ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
1389

#ভালোবাসি_প্রিয়( ২২ অন্তিম পর্ব)

#অপরাজিতা_রহমান (লেখনীতে)

তড়িঘড়ি করে ফোন তুলে হ্যালো বলতেই ঐপাশ থেকে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল।ঐপাশ থেকে বলল,ফোনের মালিক আপনার কি হয় ম্যাম?

আমার কণ্ঠস্বর কাঁপছে।কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম আ আ আমার স্বামী।

ম্যাম উনি খুব বাজে ভাবে এ*ক্সি*ডে*ন্ট করেছেন।প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। আমারা উনাকে সিটি হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি যত দ্রুত পারেন হসপিটালে চলে আসেন।পাশ থেকে অন্য জন বলল,আরে এই লোকটা তো সদ্য বিসিএস ক্যাডার হয়েছে।এনার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ফেইসবুকে ও ভাইরাল হয়েছিল এই লোকটা। আহারে ছেলেটার ক্যারিয়ার গড়ার আগেই বোধহয় শেষ হয়ে গেল।

আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, আপনারা প্লিজ একটু চুপ করুন। আমার রাজের কিছু হবে না। আমি কিছু হতে দিব না। হঠাৎ মনে হল আমার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। চোখে ঝাপসা দেখতে পেলাম।কোনমত আম্মাকে ডাক দিয়েই মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখি আম্মা হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে আম্মা বললেন,কি হয়েছে কুয়াশা? তুমি এইভাবে চিৎকার দিলে কেন?

আম্মা রাজ ভালো নেই।

রাজের কি হয়েছে মা?আজ সকাল থেকেই আমার মনটা কেমন যেন কু গাইছে। আল্লাহ আমার ক*লি*জা*র টুকরো টা কে তুমি যেইখানেই রেখ ভালো রেখ সুস্থ্য রেখ।

আম্মা রাজের এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে। ঐ‌ খানের লোকজন রাজকে সিটি হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে, আমাদের যেতে হবে মা।

তোমার অসুস্থ শরীর নিয়ে যেতে হবে না মা। তুমি দেখ আমার রাজের কিছু হবে না।

আমি আম্মার কথা না শুনে সিটি হসপিটালের উদ্দেশ্য র‌ওনা দিলাম। নিজেকে কেমন পা*গ*ল পা*গ*ল লাগছে। খোলা চুল , চোখের কাজল লেপ্টে গেছে , শাড়ি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আমার সে দিকে কোন খেয়াল নেই। আমি হসপিটালে গিয়ে শুনতে পেলাম লোকে বলাবলি করছে, ছেলেটা মনে হয় বাঁ*চ*বে না। ট্রাকে একদম পিসে দিয়ে চলে গেছে। ডাক্তাররা ও হাল ছেড়ে দিয়েছে।কতোমত নিঃশ্বাস চলছে।যে কোন সময় সব কিছু স্থির হয়ে যাবে। কতটুকুই বা বয়স হয়েছিল এর‌ই মধ্যে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। আল্লাহ যেন এমন অকাল মৃ*ত্যু কাউকে না দেই।

আমি গিয়ে ওনাদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা যার কথা বলছেন তাকে কোথায় শিফট করা হয়েছে বলবেন প্লিজ। ওনারা আমাকে রাজের কেবিন দেখিয়ে দিল। আমি কেবিনে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমার পা শিকলে বাঁধা পড়েছে। আমার বুক ভারি হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে ভেতর থেকে আমার ক*লি*জা বেড়িয়ে আসতে চাইছে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম রাজের নিথর দেহ টা বেডে পড়ে রয়েছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। ফর্সা মুখশ্রী তে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সাদা বিছানা র*ক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম রাজের কোন রেসপন্স নেই। আমি মৃদু স্বরে ডাক দিলাম ,রাজ।

আমার ডাক শুনে রাজ চোখ খুলে তাকিয়ে অক্সিজেন মাস্ক খুলে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,ব‌উ! আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারলাম না। তোমার হাত ধরে আমার বুড়ো হ‌ওয়া হলো না। তুমি না বলেছিলে ইদানিং আমি ব্যস্ত থাকি তোমাকে সময় দেই না। আমি চেয়েছিলাম তোমার হাত ধরে ওমরাহ হজ্ব করতে যাবো।তার‌ই জন্য একটু ব্যস্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম আজ তোমায় সারপ্রাইজ দিব। আজকের মূহুর্ত টা আমাদের জীবনের স্বরণীয় একটা মুহূর্ত হয়ে থাকবে। কিন্তু ভাগ্য আমাদের এক হতে দিল না ব‌উ। আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল না । আমি তোমার জন্য জান্নাতে অপেক্ষা করব‌। জান্নাতে আবার আমাদের দেখা হবে ব‌উ।

তোমার কিচ্ছু হবে না রাজ। এখন ও আমাদের একসাথে অনেক পথ চলা বাকি। আমাদের আব্বু আম্মু ডাক শোনা বাকি।

আমার একটা শেষ অনুরোধ রাখবে ব‌উ? আমাকে একটি বার বলবে #ভালোবাসি_প্রিয় ।

আমি সমস্ত লাজ লজ্জা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে রাজের মুখে অজস্র চুমু দিয়ে বললাম ভালোবাসি প্রিয়। অনেক বেশি ভালোবাসি। আমি তো চেয়েছিলাম আজ আমার অপ্রকাশিত ভালোবাসার প্রকাশ করতে। তোমাকে একবার নয় হাজার বার বলতে #ভালোবাসি_প্রিয় । আমার মুখে ভালোবাসি প্রিয় কথা টা শুনে রাজের চোখ মুখের প্রতিক্রিয়া পাল্টে গেল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো।ভেতর থেকে গোঙ্গানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। মূহুর্তের মধ্যেই রাজের দুই চোখের পাতা এক হয়ে গেল। চোখের সামনে কি হয়ে গেল কিছুই বোধগম্য হলো না আমার।

রাজ প্লিজ চোখ খোল না।দেখ না আমি আজ তোমার বাসর রাতের দেওয়া সেই শাড়ি টা পড়েছি, তোমার জন্য সেজেছি। তুমি না সবসময় বলতে তোমার বড় চুল পছন্দ। আমাকে তুমি বড় চুলে দেখতে চাও। আমার চুলে তেল দিয়ে বেনী করে দিতে চাইতে।রাজ দেখ আমার চুল এখন কোমর ছুঁয়ে গিয়েছে। আমি তোমার থেকে এতো দিন লুকিয়ে রেখেছিলাম আজ তোমায় সারপ্রাইজ দিব বলে।

ম্যাম উনি এখন আমাদের মাঝে নেই।এই মিছে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছে। আসলে উনার অত্যন্ত বাজে ভাবে এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে। আমরা তো ভেবেছিলাম হয়তো ঘটনাস্থলেই মা*রা যাবে । এখন মনে হচ্ছে আপনার মুখে ভালোবাসি প্রিয় কথা টা শোনার জন্যই এতোক্ষণ সে অপেক্ষায় ছিল। এখন আর হাজারবার ডাকলে ও তিনি আপনার ডাকে সাড়া দিবেন না।

আপনারা মিথ্যা বলছেন। আমার রাজ ম*র*তে পারে না।ও আমাকে কথা দিয়েছিল আমার হাত ধরে ও বুড়ো হবে।বুড়ো বয়সে ও লাঠি তে ভর করে কাঁপা কাঁপা স্বরে আমাকে ভালোবাসি প্রিয় বলবে।রাজ কখনো মিথ্যা কথা বলে না।ও কথা দিয়ে কথা রাখে । আসলে কি জানেন রাজের অভিমান হয়েছে আমার উপর।বিয়ের এতো গুলো দিন হয়ে গিয়েছে অথচ ওকে ভালবাসি প্রিয় কথাটাই বলতে পারি নি।তাই তো অভিমানে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আপনারা দেখবেন রাজ এক্ষুনি চোখ খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে ভালবাসি প্রিয়।এই রাজ চোখ খোল না। আমার কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি চোখ খুলে প্লিজ একবার বল না ভালোবাসি প্রিয়।

রাজ আর কখনোই চোখ খুলবে না মা। পিছন থেকে শ্বাশুড়ি আম্মা কথা টা বলে উঠলেন। আম্মা কে দেখেই আম্মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আম্মা আপনার ছেলেকে প্লিজ উঠতে বলুন না।ও তো জানে ওর বুকে ছাড়া আমি ঘুমতে পারি না। তারপর ও কিভাবে আপনার ছেলে স্বার্থপরের মত নিজে শান্তি তে‌ ঘুমিয়ে রয়েছে। আপনার ছেলের জন্য আমি আমার ক্যারিয়ার ছেড়েছি ওর মতো অশিক্ষিত লোক কে ভালোবেসেছি। এখন ও কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেল?আর যাবেই যখন কেন ও আমার জীবনে আসল? আমার এলোমেলো জীবন টা কে গুছিয়ে দিয়ে আমাকে একা রেখে নিজে কেন চলে ‌গেল? কেন আম্মা কেন ?






এইটুকু বলেই চোখের পানি মুছতে লাগল জামিয়া। জামিয়ার সাত বছরের মেয়ে জিজ্ঞেস করল, তারপর কি হলো আম্মু? কুয়াশা খালাআম্মু কি রাজ আঙ্কেল কে ভুলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পেরেছিল?

না রে মা। কুয়াশা রাজ কে সত্যি অনেক বেশি ভালোবেসেছিল। অবশ্য আমি ও ভালোবেসেছিলাম তবে রাজ কে নয় শিক্ষিত, সুদর্শন আহনাফ আহমদ শায়ান কে। কিন্তু কুয়াশা ভালোবেসেছিল অশিক্ষিত আনস্মার্ট থার্ড ক্লাস রাজ কে। আমি কখনোই কুয়াশার মতো করে রাজ কে ভালোবাসতে পারি নি। কুয়াশার ভালোবাসার গভীরতা এতোটাই বেশি ছিল যে রাজ মা”রা যাওয়ার পর কুয়াশা মানসিক ভাবে অনেক ভেঙ্গে পড়ে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিন রাত রাজের কবরের পাশে বসে বসে চোখের পানি ফেলত। এর ওর বাচ্চা নিয়ে লুকিয়ে রেখে বলত ,এটা আমার আর রাজের বাচ্চা। আমার বাচ্চা আমি কাউকে দিব না।দিন দিন কুয়াশার পা*গ*লা*মী বাড়তেই থাকে।এক পর্যায়ে আঙ্কেল , আন্টি ওর পা*গ*লা*মী সহ্য করতে না পেরে কুয়াশা কে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে।রাজকে ভালোবেসে কুয়াশা আজ একজন মানসিক রোগী। অথচ রাজ জানতেও পারল না কুয়াশার অপ্রকাশিত ভালোবাসার গভীরতা ঠিক কতোখানি ছিল। এখন মেন্টাল হসপিটালে থেকে ও কুয়াশা রাজের একটা ছবি বুকে নিয়ে দিনরাত শুধু একটা কথাই বলতে থাকে #ভালোবাসি_প্রিয় ।

‌ সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে