ভালোবাসি তোকে পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
4466

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৮
.
সময় খুব দ্রুত প্রবাহমান। বিশেষ করে ব্যস্ত সময়গুলো জেনো ঝড়ের বেগে পার হয়। কীভাবে যে সপ্তাহ মাস দিন পার হয়ে যায় সেটা বোঝাই যায়না। দিন, সপ্তাহ, মাস কীভাবে পার হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায়না। ঠিক সেরকম সময়ই কাটছে এখন। আরও সপ্তাহখানেক কেটে গেছে এর মধ্যেই। বাড়ি টু মেডিকেল মেডিকেল টু বাড়ি বাকি সময়টা খাওয়া, পড়া, ঘুম এসবের মধ্য দিয়েই কাটছে। তবে এসবের মধ্যে একটা জিনিসের পরিবর্তন ঘটেছে। আদ্রিয়ানের প্রতি আমার অনুভূতি গভীরতা। কেন জানিনা এক অদ্ভুতরকম ফিল হয় আমার। ওর ছোট ছোট কেয়ারিং, ভালোবাসা, শাসনগুলো এখন আর আগের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু ক‍রেছি। আমি জানিনা এটা কেমন অনুভূতি। এটুকুও জানিনা যে এই অনুভূতি ঠিক কীরকম বা কেন হচ্ছে? শুধু এতটুকুই জানি যে এই অনুভূতি আগের মত না। একটু বেশিই ভিন্ন। নবীন বরণের পর থেকে একদিনও আমাকে একা ছাড়েনি ও। সবসময় চোখে চোখে লাগে, একটা বাচ্চার মতো আগলে রাখে আমাকে। যদিও মাঝেমাঝে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই করে তবুও আমার খুব ভালোলাগে। মেডিকেল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করতে নিচে নামতেই মামনী বলল,

— ” এসে গেছিস? তাড়াতাড়ি বোস। সেই সকালে বেড়িয়েছিস নিশ্চয়ই কিছু খাসনি? ক্যানটিনে তো কিছু খেয়ে নিতে পারিস মা?”

আমি চেয়ার টেনে বসে বললাম,

— ” বাড়ির সবাই খেয়ে নিয়েছে?”

মামনী আমার প্লেটে খাবার প্লেটে দিতে দিতে বলল,

— ” হিয়া আর আমি আর তোর বড় আম্মু বসে আছি তোর জন্যে।”

— ” তোমরা খেয়ে নিলেই তো পারো। আমি এসে নিজেই নিতে পারি।”

— ” হ্যাঁ! হ্যাঁ! জানি আমরা সেটা আপনি খুব পারেন। এবার চুপচাপ শুরু করুন। এতোটা সময় খালি পেটে থাকার কোনো মানে হয়?

— “প্লিজ মামনী এই কথাটা তোমার ছেলের সামনে বলোনা। একসপ্তাহ কানে শুনতে পাবোনা আমি!”

তখন আপি আর বড় আম্মু একসাথে এলো। আপি চেয়ার টেনে বসে বলল,

— ” বলাই উচিত। একমাত্র ওই পারে তোকে শিক্ষা দিতে। এতো অনিয়ম মানুষ করে?”

বড় আম্মুও ওদের কথায় তাল দিয়ে বলল,

— ” তবুও তো এখন আদ্রিয়ানের শ্বাসনে একটু সোজা হয়েছে।”

আমি ওদের সবার দিকে গোমড়া মুখ করে একপলক তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। ওরা সবাই আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো। এরপর সবাই হাসি, মজা আর আড্ডা দিতে দিতে লাঞ্চ নিয়ে সেরে নিলাম।

__________________

বিকেল বেলা ইফাজ ভাইয়া, আদ্রিয়ান কেউই বাড়িতে নেই তাই ঘুমোনোর জন্যে আপির রুমেই চলে গেলাম। আপি আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আর আমি আপির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আদ্রিয়ানকে নিয়েই ভাবছি। উনি এ নিয়ে দুবার আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি ওনাকে আমি ভালোবাসি কী না। কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। কীকরে দেবো? আমি নিজেও যথেষ্ট দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু এই সপ্তাহ আমি বারবার ভেবেছি গভীরভাবে ভেবেছি। কিন্তু ওনার প্রতি আমার অনুভূতিটাকে ভালোবাসা বলা যায় কী না? সেটা বুঝতে পারছি না। এসব চিন্তা করতে করতেই আপি বলল,

— ” তোদের ব্যপারটা কতদূর কী হলো বলতো? মানে কিছুকি এগোলো?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম,

— ” কী এগোনোর কথা বলছ! তুমি?”

— ” বাঃ রে। এতো কিছু হলো। আদ্রিয়ান ভাইয়া থেকে আদ্রিয়ান হলো। আপনি থেকে তুমি হলো? সব সেটেল?”

আমি আবারও আপির কোলে গুটিয়ে শুয়ে বললাম,

— ” নোওও। ও বলে দিয়েছে যে ও আমায় ভালোবাসে কিন্তু আমিই এখনও কিছু বলিনি। ইন ফ্যাক্ট আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা।”

আপি একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

— ” আদ্রিয়ান ঠিকই বলে তুই আসলেই একটা গাধা।”

আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,

— ” এখানে গাধার কী দেখলে?”

