#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১৩তম_পর্ব
লেখনীতে ; নাহার সাইবা
~ এ..এসব কী বলছ মাসিমণি মা..মানে আমার বাবা বেঁচে আছে??তা..তাহলে তিনি কোথায়?আমি তো আমার জন্মের পর তার দেখা পাইনি।তুমি আমায় মিথ্যে বলছ তাই না?( মেঘলা)
মেঘলা ছলছলে নয়নে তাকিয়ে বলল দিশা দেবীকে তা শুনে তিনি আলতো করে চোখের কোণে জমা জলটা মুছে দৃঢ় কন্ঠে বললেন
~ নাহ মেঘু আমি মিথ্যে বলছি এখন বরং এতদিন যা বলে এসেছি তা ছিল মিথ্যে। তুই অনাথ নস,তোর বাবা জীবিত আছেন তবে তিনি..
দিশা দেবী আর বলতে পারলেন না থেমে গেলেন।দিশা দেবীকে চুপ করে যেতে দেখে মেঘলাই বলে উঠে
~ তবে কী মাসিমণি?চুপ করে থেকো না উত্তর দাও তিনি বেঁচে থাকলেও এতদিন কেন আমি জানিইনি?আর উনিও কী জানেন না যে তার মেয়ে বেঁচে আছে?( মেঘলা)
~ জানেন তিনি সব জানেন এবং সব জেনেশুনেই তোকে রেখে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে।তোর বাবা আর মায়ের বিয়েটা ছিল পারিবারিক। তোর বাবা পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর সম্পত্তির মালিক ছিলেন সেই সাথে ব্যবসা বাণিজ্যও করতেন।সবই ঠিক ছিল তবে আমি বুঝতাম দিদির সাথে তোর বাবার খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিল না,তিনি ছিলেন পরনারীতে আসক্ত। এছাড়াও তার বিয়ের পূর্বে এক ধনীর দুলালির সাথে সম্পর্ক ছিল একেবারে কঠিন সম্পর্ক তোর মায়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরও সে পরকীয়ার লিপ্ত হয়।খুব বুঝানোর চেষ্টা করেছিল দিদি তবে তোর বাবা তোর মা’কে খুব একটা মান্যগণ্য করেনি বরাবরই তার সাথে বাজে আচরণ করত আর দিদি সবটা মুখ বুজে সহ্য করত।এমন সময় দিদির গর্ভে তুই এলি তাতে তোর বাবার মায়ের প্রতি অত্যাচার কমল,তবুও তিনি তার প্রেমিকার থেকে দূরে সরে আসতে পারেননি ঠিকই রাত-বিরেতে ছুটে যেতেন তার কাছে।এমনভাবে মানসিক মৃত্যু দিদির অনেক আগেই হয়েছিল, শরীরটারও মৃত্যু হলো তোকে জন্ম দেওয়ার সময়,ঠোঁটে বিষাদের হাসি নিয়েই চিরঘুম দিল দিদি এই যেন বহুদিন পর শান্তির ঘুম!! আর তোর বাবা তুই মেয়ে হয়েছিলি বলে রাগে দুঃখে তোর দিকে ফিরেও তাকায়নি তার প্রত্যাশা ছিল একটা ছেলে।অতঃপর উপায় না পেয়ে তোকে আমার বাড়িতে এনে মানুষ করলাম হাজার মানুষের হাজার কথা শুনেও বড় করেছিলাম আমার দিদি অর্থ্যাৎ তোর মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে। তোর মেসোকে তো তুই নিজেই দেখেছিস তোর সাথে কতটা বাজে ব্যবহার করত তবুও আমি কিছু বলতাম না তুই আমার কাছে মানুষ হলেই হলো তারপর বিয়ের বয়স হতেই তোর মেসোর বন্ধুর বোনের ছেলে মানে আকাশের সাথে বিয়ে ঠিক হলো।আকাশের সম্পর্কে আমার ধারণা না থাকলেও আমি মানা করতে পারিনি কারণ তুই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গিয়েছিস আর বেশিদিন ও বাড়িতে তোকে নিরাপদে রাখতে পারতাম না।( দিশা দেবী)
দিশা দেবী এবার বিরাম টানলেন কথার।মেঘলা আঁখিজলে ভেসে যাওয়া মুখ টার দিকে দিশা দেবী তাকিয়ে থাকতে পারল না উঠে দাড়ালো।নিজের হ্যান্ডব্যাগ আর ফোনটা হাতে নিয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললেন
~ আজ আসি রে মেঘলা তোর মেসোর হয়ত অফিস শেষ কিছুক্ষণ পরই চলে আসব আমি নিচে অপেক্ষা করব তার জন্য। ভালো থাকিস মা আমার আর হ্যা আজ কথাগুলো বলতে আমি বাধ্য হয়েছি তার কারণ তোর মেসোর সাথে ঐ ভদ্রলোকের দেখা হয়েছিল একটা বিজনেস মিটিং এ। তাই আমি আর চাই না সত্যটা চাপা থাকুক বলেই দিয়ে গেলাম আজকে।( দিশা দেবী)
দিশা দেবী আর দাঁড়ালেন রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে পড়লেন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিজের রুমালের সাহায্যে চোখের নাকের পানি মুছতে লাগলেন।
মেঘলা উঠে দাঁড়ালো কোনোমতে মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে, পা দুটো অবস হয়ে আসছে চোখের পানি তার শুকিয়ে এসেছে এখন কেবল শূণ্য দৃষ্টি তার।কোনোমতে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে দরজার সামনে নিয়ে গেলো দরজাটা লাগিয়ে দাঁড়ালো, দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে পাশের দেওয়াল অবলম্বন করে দাড়ানোর চেষ্টা করল তবে পারল না।ভারসম্য হারিয়ে পড়ে গেলো টাইলসের মেঝেতে খুব দ্রুতই জ্ঞান শক্তিও লোপ পেলো।কেবল মেঝেতে পড়ে রইল নিথর মেঘলার দেহটা।
আকাশ তার মামা-মামীর সামনে বসে আছে আজ বিশেষ কথা বলতেই তাদের এখানে আসা তার কারণ এই মুহুর্তে তাদের স্বাক্ষী রেখে খুব বড় সিদ্ধান্ত নিবে তা হলো যেমন তাদের কথায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল ঠিক একই ভাবে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি নিতে এসেছে।তারা এতে সম্মতি প্রদান করলে ভালো,যদি তা না হয় তবে আর সে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটবে না সে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।
~ মামা এবং মামী মা তোমাদের আজ আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানাতে এসেছি। আমার বিশ্বাস তোমরা দুজনেই আমার কথাগুলো বিবেচনা করে দেখবে এবং আমার নেওয়া সিদ্ধান্তে সম্মতি প্রদান করবে।যদিও তা না কর, তবে আমি ঠিক তাই করব যা আমি ঠিক করেছি।( আকাশ)
আকাশের কথায় দিবাকর বাবু কিছু বললেন না মুখভার করে বসে রইলেন।শ্রীলেখা দেবীই বলে উঠেন
~ কী এমন কথা বলবে আকাশ এবং কী সিদ্ধান্তই নিয়েছ যা আমরা নাও মেনে নিতে পারি?তা কী মেঘলা সংক্রান্ত বা তোমাদের সম্পর্ক বিষয়ক?তবে আমি বলব আমরা এ বিষয়ে আর কিছু শুনতে ইচ্ছুক নই। এ ব্যাপার ছাড়া অন্যকোনো কথা থাকলে বলতে পারো।আমার মাথায় এটাই ঢুকে না মেঘলার মতো এত মিষ্টি, সুশ্রী মেয়েকে দুমাসের উপরে হয়ে গেলো তাও কী করে তুমি মেনে নিতে পারছ না?( শ্রীলেখা দেবী)
শ্রীলেখা দেবীর কথায় তাকে দিবাকর বাবু থামিয়ে দিলেন
~ আহ্ শ্রী,থাম তুমি ওকে বলত দাও ও কী বলতে চায়।অবশ্যই তার বাকস্বাধীনতা আছে যা আমরা মোটেও হরণ করতে পারি না।বল আকাশ তুমি কী বলতে চাও আমরা শুনছি। ( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় শ্রীলেখা দেবীর মুখ চুপসে গেলো সে মুখ কালো করে বসে রইল।আকাশ একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল
~ মামা-মামী, তোমাদের আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি এবং এই জীবনে যা বলেছ প্রতিটি পদে তোমাদের কথা অনুযায়ী তাই করে গিয়েছি ইভেন আমি আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাদের কথামতো মেঘলাকে বিয়েও করেছি শুধুমাত্র তোমাদের সন্তুষ্টির জন্য নিজের ভালোবাসা, সুখ বিসর্জন দিয়েছি।ভেবেছিলাম কখনো ভালোবাসতে না পারলেও কাগজে কলমে স্ত্রীর অধিকার দিয়ে যাব মেঘলাকে।তবে বিশ্বাস কর আমি নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। আর পারছি না এই মানসিক যুদ্ধ থেকে অবসান চাই।আমি চাইলেও পারি না রোশানির থেকে মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে আর রোশানি আর আমার বিচ্ছেদের পেছনে আমার আবেগ সবসময় মেঘলাকে দায়ী করে অপরদিকে বিবেক তোমাদের দায়ী কর।বল বিবেকের কথা বিবেচনা করে তো আর আমি তোমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারব না তাই না হয় আবেগকেই দেই এবারের সুযোগ? আর পারব না প্রতিদিন মেঘলাকে দোষী ভেবে শাস্তি দিতে তাই আমি তাকে মুক্তি স্বরূপ ডিভোর্স দিতে চাই।( আকাশ)
আকাশের কথায় শ্রীলেখা দেবী চরম অবাক হলেন,তিনি বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন
~ তুমি এসব কী বলছ আকাশ?তোমার মাথা ঠিক আছে তো?বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়।হুম আমরা তোমায় জোর করেছিলাম তবে তুমি মৌনসম্মতি দিয়েছিল তো এখন বিয়ের দুমাস যেতে না যেতেই ডিভোর্স!! ( শ্রীলেখা দেবী)
শ্রীলেখা দেবীর কথায় আকাশের মেজাজ চড়ে গেলো সে জোর গলায় বলল
~ এইতো মামী আবারো তুমি আমার গৃহীত সিদ্ধান্তে বাধা দিচ্ছ,আমার উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছ।ঠিক এই কারণেই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম ঐ ক্লাস লেস মেয়েটার সাথে আর এখন এতটা সাফার করছি।দিনদিন মানসিক অশান্তি কুড়ে খাচ্ছে আমায়।শুধুমাত্র তোমাদের এসব বাজে সিদ্ধান্ত যে দুটো নয় তিনটে জীবন নষ্ট করে দিয়েছে এবং তার ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চালাচ্ছে তা কী বুঝতে পারছ না তোমরা?( আকাশ)
আকাশ একটানা কথাগুলো বলে রাগে ফুঁসতে লাগল।শ্রীলেখা দেবী থ হয়ে গেলো আকাশের কথা শুনে সে যে এতটা ডেস্পারেট তা জানা ছিল না তার।চারদিকে পিনপতন নীরবতা ভেঙে দিবাকর বাবু গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল
~ ঠিক আছে আকাশ আমরা সকলে তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি তুমি মেঘলার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারো।তবে তোমার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তিগুলো দেখালো আর আমাদের সিদ্ধান্ত গুলো বাজে আখ্যা দিলে তাহলে তো তোমাকে অবশ্যই জানতে হবে আমাদের সিদ্ধান্তের মূল কারণ তা অবশ্য শুধু তুমি না শ্রীও জানে না।আমি আজ জানাবো তোমাকে মেঘলার সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়ার কারণ।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় উপস্থিত দুজনেই অবাক হলো।আকাশ দিবাকর বাবুর যুক্তির অপেক্ষায় রইল আর শ্রীলেখা দেবী ভাবতে লাগলেন দিবাকর বাবু কী বলতে যাচ্ছেন যা তার জানা নয়?
চলবে….
#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১৪তম_পর্ব
লেখনীতে ; নাহার সাইবা
~ দিবা,আমার মনে হয় না তোমার সাথে আর পথ চলা হবে।
রজনী নিজের চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল।দিবাকর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
~ এসব কী বলছ রাত?কী হয়েছে তোমার?হঠাৎ করে আমায় ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছ কেন?বাড়িতে কোনো গন্ডগোল হয়েছে?( দিবাকর)
দিবাকরের কথায় রজনী ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। হঠাৎ করে রজনীকে কাঁদতে দেখে দিবাকর স্বাভাবিকভাবেই ভরকে গেলো। রজনীর কোমল গালে হাত ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করল
~ কী হয়েছে রাত? বল আমায়,তুমি না বললে বুঝব কী করে?কেউ তোমায় বকেছে?কোনো সমস্যা? ( দিবাকর)
দিবাকরের কথায় রজনী ফুপাতে ফুপাতে বলল
~ দিবা,বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে বাবার অফিসের বসের ছেলের সঙ্গে। আর খুব শীঘ্রই ও বাড়ি থেকে আমাকে আশীর্বাদের অনুষ্ঠান করতে আসবে।আমি বুঝতে পারছি না এখন কী করব?( রজনী)
রজনীর কথায় দিবাকর আগের চেয়েও দ্বিগুণ অবাক হলো সে তার বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল।।সে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল নয়নে রজনীর দিকে।রজনী তখনো সমানে কাঁদছে।দিবাকর নিজেকে সামান্য সামলে নিল তারপর রজনীর দুবাহুতে হাত রাখল আশ্বাসের। কিছুক্ষণ নীরবেই দাড়িয়ে রইল অতঃপর শান্ত স্বরে বলল
~ কান্না থামাও রাত,তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় জেনেও কেন তুমি তোমার মূল্যবান অশ্রু বিসর্জন দেও বল তো?( দিবাকর)
দিবাকরের কথায় রজনী উত্তর না দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল।দিবাকর এবার হিমশীতল কন্ঠে বলল
~ রাত!!!
দিবাকরের এমন নিশীথ শীতল স্নেহ মাখা ডাক উপেক্ষা করতে পারল না রজনী,চোখ তুলে তাকালো।সেই গভীর দৃষ্টিতে আবদ্ধ তার প্রেমিক পুরুষের চোখ দুটি।ধীরে ধীরে রজনীর কান্নার বেগ কমে এলো।দিবাকর রজনীকে শান্ত হতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তারপর বলল
~ তুমি কী থাকতে পারবে আমায় ছাড়া রাত?( দিবাকর)
দিবাকরের প্রশ্নে রজনী তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠ
~ না,কখনোই পারব না।( রজনী)
রজনীর উত্তরে মলিন হাসল দিবাকর অতঃপর তার এলোমেলো চুলের রাশি গুলো দু’কানের পাশে গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করল
~ আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারব দুটো বছর?আমার মার্স্টার্স শেষ হওয়ার পর চাকরি পাওয়া অবধি?( দিবাকর)
দিবাকরের এই প্রশ্নে থেমে গেলো রজনী, তার উত্তর জানা থাকলেও দেওয়া হলো না। রজনীকে চুপ থাকতে দেখে মৃদু হাসল দিবাকর তার থেকে দূরে সরে এসে বলল
~ পারবে না তো আমার জন্য অপেক্ষা করতে?আমিও বলব না আমার জন্য অপেক্ষা করে নিজের জীবন ধ্বংস কর।( দিবাকর)
দিবাকরের কথায় প্রচন্ড অবাক হলো রজনী, সে বিস্ময়ের সাথে বলে উঠে
~ তার মানে তুমি বলছ আমি বিয়েটা করে ফেলব?তোমার খারাপ লাগবে না যদি আমি অন্যকারো হয়ে যাই?( রজনী)
রজনীর কথায় স্মিত হাসল দিবাকর, হাসির মাঝে দুঃখটাই যেন প্রাধন্য পাচ্ছিল।
~ আমি কী একবারের জন্য ও বলেছি আমি কষ্ট পাব না?বরং তুমি আমার না হলে,হয়ত অন্য কেউ আমার হবে না আবার হতেও পারে এটাই বাস্তবতা। আমাদের গ্রামের বহু মেয়েকেই দেখেছ মাধ্যমিক শেষের আগেই দুই তিন বাচ্চার মা হয়ে যায়।তবে তোমাকে তোমার বাবা মা সুযোগ দিয়েছে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখার তোমার একটা পরিচয় তৈরি করার।আমার মনে হয় তাদের সন্তুষ্টির জন্য হলেও বিয়েটা করা উচিত।যারা তোমার জন্য এত কিছু করল তাদেরকে কষ্ট দিও না।মনে রেখো বাবা মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কখনো সুখী হওয়া যায় না।তাছাড়া আমার এখনো পড়ালেখা শেষ হয়নি,চাকরি খুঁজব, চাকরি পাব ভালো একটা স্যালরির জন্য আমায় কমপক্ষে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে তবুও সবটা অনিশ্চয়তার বেড়াজালে বন্দী। তাই আমি চাই আমার জন্য নিজের সোনালি ভবিষ্যতকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না কাছে টেনে নেও।মনে রেখো তোমার ভালো থাকাই,আমার ভালো থাকা।( দিবাকর)
দিবাকরের কথায় রজনী আর নিজেকে সামলাতে পারল না,হুহু করে কেঁদে দিল।ক্রমেই তার কান্নার গতি বাড়তে লাগল। দিবাকর কেবল তাকিয়ে রইল তার রাত নামক স্নিগ্ধতার দিকে।একসময় দিবাকরকে জড়িয়ে ধরল রজনী কাঁদতে কাঁদতে বলল
~তুমি আমায় এত ভালোবাস কেন দিবা?একটু কম ভালোবাসলেও পারতে তাহলে হয়ত কষ্টটা কম পেতে।( রজনী)
~ উঁহু তোমায় কম ভালোবাসলে আমার সারাজীবন আমি কেবল আফসোস করতাম রাত,ভালোই হয়েছে তোমায় আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালোবেসেছিলাম।( দিবাকর)
দিবাকরের কথায় রজনীর কিছু বলার থাকল।সে দিবাকরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী মনে হতেই একছুটে সেখান থেকে চলে গেলো।দিবাকর তাকিয়ে রইল রজনী নামক চঞ্চলা মেয়েটার যাওয়ার দিকে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল নয়ন বেয়ে।
এরপর কেটে গিয়েছে দু’মাস এইতো গত পৌষের ১৫ তারিখেই বিয়ে হয়ে গেলো তার রাতের এক ধনী ব্যবসায়ীর সাথে নামটা কী যেন?ওহ্ তথাগত মজুমদার। পালকি করে ঘরের বউকে নিয়ে গিয়েছিল তারা, দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছিল সে। সবার মাঝেই ছিল আনন্দ উদ্দীপনা তবে যাকে ঘিরে উৎসব সেই যেন ছিল মৃতপ্রায়। সাথে সাথে সেই মণ্ডপে অন্যের দান কৃত সিঁদুর যখন রজনীর সিঁথি ছোঁয়ালো হারিয়ে ফেলেছিল দিবাকর অধিকার। সমাপ্তি ঘটেছিল এক অসমাপ্ত প্রেমের।তবুও দিনে-রাতে রজনীর বলা কথাগুলো কানে ভেসে বেড়ায়
~ তুমি আমার দিবা,দিনের বেলার মেজাজি দিন মণির মতো আর আমি তোমার রজনী,স্নিগ্ধতায় ঘেরা রাত।দিন-রাতের বিশাল পার্থক্য তাদের কখনো একসাথে পাওয়া যায় না।ঠিক তেমনই তোমার আমার মাঝেও বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তবুও ভালোবাসি একে অপরকে। তবে ভয় হয়!! দিন রাত যেমন কখনো এক হয়নি তবে আমরাও কী এক হব না দিবা!!
রজনীর সেই প্রশ্নে ছিল এক সাগর ভয়,উদ্বেগ! প্রশ্নটা হুটহাট করে বসত রজনী, একসময় একই প্রশ্ন বারবার শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল দিবাকর।তাই যখনই এমন প্রসঙ্গ উঠত রজনীকে থামিয়ে দিত আর আশ্বাস দিয়ে বলত ” এমনটা কখনোই হবে না।” তবে কে জানত দিবাকরের আশ্বাসকে মিথ্যে করে রজনীর ভয়ের জয় হবে?
এরপর কেটে গেলো প্রায় বছরখানেক হঠাৎ একদিন দিবাকরের ফোনে ল্যান্ডলাইন থেকে এলো।কলটা রিসিভ করতেই স্তম্ভিত আরে এ-তো তার রাতের ভেজা কন্ঠ!! তাকে কিছু বলত না দিয়ে নিজে একাধারে বলে গেলো অতঃপর কলটা ডিসকানেকটেড হয়ে গেলো। কথাগুলো ছিল
~ আমার দিবা,দিনমণি তোমায় ছাড়া আমি ভালো নেই প্রিয়।এক অসুখী জীবন কাটাচ্ছি প্রতি মুহুর্ত যেন দম আঁটকে আসছে আমার।প্রতিনিয়ত শারীরিক মানসিক আঘাতে আমি জর্জরিত।হয়ত এই মনের সাথে সাথে দেহের খুনটাও রচিত হবে শীঘ্রই। তবে তোমায় আমি কোনোকিছু বিস্তারিত জানাতে পারব না।শুধু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে গেলাম আমার গর্ভের মেয়েকে জানি তার বাবা মেনে নিবে না তবে তোমায় তার দায়িত্ব নিতে হবে না কিন্তু তার ভবিষ্যতের কল্যাণে এমন একজন জীবন সাথির হাতে তুলে দিও যে তার বাবা মতো তাকে কষ্ট দিবে না বরং তোমার মতো ভালোবাসবে।এটা আমার একান্ত অনুরোধ, আশা করি রাখবে।আর হ্যা শুনেছি বিয়ে করনি এবং করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ এসব ছেড়ে একটা সুন্দর মেয়ে দেখে বিয়ে কর আর তাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবেস।( রজনী)
রজনীর কথা রেখেছিল দিবাকর তার মৃত্যুর মাসখানেক পরই বিয়ে করে এবং শ্রীলেখাকে ভালোবাসতে সক্ষম ও হয়েছিল তবে রজনীকে ভূলে গিয়ে নয়।যদিও মেঘলা অর্থাৎ রজনীর শেষ স্মৃতি তার মাসির কাছে বড় হচ্ছিল তবে তার অর্থয়ানে বড় অবদান রেখেছিল দিবাকর। তাই তো এতদিন মেঘলা সে বাড়িতে শান্তিতে ছিল, না হলে কবেই দূরদূর করে তাড়িয়ে দিত।
এতক্ষণের অতীত স্মৃতিচারণ থেকে বেড়িয়ে এলেন দিবাকর বাবু আবারো যেন স্মৃতির প্রতিটি পায় প্রথম প্রেমের অনুভূতিগুলো জেগে উঠল।ধরা গলায় বললেন
~ তুই( আকাশ) তো আমার আর মায়ের কাছেই ছোট থেকে মানুষ হয়েছিলি ভেবেছিলাম তুই যেমন অনাথ, তেমন অন্য একটি অনাথ মেয়ের দুঃখ কষ্টগুলো বুঝে আপন করে নিবি তাকে একটা সুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাবি তবে আমি ভূল ছিলাম।আমি নিজের প্রথম প্রেমকে বুকের একপাশে ঠাঁই দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে জীবন চালিয়ে গিয়েছি এবং শ্রী কখনো অস্বীকার করতে পারবে না তাকে আমি অধিকার বঞ্চিত করেছি বরং কখনো বুঝতেই দেয়নি সে আমার দ্বিতীয় প্রেম।কিন্তু তুই আমার ভাগ্নে হয়েও আমার মতো হলি না।এক গুয়ে জেদ ধরে নিজের অতীতেই পড়ে রইলি আর মেয়েটাকে দিয়ে গেলি অগণিত কষ্ট। আমি ব্যর্থ রাত,আমি ব্যর্থ তোমার কথা রাখতে পারলে আমার মতো পাপীকে ক্ষমা করো।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবু আর বসে থাকতে পারলেন চশমার গ্লাস পাঞ্জাবির কাপড়ে মুছতে মুছতে উঠে গেলেন।শ্রীলেখা দেবী সেখানে বসেই কাঁদতে লাগলেন তবে কাঁদার সুনির্দিষ্ট কারণ উপলব্ধি করতে পারলেন না।স্বামীর প্রথম ভালোবাসা উন্মোচিত হওয়ায় তিনি কাঁদছেন?নাকি মেঘলা নামক মেয়েটার কষ্টে ঘেরা জীবনের কথা কল্পনা করে?
আর আকাশ?সে যেন নিজের মাঝেই নেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মামীর দিকে কিছু বলার মতো ভাষা পেলো না।
চলবে…