#ভালোবাসি
#পর্ব_৫
#সুমাইয়া_জাহান
ঠোঁট চেপে বারবার কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি কিন্তু এতো চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারছি না।কান্না ঠিক বেরিয়ে আসছে কিছুতেই বাধ মানতে চাইছে না।তবুও বৃথা চেষ্টা করেই চলেছি।খুব কষ্টে হোস্টেল পর্যন্ত এসেই নিজের রুমে ঢুকেই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে এতোক্ষণ ধরে রাখা চোখের পানি গুলো ফেলতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম আমাদের এই একবছর সম্পর্ক সবটাই মিথ্যে ছিলো তাহলে?সবটাই নাটক ছিলো?কিন্তু আমার ভালোবাসা টা তো মিথ্যে বা নাটক ছিলো না!আমি তো রেহান কে সত্যিই ভালোবেসেছি!আমার ভালোবাসায় তো কোনো খাত ছিলো না।তবে কেন উনি আমার সাথে এমন ভালোবাসার নাটক টা করলেন?আমি তো ভালোবাসতে চাইনি নিজের সুপ্ত অনুভূতি টা নিজের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিলাম। উনিই তো আমার সেই সুপ্ত অনুভূতি টাকে জাগিয়ে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলেন।ওহ্ উত্তর টা তো আমি জানি একটা চ্যালেন্জ জেতার জন্য উনি আমার সাজানো গোছানো জীবন টাকে তছনছ করে দিলেন!
আজ আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছিলো।আর আমি এবারের পরীক্ষায় টপ করেছিলাম।রেজাল্ট টা দেখিয়ে রেহানকে সারপ্রাইজ দিবো বলে উনার কাছে যাচ্ছিলাম।আসলে এই পরীক্ষার সময় আমি খুব অসুস্থ ছিলাম।তখন রেহান আমার পাশে থেকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছিলেন।আমি যাতে রাত জেগে পড়তে পারি তার জন্য উনি নিজের হাতে কফি বানিয়ে নিজে আমার সাথে রাত জেগে আমার পাশে বসে থাকতেন।যতক্ষণ না আমার পড়া শেষ তো ততোক্ষণ আমার পাশেই বসে থাকতেন।আমার পড়া শেষ হলে আমি ঘুমিয়ে পরার পর উনি নিজের বাড়ি যেতেন।আমার কোনো বারনই উনি শুনতেন না। কিছু বলতে গেলেই বলতেন,
—- ” তুমি যদি পাস না করতে পারো তাহলে ভার্সিটি আর হবু শ্বশুর বাড়ি দুই জায়গাতেই আমার মানসম্মান আর থাকবে না।তাই এখন আমাকে নিয়ে এতো না ভেবে আপাতত পড়ায় মনোযোগ দেয়।তাহলে অন্তত টেনে টুনে পাসটা করলেও আমার মানসম্মান টা ধুলোয় মিশবে না।”
আমি উনার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
—- ” ভার্সিটির মানসম্মান না-হয় বুঝলাম কিন্তু কিন্তু এর ভিতর শ্বশুর বাড়ির মানসম্মান আসলো কিভাবে? ”
উনি ভাব নিয়ে বললেন,
—- ” তুমি যদি এখন পাস না করো তাহলে আমার হবু শ্বশুর বাড়ি আই মিন তোমার বাড়ির লোকেরা বলবে না যে আমাকে ভালোবাসার জন্য তোমার পড়ালেখা সব জানালা দিয়ে আকাশে উড়াল দিছে।তখন আমার আর কোনো সম্মান থাকবে?”
উনার এমন কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। আর উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার পড়ার জন্য তাগিদ দিয়ে বললেন,
—- ” পরে অনেক সময় পাবে হাসার গল্প করার কথা বলার কিন্তু এখন শুধুই পড়ায় মনোযোগ বসাও। ”
কথাগুলো ভাবতেই একটা মুচকি হাসি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। কিছুদূর এগোতেই দেখি রেহান গিটার নিয়ে বসে আছে আর উনার বন্ধুরা উনাকে ঘিরে বসে আছেন।রেহান খুব ভালো গান গায়।মাঝে মাঝেই উনার বন্ধুরা মিলে গানের আড্ডা বসান।আজও হয়তো এমনই আড্ডা বসিয়েছেন।আমি আর একটু এগোতেই ওদের কথা শুনে থমকে গেলাম।এক পা-ও আর এগোতে পারলাম না।
—- ” ভাই তোর সাথে আমি জীবনেও কোনোদিন কোনো বাজি জিততে পারলাম না!বাজি ধরে মিহির থেকে ঠিক ভালোবাসি কথাটা আদায় করে নিলি!মেয়েকে পুরো ভার্সিটির ছেলেরা প্রপোজ করে কোনো দিন হ্যা উত্তর আনতে পারলো না সেই মেয়ে এখন তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! আমি ভাবতেই পারছি না।এটা শুধু তোর দ্বারাই সম্ভব! ”
আরেকজন পাশ থেকে বললো,
—- ” তো আর কয়দিন ওই মেয়ে কে নাকে দড়ি দিয়ে তোর পিছনে ঘুরাবি?যেইদিন ওই মেয়ে জানতে পারবে তুই ওকে ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু না শুধু মাত্র বাজি ধরে ওর সাথে প্রেমের নাটক করছোস সেই দিন ওর মুখ টা কেমন হবে আমার ভাবতেই আগাম হাসি পাচ্ছে। ”
কথাটা বলার সাথে সাথেই সবাই মিলে হাসিতে ফেটে পরলো।আমি আর শুনতে পারছিলাম না তাই কানে হাত দিয়ে একপ্রকার দৌড়ে ওখান থেকে চলে আসলাম।
স্মৃতি গুলো মনে করতেই চোখের পানি গুলো দু’হাত দিয়ে ভালো করে মুছে উঠে বসলাম।জামা কাপড় হাতে নিয়ে ওয়াস রুমে ঢুকে একটা লম্বা শাওয়ার নিলাম।তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখি তিহা খাটে বসে আছে। আমাকে দেখেই তারাতাড়ি ব্যাস্ত হয়ে ওঠে বলতে লাগলো ,
—- ” মিহু তুই হোস্টেলে চলে আসবি আমায় বলে আসবি তো!কতো ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস!সেই কখন রেহান ভাইয়াকে রেজাল্ট দেখাবি বলে গেলি। আমি তোভেবে ছিলাম তুই উনার সাথেই আছিস।পরে যখন ভাইয়া কে একা দেখে৷ তোর কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে তুই নাকি উনার সাথে দেখা করিসনি।আর উনিও তোকে খুঁজছেন তখন তো আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভাইয়া তোর ফোনে অনেকবার ফোন করেছে তুই নাকি ধরিসনি?”
ওর কথা শুনে একটা মুচকি হাসি দিয়ে তোয়ালে রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখি রেহানে ছিয়ানব্বই টা মিস কল ফোন সাইলেন্ট থাকার কারনে বুঝতে পারিনি।তিহার দিকে তাকিয়ে ফোন দেখিয়ে বললাম,
—- ” ফোন সাইলেন্ট ছিলো। ”
কথাটা বলেই ফোন থেকে সিম কার্ড টা খুলে ভেঙ্গে দুই টুকরো করে বাইরের দিকে ফেলে দিলাম।তারপর বাইরে বের হওয়ার জন্য রেডি হতে লাগলাম।তিহা আমার কান্ড দেখে এতোটাই অবাক হয়েছে যে মুখ টা হা হয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে রেডি হতে হতেই বললাম,
—- ” হা বন্ধ করবি নাকি মসা মাছির গোডাউন বানাবি মুখটাকে!”
নিজেকে সামলিয়ে আমার কাছে এসে বললো,
—- ” তুই ঠিক একটু আগে কি করলি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবি আমার না সব মাথার উপর দিয়ে গেছে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—- ” কেন দেখলি না সিম টা ভেঙ্গে ফেললাম!”
ও ব্যাস্ত গলায় বললো,
—- ” হ্যা তা তো দেখেছি। কিন্তু কেন করলি এইটা?”
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তখনকার সব ঘটনা বললাম।তিহা সব শুনে রীতিমতো হা হয়ে গেছে।নিজের হা হয়ে যাওয়া মুখে নিজেই হাত রেখে বললো,
—- ” রেহান ভাইয়া এতো খারাপ! ”
তারপর আমার দিকে একবার ভালো ভাবে তাকিয়ে আমার মুখের এক পাশে হাত রেখে বললো,
—- ” এতো বড়ে একটা ধাক্কার পরও তুই এতো স্বাভাবিক কিভাবে আছিস?ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পাচ্ছিস তাই না!”
আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
—- ” আমি শুধু শুধু ওই প্রতারকের জন্য কষ্ট পাবো?আমি কি কিছু করেছি নাকি?তবে প্রথমে ধাক্কা টা সত্যি সহ্য করতে পারিনি!খুব কেঁদেছি পরে ভাবলাম আমি কেন কাঁদছি আমি তো কিছু করিনি করেছে তো ওই লোকটা কাঁদলে কাঁদবে সে আমি না।তাই এখন নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছি।”
তিহা আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
—- ” প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে!বিশ্বাস কর আমি একটুও বুঝতে পারিনি রেহান ভাইয়া এতো টা খারাপ। আমি তো ভেবেছিলাম উনি তোকে সত্যিই ভালোবাসে তাই তো উনাকে সাহায্য করেছিলাম।”
আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম আর বললাম,
—- ” ধুর পাগলি! তুই কেন ক্ষমা চাচ্ছিস? আমি উনার এতো কাছে থেকেও বুঝতে পারিনি উনার মিথ্যে নাটক টা আর সেখানে তুই কি করে বুঝবি।”
তারপর ওকে ছাড়িয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে আবারও বললাম,
—- ” এখন ঝটপট রেডি হয়ে নে তো আমাদের বেরোতে হবে!”
—- ” কোথায়?”
তিহা অবাক হয়ে বললো কথাটা।আমি আবার রেডি হতে হতে বললাম,
—- ” সিম টা যে ভেঙ্গে ফেলেছি ভুলে গেছিস নাকি? এখন তো একটা নতুন সিম কিনতে হবে! তোর সিমটাও পাল্টিয়ে ফেলবি।আমি চাই না রেহান এর সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ থাকুক।আর একটা ভাড়া বাসাও খুঁজতে হবে।এখানে আর থাকবো না।”
তিহাও একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমার সাথে রেডি হয়ে নিলো।তারপর আমরা বেরিয়ে পরলাম।
প্রথমে নতুন সিম কার্ড কিনলাম।তারপর বাড়ির খুঁজ করতে লাগলাম।কিন্তু একটাও মন মতো বাড়ি পেলাম না।কোনোটা বাড়ির ভাড়া বেশি তো কোনোটা বাড়ি একদমই ভালো না।এরকম করতে করতে একটা বাড়ি পেয়েছে। বাড়িটার পাশেই দেখলাম একটা ভার্সিটিও আছে।সব মিলিয়ে পুরোপুরি না হলেও মোটামুটি পছন্দ হয়েছে। তাই আর কিছু না ভেবেই বাড়ি টা নিয়ে নিলাম।
ওইদিন বিকেলের মধ্যেই আমরা নতুন বাড়িতে উঠেছি।আমি চাইনা রেহানের সাথে আমার আর দেখা হোক।আমি জানি আমার ফোন বন্ধ পেলে হোস্টেলে ঠিক আসবে তাই এতো তারাতাড়ি নতুন বাড়িতে উঠা।
সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক দেখালেও আমি কি সত্যি স্বাভাবিক আছি?ভিতরে ভিতরে যে আমি পুরে ছাই হয়ে গেছি।নাহ!আমার একদম ভেঙ্গে পরা চলবে না।ওই লোকটাকে আমি এর যোগ্য জবাব দিবোই।তার জন্য তো আমাকে শক্ত থাকতে হবে!নিজেকে তৈরি করতে হবে!তাই আমি আর ওই৷ লোকের কথা ভাববো না।ধরে নিবো উনি আমার জীবনে একটা দুর স্বপ্ন ছিলো!
চলবে,,,,,,