আপি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— ” আচ্ছা একটা কথা বলতো আদ্রিয়ান যখন তোর আশেপাশে থাকে তোর কাছে থাকে। তখন তোর মনে হয়না যে তোর আর কিচ্ছু চাই না। আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রাখলে তোর মনে হয়না যে তুই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাতে আছিস? যতক্ষণ আদ্রিয়ান তোর থেকে দূরে থাকে ততক্ষণ ওকে ভীষণভাবে মিস করিসনা তুই?”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আপির দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। আপি মুচকি হেসে বলল,

— ” এগুলোই ভালোবাসার একেকেটা প্রকাশ।তুইও ওকে ভালোবাসিস আর ভীষণভাবে ওকে চাসও। সেটা এট্রাকশন বা ভালোলাগা নয় ভালোবাসা। বুঝলি?”

আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। আপিও আর কিছু না বলে আবার আমার মাথায় বিলি কাটতে শুরু করল। আর আমি আবার ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলাম। আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পরলাম আপির কোলে।

__________________

রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আদ্রিয়ান একটু আগে ফিরে এসছে। এখন ওয়াসরুমে গেছে ফ্রেশ হতে। আমি বেড ঠিক করছি আর বিকেলে আপির বলা কথাগুলো এখনও ভাবছি। আদ্রিয়ান দরজা খুলে বেড়িয়ে আসতেই আমি পেছন ঘুরে একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাত চালাতে শুরু করলাম। একটু পরেই ও আমায় পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে আমার ঘাড়ে একটা চুমু দিলো আমার শরীর হালকা করে কেঁপে উঠল। তারপর ও আমার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

— ” কী নিয়ে এত ভাবছেন ম্যাডাম?”

— ” ক্ কই কী নিয়ে ভাবছি? তেমন কিছুই না জাস্ট এমনি।”

— ” এমনি? কিন্তু আমার তো মনে হলো আমার বউটা খুব গভীরভাবে কিছু একটা নিয়ে ভেবে চলেছে। আমি বলেছিলাম না যে মিথ্যেটা তোমার দ্বারা হয়না। ”

আমি কথা ঘোরাতে বললাম,

— ” হ্যাঁ অনেক হয়েছে ছাড়ো এবার। ঘুমাবে না রাত হয়েছে অনেক।”

ও আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমরের দুপাশে হাত রেখে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,

—- ” তোমার কী পালাই পালাই রোগ আছে না কী? আমি কাছে এলেই সবসময় এভাবে পালাও কেন ? অস্বস্তি হয়? খারাপ লাগে? এসবে কী হার্ট হও তুমি?”

ওর কথায় আমি চমকে গেলাম। সাথেসাথেই বলে উঠলাম,

— ” নানা। তেমন কিছুই না।”

ও আমার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ” সত্যি?”

আমি চোখ বন্ধ করে রেখে বললাম,

— ” হুম।”

ও আর কিছু বলল। ওভাবেই কপালে কপাল লাগিয়ে রাখল। আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম ওর দিকে। ও মুচকি হেসে আমার নাকে নাক ঘষে দিল। আমিও হেসে দিলাম। আর লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলাম। ও আমার গালে পরে থাকা কাটা ছোট চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে ডান গালে খুব সফটলি একটা কিস করল। আমি সাথে সাথে ওর টিশার্ট খামছে ধরলাম। একটুপর ও আমার বামগালেও কিস করল। আমি জমে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর চোখ বন্ধ করে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। ও আমাকে ঝট করেই কোলে তুলে নিল আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। ও আমায় কোলে করে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। তারপর নিজেও আমার পাশে শুয়ে আমার ওপর আধশোয়া হলো। আমি অবাক আর লজ্জা দুটোরই মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওর আঙ্গুল দিয়ে আমার চুল নাড়াচাড়া করতে করতে চুলে নিজের নাক ডুবিয়ে দিয়ে ঘ্রাণ নিতে শুরু করল। আমি শক্ত হয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে শুয়ে আছি। ও আস্তে আস্তে ঘ্রাণ নিতে নিতে আমার গালের কাছে এসে থামল এরপর ওর নাক নিয়ে গালে আলতো করে স্লাইড করতে শুরু করলো। আর তার সাথে সাথে আমার নিশ্বাসও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। ওর স্পর্শগুলো যতো গভীর হচ্ছে ততোই আমি হারিয়ে যাচ্ছি কোথাও। এক অন্যরকম অনুভূতি ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে আমাকে। আমার এরকম মনে হচ্ছে যেন ওও নিজের মধ্যে নেই, কোনো এক অদ্ভুত নেশা জেনো ওকেও ঘিরে রেখেছে। কিন্তু আজ আমি ঠিক করে নিয়েছি আমিও ওকে বাধা দেবোনা। ও। বারবার ওকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার নেই আমার, একেবারেই নেই। আমিতো ওরই। হয়তো নিজের অনুভূতি নিয়ে দিধা-দন্দ্বে ছিলাম। তাতে যাই হোক। বেশ কিছুক্ষণ পর ও নিজেই থেমে গেল। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে আমার ওপর থেকে সরে গিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে আমায় টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— ” আমায় ভালোবাসো কী না? কথাটা জিজ্ঞেস করাও বোকামি তাইনা? কারণ তুমি ভালো বাসো বা না বাসো তোমার জন্যে কোনো সেকেন্ড অপশন তো কেউ খোলা রাখেনি। তাইনা? আর এখনতো আমি মরার আগে তোমাকে ছাড়তেও পারবোনা। আর না তোমাকে যেতে দেবো। হয়তো সেটা অন্যায় করা হবে তোমার ওপর, হয়তো একটু বেশিই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি খুব সরি জানপাখি। আমার কিছু করার নেই। পারবোনা আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে। ভালো না বাসলেও তোমাকে আমার হয়েই থাকতে হবে। তোমার ভালোবাসা নাই বা পেলাম, সারাজীবন তোমাকে ভালোবেসেই কাটিয়ে দিতে পারব।”

