নিদ্রর বিয়েতে উপস্থিত থাকবো না।মাথা ঠিকমতো কাজও করছে না।
তাই কথাটা বলে জেদ করে আবারো তার হাত ছাড়াতে নিলাম কিন্তু সে আমাকে না ছেড়ে আমাকে উঁচু করে তার কাঁধে তুলে নিল।আমি কেঁদে কেঁদে তার পিঠে অনবরত হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগলাম ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু তার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপই হলো না।আমাকে সোজা রুমে এনে বিছানায় ফেলে দিল।আমি আবারো উঠতে নিলে তিনি আমার উপর উঠে তার শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলেন।আমি হাত দিয়ে তাকে সরানোর জন্য ক্রমাগত ধাক্কা দিতে লাগলাম।তিনি রাগী চোখে আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে থামিয়ে দিলেন।আমি এবার কাঁদতে কাঁদতে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম।এতে তিনি আমার হাত দুটো বিছানায় শক্ত করে চেপে ধরে রাখলেন।আমি কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলাম,
-‘আমাকে ছাড়ুন,আমি চলে যাবো।কিছুতেই থাকবো না এখানে।’
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-‘আরেকবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বললে পা কেটে ফেলবো কিন্তু!’
বিছানায় চেপে রাখা আমার হাতের নখ দিয়ে তার হাত প্রচন্ড জোরে খামছে ধরলাম কিন্তু তার তাতে কোনো ভাবান্তরই হলো না।আমি জেদ চেপে বললাম,
-‘আমিও দেখি আপনি কি করে আটকান।আমি যাবোই।’
তিনি আমার দিকে একটি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে কামড় লাগিয়ে দিলেন।তার সমস্ত রাগ আর কষ্ট যেনো দাঁতের তীক্ষ্ণ আঘাতে আমার ঘাড়ে ঝারতে লাগলেন।ঘাড়ে তার চোখ থেকো গড়িয়ে পড়া নোনাজলের ঠান্ডা স্পর্শও অনুভূত হতে লাগলো।আমিও পুরো শান্ত হয়ে গেলাম।অন্তত এই আঘাতের মাধ্যমে তার কষ্টগুলো যদি একটু হলেও কমতে পারে।তাকে খামছে ধরা আমার হাত শীথিল করে নিলাম।ধীরে ধীরে তার কামড় ভালোবাসার পরশে পরিণত হতে লাগল।তার গভীর পাগলামোময় ভালোবাসা।
কিছুক্ষণ পর আমার শান্ত হয়ে যাওয়া উপলব্ধি করতে পেরে তিনি আমায় ছেড়ে চলে যেতে নিলে আমি উঠে খপ করে তার হাত ধরে বললাম,
-‘আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে ছাড়বো না।’
তিনি আমার হাত ছাড়িয়ে একটি বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন,
-‘সেটা বিয়ের দিনই দেখা যাবে।’
সকালে আমার ঘুম ভাঙলো খুব বেলা করে।রাতে করা আমার পাগলামো গুলোর কথা মনে পড়ে এখন আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।যেই চলে যাওয়া নিয়েই এত কান্ড হলো সেই আমিই নাকি আবার তাকে চলে যাওয়ার কথা বলছিলাম।
দোতলা থেকে নিচে নেমে দেখি পুরো বাড়িতে মেহমানরা গিজগিজ করছে।আব্বু সবাইকে দু দিন আগের থেকেই আনিয়ে রেখেছে।আব্বু এত বেশি বেশি করছে কেনো,নিজের মেয়ের কষ্ট কি তার একটুও চোখে পড়ছে না!
যেসব কিছু আমার বিয়েতে করার কথা বলেছিল সেসব করছে আমার সতীনের বিয়েতে।আব্বু সবসময় বলতো আমার বিয়ের দু দিন আগে থেকেই সকল মেহমানদের আনিয়ে রাখবে।তারপর সবাই মিলে জম্পেশ মজা করবে।
সাফার পুরো পরিবার,সোমা আপু নিদ্রর সব বন্ধুরা সবাই এসেছে।এই সাত মাসে কতকিছু হয়ে গেছে।তানিয়া আপু আর নাঈম ভাইয়া লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।নাঈম ভাইয়া তার মাকে ভয়ে আর তাদের সম্পর্কের কথা জানাতেই পারেনি।তাই তানিয়া আপু নাঈম ভাইয়ার কান ধরে নিয়ে গিয়ে একেবারে বিয়ে করে তার মার সামনে উপস্থিত হয়েছে।অবশ্য তার মা হাসিমুখেই তানিয়া আপুকে মেনে নিয়েছে আর ছেলেকে একশোবার কান ধরে উঠবোস করিয়ে শাস্তি দিয়েছে।নাঈম ভাইয়ার এখন করুণ অবস্থা।বউ আর মা দুজন একজোট হয়ে তাকে কান ধরে উঠবোস করায়।
সোমা আপু আর রাফি ভাইয়ার এনগেজমেন্ট হয়ে আছে।সাফা আর তামিম ভাই চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে।শুধু আমি আর নিদ্রই আজ আলাদা।আমাদের মাঝেই অদৃশ্য বেড়াজালের দেয়াল।
নিচে নেমে সোফার দিকে নজর পড়তেই দেখি নিদ্র আর ঐ রাইশা না ফাইশা নামের মেয়েটি পাশাপাশি বসে আছে।দেখেই শরীরটা পুরো জ্বলে উঠলো।রাইশা মেয়েটি নিদ্রর হাত ধরে বলল,
-‘নিদ্র তোমার হাতে এমন করে এত খামছি দিলো কে?’
নিদ্র আমার দিকে তাকিয়ে সোফায় গা হেলিয়ে বলল,
-‘দিয়েছে,এক বান্দরনি।’
-‘সো স্যাড!’
ঐ রাইশা ফাইশার ন্যাকামোতে এমনিতেই গা জ্বলে যাচ্ছিলো আর এখন তার কথা শুনে মাথা আরো গরম হয়ে গেল।আমাকে বান্দরনি বলা!
ইচ্ছে করছে ঐ রাইশার হাতটা ছিটকে দিয়ে তার থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় থেকে চাদর সরিয়ে বলি,
-‘দেখুন মিস রাইশা,খামছি শুধু আমি একাই দেইনি।আপনার হবু মিস্টারও কাল রাতে আমাকে এখানে কামড় দিয়েছে সাথে অসংখ্য কিসও করেছে।এখন আপনি আপনার ন্যাকামো বন্ধ করে আমাদের মাঝ থেকে ফুটে যান।’
কিন্তু কিছু বলার ভাগ্য আর আমার কই!আমাকে তো শুধু শুনতে হয়।তাই আম্মু এসেও আমাকে শোনাতে লাগলেন,
-‘কিরে তুই এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে রইলি যে?আর বিয়ে বাড়িতে মুখটাকে এমন পেঁচার মত বানিয়ে রেখেছিস কেনো?’
আম্মুর কথা শুনে আমি জাস্ট হতবাক হয়ে গেলাম।মুখটাকে ফুলিয়ে বললাম,
-‘তাহলে বলো লাউড স্পিকারে গান ছাড়তে আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে নাচ দেখিয়ে বেড়াই।’
নিদ্র হেলান দেওয়া থেকে উঠে কফির মগটা ধরে বলল,
-‘তাহলে তো ভালোই হয়।আমাদের আর এক্সট্রা নাচের মানুষ আনতে হবে না।তা কোন গান ছাড়তে বলবো?কালা চাশমা নাকি ডিজে ওয়ালে বাবু?’
আমি রাগে,দুঃখে,ক্ষোভে সেখান থেকে চলে এসে রুমে বসে রইলাম।একটু পর সত্যি সত্যিই কালা চাশমা গানটা ছেড়ে দিয়ে নিচ থেকে সবার উল্লাসের প্রতিধ্বনি কানে আসতে লাগলো।রাগের চোটে আমার চোখে পানি এসে পড়লো।সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছে।কষ্ট তো শুধু আমার।
নাচ,গান,উল্লাসে আমি আর বাড়িতে টিকতে পারলাম না।ঠিক করলাম বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসবো।সঙ্গে নিলাম আমার চিরকুমার ছোট্ট কাকুকে।কাকু সেই দুবাই থেকে এসেছে কিনা নিদ্রর বিয়ে খেতে।সবার আহ্লাদ দেখে আমি হতভম্ব।তাদের মেয়ের যে আজ বিয়ে ভাঙতে যাচ্ছে সেদিকে কারো কোনো কষ্ট নেই।বের হওয়ার সময় আব্বু বলে দিল সাবধানে যেতে গাড়িতে একটু ডিস্টার্ব আছে।আমাদের ব্রিটিশ আমলের দাদার আদিম যুগের গাড়ি।এর মধ্যে অলয়েজ ডিস্টার্ব থাকে।বছরে চলে পাঁচবার আর মেকানিকের কাছে যায় দশবার।গাড়ির রঙটাও একদম টকটকে লাল।আব্বুকে কত বলা হয়েছে এই গাড়িটা বিক্রি করে একটা নতুন গাড়ি কিনতে।কিন্ত নাহ্! আব্বু আর কাকু মিলে তাদের পূর্বপুরুষের সম্পদ বুকে আগলে রেখেছে।কিছুতেই বিক্রি করবে না।এই গাড়িতেই তারা চলাফেরা করবে,এই গাড়িতে চড়ার মতো শান্তি নাকি আর অন্য কোনো গাড়িতে নেই।
টাক মাথা ঢাকতে কাকু মাথায় ক্যাপ পড়ে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়ল।গাড়ির দরজা খুলে আমি তার পাশে বসতে যাবো তার আগেই নিদ্র এসে কাকুর পাশে বসে পড়ল।আমি হতভম্ব হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে বললাম
-‘আপনাদের চার পাঁচটা দামী পাজোরা গাড়ি থাকতে আপনি আমাদের এই ব্রিটিশ আমলের গাড়িতে বসলেন কেনো?’
তিনি আমার প্রশ্নে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে কাকুকে বললেন,
-‘কাকু আপনারা নাকি শালবনের দিকে যাচ্ছেন?আমাদেরও একটু তার একটু পেছনে নিয়ে যান।গায়ে হলুদের জন্য হলুদ আনা হয়নি।’
কাকু বললেন,
-‘তা বুঝলাম কিন্তু হলুদ তো তুমি এখানের বাজার থেকেও কিনতে পারো ইয়াং ম্যান।’
-‘তা পারি কিন্তু আমি চাই একদম খাঁটি হলুদ।শালবনের পরে শহরের বাইরে গ্রাম্য বাজারে তা ভালো পাওয়া যাবে তাই।আর পুরনো গাড়িতে যেই মজা তা নতুনত্বে কই,ঠিক বললাম তো কাকু?’
-এক্সিলেন্ট!তোমাকে আমার এর জন্যই বেশি পছন্দ ইয়াং ম্যান।একদম সব কাজ গুছিয়ে পারফেক্ট টাই করো।দেখলি সুপ্তি তুই এতদিনেও বুঝলি না আর ও দু দিনেই বুঝে গেল।আই লাইক ইট!হা হা হা।
তাদের দুজনের কথায় আমার মাথা ধরে গেল।পেছনে তাকিয়ে তো আরো জ্বলে উঠলো ঐ রাইশাও যাচ্ছে দেখি।আমিও মুখ বাঁকিয়ে পিছনে রাইশার পাশে বসে পড়লাম।বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,
-‘আজকাল কার ছেলেমেয়েদের লজ্জা শরম সব গেছে দেখছি।নিজেদের বিয়ের হলুদ নিজেরাই কিনতে যায়।’
নিদ্র গাড়ির ব্যাক মিররে তাকিয়ে শয়তানী হাসি দিয়ে আমাকে বলল,
-‘ঐ পদার্থটা তো আমার মধ্যে কোনো কালেই ছিল না সুপ্তি।তুমি তো জানোই!’
