ভালোবাসি পর্ব-০৬

0
1040

#ভালোবাসি
#পর্ব_৬
#সুমাইয়া_জাহান

দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেলো।এই দু’দিনে জীবন টাকে নতুন ভাবে সাজিয়ে নিয়েছি।নতুন সিম কার্ড নতুন বাড়ি নতুন ভার্সিটি সব কিছুই নতুন ভাবে শুরু করেছি।পুরোনো সব খারাপ কিছু জীবন থেকে যে ধুয়ে ফেলতে চাই। তাই তো সব নতুন ভাবে শুরু করা!

এখানে আসার সাথে সাথেই নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি।আমার সঙ্গে তিহাও ভর্তি হয়েছে।এতো সব খারাপের মধ্যেও তিহার মতো বন্ধু পেয়ে আমি ধন্য।এমন বন্ধু সবাই পায় না আমি পেয়েছি আল্লাহর অশেষ রহমত।শুধু মাত্র আমার জন্য ও নিজের জীবনটাও নতুন ভাবে শুরু করলো।

এরমধ্যে রেহান এর সাথে একবারও দেখা হয়নি।কি করেই বা হবে আমি যে আমার সব ঠিকানাই বদলে পেলেছি।এখন আমাকে খুঁজে পাওয়া এতো সহজ না।আর আমাকে খুঁজতে বা যাবে কেন?উনি তো আর আমাকে ভালোবাসেন নি শুধু মাত্র বাজি জেতার জন্য ভালোবাসার নাটক করেছেন।হয়তো এখন খুশিই হয়েছেন! কষ্ট করে আর নাটক করে ব্রেকআপ করাতে হবে না।হয়তো এখন সেই খুশিতে বন্ধুদের সাথে পার্টি করে বেড়াছেন!আবার নতুন কোনো মেয়েকে উনার মিথ্যে ভালোবাসার জালে ফাসানোর জন্য জাল বুনছেন!আমি এসব কেন ভাবছি উনার মতো একজন প্রতারক কে নিয়ে আমার একদমই ভাবা উচিত না।কিন্তু কি করবো না ভাবতে চাইলেও উনার কথাই বারবার ভেবে চলেছি।দিনের বেলা সবার সামনে নিজে শক্ত দেখালেও রাতে ঠিকই সারারাত চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতে থাকি।তিহা ঠিকই বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না।হয়তো কাঁদলে কষ্ট গুলো থেকে একটু হালকা হতে পারবো এই ভেবে কিছু বলে না!

এসব ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটির জন্য রেডি হচ্ছি। তিহা আগেই রেডি হয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। এখন আর ও আগের মতো আগে গিয়ে ফাস্ট বেঞ্চের জন্য বসে থাকে না।আমার সাথেই যায় যেখানে জায়গা পায় সেখানেই বসে।কতোটা পরিবর্তন হয়ে গেছে!সবসময় দুষ্টুমিতে ভরপুর মেয়েটা এখন একদম শান্ত একটা মেয়ে গেছে।একটা মানুষ আমাদের এতোগুলা জীবন ওলোট পালোট করে দিলো।ভেবেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম।পুরো পুরি রেডি হয়ে তিহার কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললো,

—- ” রেডি হওয়া শেষ?”

আমিও একটা মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নেরে হ্যাঁ বললাম।তারপর দুজনে বেড়িয়ে পরলাম নতুন ভার্সিটির উদ্দেশ্য অবশ্য দুদিন হয়ে গেছে এই ভার্সিটিতে তারপরও নতুনই তো!এই বাড়ি থেকে কাছেই তাই হেঁটেই দুজন রওনা হলাম।হাঁটতে অবশ্য ভালোই লাগছে।

রেহান পুরো পাগল হয়ে গেছে মিহিকে খুঁজতে খুঁজতে! হাজার বার মিহিকে ফোন দিয়েছে কিন্তু প্রত্যেক বারই বন্ধ পেয়েছে।তিহার ফোনেও দিয়েছে কিন্তু সেটাও বন্ধ। হোস্টেলেও ওদের পায়নি।সেখান থেকেও ওরা চলে গেছে।কিন্তু কোথায় গেছে কেউই জানে না।পুরো ঢাকার শহর তন্নতন্ন করে খুজে ফেলেছে। মিহি যেই জায়গা গুলোতে যেতে পছন্দ করতো সেগুলোতেই খুঁজেছে কিন্তু ফলাফল শূন্যই এসেছে। রেহান কিছুতেই বুঝতে পারছে হঠাৎ করে মিহি এমন কেন করছে?কেন ওর থেকে পালিয়ে গেলো?কিছুই রেহানের মাথায় ঢুকছে না!