বলে আমার মাথায় খুব গভীরভাবে একটা চুমু দিল আর খুব শক্ত করে নিজের বুকের সাথে জরিয়ে ধরে রাখল। পারলে যেনো নিজের বুকেই ঢুকিয়ে ফেলতো আমাকে। আমি স্হির হয়ে শুয়ে আছি ওর বুকে। কাউকে কেউ এতোটা কীকরে ভালোবাসে সেটাই বুঝতে পারিনা। এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার আদোও কী আছে? হ্যাঁ আপির বলা কথাগুলো ভেবেছি। বারবার ভেবেছি। প্রথম যখন ওকে দেখেছিলাম ভালোলেগেছিল। ওর লুক এটিটিউট এসব দেখে অল্প হলেও মুগ্ধ হয়েছিলাম। বারবার ওর বিভিন্ন কাজও ভালোলেগেছে। মানে ভালোলাগা ছিল সেটা। আর বিয়ের পর ওর কাছ থেকে এটেনশন, প্যামপার এসব পেতে মন টাইতো। ঠিক যেভাবে নায়করা নাইকাদের করে ঠিক সেরকম ওর কেয়ার পেতে ইচ্ছে হতো। সেটা এট্যাকশন ছিল! কিন্তু এখন এসব পেয়েও আমি সুখি নই কারণ ও কষ্টে আছে। কোথাও না কোথাও ও ভালো নেই। করণটাও আমি। এখন প্রতি মুহূর্তে ওকে মিস করা, ওর সামান্য আবেগ মেশানো কথায় কেঁদে দেওয়াটা, ওর প্রতিটা কথা ফিল করা, ওকে সবসময় খুশি দেখতে চাওয়া কী ভালোবাসা নয়? হ্যাঁ ভালোবাসাই তো। ভালোবাসি আমি ওকে। সত্যিই ভালোবাসি। ও চাইলে আগেই পারতো নিজের অধিকার আদায় করে নিতে। আমি হয়তো বাধা দিতাম না। হ্যাঁ সেদিন কেঁদে দিয়েছিলাম কারণ ও খুব রেগে ছিল তাই ভয় পেয়ে গেছিলাম খুব। কিন্তু যেদিন ও বলেছে ও আমাকে ভালোবাসে তারপর থেকে আমি এমনিতেও ওকে আটকাতাম না। কিন্তু ও করেনি সেটা কারণ ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। ও অন্যসবার মতো নয়। ও চায়না আমি মেনট্যালি হার্ট হই। ও চয়না আমাকে মনের ওপর জোর খাটাতে। তাইতো এখনও আমার মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শুনবে বলে অপেক্ষা করছে। না আমি বলব। আজকেই এখনই বলব। ভালোবেসে ফেলেছি আমি ওকে। সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি।

— ” শুনছো?”

— ” হুম।”

আমি ইতস্তত করে বললাম,

— ” একটা কথা বলার ছিল।”

— ” হ্যাঁ বলো? এতে জিজ্ঞেস করার কী আছে?”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে বললাম,

— ” আমি…

হঠাৎ করেই ওর ফোনটা বেজে উঠল। ও ফোনটা রিসিভ করে কী শুনলো জানিনা। তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল,

— ” অনি নূর ওয়াসরুমে পরে গেছে। অবস্থা ভালো না। আমাদের যেতে হবে। তুমি ওড়না নিয়ে এসো আমি গাড়ি বার করছি।”

বলে একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। আমি স্হির হয়ে বসে আছি। সবতো ঠিক ছিল। কদিন পর ডেলিভারি ছিল। শেষ মুহূর্তে এসে এটা হতে হলো? এমনিতেই মেয়েটার সাথে এর আগে এতো বড় অন্যায় হয়ে গেছে। ইশরাক ভাইয়া চলে গেলেন। এখন এই বাচ্চা আর আপু কে নিয়েও টানা হ্যাচড়া হবে ? আবার নতুন করে কেন? ভালোদের সাথে সবসময় খারাপই কেন হয়? কেন?

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩৯
.
অপেক্ষা! ভীষণ কঠিন একটা জিনিস।অপেক্ষার সময়গুলো কাটতেই চায়না। আর সেই অপেক্ষা যদি কোনো ভয়ংকর সময় কেটে যাওয়ার তাহলে সেই অপেক্ষার প্রহর পার করা যে কত কঠিন সেটা কোন ভাষা বা শব্দ বোঝানো যায় না। প্রতিটা মুহূর্ত একেকটা যুগের মতো মনে হয়। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা তাই হয়েছে। সময় কাটতেই চাইছে না, অপেক্ষার একেকটা প্রহর শেষই হচ্ছে না। এটা যেন অনন্তকালের অপেক্ষা। সবাই হসপিটালের ওটির সামনে বসে আছি। ইশরাক ভাইয়ার মা মানে আন্টি বেঞ্চে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে কাঁদছেন আর আঙ্কেল ওনাকে সামলানোর চেষ্টা করছে । আদিব ভাইয়া আর ইফাজ ভাইয়া আর আপি একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বড় আব্বু, আর বাবাও ওপর একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন। আর আদ্রিয়ান একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে ভ্রু কুচকে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি ওর কাছ থেকে একটু দূরে। সকলের মুখেই মারাত্মক চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। নূর আপু আর ওনার বাচ্চা আমাদের কাছে যে শুধু দুটো প্রাণ নয়, আমাদের সবার আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা সব মিশে আছে ওই দুজনের সাথে। আর ইশরাক ভাইয়াও তো আমাদের খুব ভালোবাসার একজন মানুষ ছিল। আর ওরাতো একজন ইশরাক ভাইয়ার অর্ধাঙ্গিনী আর একজন ইশরাক ভাইয়ার অংশ। দুজনের কারোরই যদি সামান্যতম ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে আমরা নিজেদের সামলাতে পারবোনা, কিছুতেই না।