তার শয়তানী হাসি দেখে মনে চাচ্ছে তার চুলগুলো খামছে ধরি।এতদিন আমার সাথে লুচুগিরি করে এখন আবার আরেকজনকে নিয়ে গায়ে হলুদের প্রস্তুতি নিচ্ছে।যার জন্য ঘর থেকে বের হলাম সেই বিয়ের আয়োজন আবার আমার পিছু নিল।মনটাই দমে গেল।
আমার দাদার গাড়ি তার নিজস্ব নিয়মে ধীর গতিতেই গটগট শব্দ করেই চলছে।গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে আমি জানালার পাশে ঠেস দিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।বাইরে থেকে আসা বাতাসে আমার চুলগুলো মৃদু মৃদু উড়ছে।হঠাৎ গাড়ির সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলাম নিদ্র আড়চোখে আমাকে আয়নায় দেখছে।আমার সাথে চোখ পড়ার সাথে সাথেই নিদ্র দৃষ্টি সরিয়ে নিল।এক মুহুর্তের জন্য মনে হল হয়তো সে আমাকে দেখছিলো পরে ভাবলাম হয়তো দূর্ঘটনা বশত চোখ পড়ে গিয়েছে।নয়তো সে এখন আর আমাকে দেখবে কেনো।সে তো দেখবে তার হবু বউ রাইশাকে।
হলুদ কিনে ফিরতি পথে হঠাৎ একটা টঙ দোকানের সামনে এসে সেই ব্রিটিশ আমালের দাদার গাড়িটা ঘটঘট শব্দ করে থেমে গেল।আমি বলে উঠলাম,
-‘ঐ যে আবার হয়ে গেল।তোমাদের গাড়ির মেকানিকের কাছে যাওয়ার সময় এসে পড়েছে।আমি তো বলি ঐ মেকানিকের সাথেই এই গাড়ির বিয়ে দিয়ে দাও।’
কাকু বলল,
-‘তুই একটু চুপ থাকবি।গাড়িটা কতটা পথ এসেছে এর রেস্ট দরকার তো হতেই পারে।’
রেস্ট না ছাই!গাড়ী যে আর চলবে না সেটা কাকুও বুঝে গেল।এখন এই ফাঁকা ভাঙাচোরা রাস্তায় আমরা চারজন আটকে রইলাম।শহর থেকে বেশ দূরে এসে পড়েছি।এদিকটায় গাড়ি পাওয়া যায় কিনা তারও ঠিক নেই।চারদিকে ধূ ধূ বিস্তর ফাঁকা মাঠ।তারপরে সব বড় বড় গাছপালার জঙ্গল।টঙ দোকানের সামনে পাতা কাঠের বেঞ্চে আমি আর নিদ্র পাশাপাশি বসে রইলাম।আর এদিকে রাইশা আর কাকু ফোনের নেটওয়ার্ক খুঁজে যাচ্ছে।নিদ্র গভীর মনোযোগে ফোন টিপছে আর টঙ দোকানের সস্তা কাঁচের গ্লাসে চা খাচ্ছে।তিনি না চা খান না,এখন আবার খাওয়া শুরু করলেন নাকি!সাত মাসে কি সত্যিই অনেক কিছু বদলে গেল।আমার হাতেও চায়ের কাপ কিন্তু আমি এখনো এক চুমুকও দেইনি,আমি তো এখন তাকে দেখায় ব্যস্ত।যতই দেখি তবুও দেখার হয় না যেন শেষ।তার অর্ধেক খাওয়া চায়ের গ্লাস আমাদের দুজনের মাঝখানে রেখে তিনিও নেটওয়ার্কের খোঁজে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে হাত নাড়াতে লাগলেন।তার চায়ের গ্লাসের দিকে অপলক তাকিয়ে দেখে আমার দুটি পুরনো কথা খুব মনে পড়ল।
-“আমি কারো ঝুটা খাই না।”
-“একদিন ঠিকই খাবে।”
সত্যিই তার অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ থেকেই চা খেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।আমি আস্তে আস্তে তার চায়ের কাপটা হাতে তুলে আলতো দু হাতে ধরে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে খেতে লাগলাম।সত্যিই এক পরম উষ্ণতায় আমার শরীর শিহরিত হতে লাগল।এমন মজার চা যেনো আমি কখনো খাইনি।এক একটা চুমুক আমি চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতে লাগলাম।হঠাৎ নিদ্র এসে খপ করে চায়ের কাপটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
-‘এটা আমার চা।’
কথাটি বলে তিনি সেই চা খেতে লাগলেন।
আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।তার এত অবহেলা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
ফাঁকা মাঠের দিকে উদাস মনে আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম।শেষ বিকেলে ফাঁকা মাঠ থেকে শো শো করে পৌষ মাসের শীতল হাওয়া বইছে।আমার পরণে শুধু একটা হালকা গোলাপি রঙের পাতলা সুতির থ্রিপিছ।ওড়নাটাও শিফনের,বাতাসে তা ক্রমাগত উড়ছে।
ভেবেছিলাম পৌষ মাসের সবে শুরু তাই শীত করবে না।কিন্তু এখন মোটামুটি শীত শীতই লাগছে।হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে রেখে আমি মৃদু ঘষতে লাগলাম।এসময় রাইশা এসে আমাকে বলল,
-‘সুপ্তি,একটা হেল্প দরকার ছিল।নিদ্রর নাকি গরম লাগছে,তাই জ্যাকেটটা খুলে আমার হাতে দিয়ে দিল।এখন হাতের মধ্যে একটা জ্যাকেট নিয়ে ঘুরতে আমার বিরক্ত লাগছে।তুমি প্লিজ জ্যাকেটটা তোমার কাছে রাখো।’
কথাটি বলেই রাইশা আমার গায়ে নিদ্রর কালো জ্যাকেটটা জড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।আমি পাশে তাকিয়ে দেখি নিদ্র খানিকটা দূরে একটা চেক চেক বাদামী রঙের শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আমাকে দেখছে আবার সামনে দেখছে।আমি হেঁটে তার কাছে গিয়ে বললাম,
-‘আমি তো আপনার কেউ না।আপনার জ্যাকেট আপনার হবু বউ রাখতে পারলো না তাহলে আমি রাখবো কেনো?’
কথাটি বলে আমি জ্যাকেট খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।তিনি একবার তীক্ষ্ণ চোখে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটটা তার হাতে তুলে নিয়ে সামনে হাঁটা দিলেন।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।আমি ভেবেছিলাম আমার শীত লাগা বুঝতে পেরে হয়তো তিনিই জ্যাকেটটি পাঠিয়ে ছিলেন।তাই আমিও একটু পরখ করতে গেলাম,এখন দেখছি রাইশা যেকারণ বলেছে তাই সত্যি।রাগে আর দুঃখে আমার শরীর গরম হয়ে শীতটাই চলে গেল
অবশেষে একটি ভ্যানগাড়ি পাওয়া গেল।কিন্তু রাইশা আর কাকু ভ্যানগাড়িতে যাওয়া বাঁধ সাধলেন।রাইশা যাবে না কারণ ভাঙা রাস্তায় ভ্যানগাড়ির ঝাকুনিতে ওর চুল নষ্ট হয়ে যাবে আর কাকু যাবে না কারণ তার কোমড় ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে।ভাগ্য সহায় ছিলো বলেই হয়তো তারা একটা পিকআপ ভ্যান পেয়ে গেল।সেখানে ড্রাইভারের পাশে দুজনই বসতে পারবে তাই তারা দুজন উঠে চলে গেল।আমি আর নিদ্র ভ্যানগাড়ির পেছনের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে পরলাম।আমরা ছাড়াও গাড়িতে আরো দুজন বোরকা পড়া মহিলা উপরে পা উঠিয়ে বসে আছে।
ভ্যানগাড়ি চলতে শুরু করলো।নিদ্র ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো
আর আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।একসময় অস্ফুট স্বরে বললাম,
-‘একটা সত্যি কথা বলুন তো আপনি কি আমাকে এখন আর এক বিন্দুও ভালোবাসেন না?’
তিনি আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না।
হঠাৎ করে গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমি তার হাতের উপর হাত রাখলাম।ঝাঁকুনি থেমে গেলেও আমি আর হাত সরালাম না।তার কালো ঘড়ির উপরে ফোল্ড করে রাখা শার্টের হাতার একটু নিচে হাত উঠিয়ে আরো শক্ত করে ধরলাম।কিন্তু তিনি আমার হাত ছাড়িয়ে পেছনের মধ্যবয়স্কের একজন মহিলার হাতে ধরিয়ে বলে উঠলেন,
-‘অ্যান্টি,ওর হাতটা আপনি একটু ধরে রাখবেন,আসলে একটু পর পর গাড়িতে ঝাঁকুনি হচ্ছে তো তাই।’
আমি ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এখন কি আমার হাত ধরাও তার সহ্য হচ্ছে না।এতটা অচেনা হয়ে গেছি আমি!
হলুদ নিয়ে আসতে দেরি হওয়ায় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেরও দেরি হয়ে গেল।সবাই এখন হৈ হুল্লোর করে হলুদ বাটায় ব্যস্ত।আমি রুম অন্ধকার করে বসে আছি।আর নিচে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে।রাত আটটার দিকে আম্মু এসে রুমের লাইট অন করে বিছানায় একটা হলুদ শাড়ি রেখে বলল,
-‘সুপ্তি তুই এখনো এই কাপড়েই বসে আছিস।নিচে অনুষ্ঠান এক্ষুণি শুরু হয়ে যাবে।যা একটা শাড়ি পড়ে আয়।’
-‘আমি চোখের পানি মুছে চেঁচিয়ে বললাম,
-‘অনুষ্ঠান শুরু হলে হোক।আমার তো আর গায়ে হলুদ না।তুমি যাও এখান থেকে আমি যাবো না নিচে।’
কথাটি বলে আমি আম্মুকে জোর করে রুম থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলাম।কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় বারি পড়তে লাগলো।আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-‘আম্মু আমি বলেছি না আমি যাবো না।তুমি যাও এখান থেকে।’
বাইরে থেকে কেউ কোনো সাড়া না দিয়ে ক্রমাগত দরজা পেটাতে লাগল।শব্দে আমার মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম।আমি চরম বিরক্তি নিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখলাম নিদ্র দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে আমি পুনরায় দরজা লাগাতে গেলাম কিন্তু সে জোর করে ভেতরে ঢুকে গেল।
আর বলল,
-‘তুমি এখনো তৈরি হওনি কেনো?বলেছি না আমার বিয়ের সব আয়োজন তুমি করবে।আমার গায়ে হলুদও তুমি প্রথমে লাগাবে।নাও তাড়াতাড়ি তৈরি হও।’
আমি কেঁদে কেঁদে রাগ করে বললাম,
-‘না,আমি হবো না তৈরি।যাবো না নিচে।’
সে বিছানা থেকে শাড়িটা তুলে আমার সামনে ধরে বললো,
-‘বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করো না তো!তাড়াতাড়ি রেডি হও।’
আমি তার হাত থেকে শাড়িটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরে বললাম,
-‘বলেছি না পড়বো না!’
এতে সে রেগে ফ্লোর থেকে শাড়িটা তুলে দরজা লাগিয়ে বলল,
-‘ঠিকাছে,আমি নিজেই পড়িয়ে দিচ্ছি।’
তার কথায় আমি চমকে গিয়ে পিছনে যেতে নিলাম।সে কি সত্যিই সত্যিই আমাকে জোর করে শাড়ি পরাবে নাকি!সে দ্রুত আমার একেবারে কাছে চলে এসে কামিজের পেছনের ফিতায় হাত দিতেই আমি চোখ বন্ধ করে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম,
-‘আমি পড়বো।’
সে আমার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
-‘গুড গার্ল।’
সে চলে গেলে আমি নিজে নিজেই শাড়িটা পড়ে নিচে গেলাম।নিচে গিয়ে দেখি নিদ্র আর রাইশাকে পাশাপাশি বসিয়ে রাখা হয়েছে।দেখেই বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ ব্যাথা শুরু হয়ে গেল।নিদ্র আজ সাদার মধ্যে কলারের কাছে হলুদ সুতোর এমব্রয়ডারি করা একটি সুন্দর পান্জাবী পড়ে আছে।তাকে দেখতে কি সুন্দরই না লাগছে।সাদা রঙের জামায় তাকে ঠিক আর পৃথিবীর কেউ বলে মনে হয় না।মনে হয় জান্নাতের কোনো বাসিন্দা।আল্লাহ তাআ’লা তাকে কি সুন্দর করেই না তৈরি করেছেন!
কি সুন্দর হেসে হেসে সবার সাথে কথা বলছেন।কোনো দুঃখের ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই।তবে আমি কেনো একটু ঠিক হতে পারছি না।সামনে যে আমার জন্য গভীর আঘাত অপেক্ষা করছে।নিদ্র আমাকে তার বিয়ে দেখিয়েই ছাড়বে।
আমি একটু আগাতেই নিদ্রর মা কাছে এসে আমার চিবুকে হাত রেখে বললেন,
-‘বাহ্!কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।একদম হলুদ পরী।’
সোমা আপু এসে বলল,
-‘সুপ্তি,তাড়াতাড়ি আয়।সবাই কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।’
নিদ্রর মা বলল,
-‘হ্যাঁ,তুই নাকি সব আয়োজন নিজের হাতে করবি নে শুরু কর।’
তারা আমাকে নিদ্রর কাছে নিয়ে যেতে লাগলো।যতই তার কাছে আগাতে লাগলাম,আমার চোখ ছুটে অশ্রু বেড়িয়ে আসতে চাইলো।কিন্তু নাহ্!
আমার এই অশ্রু বের হতে দেওয়া যাবে না।নিদ্র যদি এতেই খুশি থাকে তবে তাই হোক।
তার খুশির জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি।
আমি ঝুকেঁ নিদ্রর সামনে রাখা হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তার গালে হলুদ লাগিয়ে দিলাম।সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো।আমার চোখ টলমল করতে লাগলো।তারপর পাশে রাইশার গালেও লাগাতে গেলে নিদ্র বলে উঠল,
-‘রাইশাকে কেউ হলুদ লাগাবে না।রাইশার হলুদে এলার্জি।’
আমার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো।এত ধ্যান রাখে ওর।আমি বলে উঠলাম,
-‘তা কি হয়!গায়ে হলুদে তো একটু হলেও হলুদ ছোঁয়াতে হবে।’
কথাটি বলে হলুদ নিয়ে ওর গালের কাছে যেতেই নিদ্র আমার হাত খপ করে ধরে তার বুকের বা পাশে নিয়ে সাদা পান্জাবীতে আমার হাত জোর করে মুছাতে লাগলো।তার কান্ড দেখে আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।হাত মুছানো হয়ে গেলে ছেড়ে দিয়ে পাশে থাকা বন্ধুদের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলতে লাগলো।আমি সেখান সরে আসলাম।নিজেকে আজ বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান খুব ভালো ভাবেই জমে উঠেছে।সবাই আনন্দে মেতে উঠেছে।যে যার গালে পারছে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে।আমি মেহমানদের ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।সব ঠিক থাকলে এই গায়ে হলুদটা হয়তো আমার হতো!
কথাটি ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ নামিয়ে সামনে থাকা খোলা চুলগুলো কানে গুঁজে নিলাম।
হঠাৎ কোমড়ের পাশে আলতো শিহরিত ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব হতেই চমকে উঠে হাত দিয়ে দেখলাম কে যেন হাত দিয়ে পাশ থেকে আমার কোমড়ে এক মুঠ হলুদ লাগিয়ে চলে গেছে।পেছনে ঘুরে মেহমানদের ভীড়ের জন্য কাউকেই দেখতে পেলাম না।কে লাগিয়ে গেলো এভাবে!হয়তো কোন বাচ্চা এমন করেছে ভেবে ব্যাপারটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।
আজ নিদ্রর বিয়ে।সকাল থেকেই কথাটা যতবার ভাবছি ততবারই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছে।হাত পা গুলো ক্রমাগত কাঁপছে।কাল রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের পর থেকে আমি আর সারারাত ঘুমাইনি।পুরো বাড়ির চেহারাই পাল্টিয়ে ফেলা হয়েছে সাজিয়ে।পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আমার এই মনে হতে লাগলো,আমার জীবনের সূর্যটাও আর কিছুক্ষণ পর এভাবেই ডুবে যাবে।আজ সারাদিন যে আমি কিভাবে কাটিয়েছি তা আমিই জানি।আর কিছুক্ষণ পরই সব শেষ,সব।আমার নিদ্রর উপর আর কোনো অধিকার থাকবে না।তার জীবনে অন্য কেউ এসে পড়বে।আমাদের ভালোবাসার গল্পটা খুব বিশ্রী ভাবে অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে।
সাফা সোমা আপু,তানিয়া আপু মহা আনন্দে সাজগোজ করছে অথচ আমার এমন অবস্থায় আমার কাছে কেউ নেই।আমার পরণে শুধু একটা সাধারণ হালকা আকাশী রঙের সুতি শাড়ি।কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ লাল হয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পড়ল বিয়ের আসরে সাক্ষীর জন্য সিগনেচার দিতে।
আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে।দেখলাম নিদ্র বর বেশে বসে আছে।কতটা খুশি সে,তাকে দেখে আমার বুকের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে উঠলো।শ্বাসও যেনো নিতে কষ্ট হচ্ছে।রাইশাকে দেখা যাচ্ছে না।হয়তো ওকে অন্য রুমে সাজিয়ে বসে রাখা হয়েছে।
নিদ্রর পাশে চোখে পড়লো আমাদের বিয়ের সেই বিরক্তমুখো কাজী সাহেব।আজ সেও হাসিখুশি।আমাকে দেখে হেসে বলল,
-‘এইযে মা জননী আজকে কিন্তু সময় নষ্ট করো না।এই যে সবাই সিগনেচার করে দিয়েছে এবার তুমিও করে দাও।’
কথাটি বলে তিনি আমার সামনে কলম বাড়িয়ে দিলেন।আমি নিদ্রর দিকে একবার আহত চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কলম ধরলাম।কলমটা ধরে রাখতেও খুব কষ্ট হচ্ছে।মনে হচ্ছে আমার হাত অবশ হয়ে গেছে।আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো।কাঁপা কাঁপা হাতে আমি কষ্টে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কাগজে স্বাক্ষর করে দিলাম।
কাজী সাহেব আলহামদুলিল্লাহ বলে সাবইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘নিন,এবার সব সম্পূর্ণ হলো।’
কথাটা শুনে আমি জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম।
চলবে,,