গল্পঃ #ভালোবাসি প্রিয় তোমাকে
পর্বঃ ০৯
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)
শোয়া থেকে উঠে বসার ঘরে গিয়ে যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
নিষান ভাইয়াদের গাড়ি নাকি যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট করেছে। কথাটা শোনা মাত্র আমার
বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল। বাড়ির বড়রা
সকলে সিদ্ধান্ত নিল নিষান ভাইয়াদের ওখানে যাবে।
তারা সাথে সাথেই রওনা হয়ে গেল। আমারও যেতে
খুব ইচ্ছা করছিল কিন্তু তারা আমাকে নেয় নি।
ঘরটা কিছুক্ষনের মধ্যে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রিমি, তিন্নি ওরা সবাই ঘুমাচ্ছে। বাড়ির কেউ জেগে
নেই আমি ছাড়া। আমার কেনো জানি
গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খবরটা শোনার পর থেকে ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছিল। কয়েক ঘন্টা আগেও কত সুন্দর হাসি-আড্ডা দিলাম। অথচ পাঁচঘন্টার ব্যবধানে কি ঘটতে চলছে? না, আর ভাবতে পারছি না। মহান আল্লাহর কাছে এখন একটাই প্রার্থনা গাড়িতে থাকা
সকলে যেন ভালো থাকে।। তাদের যেন কোন বড় ক্ষতি না হয়।
নিরাদের বাড়ির সকলে হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছালো। সেখানে নিষানের বাবা-মা, ভাই,লিজা
আগেই ছিল। গাড়ীতে নিষানেরা ছয় বন্ধু ছিল।
তাদের মধ্যে নিষান আর ওর বন্ধু সাগর গুরুতর আহত হয়েছে। ওরা দুজন সামনের সিটে ছিল, আর সাগর ড্রাইভিং করছিল। এজন্য ওরা গুরুতর আহত হয়েছে। বাকি বন্ধুরা ব্যথা পেলেও কোথাও মারাত্মক
জখম হয় নি। নিষানের মাথার একসাইডে কিছুটা কেটে গেছে, বাম হাতেও প্রচন্ড চোট পেয়েছে আর সাগর জ্ঞান হারিয়েছিল কিছুক্ষন আগে সাগরেরও জ্ঞান ফিরেছে।
নিরাকে লিজা ফোন করে জানিয়ে দিল নিষানসহ ওর বন্ধুরা সুস্থ আছে। তেমন কোনো ক্ষতি হয় নি।
লিজার কথা শুনে নিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর মনে মনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে নিল।
.
সারাদিনের ঝামেলা কাটিয়ে রাত আটটার দিকে নিষান বরবেশে নিরাদের বাড়িতে আসল। যে বিয়ে দুপুরে হওয়ার কথা ছিল সেটা হচ্ছে রাতে।
নিষান আসার সাথে সাথেই বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে যায়।৷ তিন কবুলের মাধ্যমে
ওরা দুজন পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ে শেষ হলে
দুজনকে পাশাপাশি বসানো হয়। নিরাকে দেখে
নিষান লিজাকে বলে উঠে,
‘কি ভাবী? বউ-টউ বদলে দেন নাই তো আবার। যা আটা-ময়দা মাখছে চিনার তো কোনো উপায় নাই।’
নিষানের কথা শুনে নিরা ওর হাতে জোরে একটা চিমটি দিয়ে বলে,
‘চিমটি খেয়ে কি মনে হয়? বউ বদল হয়েছে?’
‘উহ্ঃ! চিমটি দিয়েছো নাকি মাংস তুলে ফেলতে চাইছো?’
নিরা কিছু বলার আগেই তিন্নি হাত বের করে হেসে বলল,
‘ভাইয়া, ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেও মেকাপকে যে মেকাপ বলতে হয় সেটাও জানে না, মেকাপকে আটা-ময়দা বলছে। হিহিহি।’
নিষান তিন্নি কথা কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। কিছু বলল না। এরপর লিজা একটা আয়না এনে নিষানের সামনে ধরে বলল,
‘ আয়নায় কি দেখতো পাচ্ছো নিষান?’
নিষান মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বলে উঠল, ‘আকাশ থেকে নেমে আসা একটা পরী।’
নিষানের কথা শুনে রুমের সবাই হালকা চিৎকার দিয়ে শিষ বাজিয়ে উঠে। এবারে নিরাকে জিজ্ঞেস করা হলে নিরা উত্তর দেয়,
‘আমিও দেখতে পাচ্ছি আকাশ থেকে নেমে আসা হ্যান্ডসাম একটা জ্বীন। হিহিহি।’
নিরার কথা শুনে রুমে সবাই হাহাহা করে হেসে দেয়।
.
.
এবার নিরাকে বিদায় দেওয়ার পালা। অন্যদের বিয়েতে বউদের কান্না দেখলে নিরার ভীষণ হাসি পেতো। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। মা-বাবাকে
ছেড়ে যেতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্টদায়ক অনুভূতি এই পরিস্থিতিতে আসার আগে সে
কখনো অনুভব করে নি। যদিও বিয়ের আগে নিষানের পরিবারের সাথে কথা হয়েছে ইন্টার পরীক্ষার পর্যন্ত নিরা ওদের বাড়িতেই থাকবে। তবুও নিরার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিরার বাবা নিষানের তুলে দিল। নিরা ওর বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন কাঁদল। একটু পরে নিরা দেখে মিরা চিল্লিয়ে কাঁদছে আর বলছে, ‘ও আল্লাহ গো,, নিরাপু যাইতাছে গা গো!’..
মিরার কান্না দেখে নিরা কান্নার মাঝেই ফিক করে হেসে দিল। নিষান মিরাকে বলল,
‘এভাবে কাঁদছো কেন? তুমিও আমাদের সাথে চলো।’
মিরা কান্না থামিয়ে বলল,
‘না গো নিষানা ভাইয়া, আমি আম্মুকে ছাড়া থাকতে পারি না। আর এখন কাঁদছি যাতে নিরাপুও
আমার বিয়ের সময় কাঁদে।’
‘ওরে বাব্বা! এই বয়সেই কি চিন্তা! ‘(নিষান)
মিরার কথা শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সাথে নিরাও হেসে ফেলল।
.
নতুন বউ নিয়ে নিষান রাত বারোটায় বাড়িতে পৌছাঁল। চোখে হাজারো রঙিন স্বপ্ন নিয়ে নিরা
শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল। ওকে বরণ করে ঘরে নেওয়া হলো।
.
রাত একটায় কাজিনদের সাথে অনেক যুদ্ধ করে
নিষান বাসর ঘরে ঢুকলো। কাজিনদের কথা তিন হাজার টাকা না দিলে বাসর ঘরে ঢুকতে দিব না,
অন্যদিকে নিষানের কথা আমার বউ,আমার ঘর
তোদের কেন টাকা দিব? এ নিয়ে একঘন্টা তর্ক-বিতর্কের পরে নিষানের মা নিষানের কাজিনদের দুই হাজার টাকা দেওয়ার পরে নিষানকে যেতে দেয়। বাসর ঘরে ঢুকতেই নিরা ওর পায়ে সালাম করতে যায় তখনি নিষান পা সরিয়ে ওকে
হাত ধরে উঠায়।
‘আরে, আরে কি করছো? সালাম করছো কেনো?’
‘আপনার বাবার আম্মু মানে দাদী বলেছে বাসর ঘরে
স্বামীর পায়ে ধরে সালাম করতে হয়। এটাই নাকি নিয়ম।’
‘ওরে বাব্বাহ! তাই নাকি?’
‘হুম।’
নিষান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘এখন বিয়ে করেছি, আমার কত দায়িত্ব। বউয়ের সব দায়িত্ব তো আমার। নিজেকে ভালো রাখার পাশাপাশি তোমারও তো ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছি। কে জানে কতটুকু খুশি রাখতে পারব? তবে
আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমাকে খুশি রাখার।’
‘হঠাৎ এই কথা বলছেন?’
‘ এমনিই কথাগুলো বলছি। তোমার বাবা-মা আমাকে কত ভরসা করে তোমাকে আমার হাতে
তুলে দিয়েছেন তার একটা দায়িত্ব আছে না। আমাকে তো শীঘ্রই একটা জবও পেতে হবে।’
‘আচ্ছা, এখন এই কথা বাদ দিন।’
‘আচ্ছা। সারাদিন অনেক ধকল গেছে, কাল সারারাত ঘুমাতে পারি নি,আজকে সারাদিনও ঘুমাই নি। এখন না ঘুমাতে পারলে পাগল হয়ে যাব। তুমি আমার চুল নেড়ে দিবে একটু।’
‘ঠিক আছে।’
নিরা নিষানের চুলে বিলি কাটতে কাটতে একসময় সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
.
পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে নিরার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভেঙে নিরার বুঝতে কিছুসময় লাগলো সে আসলে কোথায় আছে। পাশে তাকিয়ে দেখে
নিষান নেই। কোথায় গেল নিষান?
মামাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি হিসেবে নিরা এবাড়িতে একবার এসেছিল তাও বৌভাতের দাওয়াত খেতে।
এ বাড়ির তেমন কিছুই চিনে না নিরা। হাতমুখ ধুয়ে
নিরা রুমের বাইরে গেল। সবাই হয়ত ঘুমাচ্ছে। কালকে সবারই মোটামুটি ধকল গেছে। কিন্তু নিষান ভাইয়া কোথায়? নিষানের রুমের সাথের রুমটা খোলা আবার আলোও জ্বলছে তাই নিরা সেখানে যাওয়ার জন্য পা পাড়ালো।
সেই রুমে গিয়ে তো নিরা পুরো টাস্কি খেল। রুমটাতে তিনটা বড় বড় বইয়ের সেলফ। সবগুলো বই দিয়ে ঠাসা । খুব সম্ভবত নিষানদের পারিবারিক লাইব্রেরি।
সেখানে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার। সেই চেয়ার-টেবিলে বসে বসে নিষান পড়াশোনা করছে।
নিরা আলতো পায়ে হেঁটে নিষানের কাছে
গেল।
‘এতো সকালে আপনি পড়তে বসেছেন?’
নিষান নিরাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
‘হুম, ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে পড়তে বসেছি। বিয়ে করেছি, এখন চাকরি পেতে হবে না। তা তুমি এত সকাল সকাল উঠে গেলে? আরেকটু ঘুমাতে, তোমার ডিস্টার্ব হবে বলে এখানে পড়তে
এসেছি।’
‘তাই বলে এত সকালে উঠে পড়তে বসবেন? আপনি
গতকাল এক্সিডেন্ট করেছেন, এখন আপনার উচিত দুই-তিনদিন রেস্ট করা।’
‘ নাহ,আমি ঠিকঠাক আছি। মা বলেছে, দুই মাসের মধ্যে চাকরি পেতে হবে। শুনেছি বউ পালা আর হাতি পালা সমান। সো শীঘ্রই চাকরি পেতে হবে রাগী ম্যাডাম।’
নিরা নাক ফুলিয়ে কোমড়ে দিয়ে বলল,
কিহ! আমি হাতি??’
‘আরে নাহ! হাতি বলব কেন? লোকমুখে এই কথাটা খুব প্রচলিত যে, বউ পালা আর হাতি পালা এক সমান। এই কথাটা ব্যঙ্গ করে বলে না। বলে
এইজন্য যে হাতি পালতে অনেক টাকার দরকার , আর বউয়ের শখপূরন করতেও টাকার প্রয়োজন।
আর হাজবেন্ড যদি শখপূরণ না করে তাহলে
কে করবে? ‘
‘হইছে হইছে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না।
আপনি পড়ুন, আমি যাই দেখি লিজা আপু উঠেছে কিনা?’
‘ঠিক আছে। বাই নিরা। ব্রেকফাস্ট করতে গেলে
দেখা হবে নিরু।’
বলে নিষান নিরার দিকে ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মা’রল।
‘ইশ! ঢং।’ বলে নিরা চলে গেল।
#চলবে..