আদ্রিয়ান বেড়িয়ে যাওয়ার পরেই কয়েকসেকেন্ড ‘থ’ মেরে বসে থেকে আমি ওড়নাটা হাতে নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলাম। আদ্রিয়ান খুব জোরে ড্রাইভ করছে। হসপিটালে পৌছাতেই আমরা দুজনে গাড়ি থেকে নেমে একসাথে প্রায় দৌড়ে ভেতরে গেলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি আঙ্কেল, আন্টি বসে আছেন। আদ্রিয়ান দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে আঙ্কেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— ” নূরের কী অবস্থা এখন?”

আঙ্কেল আস্তে করে বললেন,

— ” ওপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হয়েছে। ডক্টর বলেছে আঘাত বেশ ভালোভাবেই লেগেছে। বাচ্চাটাকে হয়তো বাঁচাতে পারবোনা।”

আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো। আমিও আন্টিকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখের জল ছেড়ে দিলাম। আদ্রিয়ান বলল,

— ” কী করে হলো এসব?”

এরপর আঙ্কেল আমাদের সবটা খুলে বলল। আঙ্কেলের ভাষ্যমতে, নূর আপুকে খাবার নিয়ে আসতে গিয়েই আপুর চিৎকারের আওয়াজ পায় আন্টি এরপর খাবার ফেলেই দৌড়ে গিয়ে দেখল নূর আপু ওয়াসরুমের ফ্লোরে পরে আছে আর পেট ধরে চিৎকার করছে। এরপরেই প্রতিবেশিদের ডেকে গাড়িতে তুলে হসপিটালে আসার পথেই আদ্রিয়ানকে ফোন করেছে। আমি আন্টিকে ধরে বেঞ্চে বসলাম। আঙ্কেল ও বসল। আমাদের বাড়িয়েও খবর দেওয়া হয়েছে। একটু পর বড় আব্বু, বাবা, ইফাজ ভাইয়া, আপি আর আদিব ভাইয়া এলেন।

আর এরপর থেকেই এই নিরব, দমবন্ধকর পরিবেশে আটকে আছি আমরা। ভেতর থেকে এখনও কোনো খবর আসছে না। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স একপ্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে এলো, আমরা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না।কিছুক্ষণ পর যখন নার্স ফিরে এলো তখন আদ্রিয়ান ওনাকে আটকে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু নার্স উত্তর না দিয়েই চলে গেল। সুতরাং খুব সহজেই আমরা সবাই বুঝতে পারলাম যে নূর আপুর অবস্থা একেবারেই ভালো না। আদ্রিয়ান দিকে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ানের নিচের ঠোঁটটা হালকা কাঁপছে। আদ্রিয়ান দেয়ালে জোরে একটা পাঞ্চ মেরে হনহনে পায়ে চলে গেল ওখান থেকে। আমিও আদ্রিয়ানের পেছনে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি ও বাইরের একটা বেঞ্চে বসে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে চুপচাপ বসে আছে। আমি ধীরপায়ে ওর পাশে গিয়ে বসে ওর কাধে হাত রাখলাম। ও মাথা তুলে আমার দিকে ছলছলে চোখে একবার তাকিয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেল। আমি ওর পিঠ আকড়ে ধরতেই ও আমার জরিয়ে ধরে রেখেই ভাঙা গলায় বলল,

— ” নূর আর ওর বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা অনি। ইশরাককে কী জবাব দেবো আমি? ও তো ওদের দায়িত্ব আমাকেই দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যদি আজ কিছু হয়ে যায় নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাবো। ইশরাকের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ ছিল ওরা। ইশরাক কে না চাইতেও যেতে দিতে হয়েছে কিন্তু ওদের যেতে দিতে পারবোনা।”

আমি ওকে আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললাম,

— ” কিচ্ছু হবেনা নূর আপুর। ওরা দুজনেই ভালো থাকবে দেখবেন। আল্লাহ এতোটা নির্দয় হতে পারেন না। একটা মানুষের বারবার এরকম ভয়ংকর পরিণতি দেবেন না উনি। দেখবেন এবার সব সব ঠিক হবে।”

আমার কথায় আদ্রিয়ান কিছুটা স্বস্তি পেল কী না জানিনা কিন্তু ওর কাঁপুনি পুরোপুরি থেমে গেল। কিন্তু আমাকে ছাড়লোনা ও খুব শক্ত করেই নিজের সাথে জরিয়ে রেখে দিল। আমিও চুপচাপ ওকে ধরে বসে রইলাম।

এভাবে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর কয়েক ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরে সবাই বুক থেকে পাথর নামিয়ে দিয়ে ভালো খবর এলো। নূর আপুর ছেলে হয়েছে। আর নূর আপু আপু এবং বাবু দুজনেই সুস্থ আছে। তবে আপুর অনেকটা ব্লাড চলে গেছে যার ফলে রক্ত দিতে হচ্ছে এখনও। আঙ্কেল আন্টিকে দেখিয়ে আদ্রিয়ানের কোলে যখন বাচ্চাটাকে দিল। আদ্রিয়ান কাঁপাকাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে একটা চুমু দিল। চোখ ছলছল করছে ওর। আমিও এগিয়ে গেলাম। বাচ্চাটা একদম ইশরাক ভাইয়ার মত হয়েছে। আদ্রিয়ান আমার দিকে এগিয়ে দিল আমিও বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। তারপর ডক্টর বাচ্চাটা নিয়ে চলে গেল।

হঠাৎই ডক্টর এসে বলল,

— ” দেখুন পেশেন্ট ঠিক আছে কিন্তু ওনার এখন আরও রক্তের প্রয়োজন। ব্লাডব্যাংকে আপাতত AB+ আর নেই। যা আছে সেটা ওনাকে দেওয়া যাবেনা। কারণ উনি সদ্য বাচ্চা প্রসব করেছেন। আপনাদের কারো AB+ রক্ত হবে?”

আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে বললাম আমার রক্ত AB+। ডক্টর সাথে যেতে বললেন। আমি যেতে নিলেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে বলল,

— ” তুমি এমনিতেই দুর্বল অনি। পারবেতো?”

আমি চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললাম। আদ্রিয়ান কিছু বলতে গিয়েও বলল না। কারণ রক্ত দেওয়াটা এখন সত্যিই জরুরি। আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সব টেস্ট করে চেক করে নিয়ে ব্লাড নেওয়া হলো। বেশ অনেকটাই রক্ত দিতে হয়েছে। প্রথমে ডক্টর এতটা নিতে চায়নি কিন্তু ব্লাড দরকার নূর আপুর। তাই আমি ডক্টরকে রিকোয়েস্ট করে আরো দিয়েছি। আর এটাও বলেছি আদ্রিয়ানকে না বলতে। তবে এসবে ডক্টরকে কন্ভেন্স করতে আমার অনেক কাঠখর পোড়াতে হয়েছে। ভাগ্যিস উনি আব্বুর বন্ধু তাই আমার রিকোয়েস্ট ফেলতে পারেননি। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হওয়ার জন্যে এটুকু জানি যে এতে আমি মরে যাবোনা শুধু তিন চারটা দিন শরীর খুব উইক যাবে। একটু বেশি খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেকটা রক্ত দেওয়ায় শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে আমার। ডক্টর আঙ্কেল বলল,

— ” মামনী আমি বলেছিলাম তোমাকে এমন করোনা। তুমি নিজেও এমনিতে উইক। এখন আরো অসুস্থ হয়ে পরছো। ”

আমি কিছু বলব তখনই আদ্রিয়ান এলো। আদ্রিয়ান আমার রেস্টের জন্যে আলাদা একটা কেবিন নিয়েছে। যদি জানতে পারে বেশি রক্ত দিয়েছি তখন আমার গালে ঠাটিয়ে না মারলেই হয়। আমি কেবিনে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই মাথা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। আমি পরে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান আমাকে ধরে ফেলল। ডক্টর আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এতোটা উইক কীকরে হলো।”

উনি কিছু বললেন না। মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আদ্রিয়ান উত্তরের অপেক্ষা না করে আমাকে কোলে তুলে নিলো। আমি বোকার মত তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে যে রেগে আছে। ও আমাকে নিয়ে কেবিনে বালিশে হেলান দিয়ে শুইয়ে দিলো। এরপর ওখানে রাখা ডাবেল জলের গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

— ” ফিনিস ইট!”

আমি মুখ কুচকাতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু ওর চোখ রাঙানো দেখে আমি আর সেটা পারলাম না ইচ্ছে না থাকা ঢকঢক করে গিলে ফেললাম। এরপর ডিম সেদ্ধ এরপর ডিম সেদ্ধ খেতে হলো খালি। জনমেও এভাবে ডিম সেদ্ধ খাইনি কিন্তু আদ্রিয়ানের ভয়ে সেটাও কয়েক কামড়ে খেয়ে ফেললাম। এরপর ও পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো সেটাও খেয়ে নিলাম। শরীর ভীষণ দুর্বল লাগায় বালিশে সব ভর ছেড়ে দিয়ে হেলান দিলাম। আদ্রিয়ান সব পাশে রেখে আমার পাশে রেডে এসে বসে আমার দুই বাহু একটু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— ” এক্সট্রা ব্লাড দিয়ে তাইনা?”

ড্যাম! এই ছেলের কাছে কী জীবণেও কিছু লুকাতে পারবোনা আমি? ঠিক ধরে ফেলেছে। মিথ্যেও বলতে পারিনা ওকে আমি। তাই মাথা নিচু করে ফেললাম। ও একটু ঝাড়া দিয়েই আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর কিছু না বলে কাউকে কল দিয়ে বলল,

— ” অনির কেবিনে এসো। একটু পর ফ্রুটস খাইয়ে দিও একটু। আমি দেখে আসছি বেইবি ঠিক আছে কী না।”

বলে আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,

— ” আশা করি ফ্রুটসগুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করবেন। এটার জন্যে অন্তত আমাকে আর কিছু বলতে হবেনা।”

আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর যাওয়ার দিকে এভাবে ওভার রিঅ্যাক্ট করার কী আছে? মরে গেছি আমি? কিন্তু আমার মনে আরেকটা প্রশ্নও জাগছে। নূর আপি পরলো কীকরে? এই শেষ মুহূর্তে হঠাৎ এমনিই স্লিপ কেটে পরে গেল? যেখানে আপু খুব শতর্ক মানুষ ছিল। এটাকি সত্যিই এক্সিডেন্ট? কেমন জেনো খটকা লাগছে।

রাতটা পার হয়ে বিকেল অবধি হসপিটালেই কাটলো। সন্ধ্যায় চলে এলাম আমরা। নূর আপু ভালো আছে এখন আর বাচ্চাও । কিছুদিন হসপিটালে থাকবে। সাথে আঙ্কেল আন্টি তো আছেই। আদ্রিয়ান সারাদিন আমার যথেষ্ট কেয়ার করলেও দরকার ছাড়া কথা বলেনি। আর যেটুকু করেছে আপনি করে করে বলেছে। ভীষণ রেগে আছে বাবু সাহেব। আমি খাটে হেলান দিয়ে বসে আছি ও খাইয়ে দিচ্ছে আমায়। আমাকে খাওয়ানোর সময়ও ও কিছু বলল না। আমার ভালো লাগছেনা ওর এই রাগ করে থাকা। সব ঠিক করে রেখে শুতে নিলেই আমি নিচু বললাম,

— ” সরি।”

ও কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মতো কাজ করছে। আমি এবার কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,

— ” সরি তো। আর হবেনা।”

ও এবার ঠোঁট কামড়ে নিজের চুলগুলো উল্টে ধরে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার দুই বাহু টাইট করে ধরে বলল,

— ” সরি হ্যাঁ? সরি? এরকম কেন করিস তুই? আমাকে টেনশনে ফেলে কী মজা পাস বল? বুঝিস যে আমার ভয় হয়? দম আটকে আসে? কতোবার বোঝাবো তোকে এসব? ব্লাডের ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যেত। কে বলেছিল এসব করতে? হ্যাঁ? তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে ভেবেছিস তুই? আমাকে জিন্দা লাশ বানানোর খুব শখ তোর? মেরে ফেলতে চাস আমায়?কীভাবে বোঝাবো যে তোকে আমার কতোটা প্রয়োজন? কী করলে বুঝবি যে ভালোবাসি তোকে? বল কী করলে?”

#চলবে…

(রি-চেইক করতে পারিনি। একটু কষ্ট করে মিস্টেক গুলো বুঝে নেবেন।)

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪০
.
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আদ্রিয়ানের দিকে। কতোটা রেগে গেছে সেটাই ভাবছি আমি। কতটা রেগে গেলে আমাকে তুইতুকারিও করছে সেটাই ভাবছি। যদিও ওর এই রাগের মধ্যেও আমার প্রতি ওর সীমাহীন ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, ওর ভালোবাসার মারাত্মক পাগলামো লুকিয়ে আছে। ওর কথার উত্তরে কোনো কথাই আর মুখে এলোনা শুধু ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ও আমার বাহু ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে শুয়ে পরলো উল্টোদিকে ঘুরে। আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমি অসহায় চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওর পাশ দিয়ে শুয়ে পরলাম। কিছুটা সময় কেটে গেল কিন্তু ও আমার দিকে ঘুরেও তাকাল না। অথচ আমি শোয়ার সাথে সাথে আমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। খুব বুঝতে পারছি বাবু সাহেব ভীষণ রেগে আছে আমার ওপর। আমি নিজেই পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার হাত ধরে সরাতে নিলে আমি ওর টিশার্ট থামচে ধরে টাইট করে ধরে রইলাম। ও যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আমি ততই শক্ত করে ধরছি আমি ওকে।কিছুক্ষণ পর ও আর ছাড়ানোর চেষ্টা করলোনা চুপচাপ শুয়ে রইল, আমিও মুচকি হেসে ওকে জরিয়ে ওর সাথে মিশে শুয়ে রইলাম। ওর শক্তির কাছে আমার শক্তি কিছুই না, ও যদি সত্যিই চাইত তো এক ঝটকায় আমাকে ছাড়াতে পারতো কিন্তু বাবু সাহেব তো সেটা চায়ই নি, শুধু ওপর ওপর দিয়ে রাগ দেখাচ্ছে। ছেলেটা আসলেই একটা পাগল। ওর ভালোবাসা, যত্ন, দায়িত্ববোধ এর মত ঠিক তেমনই ওর শাসন, অভিমান আমাকে একই ভাবে মুগ্ধ করে। এসব নানারকম কথা ভাবতে ভাবতে ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পরলাম।

সকাল রোদের হালকা আলো চোখে পরতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটা লম্বা হাই তুলে উঠে বসে দেখলাম আদ্রিয়ান নেই পাশে। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। আর একদৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছি এখনও রেগে আছে আমার ওপর। কারণ রোজ সকালেই ও আমার কপালে চুমু দিয়ে আমায় ঘুম থেকে তোলে। উফফ! এই ছেলের ভালোবাসা যত মারাত্মক, রাগ তার চেয়েও বেশি মারাত্মক। তবে আমিও দেখি এই ছেলে কতক্ষণ রেগে থাকতে পারে আমার ওপর। আমি গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর একহাতে কফি মগ তাই আরেক হাত দিয়ে আমার এক হাতের ওপর হাত দিয়ে সরাতে নিলো কিন্তু আমি ছাড়লাম না। আদ্রিয়ান বলল,

— ” অনি ছাড়ো।”

আমি আরও টাইট করে জড়িয়ে ধরে বললাম,

— ” উমহুম? তোমার কথায় ধরেছি নাকি যে তোমার কথায় ছাড়বো?”

— ” সকাল সকাল আবার ড্রামা শুরু করে দিলে?”

আমি দুষ্টু হাসি দিয়ে বললাম,

— ” বাংলা ড্রামা। আর ড্রামার নাম “পতীদেবের মান ভাঙাও”।

আমার কথাটায় ওর মুখের রিঅ্যাকশন ঠিক কেমন হয়েছে সেটা বলতে পারছিনা কারণ ও উল্টো ঘুর‍ে আছে। কিছুক্ষণ পর ও বলল,

— ” ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমাকে খাইয়ে হসপিটালে যাবো আমি।”

— ” আমিও তো যাবো।”

ও এবার আমাকে ছাড়িয়ে পেছনে ঘুরে বলল

— ” থাপ্পড়টা হয়তো অনেকদিন যাবত খাননা আপনি? তাই খাওয়ার খুব শখ হয়েছে। নিজের অবস্থা দেখেছো?”

আমি মুখ ফুলিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,

— ” তুমি আছোতো? তোমার সাথেসাথেই থাকব। কিচ্ছু হবেনা দেখো।'”

— ” চুপচাপ গিয়ে ফ্রেশ হতে এসো।”

আমি এবার করুণ স্বরে বললাম,

— ” প্লিজ! আমি বাবুকে দেখব।”

আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” জেদ করোনা অনিমা। মিনিমাম তিনদিনের আগে বাড়ি থেকে বেড় হতে দেবোনা আমি।”

— ” কিন্তু..”

— ” নো মোর কিন্তু! আমি ভিডিও কলে নূরের সাথে কথা বলিয়ে দেবো তোমার সাথে। আর বাবুকেও দেখিয়ে দেবো।”

আমি গোমড়া মুখ করে আস্তে আস্তে হেটে ওয়াসরুমে চলে গেলাম কারণ আমি জানি যে আদ্রিয়ান যখন একবার বলে দিয়েছে বেড়োতে দেবেনা তখন দেবেই না। এতোক্ষণ ও আমার ওপর রেগে থাকলেও এখন আমিও ওর সাথে আছি।

আদ্রিয়ান হসপিটালের আর নিজের ল্যাবের সব কাজ সেড়ে রাতে বাড়ি ফিরলেন। সারাটাদিন বড্ড বোরিং কেটেছে আমার। সারাটাদিন আমার একলা সময়ের ফ্রেন্ড ‘বোনি” এর সাথেই কাটিয়েছি। বোনি কে চিনলেন না নিশ্চয়ই? আসলে আমাদের মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের একটা ক্লোজ, ডিয়ারেস্ট ফ্রেন্ড থাকে। সেটা হলো আস্তো একটা মানব কঙ্কালের মডেল। কঙ্কালই বলা যায়। রিয়েল না হলেও দেখতে পুরোটাই রিয়েল লাগে। আমি ওনার নাম রেখেছি ‘বোনি’ যেহেতু এটা বোন থেকেই বোনি নামটা রেখেছি। তো ওটাকেই কোলে নিয়ে বসে বসে কথা বলছিলাম তখনই ও রুমে এলো। যেহেতু আমি ওর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বোনির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম,

— ” দেখলি? এলো সারাদিন পর। হুহ মুখেই এতো কেয়ার। আসলে সবটাই আমাকে ঘরে আটকে রেখে দেওয়ার ধান্দা।”

আদ্রিয়ান টাই খুলতে খুলতে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী বিড়বিড় করছো?”

আমি নিজেকে সামলে একটা মেকি হাসি হেসে বললাম,

— ” না কিছুনা তুমি বসো আমি তোমার খাবার আনছি।”

— ” না ম্যাম। আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবেনা। আমি মনিকে বলে দিয়েছি এক্ষুনি নিয়ে আসবে।”

আমি একটা মুখ ভেংচি দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। আদ্রিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আয়না দিয়ে আমায় দেখছে। আর আমি মাঝেমাঝে আড়চোখে ওকে দেখছি আর মুখ বাঁকাচ্ছি। একটু পর মনি আমাদের দুজনের খাবারের প্লেট নিয়ে এসে রেখে দিয়ে গেল। আর আদ্রিয়ানও ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এলো। খাওয়ার সময় দুজনের কেউই কারো সাথে আর কথা বলিনি। সব ঠিক করে ওয়াসরুম থেকে এসে দেখি আদ্রিয়ান নিজের চুল ঠিক করছে আয়না দেখে। আমার মেজাজটা মারাত্মক খারাপ হচ্ছে। ঠিক করে কথাও বলছেনা আমার সাথে। ভাব! আমি বেড ঠিক করতে করতে গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলাম,

— ” দেখতে বর বর কিন্তু আস্ত বর্বর
একটা জুটে গেছে কপালে
দেখতে হ্যান্ডসাম কিন্তু ফেলুরাম
ফেসে গেছি আমি অকালে..”

গেয়ে আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও ভ্রু কুচকে আয়না দিয়ে দেখছে আমাকে। আমি বালিশগুলো ঠিক করে বসিয়ে দিতে দিতে গাইলাম,

কফিনের ফেলেছি গর্ত করে
ক’দিনেই গিয়েছি জ্বলে পুড়ে
গেলো না আর এই জীবনে
আমায় ছেড়ে এ আজব হেডএক
হুমমম হুমম হুমমমম হুমমম হুমম

দেখতে বর বর কিন্তু আস্ত বর্বর
একটা জুটে গেছে কপালে
দেখতে হ্যান্ডসাম কিন্তু ফেলুরাম
ফেস..”

এটুকু গাইতে গাইতে আমি পেছনে তাকাতেই আমি চমকে গেলাম, হাত থেকে বালিশটা পরে গেলো। আদ্রিয়ান আমার একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পুরোপুরি গানের তালে থাকায় শেষের লাইনটা চেষ্টা করেও আটকাতে পারলাম না মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়েই গেল,

— ” ফেসে গেছি আমি অকালে।”

ও একটু এগিয়ে বলল,

— ” ফেসে গেছো?”

আমি একটু পিছিয়ে প্রথমে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লেও ব্যপারটা বুঝতে পারার সাথে সাথেই না বোধক মাথা নাড়লাম। আমি আরও পেছাতে গেলেই ও আমার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

— ” আমি বর্বর? ফেলুরাম?”

আমি আবারও খানিকা তুতলে বললাম,

— ” অব্ আমিতো আসলে গান গাইছিলাম। এটাতো বাংলা একটা মুভির গান।”

ও চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ” দিন দিন খুব বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো তুমি! আর তোমার সাহসও বেড়ে যাচ্ছে।”

আমি একপলক ওর দিকে আবার নিচের দিকে তাকালাম। ও আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে হেসে দিল আর আমিও হেসে দিলাম।

_________________

সপ্তাহ কেটে গেছে। নূর আপুকে আগেই বাড়িতে আনা হয়েছে। আজ নূর আপুদের বাড়িতে ছোট করে একটা গেট টুগেদার হচ্ছে। সবাই মিলে একসাথে খাওয়াদাওয়া করব, আর বাবুর নাম রাখা হবে এটুকুই। আমাদের বাড়ি থেকে আমরা সবাই গেছি। ও বাড়িতে গিয়েই নূর আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। আপুর চেহারা এখন একটু হলেও খুশির ঝলক আছে। মা হয়েছে তো, নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিজের বুকের চাপা কষ্ট কিছুটা হলেও কমাতে তো পারছে। বাবুকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করলাম। বাবুর নামকরণের দায়িত্ব নূর আপু আমার আর আদ্রিয়ানের ওপর দিলো। আমি আর আদ্রিয়ান পাশাপাশি সোফায় বসে ছিলাম। বাবু আমার কোলে। আমি আর আর আদ্রিয়ান দুজনেই ভাবছি আর বাবু দেখছি। ছেলেটার চেহারা প্রায় পুরোটাই বাবার মতই হয়েছে, কিন্তু নাক আর গায়ের রং নূর আপুর মত। ইশরাক ভাইয়া উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিলেন যদিও কিন্তু নূর আপু বেশ ফর্সা আদ্রিয়ানের মতই। কিছু একটা ভেবে আমি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— “ইসরার”

আর আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” নীড়।”

এরপর আমরা দুজনেই একটু ভেবে ওর পুরো নাম ঠিক করলাম ‘ইসরার আহমেদ নীড়’। সবারই নামটা খুব পছন্দ হয়েছে। সুন্দরভাবেই সব মিটেছে। তবে এসবের মাঝে নূর আপুর চোখের কোণের জল এড়ায় নি আমার। হয়তো ইশরাক ভাইয়ার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। সত্যিই উনি থাকলে হয়তো দিনটা অন্যরকম হতো।

আপির আগে সবাই একদিন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চে গেছিলাম। সবাই খাচ্ছি আর ইশরাক ভাইয়া আলোচনা করছে ওনার বেবিকে নিয়ে। নূর আপু বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” ইশরাক থামবে তুমি? বেবি আসা অবধি তো ওয়েট করো। সব প্লান এখনই করে ফেলছো।”

ইশরাক ভাইয়া হেসে বলল,

— ” আরে সুইটহার্ট আমার বেবি আমি ভাববোনা?”

আদ্রিয়ান হেসে বলল,

— ” তা সব ঠিক করলি বাচ্চার নামটা ঠিক করলি না? সেটা ফেলে রাখলি কেন?”

ইশরাক ভাইয়া মাথা নেড়ে বলল,

— ” উমহুম সেটা তুই করছি। বেবি আসার পর। আর তারমধ্যে যদি বিয়ে করে ফেলিস তো বউয়ের সাথে মিলে করবি।”

আদ্রিয়ান হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলল,

— ” আমার আর বিয়ে। দেখ কবে সে বড় হয় আর আমার ঘরে আসে।”

আদ্রিয়ানের কথার অর্থ সেদিন কেউ বুঝিনি আমরা। ইশরাক ভাইয়া হেসে বলল,

— ” আসবে মাম্মা আসবে। আমার বেবির কপালে যদি তোর বউয়ের দেওয়া নাম লেখা থাকে ঠিক চলে আসবে।”

অট্টোহাসির রোল পরে গেছিল সেদিন ওখানে ভাইয়ার কথা শুনে। তবে এখন এসব মনে পরলে আর হাসি পায়না। শুধু বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে