#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৩
.
আদ্রিয়ানের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে মুখ ফুলিয়ে রুমে গিয়ে দেখি সম্রাট শাজাহান শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওনাকে দেখে মাথাটা প্রচন্ড গরম হচ্ছে। পেয়েছেন টা কী হ্যাঁ ? যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন? এই তিনটে মাস তো শুধু কেয়ারিং এর নাম করে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাহলে আজ কী হলো? আজ কেন এসে এমন ন্যাকামো করছেন সেটাইতো বুঝতে পারছিনা। উনি শুতে নিলেই আমি হনহনে পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা বালিশ নিয়ে ওনার দিকে ছুড়ে মারলাম। উনি বালিশটা ক্যাচ করে আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,
— ” দেখো অনি কাল সারারাত না ঘুমিয়ে তোমাকে পাগলের মতো খুজেছি। নাও আ’ম সো মাচ টায়ার্ড। খুব ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে এনার্জি গেইন করে নেই তারপর উঠে তোমার সাথে আবার ঝগড়া করব।”
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এই ছেলে সবসময় এতো চিল মুডে কীকরে থাকে। এতো কান্ড ঘটিয়েও এমন একটা ভাব করছে জেনো সবটাই নরমাল। আমি হাত ভাজ করে বললাম,
— ” এসব করে আপনি ঠিক কী প্রুভ করতে চাইছেন বলবেন?”
আদ্রিয়ান বালিশটা বেডে রেখে হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,
— ” দেখো আমি যা আমি তাই। আমি কোনোদিন কারও কাছে কিছু প্রমাণ করি না। ইনফ্যাক্ট প্রয়োজন ও মনে করি না। আমাকে বুঝতে হলে নিজে থেকেই বুঝতে হয়। আর যে বুঝতে পারেনা তার জন্যে.. কী জেনো বলেনা? হ্যাঁ একবালতি আফসোস।”
ওনার কথাটার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওনার এসব ধাঁধাময় কথাবার্তা বুঝতেই পারিনা আমি। মানছি উনি ইঞ্জিনিয়ার তাই বলে সবসময় ম্যাথের ইকুয়েশনের মতো করে জটিল জটিল কথা বললে হয়? আমি একগাদা বিরক্তি নিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
— ” সবসময় এরকম পেঁচিয়ে কথা কেনো বলুন তো? একটু সোজা করে বললেও তো হয় তাইনা?”
উনি গায়ে দেওয়ার চাদরটা মেলতে মেলতে বললেন,
— ” কেয়া কারু বেইবি আদাত সে মাজবুর হু।”
আমি বেডে বসে রাগী গলায় বললাম,
— ” আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড? নাকি আমি বাচ্চা? যে বেইবি বলছেন?”
উনি শুতে গিয়েও থেমে গিয়ে আমার আগাগোড়া একবার স্কান করে বললেন,
— ” ওওও তুমি বাচ্চা নও? ওহ দেন মাই ফল্ট।”
বলে আবার শুয়ে পরতে নিলেই আমি ওনার হাত ধরে বললাম,
— ” এই দাঁড়ান দাঁড়ান আপনি কী আমায় ইনসাল্ট করলেন?”
উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” তোমার তাই মনে হলো?”
— ” অফকোর্স হলো।”
— ” ওহ তোমার মনে হয়েছে? তাহলে তো ঠিকই আছে।”
বলে শুয়ে পরে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ওনার কথাটা বোঝার চেষ্টা করলাম আর যখন বুঝতে পারলাম তখন রেগে ওনাকে ঝাকিয়ে বললাম,
— ” এই কী বললেন আপনি? আমি বাচ্চা?”
উনি চোখ বন্ধ করে রেখেই ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” আরে নারে বাবা। তুমিতো আমার বউ। মানে গার্লফ্রেন্ডের আপডেটেড ভার্সেন। তাই বেবি বললাম। হয়েছে?”
আমি কনফিউসড হয়ে বসে রইলাম। কী বললেন উনি? বউ, গার্লফ্রেন্ড, আপডেটেড ভার্সেন। দূর। এসব মেলাতে গেলে আমিই পাগল হয়ে যাবো। আমি আবার ওনাকে ঝাকিয়ে বললাম,
— ” এই?”
উনি চোখ খুলে বিরক্তি নিয়ে বলল,
— ” অনি প্লিজ একটু ঘুমাতে দাও। এসব কথা পরে হবে।”
আমি ওনার শরীর থেকে চাদরটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললাম,
— ” না পরে না এখনই হবে। আপনি এখনই চলে যাবেন। এটা আমার মামা বাড়ি আপনার কারোর না। তাই এক্ষুনি বেড়িয়ে যান।”
— ” উফফ। এসব কথা তো হয়ে গেলো তাইনা অনি?”
— ” না কিছু হয়নি আপনি থাকবেন না এখানে ব্যাস।”
উনি আমার দিকে ঘুরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন,
— ” অনি এখন বাচ্চামো করোনা ঘুমাতে দাও আমায়।”
বলে চুপ হয়ে গেলেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
— ” মানে কী হ্যাঁ? দেখুন আপনি যাই করুন না কেনো। যতোই এখানে থাকুন আর যতোই যা করুন আমি আপনার সাথে আর যাবোনা মানে যাবোনা। আর আপনার সাথে থাকবোও না বুঝেছেন?”
কিন্তু উনি কোনো রিঅ্যাক্টই করলেন না। আমি বিরক্ত হয়ে ওনাকে আবারও ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে আরো জোরে বললাম,
— “এই।”
উনি এবার বিরক্ত হয়ে উঠে বসে বললেন,
— ” ভালো কথায় শোনার মেয়ে তুমি নও।”
বলে উঠে হাটুতে ভর দিয়ে বসে চট করেই আমায় কোলে তুলে নিলেন। আমি হকচকিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। ব্যপারটা এতো দ্রুত ঘটল যে কিছুই বুঝলাম না। এরপর উনি আমায় বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে আমার কোলে শুয়ে পরলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। গোটা ব্যাপারটা মাথার অনেক ওপর দিয়ে গেছে আমার। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
— ” এবার আমি যতোক্ষণ ঘুমাচ্ছি ততোক্ষণ আমায় পাহাড়া দাও। এটাই তোমার শাস্তি। আর হ্যাঁ আমার মাথায় একটু বিলি কেটে দাও তো ঘুমটা ভালো হবে।”
আমি রেগে ওনাকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,
— ” বাহ। মামা বাড়ির আবদার নাকি? যা বলবেন তাই করতে হবে? সরুন উঠুন।”
উনি এবার আমার দিকে মুখ করে আমার কোমর জরিয়ে ধরে রইলেন যাতে আমি সরতে না পারি। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। হুটহাট করে এতো কাছে কেনো চলে আসেন উনি আমার? উনি কী জানেন ওনার এই কাছে আসাটা আমার বুকে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি করেন, হার্ট কতো জোরে জোরে বিট করে? যদি আমি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাই তার দায় কী উনি নেবেন? উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” কী হলো মাথায় বিলি কেটে দাও?”
আমি বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বললাম,
— ” আমি পারবোনা।”
উনি সাথে সাথেই আমার পেটে মুখ গুজে দিলেন। মুহূর্তেই চমকে উঠলাম আমি। শরীর হালকা কাঁপতে লাগল। আমি কিছু বলবো সেই শক্তিও নেই আমার মধ্যে। এমন কেনো ছেলেটা? উনি অস্ফুট স্বরে বললেন,
— ” আবার বলো?”
আমি আবারও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
— ” প্ পারবোনা।”
উনি ওভাবে থেকেই বললেন,
— ” তাহলে আমিও ছাড়বোনা।”
উফ! এমন কেনো এই ছেলেটা? পুরো ফাসিয়ে দিলো। এখন আমি না রাজি হলে তো উনি সরবেনও না। আর এভাবে আমার পেটে মুখ গুজে রাখলে আমিতো শেষই হয়ে যাবো। ইতিমধ্যে যা অবস্থা হয়েছে। আমি কোনোরকমে বললাম,
— ” আচ্ছা দিচ্ছি।”
এটা শুনে আমায় ছাড়লেন। তারপর হেসে বললেন,
— ” দাও?”
আমি মনে একবস্তা বিরক্তি নিয়ে ওনার মাথায় বিলি কাটতে শুরু করলাম। উনিও চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম উনি ঘুমিয়ে পরেছেন। সত্যিই খুব ক্লান্ত ছিলো তাইতো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরলো।ক্লান্ত ঘুমন্ত মুখটাতেও অদ্ভুত মায়া কাজ করছে। আমি একদৃষ্টিতে দেখছি ওনাকে আর সেই মায়ায় নিজের অজান্তেই হয়তো জরিয়ে যাচ্ছি। ছেলেটা কখন কী করে কী চান সত্যিই বুঝতে পারিনা আমি। আচ্ছা উনি কেন এসছেন এখানে? আর আমায় ফেরাতেই বা কেনো চাইছেন? শুধু দায়িত্বের খাতিরে? তাহলে তো সকালেই রওনা দিতে পারতেন ওই রাতের বেলা খাওয়া, ঘুম সব ছেড়ে কেন এলেন? উফফ কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। তবে যাই হোক এতো তাড়াতাড়ি রাজি হবোনা আমি। অনেক কষ্ট দিয়েছে আমায়। যতো যাই করুক না কেনো? এসব ভাবতে ভাবতে মামী এসে বলল,
— ” এই অনি শোন হি..”
কিন্তু আমাদের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। এইরে দরজাটাও বন্ধ করিনি। এরমধ্যে নানুও এলো পেছন পেছন উনিও আমাদের এভাবে দেখে থেমে গেলেন। নানু আর মামী একে ওপরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। মামী হাসতে হাসতে বলল,
— ” আরে দরজাটা বন্ধ করে নিবিতো।”
আমি হকচকিয়ে গিয়ে একটু তুতলিয়ে বললাম,
— ” ন্ না আসলে মামি।”
নানু্ও হাসতে হাসতে বলল,
— ” আচ্চা হয়েছে আমরা দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ও ওঠার আগে কেউ আর এসে ডিসটার্ব করবেনা।”
হিয়া আপি আর ইফাজ ভাইয়া আসছে সেই নিউসটা দিয়ে ওনারা চলে গেলেন। আমি মুখ ভার করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। না জানি কখন উঠবে। ততোক্ষণ আমায় এভাবে বসে থাকতে হবে দূর। শুধু শুধু বসে থাকতে ভাল্লাগছেনা তাই ওনার মাথায় আবার বিলি কেটে দিতে শুরু করলাম আর নানারকম ভাবনার সমারোহ ঘটলো মনে।
_________________
বিকেলের দিকে আপিরা চলে এলো। সাথে করে আদিব ভাইয়া, জাবিন আর আমার বাদর হতে গিয়ে ভুল করে মানুষ হয়ে যাওয়া আমার ভাই কাব্যকেও নিয়ে এসছে। আদ্রিয়ান, ইফাজ ভাইয়া,আপি, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য, আদিব ভাইয়া ছাদে বসে সবাই মিলে গল্প করছে কিন্তু আমি মুখ ভার করে হাটু গুটিয়ে বসে আছি। অন্যসময় হলে হয়তো সব মাতিয়ে রাখতাম। কিন্তু আপাতত আমি রেগে আছি সবার ওপর বিশেষ করে আদ্রিয়ানের ওপর তাই কিছু বলছিনা। অর্ণব ভাইয়া বলল,
— ” কী হলো? আমাদের মিস বাচালনি এতো চুপচাপ? এটা ভাবা যায়?”
সজীব ভাইয়াও তাল মিলিয়ে বলল,
— ” আমিও সেটাই ভাবছি। কী রে বুড়ি? কী হয়েছে? খিদে পেয়েছে?”
আমি রাগে কটমট করে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” দেখো আমাকে একদম লেগ পুল করবেনা বলে দিচ্ছি।”
কাব্য হাসতে হাসতে বলল,
— ” তোর যেই দুফিটের লেগ। ওটা কেউ পুল করতে যাবেনা।”
আমি রেগে বললাম,
— ” এই তুই চুপ করবি? কানের নিচে ঠাটিয়ে একটা মারবো বেয়াদব ছেলে।”
ইফাজ ভাইয়া বললেন,
— ” হ্যাঁ তাইতো আমার বাচ্চা শালীটার লেগ পুল কেনো করছো?”
আমি বিরক্তি হয়ে বললাম,
— ” ভাইয়া আমি মোটেও বাচ্চা নই। আ’ম এইটটিন নাও।”
আদ্রিয়ান ফোন দেখতে দেখতে বললেন,
— ” হ্যাঁ হ্যাঁ। ওকে বাচ্চা বলোনা। ও মোটেও বাচ্চা নয়। ও তো বুড়ি হয়ে গেছে। ঠাকুমা বলো।”
এরপর ফোন থেকে চোখ তুলে বলল,
— ” তা ঠাকুমা তোমার ঝুলিটাও একটু খোলো? আমরা সবাই একসাথে শুনি। ঠাকুমার ঝুলি?”
সবাই খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— ” এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা।”
আদিব ভাইয়া হাসি থামিয়ে বলল,
— ” ছাড়না মেয়েটাকে এভাবে রাগাচ্ছিস কেনো।”
আপিও বলল,
— ” হ্যাঁ আদ্রিয়ান এবার থামো।”
আদ্রিয়ানও হাসি থামিয়ে দিয়ে সিরিয়াস মূখ করে বলল,
— ” ওহ হ্যাঁ তাইতো? ঠাকুমা রেগে গেলে তো আর ঝুলি খুলবেন না। না না ঠাকুমা রাগ করেনা আমরা আর কিছু বলছিনা।”
বলে আবারও শব্দ করে হেসে দিলেন। সাথে সবাই যোগ দিলো। আমি একবস্তা রাগ নিয়ে ফুসতে ফুসতে ওখান থেকে চলে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” এই একদম আমার বউকে রাগাবেনা কেউ। যে রাগাবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। আর খবরদার কেউ ধারা জানতে চেওনা কারণ ওটা আমারও জানা নেই। সো বি কেয়ারফুল ওকে?”
সবাই একসাথে বলে উঠল,
— ” ওকে।”
বলে সবাই আবারও হেসে দিলো। আমি মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। উঠতেও পারছিনা কারণ আদ্রিয়ান আমার কোমর জরিয়ে ধরে বসে আছেন। শুধু শুধু আমায় ইরিটেড করছে। ইচ্ছে করছে একটা আস্তো নারকেল নারকেল ফাটাই ওনার মাথায়। ইচ্ছে করে এমন করছে আমার সাথে। আমি নাকি ঠাকুমা। কোন এঙ্গেল দিয়ে ঠাকুমা লাগে আমায়? কথাই বলবোনা কারও সাথে। ওনার সাথেতো একদমই না। নেভার।
#চলবে…
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৪
.
সারাদিন মোটামুটি বেশ ভালো ইগনোর করেছি ওনাকে। চরম ইগনোর যাকে বলে। উনি যতোই ভালোভাবে কথা বলতে চেয়েছেন ততোই পরিস্থিতি ঘেটে দিয়েছি আমি। আর আমার প্রতিবারের করা ইগনোরে ওনার কালো হয়ে যাওয়া মুখটা খুব ইনজয় করেছি। যদিও আমারও তখন খারাপ লেগেছে কিন্তু উনিও তো আমায় কত কষ্ট দিয়েছেন তার বেলা?
রাতে জাবিন আর আপির সাথে গল্প করে বিরক্তি নিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছি। এখন আমায় আবার ওই খাটাশের কাছে যেতে হবে। না জানি আবার কোন নতুন উপায় খুজে বসে আছে আমায় জ্বালানোর। এখন মামাবাড়িতে আছি তাই অন্যরুমেও থাকতে পারবোনা তাহলে সবাই খারাপ ভাববে, আর তাছাড়াও আলাদা থাকার মতো তেমন স্পেসও নেই। তাই নিরুপায় হয়ে ওই রুমেই যেতে হচ্ছে। আমি দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজাটা ভিড়িয়ে দেওয়া। আমি দরজাটা আস্তে করে অর্ধেক মেলতেই কেউ আমার হাত ধরে হ্যাচ আমায় ভেতরে নিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ান। এস এসপেক্টেড। এরকম কাজ উনি ছাড়া আর কে করতে পারে? উনি আমার হাত ধরে রেখেই দরজা আটকে দিলেন আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। উনি আমায় দরজার সাথে লাগিয়ে ধরে বললেন,
— “এতো লেট করছিলে কেন হ্যাঁ? জানো কখন থেকে ওয়েট করছি?”
আমি ওনার দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— ” কেনো? আমাকে দিয়ে কী করবেন আপনি?”
— ” মানুষ বউ দিয়ে কী করে?”
আমি ওনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
— ” সারাদিন বউ বউ করবেন না তো। এখন বউ বলতে এসছে।”
উনি মুচকি হেসে আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,
— ” আমার বউ আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন ডাকবো তাতে কার কী?”
— ” আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। বলবোই না কথা।”
বলে বেডের কাছে চলে এলাম। আমি মুখে বিরক্তি প্রকাশ করলেও ওনার মুখে বারবার বউ ডাকটা শুনে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে। কিন্তু ভালোলাগাটাকে বাইরে দিয়ে প্রকাশ না করে চেহারায় বিরক্তিভাব রেখেই গিয়ে বিছানা ঠিক করতে লাগলাম। বিছানা ঠিক করে আমি ওনার দিকে তাকালাম। উনি দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে মনোযোগ দিয়ে আমায় দেখছেন। ওনার চোখে এক অদ্ভুত মাদকতা দেখতে পাচ্ছি। এমন মনে হচ্ছে জেনো আমি ওনার থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ওয়াসরুমে গিয়ে দরজা লক করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই ছেলের উদ্দেশ্যেটা ঠিক কী? কই এই তিনমাসতো আমার দিকে ঘুরেও দেখেনি পাত্তাই দেয়নি আমাকে। মাস্টারদের মতো পরিয়ে গেছে, আর গার্ডিয়ানদের মতো খাওয়া, গোসল, ঘুম নিয়ে তদারকি করে গেছেন। এখন কী হল? বিয়ের তিন মাস পর এখন ওনার মনে পরলো যে আমি ওনার বউ? সিরিয়াসলি? কিন্তু আমি কেনো? মানবো? উনি নিজে যা খুশি করে যাবেন আমায় মানতে হবে নাকি? এরকম নানা কথা ভেবে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখি উনি বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখছেন। আমি কিছু না বলে চুপচাপ লাইট অফ করে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পরলাম। কিছুক্ষণ পরে উনিও শুয়ে পরলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম উনি আমার পেটের ওপর হাত রাখলেন। আহা! এখন এসছে দরদ দেখাতে। অথচ এতোগুলো দিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পরতো। আমি বেশ রেগেই হাতটা সরিয়ে দিলাম। এবার দেখো কেউ ইগনোর করলে কেমন লাগে। একটুপর উনি আবারও আমার ওপর হাত রাখলেন। আমি আবারও সরিয়ে দিলাম। কিন্তু উনি আবারও হাত রাখলেন কিন্তু এবার আর সরাতে পারলাম না কারণ উনি এবার শক্ত করে ধরে রেখেছেন। আমি ওনার সাথে কথা বলবোনা তাই চোখ বন্ধ করে রইলাম। এমনিতেও বেশ অনেকটাই রাত হয়েছে তাই প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় এভাবেই কেটে গেলো। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,
— ” অনি?”
ওনার ডাক শুনে চমকে উঠলাম আমি। তবুও কিছু বললাম না। ওনার সাথেতো কথাই বলবোনা। এমনিতেও চোখ খুলতে পারছিনা এতোটাই ঘুম পাচ্ছে। উনি বললেন,
— ” আমি জানি তুমি এখনও জেগে আছো। আচ্ছা তোমায় কথা বলতে হবেনা আমি বলছি তুমি শোনো?”
আমি এবারও কিছুই বললাম না। চেষ্টা করেও চোখ খুলতে পারছিনা। উনি আবারও বলে উঠলেন,
— ” জানো জীবন খুব অদ্ভুত হয়। আমরা ভাবি এক কিন্তু হয় আরেক। হঠাৎ হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যায় যার ফলে আমাদের আগের করা সব পরিকল্পনাও নিমেষেই বদলে যায়। নতুন করে ভাবতে হয়। এমনটাই হয়েছিল ইশরাকের মৃত্যুর পর। তুমি জানো ভাইয়া আর বউমনির এনগেইমেন্টের দিন যখন তোমা..”
আর কিছু শুনতে পেলাম না আমি। উনি কিছু বলছে বুঝতে পারছি কিন্তু সেটা আর বুঝতে পারছিনা এতোটাই ঘুম আচ্ছন্ন করছে আমাকে। চেষ্টা করছি শোনার কিন্তু শুনতে পারছিনা। আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
___________________
সকালে ঘুম থেকে উঠে আর ওনাকে পাশে দেখতে পেলাম না। হয়তো বেড়িয়েছেন। আমি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। বেড়িয়ে এসে দেখি উনি রুমে চলে এসছেন। বিছানায় বসে ফোন দেখছেন। হুহ সারাদিন শুধু ফোন? অথচ আমার ফোনটা ভেঙ্গে ফেলল। হঠাৎই উনি আমার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঝূকে কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
— ” এতো সকাল সকাল শাওয়ার নিলে যে? আমার জানা মতে আমি তো কাল রাতে কিছুই করিনি।”
আমি এবার চোখ বড় বড় করে তাকালাম ওনার দিকে। কিছুক্ষণ আহম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে তারপর রেগে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” অসভ্য লোক একটা। সমসময় মাথায় এসব ঘোরে তাইনা?”
উনি হেসে দিয়ে বললেন,
— ” বাহবা। আমার পিচ্চি বউটাতো খুব চালাক হয়ে গেছে। আমার কথা আমাকেই শোনাচ্ছে।”
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। দূর ওনার সাথে কথা বলবোনা বলেছিলাম তো তবুও কেনো বলছি? এসব ভেবে মুখ ফুলিয়ে ওনার কাছ থেকে সরে এলাম। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে লোশন লাগাবো। উনি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আয়নার আমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়েই একটা চকলেটের বক্স এনে সামনে ধরলেন। চকলেট আমার খুব বেশিই পছন্দের, চকলেট দেখে আমি খুব খুশি হয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ওটা সরিয়ে দিয়ে ওখান থেকে যেতে নিলে উনি আমার কোমর জরিয়ে ধরে বললেন,
— ” বাপরে। আমার বউয়ের এতো রাগ? এই পিচ্চিটাও এতো রাগ করতে পারে? জানতাম না তো?
আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
— ” তা আমি কী করলে ম্যাডামের রাগ ভাঙ্গবে।”
— ” কিচ্ছু করতে হবেনা ছাড়ুন আমাকে।”
বলে ওনার বুক ঠেলে সরাতে গেলেই উনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— “রাগিণী তুমি জানো? তোমার রাগ হচ্ছে বনফুল।
যা কাঁটায় ভরপুর কিন্তু সুগন্ধে সমাকুল।
আচ্ছা তুমি কী সন্ধ্যা? নাকি এক মুঠো রোদ?
যাতে হারিয়েছি আমর চেতনাবোধ?”
আমি পুরো জমে গেলাম। ওনার এই চার লাইনের কবিতাটা আমায় জমিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এই চারটা লাইন উনি আমার জন্যেই বললেন? উনি আমাকে ছেড়ে মুচকি হেসে আমার হাতে চকলেটের বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আর আমি ওখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর চকলেট বক্সটার দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল।
___________________
আমরা সবাই এখানে আছি শুনে মিলি আর মলি আপু মানে আমার বড় মামার দুই মেয়েও জামাইসহ চলে এলো আজ। সবাই মিলে অনেক মজা করে সারাটা দিন কাটালাম। কিন্তু এরমধ্যে আর আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলিনি উনিও আসেন নি কথা বলতে। হুহ একটু ইগনোর করেছি ওমনি ইন্টারেস্ট শেষ? ভালো করেছি, আর বলবোই না কথা। সকালে রাগটা যা একটু কমেছিল ওনার সারাদিনের ব্যবহারে তা আবারও বেড়ে গেলো। সন্ধ্যায় মুখ ফুলিয়ে রুমে বসে আছি হঠাৎ আপি এসে ছাদে যেতে বলে গেলো। দূর! এখন আবার ছাদে কেনো? সবাই আড্ডা দেবে? নিশ্চয়ই উনিও থাকবেন? একগাদা বিরক্তি নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখি সবটাই অন্ধকার। আমি অবাক হয়ে গেলাম বাকি সবাই কই। আপির নাম নিয়ে দুবার ডাকার পরেই লাইট জলে উঠলো। লাইট জলতেই আমি আরও অবাক হলাম কারণ পুরো ছাদটাই সাজানো। অনেক সুন্দর করেই সাজানো। তখনই ভুতের মতো টুপ করে আমার সামনে কাব্য এসে হাজির হলো। পেছন থেকে হলুদ রং এর ইংরেজি S বের করে সামনে ধরল। আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। পাশ কাটিয়ে যেতেই ইফাজ ভাইয়া O বেড় করলো। আমি আবারও অবাক হলাম সজীব ভাইয়া সরে যেতেই অর্ণব আর সজীব ভাইয়া একসাথে দুটো R নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি ওদের সরিয়ে আরকটু এগোতেই আদিভ ভাইয়া Y নিয়ে এসে দাঁড়ালো। আমি অবাকের ওপর অবাক হচ্ছি। সব মিলিয়ে তো সরি হয়। কিন্তু সরি কে বলছে? আপি, জাবিন, মিলি, মলি আপু আর জিজুরাও বেড়িয়ে এলো। সবার হাতেই সরি কার্ড। আমি কিছু বলবো তার আগেই ‘বান যা রাণী’ গানটার প্রথম দিকের মতো উইস্টলিং করতে করতে আদ্রিয়ান বেড়িয়ে এলেন পেছনে হাত দিয়ে। আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। ইফাজ ভাইয়া গিটারও বাজাচ্ছেন। উনি উইস্টলিং করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে একটা টেডিবিয়ার বের করে আমার সামনে ধরলেন যার ওপর লেখা সরি। আমি কিছু বলার আগেই আমার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন,
— “বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা
বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা
বান মেরে মেহবুবা, ম্যা তেনু তাজ পাভা দুঙ্গা
এটুকু বলে আমায় ঘোরাতে ঘোরাতে গাইলেন,
— “সুন মেরি রাণী রাণী, বান মেরি রাণী রাণী
শাহজাহান মে তেরা, তেনু মামতাজ বানা দুঙ্গা”
আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে একটা ছোট্ট তাজমহল এগিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে ওটা হাতে নিতেই উঠে দাঁড়িয়ে আবার গাইলেন,
— “বান যা তু মেরে রাণী, তেনু মেহাল দাবা দুঙ্গা
বাদান তেরি দে খুশবু, মেইনু শুন না দেভি নি
রাতান নু উঠ উঠ কে, সোচা বারে তেরি নি
সুন মেরি রাণী রাণী, বান মেরি রাণী রাণী
হান কার দে তু মেনু, ম্যা দুনিয়া নু হিলা দুঙ্গা
বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা”
উনি টেডিবিয়ারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে। কোমর চেপে ধরে আবার নিজের কাছে নিয়ে আরেক হাতে হাত ধরে ডান্স করতে করতে গাইলেন,
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আজা নি আজা সনি, আযা মেরে দিলকে কোল
আজা নি আজা সনি, আযা মেরে দিলকে কোল
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আখিয়ানু রেহনে দে, আঁখিয়া দে কোল কোল
আমাকে ঘুরিয়ে ওনার বুকের সাথে পিঠ লাগিয়ে দোলাতে দোলাতে গাইলেন,
— “সুন মেরি রাণী রাণী, বান মেরি রাণী রাণী
শাহজাহান মে তেরা, তেনু মামতাজ বানা দুঙ্গা
বান যা তু মেরে রাণী , মেনু মেহাল দাভা দুঙ্গা”
আমায় ছেড়ে আমার সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে পরলেন। আর ভাইয়ারাও ওনার পেছনে সেই সরি ওয়ার্ডগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। উনি এক হাতে এক কান ধরে ঘাড় বাঁকিয়ে কিউট স্টাইলে বললেন,
— ” সরি।”
আমি অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।
#চলবে…
( রি-চেইক করতে পারিনি। তাই মিস্টেকগুলো একটু বুঝে নেবেন।)
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৫
.
আদ্রিয়ান নিজের স্টাইলে ভ্রু বাকিয়ে কিউট এক্সপ্রেশন দিয়ে এক কান ধরে বসে আছেন। ওনাকে এভাবে দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।এতো কিউট কেনো উনি? সত্যি কথা বলতে ওনার মুখের দিকে তাকালেই ওনার প্রতি জমা সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। আমি হাসিটা চেপে রেখে ওনার দিকে তাকাতেই উনি ঠোঁটটা হালকা বাকিয়ে চোখ ছোট করে ইশারা করলো মাফ করে দিতে। আমি বাকি সবার দিকে তাকিয়ে দেখি সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি কী করি সেটা দেখার জন্যে। আমি কিছু একটা ভেবে হাত ভাজ করে গম্ভীর মুখ করে ভ্রু নাচিয়ে বললাম,
— ” সরি কীসের জন্যে?”
উনি একটু আশেপাশে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন,
— ” এখানেই বলতে হবে?”
আহারে! বেচারা সবার সামনে বলতে হেজিটেড করছে। কিন্তু আমিতো বলিয়েই ছাড়বো। তাই আমি মুখে সিরিয়াস ভাব নিয়েই বললাম,
— ” হ্যাঁ। সবার সামনে যখন সরি বলছেন তখন সরি বলার কারণটাও তো সবার সামনেই বলতে পারা উচিত তাইনা? কেনো বলছেন সরি?”
ইফাজ ভাইয়াও একটু পিঞ্চ করে বলল,
— ” হ্যাঁ বল কেনো বলছিস সরি?”
জাবিন হাত দুটো সামনে এনে এক করে দুলতে দুলতে বলল,
— ” হ্যাঁ ভাইয়া বলনা কেনো বলছিস?”
এরপর সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো,
— ” তাইতো কেনো বলছো?”
আদ্রিয়ান সবার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” বিয়ের প্রথমরাতে খুব বেশি খারাপ ব্যবহার করেছি তোমার সাথে। যা হয়েছে সবকিছুর জন্যে তোমাকে ব্লেম করেছিলাম, যেখানে তুমি ঠিক ততোটাই নিরুপায় ছিলে যতোটা আমি। এরপর প্রায় না চাইতেও তোমাকে কষ্ট দিতে হয়েছে বারবার। তাই এতোদিনের সবকিছুর জন্যে সরি বলছি। আ’ম রিয়েলি সরি।”
বলে মুখটা আবার আগের মতোই ইনোসেন্ট করে ফেলল। সবাই বলছে সরি এক্সেপ্ট করে নিতে। নাহ এই ছেলের ওপর আর রাগ করে থাকতে পারব না আমি। এভাবে সরি বললে আর রেগে থাকা যায়? তাই আর ভেতরে হাসিটা চেপে না রেখে ফিক করে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতেই হাত বাড়িয়ে দিলাম ওনার দিকে ওঠার জন্যে। উনি আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন। সবাই হেসে হাততালি দিয়ে উঠল। আদ্রিয়ান বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আরে টিম অফ গাধাস্। এভাবে হাততালি দেওয়ার কী আছে? প্রপোজ করছি আমি ওকে? সবগুলো তারছেড়া।”
আদিব ভাইয়া তুরি বাজিয়ে বললেন,
— ” বেস্ট আইডিয়া। আদ্রিয়ান সরি যখন বললি প্রপোজটাও করে ফেল?”
সাথে সাথেই সবগুলোতে মিলে হইহই করে উঠল। সবাই মিলে বলতে শুরু করল প্রপোজ করার জন্যে। আমি বোকার মতো একেকবার একেকজনের দিকে তাকাচ্ছি। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে সবার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
— ” চুপপ!”
সবাই সাথেসাথেই চুপ হয়ে গেলো। আদ্রিয়ান বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
— ” বউটা কার? আমার। প্রপোজ কে করবে? আমি। আমি আমার বউকে যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে নিয়ে গিয়ে প্রপোজ করবো তাতে তোদের কী রে?”
ইফাজ ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বললেন,
— ” আদ্রিয়ান এটা ঠিক না। আমরা সবাই হেল্প করেছি তোর বউকে সরি বলতে। এখনি ভুলে গেলি?”
আদ্রিয়ান ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বলল,
— ” হ্যাঁ তো? এটা ডিউটি ছিলো তোমাদের সবার নিজের ভাইয়ের প্রতি। বুঝলে?”
কেউ আর কিছুই বলল না কারণ সবাই জানে আদ্রিয়ানের সাথে তর্কে কেউ পেরে উঠবে না। এরপর সবাই ছাদে মামা মামীদের আর নানুকে ছাদে নিয়ে এলাম। নানু এসেই আদ্রিয়ানকে পিঞ্চ করে বলল,
— “কীগো ভাই আমার নাতনির মান ভাঙানো হচ্ছিল বুঝি?”
আদ্রিয়ান হেসে গিয়ে নানুকে একহাতে জরিয়ে ধরে গাল টেনে বলল,
— ” হ্যাঁ সুইটহার্ট। তোমার নাতনির রাগ তো না যেনো মহা শক্ত এক পাথর। ভাঙাতে ভাঙাতে আমার অবস্থা কাহিল।”
— ” করতে তো হবেই। আমার খুব আদরের নাতনি বুঝলে। আর যদি কখনও ওকে কষ্ট দিয়েছ তো লাঠির বাড়ি একটাও নিচে পরবেনা হ্যাঁ।”
আদ্রিয়ান মুচকি হাসি দিয়েই বলল,
— ” আমি ইচ্ছাকৃত আর কোনো কষ্ট দেবোনা তোমার নাতনিকে। কিন্তু তোমার নাতনি ভবিষ্যতে আমাকে কষ্ট না দিলেই হয়।”
আমি ওনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালাম। উনি মুখের হাসির রেখাটা আরও বড় করলেন। এরপর সবাই মিলে ছাদে পাটি পেতে বসে গরম গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ডিনার করতে বসলাম। বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় ঠান্ডা পরেছে তাই আরও মজা লাগবে। ঠান্ডায় গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের তুলনা হয়না। কিন্তু খেতে বসে আরেক সমস্যা হলো। আমি মাছ বাছতে পারিনা। সবসময় আম্মু বেছে দিতো। অনেকে বলে ইলিশ মাছ বাছার কী দরকার? কিন্তু আমি না বেছে মোটেও খেতে পারিনা। তাই মাছটা পাতে নিয়ে বসে আছি। এতো সুন্দর ঘ্রাণ আসছে যে খেতে ইচ্ছে করছে। ধ্যাত! হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান আমার পাত থেকে মাছটা নিজের পাতে নিয়ে নিলেন আমি অবাক হয়ে তাকালাম। সবাই খাওয়া থামিয়ে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান মাছ বেছে বেছে আমার পাতে দিতে লাগল। সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। বাকিরাও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। খেতে খেতে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিলাম। সত্যিই পরিবারের সবাই একজায়গায় বসে আনন্দ মজা করার মজাটাই আলাদা। এক অদ্ভুত শান্তি থাকে এগুলোর মধ্যে। পরিবার মানেই আস্তো এক ভালোবাসা। সবারই উচিত এই ভালোবাসাটাকে মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করা।
_________________
রুমে এসে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছি আর টেনশন করছি। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। না জানি কালকে কী হবে? এসব চিন্তায় শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। উনিও ওয়াসরুম থেকে বেড়োচ্ছেন না এখনও। আমার টেনশন বেড়েই চলেছে। একটু পরেই উনি ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেললেন। টাওয়েলটা দ্রুত রেখে আমার সামনে বসে কপালে গলায় হাত দিয়ে বললেন,
— ” কী হয়েছে অনি? এভাবে কাঁপছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে? ভয় পেয়েছো কোনো কারণে? কেউ কোনো ফোন বা মেসেজ করেছে? সেসব দেখে ভয় পেয়েছো? বলো?”
আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে ফোন, মেসেজ, ভয় কী বলছেন? আমার কিছু হতে দেখলেই ওনার মাথার তার ছিড়ে যায়। আমি নিজেকে সামলে অসহায় গলায় বললাম,
— ” কালকে রেসাল্ট দেবে তাইনা?”
আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” এইজন্যে টেনশনে এভাবে ভয় কাঁপছো আর ভয় পাচ্ছো?”
আমি করুণদৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। আদ্রিয়ান একটা শ্বাস ফেলে আমার দুই গালে হাত রেখে বললেন,
— ” কাম অন অনি? এতো টেনশন কেনো করছো? আমি বলেছি না একদম টেনশন করবে না? যা হবে ভালো হবে।”
আমি মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বললাম,
— ” আমার ভয় করছে।”
আমার কথাটা শুনে আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বেডের ওপর পাশ দিয়ে গিয়ে উঠে বেডে হেলান দিয়ে বসে আমাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এক হাতে জরিয়ে ধরে বললেন,
— “তোমার মেডিকেলে চান্স হবে এটা শিউর আমি। আমি নিজে প্রিপার্ড করেছি তোমাকে তাই বলছি। এখন প্রশ্ন ডিএমসি তে হবে কী না? সেটা তুমি এক্সাম কেমন দিয়েছো তার ওপর ডিপেন্ডেড। আর তুমিতো বলেছো ভালো দিয়েছো? যা হবে খুব ভালো হবে।”
ওনার কথায় একটু শান্ত হতে পারলেও ভয় পুরোপুরি কাটলো না তাই ওনার টিশার্ট খামছে ধরে বসে রইলাম। উনি কিছুক্ষণ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তারপর হাত বাড়িয়ে টি-টেবিল থেকে চকলেটের বক্সটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
— ” এটার থেকে দুটো নিয়ে খাও অনেকটা রিলাক্সড লাগবে। ”
আমি এমনিতেই চকলেটে মরি, তারওপর আবার টেনশনে আছি তাই কথা না বলে বক্সটা নিয়ে একটা চকলেট বেড় করে চকলেট বলটার র্যাপিং খুলে মনের আনন্দে খেতে লাগলাম। আপাতত অসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি এখন শুধু একমনে খাচ্ছি। একটা শেষ করে আরেকটা প্রায় শেষের দিকে তখন আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি হাত ভাজ করে একদৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে, কপাল হালকা কুচকানো। হঠাৎই উনি এগিয়ে আসতে শুরু করলেন আমার দিকে। আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো? আমার বেশ অনেকটা কাছে এসে পরেছেন উনি আমি পেছানোর শক্তিও পাচ্ছিনা শক্ত হয়ে বসে আছি। উনি আস্তে আস্তে ওনার মুখটা আমার দিকে এগিয়ে আনতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একটু পরেই খেয়াল করলাম উনি আমার ঠোঁটের চারপাশে আঙুল ছোয়াচ্ছেন। আমি আরো অবাক হয়ে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি উনি আমার ঠোঁটের আশেপাশটা হালকা হাতে মুছে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
— ” বেবি সাধে বলি তোমায়? কীভাবে খাচ্ছো দেখো? পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।”
আমি ওনার দিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে বাকি চকলেটটা একবারে মুখে পুরে চিবোতে লাগলাম। উনি হেসে দিলেন আমার কাজে। এই ছেলেটার হাসিতেও সম্মোহনী ক্ষমতা আছে আছে। এতো সুন্দর করে হাসে কেউ? হাসলে ওনার চেহারার সৌন্দর্য কয়েকগুন বেড়ে যায়। উনি হাসলে চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে যায়, ওনার সবগুলো দাঁত সোজা সুন্দর হলেও প্রি-মোলার দাঁতটা একটু বাঁকা। যার ফলে ওনার হাসিটা আরও সুন্দর লাগে। ওনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। উনি আমার চুলগুলো হাত দিয়ে সেট করে দিয়ে বললেন,
— ” পিচ্চি একটা।”
আমি চিবোনো বন্ধ করে থম মেরে গেলাম। মাঝে মাঝে ওনার এই ছোট ছোট আদুরে কথাগুলো শুনলে কেমন জেনো অদ্ভুত শিহরণ হয় শরীরজুড়ে। এক অন্যরকম ভালোলাগা। উনি ইশারা ইশারা করতেই আমি মুখের চকলেট টা শেষ করে ফেললাম। এরপর উনি আমাকে ধরে শুইয়ে দিয়ে গায়ে চাদর দিয়ে দিলেন। এরপর আমার পাশে শুয়ে একহাতে আমার পেট জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলেন।
_________________
সোফায় একগাদা টেনশন নিয়ে বসে আছি। আদ্রিয়ান রেসাল্ট দেখার জন্যে ল্যাপটপ খুলেছে। সবাই উৎসুক হয়ে বসে আছে। পুরো শরীর কাঁপছে অলমোস্ট। ভয়ে এক সকাল কেঁদেই দিয়েছি। আদ্রিয়ান অনেক কষ্টে আমার কান্না থামিয়েছেন। এখনও ভয়ে আছি। আমার অবস্থা দেখে আদ্রিয়ান আমায় এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখে অপর হাতে রেসাল্ট চেক করছেন। অরু, ইশু, ঐশি সবার ডি এম সি তে হয়ে গেছে একটু আগেই কল এলো। আমাদেল কলেজের স্টুডেন্টদের মধ্যে চারজনের ডিএমসিতে হয়েছে বলে এখনও জানা গেছে। আমার না হলে কী হবে? আমিই এতোক্ষণ চেক করতে দেইনি ভয়ে। অনেক কষ্টে আমাকে রাজি করিয়ে বসিয়েছেন উনি। আদ্রিয়ান কী ভাববেন? কেমব্রিজ থেকে পাশ করা একজন ইঞ্জিনিয়ার এর বউয়ের মেডিকেলেও চান্স হলোনা? এসব চিন্তা করে আদ্রিয়ানের শার্ট শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,
— ” অনি ল্যাপটপের স্ক্রিণে তাকাও?”
আমি চোখ বন্ধ রেখেই না বোধক মাথা নাড়লাম। উনি আবারও আলতো গলায় বললেন,
— ” একবার দেখে তো নাও?”
— ” না আমার ভয় লাগছে আপনিই বলুন।”
আদ্রিয়ান এবার একটু জোরেই বললেন,
— ” অনি আমি দেখতে বলেছি তোমায়।”
ওনার হালকা ধমকিতে ভয় পেয়ে পিটপিটিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি স্ক্রিনে দেখতে বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে স্ক্রিণে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা আমি।
#চলবে…