যে ছেলের মিহিকে এক মুহূর্ত না দেখলে দমবন্ধ হয়ে আসে সে ছেলে গোটা দুইদিন মিহি কে না দেখে কিভাবে ছিলো সেটা শুধু ওই জানে।এই দু’দিন এক টা দানা খাবার মুখে দেইনি।অনেক জোর করেও কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনি।ওর বারবার মনে হচ্ছে মিহি হয়তো ওর কোনো কথায় কষ্ট পেয়েছে তাই মিহি এতো দুরে চলে গেছে তাই ও নিজেকে অনেক বার আঘাত করেছে।পুরো শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন! হাতে কয়েক জায়গায়ই ব্যান্ডেজ লাগানো।দু’হাতে দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে আর ভাবছে মিহি ঠিক কোথায় যেতে পারে?এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।রেহান তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করেই বলতে লাগলো,

—- ” কিরে আমার মিহু পাখি কে খুঁজে পেয়েছিস?ও ঠিক আছে তো?কিছু হয়নি তো ওর?কোথায় আছে ও আমি এখুনি আসছি!কিরে কিছু বলছিস না কেন?আজও খুঁজে পাসনি তাই না!তোকে বলছি না ওকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে ফোন দিবিনা!”

ওপাস থেকে রনিত কে কিছু বলতে না দিয়েই রেহান একনাগাড়ে কথাগুলো বললো।আর শেষর কথাটা রেগে জোরে চিৎকার দিয়ে বলেই ফোন কেটে দেওয়ার আগেই রনিত ধমক দিয়ে বললো,

—- ” ওই একদম ফোন কাটবি না!আমি মিহিকে পেয়েছি আর তুই এখন একটাও কথা বলবি না আগে আমি বলবো তারপর তুই বলবি!তার আগে একদম না!”

রনিত কথাটা বলেই একটা দম নিলো।এ কদিনে রেহান কে যতো বার ফোন করেছে ততোবারই ও অন্য কে কিছু না বলতে দিয়ে নিজেই বকবক করে ফোন কেটে দিয়েছে।কিন্তু এবার রনিতের কথা শুনে রেহান অবস্থা এখন ঠিক আকাশের চাঁদ হাতে পেলে মানুষের যেমন অবস্থা হয় তেমন।খুশিতে ওর চোখে পানি এসে পরলো।ফোনটা আর কাটা হলো না
তবে আবারও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে ওর কিন্তু রনিতের ধকমের কারনে কিছু না বলেই চুপ করে রইলো।ওপাস থেকে রনিতও একটা মুচকি হাসি দিলো।

—- ” মিহি ওই হোস্টেল থেকে এসে এখানে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওর বন্ধু কি যেন নাম……ও হ্যাঁ তিহা নামের মেয়েটার সাথে থাকে। বাড়ি টার কাছেই একটা ভার্সিটি আছে ওখানেই ওরা দুজন ভর্তি হয়েছে।আর ওরা দুজনেই ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছে।এটুকু সময়ে এইটুকু ইনফরমেশনই কালেক্ট করতে পেরেছি।”

রেহান কপালে চিন্তার বাজ ফেলে বললো,

—- ” কি এমন হলো যে ও এমন কিছু করলো?”

রনিত ফুস করে একটা শ্বাস ফেলে বললো,

—- সেটা আমি কি করে জানবো তোদের ব্যাপার তোরাই জানবি!

—- ” হুম!এখন ঠিকানা টা দে!”

রেহান রনিতের থেকে ঠিকানা টা নোট করে নিলো।তারপর একটা ডেভিল মার্কা হাসি দিয়ে নিজে নিজেই নিজেই বললো,

—- মিহু পাখি অনেক বড়ো ভুল করলে!আমি একয়দিন যা কষ্ট পেয়েছি সব সুদে আসলে ফিরিয়ে দিবো।রেডি থেকো মিহু পাখি! আসছি আমি!

কথাটা বলেই রেহান তারাতাড়ি রেডি হতে লাগলো।৷ তখনই রেহানের মা মিসেস আয়শা আসলেন।ছেলেকে দুদিন পর এতো খুশি দেখে নিজের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। তারপর খেয়াল করলো রেহান কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে বেড়োতে দেখে ব্যাস্ত গলায় বললেন,

—- “এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”

রেহান চুল ঠিক করতে করতেই জবাব দিলো,

—- ” তোমার বউমাকে আনতে যাচ্ছি! ”

চুল ঠিক করা শেষ হলে মাকে একবার জড়িয়ে ধরে ” মা দোয়া করো” বলেই বেড়িয়ে পরলো বাইক নিয়ে।

ছেলের এমন কান্ড দেখে মিসেস আয়শা একটু হেসে বললেন,

—- ” পাগল ছেলে একটা!আল্লাহ তুমি দেখো আমার ছেলেটা যেন ওর ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনতে পারে।”

আমি আর তিহা হাঁটতে হাঁটতে ভার্সিটি পর্যন্ত এসে পরলাম।আর পাঁচ ছয় পা হাঁটলেই ভার্সিটির গেইট।আমি আর এক পা এগোতেই একটা বাইক এসে আমার আমাদের চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে আমার সামনে এসে থামলো।বাইক থামিয়েই বাইক থেকে হেলমেট পরা লোকটা নেমে মাথা থেকে হেলমেট টা খুলে হাতে নিয়ে এলোমেলো চুল গুলোতে একবার ভালো করে হাত বুলিয়ে। আবার বাইকের উপর হেলান দিয়ে বসে মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এদিকে আমি লোকটা কে দেখে কিছুক্ষন থ হয়ে রইলাম।কারন আমার সামনে লোকটা আর কেউ না রেহান।রেহান কে দেখে আমার বুকের ভিতর টা ধক করে উঠলো। শরীরের কি হাল হয়েছে উনার এই দুইদিনেই অনেক টা শুকিয়ে গেছেন।হাতে কয়েক জায়গায়ই ব্যান্ডেজ করা।মুখ টা একদম শুকনো। দেখে মনে হচ্ছে ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করেন নি।কিন্তু উনার এমন অবস্থা কেন? উনার তো খুশি থাকার কথা!তাহলে? হয়তো কারো কোনো ঝামেলা হয়েছে তাই হয়তো….আমি কেন উনার বিষয় নিয়ে ভাববো?উনার প্রতারণার কথা মনে আসতেই নিজেকে সামলিয়ে ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম,

—- ” রাস্তা টা কি আপনার বাবার কেনা?মাঝ রাস্তায় অন্যের রাস্তা আটকিয়ে ফ্যাশন সো দেখাচ্ছেন?রাস্তা ছাড়ুন আমরা যাবো আমাদের দেরি হচ্ছে! ”

আমার কথায় রেহান কপাল কুঁচকে একই ভাবে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

—- ” আপনার পথ কে আটকিয়েছে মিস?আমি তো আমার ভবিষ্যৎ সন্তানের মায়ের পথ আটকিয়েছি মাত্র! আপনার পথ তো আটকাইনি! ”

রেহানের এমন দ্বারা কথা শুনে রাগ আমার সপ্তম আকাশে চলে গেছে।ব্যাটার কি সাহস আমি নাকি এর ভবিষ্যৎ সন্তানের মা!ইচ্ছে তো করছে একগাদা কথা শুনাই!তারপরও রাগ টা মুখে প্রকাশ করলাম না শান্ত গলায়ই আবার বললাম,

—- ” দেখুন আমার কিন্তু সত্যিই দেরি হচ্ছে! আমাকে যেতে দিন প্লিজ! ”

কথাটা বলেই পাস কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম।তখনই রেহান আমার হাতটা ধরে ফেললেন।দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছেন।হয়তো এভাবে ইগনোর করছি বলে এতো রাগ!আমি কম কিসে! ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,

—- কোন অধিকারে আমার হাত ধরেছেন?

হাতটা এতোটাই শক্ত করে ধরেছেন যে আমি কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।তবুও হাত ছাড়ানো বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রেহান হাতটা আরো শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে বললো,

—- ” ভালোবাসার অধিকারে ধরেছি শুনতে পেয়েছো!”

আমি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,

—- ” ভালোবাসা!চিৎকার দিয়ে বললেই ভালোবাসা হয় না মিস্টার রেহান!আর আপনার এখন আর এই ভালোবাসার মিথ্যে নাটক চালোনোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সব জেনে গেছি। আপনি তো আমার মুখ থেকে ভালোবাসি কথা টা আদায় করতে চেয়েছেন সেটা তো পেয়ে গেছেন অনেক আগেই তাহলে এখনো কেন এই নাটক চালাচ্ছেন।আপনার বাজি তো জেতা শেষ! এখন কি আমার জীবন শেষ করার আবার নতুন বাজি ধরেছেন নাকি!কিন্তু সেটা তো এবার হবে না মিস্টার রেহান! আমি তো সব জেনে গেছি তাই আপনার ওই ফাঁদে আমি আর দ্বিতীয় বার পা দিবো না।”

আমার থেকে এই কথা গুলো হয়তো আশা করেন নি তাই অনেক টাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।হয়তো ভাবছেন আমি এগুলো কিভাবে জানলাম।হাতের বাঁধন টা আগলা হয়ে গেলো। আর আলগা হতেই আমি সেখান থেকে চলে আসলাম।আজ আর ভার্সিটি যাবো না মুড টা খারাপ হয়ে গেছে।উনাকে কথা গুলো শোনাতে আমার ভিতর টাও যে পুরে ছাই ছাই হয়ে যাচ্ছে। তাই তিহাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

ওদিকে রেহান ওখানেই দাড়িয়ে আছে। মিহি এসব কিভাবে জানলো?আর হ্যা এটা সত্যি যে ও বাজি ধরেই মিহিকে প্রপোজ করেছিলো।কিন্তু মিহিকে দেখা মাত্রই মিহি কে সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে।আর এতোদিন যা করেছে সবই ওর সত্যি কারে ভালোবাসা ছিলো।কোনো নাটক ছিলো না এগুলো।যদি নাটকই হতো তাহলে তো যেদিন মিহির ” ভালোবাসি ” কথাটা বলেছে সেদিনই সব কিছু শেস করে দিতো।এরজন্যই তাহলে মিহি ওর থেকে এতো দুরে পালিয়ে এসেছে।না জানি মেয়েটা মনে মনে কতোটা কষ্ট পুষে রেখেছে!

চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে