ভালোবাসি তোকে পর্ব-২০+২১+২২

0
4450

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২০
.
সময় খুব অদ্ভুত জিনিস। কখনো খুব দ্রুত চলে যায় আবার কখনো যেনো কাটতেও চায় না। এটা নির্ভর করে মানুষ সময়কে কীভাবে চায় তার ওপর। সে বড়ই অবাধ্য। মানুষের মন মস্তিষ্ক নিয়ে খেলে খুব মজা পায় সে। যদি কেউ চায় সময় ধীরে চলুক তাহলে সময় যেনো খুব বেশিই দ্রুত চলে যায়। আবার যদি কেউ চায় সময় তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাক তাহলে সময় যেনো আর কাটতেই চায় না। দোষটা আসলে কার? মানুষের মনের নাকি সময়ের সেটাও এক বিশাল প্রশ্ন। দেখতে দেখতে দুইমাস কেটে গেছে এর মধ্যে। সময়টা একটু বেশিই দ্রুত চলে গেলো এরকমটাই মনে হচ্ছে আমার কাছে। কিন্তু কী আর করার?

সন্ধ্যা নেমে আসবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে । সূর্য পশ্চিম আকাশে পুরোপুরি ঝুকে গেছে। একদৃষ্টিতে দূরের প্রকৃতি দেখছি আমি। সেদিনের পর আদ্রিয়ানের সাথে কোনোরকম দুষ্টুমি করিনি আমি আর। কেন জানিনা সেদিনের পর থেকেই ওনার কাছে গেলে ভয় লাগে আমার। এইজন্যই একটু দূরে দূরে থাকি। সত্যি বলতে ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি অভিমানও আছে ওনার ওপর। ওনার সেদিনের সেই ব্যবহার এ ভয়ের চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। একটু মজা করেছি বলে এরকম করতে হবে? তাই ওনার সাথে পড়াশোনা আর দরকারি কথা ছাড়া আর কোনো কথা হয়না। অদ্ভুতভাবে ওনার এতে কিচ্ছু যায় এসছে না। এমন মনে হচ্ছে যেনো এটাই স্বাভাবিক। এমন এখন আর আমার ওপর হাত দিয়ে শোয়না। মাঝখানে কোলবালিশ না রাখলেও একটু দূরত্ব রেখেই ঘুমান। ওনার এরকম ব্যবহারে ওনার প্রতি জমা অভিমানটা ধীরে ধীরে বাড়ছে আমার। তবে আগে যেমন ওনাকে নিয়ে, আরও নানা বিষয় নিয়ে কল্পনা জল্পনা করতাম এখন সেসব বাদ দিয়ে দিয়েছি। এখন নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু পড়াতেই আমার। গত সপ্তাহে এইচ এস সি রেসাল্ট দিলো আমার। আলহামদুলিল্লাহ জিপিএ ফাইভ এসছে। সবাই কতো খুশি হয়েছিল সেদিন। বিশেষ করে আব্বু। রেসাল্ট বার আদ্রিয়ানই করেছেন। কিন্তু আমার রেসাল্ট দেখে উনি খুশি হয়েছেন কী হন নি সেটা বোঝাই যাচ্ছিল না। তবুও আমি পাত্তা দেই নি। উনি খুশি হলে হোক না হলে না হোক আই ডোন্ট কেয়ার। রাতে যখন আমি সবার সাথে মজা করে একটু দেরীতে রুমে ঢুকলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা ধমক দিয়ে বললেন,

— ” অনেক লাফালাফি হয়েছে। এ প্লাস পেয়েছো বিশ্ব উদ্ধার করোনি। এখনও ইম্পর্টেন্ট পরীক্ষাটাই বাকি। তাই এসব লাফালাফি বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দাও।”

ওনার কথায় সেদিনও খারাপ লেগেছিল। কী হতো একটু মিষ্টি মুখে কনগ্রাচুলেট করলে। ওনাকে নিয়ে ভেবে বা অন্যকিছু নিয়ে ভেবে আর নিজের সময় নষ্ট করবো না আমি। এখন শুধু নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই ভাববো। পরীক্ষাটা শুধু দেই। চলে যাবো আমি এখান থেকে। আব্বু আম্মুর কাছে গিয়েই থাকবো। দরকার নেই আমার ওনার সাথে থাকার। এখন আমার পুরো ফোকাস শুধু পড়াশোনাতেই থাকবে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি। হঠাৎ আপি এসে পাশে দাঁড়ালো। আমি আপির দিকে তাকাতেই আপি আমার হাতে একটা কফির মগ ধরিয়ে দিলো। আমি ওটা হাতে নিয়ে আবারও বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আপি বলল,

— ” কী ব্যাপার বলতো? বিকেলে ঘুমাসনি?”

— ” ঘুম আসেনি আজকে আর আপি।”

আপি বেশ অবাক কন্ঠে বলল,

— ” আদ্রিয়ান বকবে তো?”

আমি বাইরে তাকিয়েই কফির মগে চুমুক দিয়ে বললাম,

— ” কী আর করার? বকলে বকুক?”

আপি রেলিং এ ভর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী হয়েছে কী তোর বলতো? কেমন যেনো হয়ে গেছিস তুই। আগের মতো আদ্রিয়ানের নিন্দে করিসনা, ওর নামে নালিশ করিস না। একদম চুপচাপ হয়ে গেছিস। কোনো সমস্যা হয়েছে?”

— ” তেমন কিছু না। কী আর হবে? ওনার নামে নালিশ করে ওনাকে বকে কী হবে বলোতো? থাকতে তো ওনার সাথেই হবে।”

আপি ভ্রু কুচকে বলল,

— ” এভাবে বলছিস কেন?”

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

— ” ছাড়োতো আপি। আচ্ছা তোমরা হানিমুনে যাবেনা? বিয়ের তো ছয় মাস হয়ে গেলো।”

আপি মুচকি হেসে বলল,

— ” তোর ইফাজ ভাইয়া বলেছে যেদিন আদ্রিয়ান যেতে রাজি হবে সেদিনই আমরা যাবো সবাই মিলে।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

— ” এটা কোনো কথা হলো? তোমরা নিজেদের মতো করে পার্সোনাল সময় কাটাবে আমাদের জন্যে বসে আছো কেনো?”

আপি একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” তোর সমস্যা কোথায় জানিস? সবসময় একলাইন বেশি বুঝিস।”

— ” ঠিকই তো বললাম।”

— ” হ্যাঁ সে অনেক ঠিক বলেছো। এবার বলতো প্রিপারেশন কেমন চলছে?”

— ” হ্যাঁ ভালো।”

আপি একটু পিঞ্জ করে বলল,

— ” হ্যাঁ সেই বর এতো যত্ন করে ধরে ধরে পড়াচ্ছে যে।”

আমি কিছু না বলে একটু হাসলাম। এরপর দুজনে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে নিচে চলে গেলাম। সবার সাথে কথা বলতে।

রাতে আপি আর জাবিনের সাথে গল্প করে নিজের রুমে যাচ্ছি তখনই বাবা মামনীর রুমে কথা শুনে থেকে গেলাম। বাবা আদ্রিয়ানকে বলছেন,

— ” আদ্রিয়ান সবকিছুর সীমা থাকে। মেয়েটা তোমার কাছে একটু এটেনশন চায়। একটু ভালোবাসা চায়। কিন্তু তুমি তোমার ব্যবহারে ওকে বারবার কষ্ট দিচ্ছো।”

মামনী বলল,

— ” দেখ ও বাচ্চা মেয়ে। টিনএজেরার বলতে গেলে। এমন সময় ওদের মনেও তো নানারকম স্বপ্ন ঘুরপাক খায়। তুই যদি এমন করিস মেয়েটার কেমন লাগে? তোরতো উচিত ওকে খুশি রাখা। কিন্তু তু..”

আদ্রিয়ান মামনীকে থামিয়ে বলল,

— ” এটাই তফাত তোমাদের আর আমার মধ্যে। তোমরা সবকিছু সাময়িকভাবে দেখো, চিন্তা করো। তোমরা শুধু সাময়িক আনন্দটা দেখো। কিন্তু আমি আগে পরে কী হতে পারে, কোন কাজের কীএফেক্ট করতে পারে সব বিবেচনা কর তবেই কাজ করি। ওর প্রতি আমার আসল দায়িত্বটাই পালন করছি।..”

আমি আর না শুনেই চলে এলাম ওখান থেকে। বারবার এই দায়িত্ব দায়িত্ব শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। হ্যাঁ উনি আমার কেয়ার করেন কিন্তু এই দুই মাসে একবার চোখ তুলে ঠিক তাকায়ও নি আমার দিকে। শুধু রোবটের মতো আমার প্রতি নিজের ডিউটি করে গেছে। এভাবে আর কতদিন চলতে পারে?

__________________

আরো একমাস কেটে গেছে। কাল মেডিকেল এডমিশন এক্সাম। তাই বই এর মধ্যে খুব মনোযোগ দিয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছি। রাতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আদ্রিয়ান আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে বন্ধ। হয়েছে এখন ঘুমিয়ে পরো। আমি একটু হাই তুলে বললাম,

— ” আরেকবার রিভাইস দেবো প্লিজ।”

আদ্রিয়ান বইগুলো সব গোছাতে গোছাতে বলল,

— ” কোনো দরকার নেই। দরকারে সকালে তাড়াতাড়ি ডেকে দেবো এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো।”

আমি বেশ অবাক হলাম যেই ছেলেটা রোজ আমার চোখে মুখে বারবার পানি দিয়ে জাগিয়ে রেখে একটা/দুইটা অবধি পড়াতো। সে আজ ঘুমাতে বলছে? কালকে এক্সাম বলে? আচ্ছা উনি ঠিক কী চান? শুধু নিজের দায়িত্বগুলো পালন করেই নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন? এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন,

— ” কী হলো শুয়ে পরো।”

আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে তারপর শুয়ে পরতেই উনিও বইগুলো সব টেবিলে গিয়ে রেখে বেডে এসে উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে পরলেন। আজ কেনো জানিনা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি যে ওনাকে ভালোবাসি বা ওনার প্রতি দুর্বল তা কিন্তু না। শুধু বিয়ের পর থেকে স্বামী হিসেবে একটু টান অনুভব হয়। কিন্তু খারাপ লাগে এটাই নিজের স্বামী কাছে আমি শুধুই দায়িত্ব। যেটা জোর করে সবাই চাপিয়ে দিয়েছে ওনার ওপর। এরচেয়ে বেশি কষ্টের কী হতে পারে। আমি উল্টো দিকে মুখ করে শোয়া ছিলাম। আস্তে করে ওনার দিকে ঘুরে কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,

— ” আদ্রিয়ান?”

উনি পেছনে না তাকিয়ে উল্টোদিকে মুখ করেই বললেন,

— ” হুম?”

— ” একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

— ” চুপচাপ ঘুমাও।”

আমি করুণ স্বরে বললাম,

— ” প্লিজ?”

আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

— ” আচ্ছা বলো।”

আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম,

— ” আমার জায়গায় যদি আপনার পছন্দের কোনো মেয়ে থাকতো? তারপ্রতিও কী শুধুই এভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতেন?”

আদ্রিয়ান এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তরপর বললেন,

— ” সবসময় মাথায় এসবই ঘোরে? ঘুমাও।”

কথাগুলো কঠোর হলেও বলার ওনার টোনটা বেশ ধীর ছিলো। আমি বিনয়ের সুরে বললাম,

— ” প্লিজ। বলুননা?”

— ” না। আমার উত্তর ‘না’। হয়েছে?”

ওনার মুখে না শোনার সাথে সাথেই আর কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছেটাই আর রইলোনা। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকাতে চাইছি। ওনার তো দোষ নেই। উনি তো নিজের জায়গায় ঠিক। উনি তো ইচ্ছে করে বিয়ে করেন নি বরং আমাকে এসে বলেওছিলো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে আমিই অযথা জেদ দেখিয়েছিলাম। তবুও নিজের কোনো দায়িত্বের অবহেলা করেন নি উনি। সব করছেন আমার জন্যে। উনি নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করলে হয়তো খুব সুখি হতেন। আমিও আর ওনার কাছে বোঝা হয়ে থাকবোনা। কালকে পরীক্ষাটা দিয়েই চলে যাবো। খুব ভালো করে পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে। কালকে পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর আমার আর কোনো প্রেশার থাকবে না, টেনশনও থাকবেনা, ফ্রি হয়ে যাবো। এরপর আর ওনার জীবনে অশান্তি বাড়াতে ফিরবোনা। কখনো আসবোনা ওনাকে আর জ্বালাতে।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২১
.
আমি বারবার বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি। আপি দুবার খাওয়ার জন্য নিচে ডেকেছে কিন্তু আমি যাই নি। যতোই পড়ছি আমার মনে হচ্ছে ততই ভুলে যাচ্ছি। কিছুতেই মনে শান্তি পাচ্ছি না।প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। সারারুম জুড়ে হাটছি আর বই দেখছি। চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে খেয়াল নেই আমার। হঠাৎ আমার মুখের সামনে কেউ খাবার ধরল। আমি মুখটা সরিয়ে বললাম,

— ” এখন খাবো না আমি। আমার এখনও পড়া হয়নি কিছুই।”

বলে আবারও এগিয়ে এলাম। কিন্তু আবারও আমার সামনে খাবার ধরতে আমি আবারও সরে এলাম। কিন্তু একটু পর আবারও আমার মুখের সামানে খাবার ধরল আমি আর না করলাম না চুপচাপ খেয়ে নিলাম। আমি টেনশনে হাটতে হাটতে পড়ছি আর বারবার আমার মুখের সামনে খাবার ধরছে আর আমি খেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু হঠাৎই আমার মাথায় চারা দিয়ে উঠল যে কে খাইয়ে দিচ্ছে আমায়? পাশে তাকিয়ে তো আমি পুরো চমকে গেলাম। আদ্রিয়ান আমায় খাইয়ে দিচ্ছেন। আমি মুখে খাবার নিয়ে থম মেরে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

— ” কী হলো? মুখের টা শেষ করো?”

এরপর আবার নিচে তাকিয়ে পরোটা ছিড়তে ছিড়তে বললেন,

— ” তুমি এখনও বাচ্চাই রয়ে গেলে অনি। আমি নিজে কতবার রিভাইস করিয়েছি তোমায়। তবুও টেনশন করেই যাচ্ছো? তাড়াতাড়ি শেষ করো খাবারটা। আর একজায়গায় বসে নাও তোমার পেছনে হেটে হেটে খাওয়াতে খাওয়াতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।”

বলে আমার হাত ধরে বেডে বসিয়ে দিলেন উনি। আর আমায় খাইয়ে দিতে শুরু করলেন। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কজন স্ত্রীর এরকম স্বামীভাগ্য হয়? বেশিরভাগ স্ত্রীর জীবন তো স্বামীর সেবা করতেই কেটে যায়।অথচ আমার স্বামী শুধু আমার সেবা নেন তা কিন্তু না প্রয়োজনে নিজেও আমার সেবা করেন। আমার সব প্রয়োজন বোঝেন। খুব কী ক্ষতি হতো যদি এইসব কিছু শুধুমাত্র দায়িত্বের খাতিরে না করে মন থেকে আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে করতেন। না না আমি আবার কেন এসব ভাবছি? আমি তো ঠিক করেই নিয়েছি উনি যখন আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানবেনই না কোনোদিন তখন ওনাকে আর দায়িত্বের জালে আটকে রাখবোনা। সব ব্যবস্হাতো করেই ফেলেছি এবার আজই চলে যাবো আমি এখান থেকে। উনি আমার সামনে তুরি বাজাতেই নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। উনি ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী এতভাবছো? শেষ করো?”

আমি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে নিলাম। উনি আমায় খাইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

— ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। সময় নেই। আর টেনশন করোনা যা হবে ভালো হবে।”

নিজের অজান্তেই আমি মাথা নিচু করে ধীরে বলে উঠল,

— ” আমার খুব ভয় করছে।”

এটা শুনে উনি যেতে নিয়েও থেমে গেলেন। প্লেট টা টি-টেবিলে রেখে এসে আমার সামনে বসে আমার দুই বাহু ধরে বললেন,

— “তোমার প্রিপারেশন যথেষ্ট ভালো। আমি নিজে পড়িয়েছি তোমায়, তাই জানি। আর মেডিকেলের প্রশ্ন অতোটাও কঠিন হয়না। আর তোমার তো দুইশ মার্ক এমনিতেই হাতে আছে। এখন শুধু হান্ড্রেটে যদি তুমি মোটামুটি এইটিফাইভ এর মতো তুলতে পারো। দেন তোমার মেডিকেলে তো চান্স হবেই, ঢাকা মেডিকেল অলমোস্ট কনফার্ম। আর এইটি ফাইভ তোলার মতো প্রিপারেশন তোমার আছে। আমি বলছি।”

আমি ওনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই ছেলেটা দুদিন আগেও আমায় ধমকাচ্ছিল। আমি নাকি মন দিয়ে পড়াশোনা করছি না। এভাবে পড়লে লাস্ট দিকের কোনো মেডিকেলেও চান্স হবেনা। সেই ছেলেটা আজ এসব বলছে? তাহলে এতোদিন এভাবে বলছিল কেন? সত্যিই ওনাকে বোঝা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে ওনার কথায় অজান্তেই মনে অনেক সাহস পেয়েছি। এখন কেন জানিনা নিজেকে খুব কনফিডেন্ট লাগছে। উনি আমায় রেডি হতে বলে চলে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেড়িয়ে এলাম। দেখলাম উনিও রেডি হয়ে গেছেন। একটা এস কালার ফুল হাতা গেঞ্জি, ব্লাক জিন্স, কপালে পরে থাকা সিল্কি চুল, গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সব মিলিয়ে অসাধারন লাগছে ওনাকে। এই তিনমাসে প্রতিদিন নতুন নতুনভাবে ক্রাশ খেয়েছি ওনার ওপর। কখনও ওনার আফটার শাওয়ার লুকে, আবার কখনও এলোমেলো ঘুমন্ত মুখ দেখে। হুটহাট করেই ক্রাশ খেয়ে যাই একেকসময় ওনার একেক লুক দেখে। উনিই প্রথম ব্যক্তি যাকে দেখে আমি ক্রাশ খেয়েছি। কিন্তু বলা বাহুল্য এটা কিন্তু শুধুই ক্রাশ এর চেয়ে বেশি কিছু না। রেডি হয়ে আমরা দুজনেই একসাথে নিচে চলে এলাম। সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে চলে গেলাম। গাড়িতে আর কেউ কারও সাথে কথা বলিনি। পরীক্ষাকেন্দ্রে উনি নিজেই নিয়ে গেলো আমাকে। সিট খুজে দিয়ে নিজে হলে পৌঁছে দিয়েছে। আমার আর ইশুর সিট এক হলেই পরেছে। কিন্তু অরু আর ঐশির সিট আলাদা আলাদা হলে। এরপর যখন পরীক্ষার্থী ছাড়া বাকি সবাইকে থেকে সবাইকে বেড়িয়ে যেতে বলল তখন উনি আমার কাছে এসে বললেন,

— ” একদম টেনশন করবেনা। কিছু কিছু কোয়েশচন থাকবে যেগুলো এন্সার তুমি পারবেনা। কিন্তু জানো মজার ব্যাপার কী? সেগুলো অলমোস্ট কেউই পারবেনা। তাই ঘাবড়ানোর কিচ্ছু নেই। একঘন্টা অনেক সময়। যেগুলো পুরোপুরি শিউর থাকবে শুধু সেগুলোই আগে এন্সার করবে। যেটা একেবারেই মনে নেই সেটা ছেড়ে দেবে। নেগেটিভ মার্কিং যেনো ভুলেও বেশি না হয়। হাইপার হবেনা একদম মাথা ঠান্ডা রেখে এক্সাম দেবে। আমি বাইরে ওয়েট করছি। ওল দা বেস্ট।”

বলে আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে, ইশুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” এডভাইসগুলো কিন্তু তোমার জন্যেও ছিল।”

ইশু মুচকি হাসলো। আদ্রিয়ানও একটু হেসে চলে গেলেন। আমি ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজকের পর ওনার এইসব কেয়ারিং এতো যত্ন আর পাবোনা। খুব মিস করবো এসব। স্পেশিয়ালি ওনার ধমকগুলোকে।

একঘন্টা কর পরীক্ষা শেষ হলো। ইশু আর আমার দুজনের পরীক্ষাই বেশ ভালো হয়েছে। বেড়িয়ে দেখি অরু আর ঐশি দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদের কাছে গিয়ে বললাম,

— ” কীরে এক্সাম কেমন হলো?”

অরু হেসে বলল,

— ” বেশ ভালোই হয়েছে এখন বাকিটা আল্লাহর হাতে। ”

ঐশিও একই কথা বলল। আমরা চারজন মিলে বেড়িয়ে পাকিং এড়িয়াতে গিয়ে দেখি উনি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই উনি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুতপদে আমার কাছে এসে বললেন,

— “পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সব ঠিক আছে কোনো প্রবলেম হয়নি তো? কোয়েশচন কেমন ছিলো?”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। ভেতরে আমাকে এতো এতো সাহস দিয়ে এলেন কিন্তু এখন এমন মনে হচ্ছে যেনো আমার চেয়ে বেশি টেনশন উনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছিলেন। উনি আমাকে চুপ থাকতে দেখে উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,

— ” কী হলো বলো? ভালো হয়নি?”

আমি হালকা হেসে বললাম,

— ” কুল। বেশ ভালো হয়েছে এক্সাম।”

— ” শিউর?”

— ” হ্যাঁ একদম।”

উনি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। অরু একটু পিঞ্চ করে বলল,

— ” এটা কিন্তু ঠিক না জিজু পরীক্ষা কিন্তু আমরা চারজনেই দিয়েছি। মানছি ও আপনার বউ তাই বলে শালিকাদের একটু জিজ্ঞেস করবেন না?”

আদ্রিয়ান হেসে বললেন,

— ” আমি তো জানি তোমাদের সবারই হবে। এমনিতেই তোমাদের দুহান্ড্রেট এমনিতেই আছে। অার তোমরা তো ওর মতো ফাঁকিবাজও নও।”

ফাঁকিবাজ কথাটা শুনে আমার বেশ রাগ হলো। উনি আমাকে ফাঁকিবাজি করতে দিয়েছেন নাকি? তবুও কিছু বললাম না মুখ ফলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

— ” আচ্ছা তোমরা কিছু খাবে?”

আমি হুট করেই বলে উঠলাম,

— ” ফুচকা খাবো। অনেকদিন খাইনা। প্লিজ।”

উনি হেসে দিলেন। কিন্তু ওনার হাসির কারণটা বুঝলাম না। আমি এভাবে ফুচকা চাইলাম বলে হাসলেন নাকি? উনি হাসি থামিয়ে বললেন,

— ” আচ্ছা চলো সবাই।”

এরপর ফুচকার দোকানে গিয়ে উনি বললেন,

— ” মামা চার প্লেট ফুচকা দিন। একটা কম্প্লিটলি ঝাল ছাড়া।”

আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম। আমি যে একদমি ঝাল খেতে পারিনা এটা ওনার মনে আছে? আপির বিয়ের শপিং করতে গিয়ে একদিন প্রচন্ড ফুচকাতে ঝাল খেয়ে ফেলেছিলাম। সামান্য ঝালেই চোখ মুখ লাল হয়ে গেছিল আমার। আমার গায়ের রং শ্যামলা। শ্যামলা আর উজ্জল শ্যামলার মাঝামাঝি টাইপ আরকি। তাতেই মুখ এতো লাল দেখাচ্ছিল। যদি ওনার মতো ফর্সা হতাম তাহলে তো কথাই থাকতোনা। সেদিন উনি খুব বকেছিলেন আমায়। যে কেয়ারফুল থাকিনা কেন? আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম ওনার এতোটা রেগে যাওয়ার কী ছিল সেটাই জানিনা আমি। ওনার ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম। উনি আমার হাতে ফুচকার প্লেট টা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

— ” কোথায় এতো হারিয়ে যাও বলোতো?”

ইশু হেসে দিয়ে বলল,

— ” আরে এটাও বোঝেন না জিজু? সারাদিন তো আপনার চিন্তাতেই মগ্ন থাকে।”

আদ্রিয়ান কিছু না বলে শুধু একটু হাসলেন। ঐশি বলল,

— ” আপনি খাবেনা জিজু?”

ফোন স্ক্রল করতে করতে বললেন,

— ” তোমরা খাও আমি খাইনা এসব।”

হুহ। খাইনা এসব। এসব ভালো জিনিস কেনো খাবে? খাবেতো ঐ ব্লাক কফি, ফ্রুটস এর মতো উদ্ভট খাবার। ফুচকা খেয়ে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে উনি সিটবেল্ট খুলে দিয়ে বললেন,

— ” আমি একেবারে রাতে আসবো। কিছু খেয়ে রেস্ট করো।”

আমি মাথা নেড়ে নেমে এলাম। উনিও গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলেন। রাতে এসে আমায় আর দেখতে পাবেন না উনি। এখন বাড়ি চলে যাবো তারপর বিকেলে সোজা গ্রামে মামা বাড়িতে। ওনাকে আর আমার দায়িত্বের বোঝা বইতে হবেনা। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আমি ব্যাগ গোছাচ্ছি আর আপি রুম জুরে হাটছে। আপি আমার কাছে এসে বলল,

— ” অনি আমার কথা শোন। আর কটা দিন থেকে দেখ?”

আমি জামা ভাজ করতে করতে বললাম,

— ” তিনমাস তো দেখলাম আপি আর কতো? আর তোমাকে তো আমি আগেই বলে দিয়েছি সব। আমার পক্ষে অার সম্ভব নয়।”

আপি কিছু বলল না মুখ গোমড়া করে আমায় হেল্প করতে লাগল। কারণ জানে কোনো লাভ হবেনা। তিনচারদিন যাবতই বুঝিয়েছে আমায়। কিন্তু আমিতো ঠিক করেই নিয়েছি। সব গুছিয়ে রেডি হয়ে নিচে চলে গেলাম। মামনী আমায় জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলো। বাবাও অনেকবার বলল থেকে যেতে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। ওনাদের সবাইকে ম্যানেজ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

___________________

আমি সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছুক্ষণ নিরবতার পর আম্মু রাগী কন্ঠে বললেন,

— ” সবকিছুই ছেলেখেলা তোমার কাছে? চলে এসছো মান কী? ও তোমার স্বামী ওটা তোমার শশুর বাড়ি ভুলে গেছো?”

আমি কিছু বলছিনা। আব্বু এবার আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— ” আচ্ছা মামনী ও বাড়িতে কেউ কী খারাপ ব্যবহার করেছে তোমার সাথে? বা আদ্রিয়ান কিছু বলেছে তোমায়? কোনোভাবে হার্ট করেছে?”

আমি মাথা নেড়ে না করলাম। আম্মু বলল,

— ” তাহলে সমস্যা কী? যে একেবারে সব ছেড়ে চলে এলে?”

আমি অসহায় দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” আমি বোঝাতে পারবোনা আপনাদের। কিন্তু আমি আর ঐ বাড়িতে যাবোনা। প্লিজ আপনারা জোর করবেন না আমায়।”

আম্মু কিছু বলবে তার আগেই আব্বু আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

— ” আচ্ছা ঠিকাছে। তুমি এখন নানু বাড়ি যেতে চাও তো? যাও গিয়ে কদিন ঘুরে এসো। পরের টা পরে দেখা যাবে।”

সজীব ভাইয়া বলল,

— ” আমরাই নিয়ে যাই ওকে। আমাদেরও অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়না। এখন আমার অফিসও বন্ধ আর অর্ণবের ভার্সিটিও। গিয়ে ঘুরে আসি। আব্বু আম্মুও খুশি হবে। বুড়ি যা রেডি হয়ে আয়।”

অর্ণব ভাইয়া বলল,

— ” হ্যাঁ আমিও ব্যাগ গোছাচ্ছি।”

আম্মু বলল,

— ” মানে কী তোমরাও ওর মতো বাচ্চা হয়ে গেলে?”

আব্বু বলল,

— ” আরে যাচ্ছে যাক। কটাদিন ঘুরে আসতে সমস্যা কী? তুমি রুমে এসো কথা আছে তোমার সাথে।”

আমি চুপচাপ রেডি হতে চলে গেলাম। রাত নটার পর গিয়ে পৌছালাম নানু বাড়িতে আমায় দেখে মামারা মামী নানু সবাই খুব খুশি হয়েছে। বিশেষ করে নানু। কিন্তু সবার একটাই প্রশ্ন জামাই কই? জামাই কেনো আসেনি? নানু তো জামাই কই জামাই কই করতে করতে অস্হির। একন ওনাদের কীকরে বলি ওনাদের জামাইর কাছে যাবোনা বলেই তো এখান আশা। কথা কোনোভাবে এড়িয়ে গেছি। আমরা টায়ার্ড হয়ে এসছি তাই ওনারা বেশি প্রশ্ন করেননি। রাতে খেয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পরলাম। রাত বেশ অনেক হয়েছে। শুয়ে শুয়ে ভাবছি আচ্ছা আদ্রিয়ান তো এতোক্ষণে চলে এসছে বাড়িতে তাইনা? আমায় না পেয়ে কী করছেন? খুজছেন আমায়? নাকি বাঁচা গেছে ভেবে শান্তির ঘুম দিচ্ছেন? ফোনটাতো সেই বিকেলেই সুইচড অফ করে রেখে দিয়েছি। আমি থাকা বা না থাকায় সত্যিই কী ওপার কিছু যায় আসছে? উনার কাছে তো শুধু দায়িত্ব আমি, দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলে সবার ভালো লাগে ওনারও লাগছে নিশ্চয়ই? না লাগারতো কারণ নেই। আমি শুধু শুধু ভাবছি ওনায় নিয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে একরাশ মন খারাপ নিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পরলাম।

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২২
.
সকালে রোদের আলো চোখে পরতেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। কাল রাতে অনেক ক্লান্ত থাকায় বেশ গভীর ঘুভে তলিয়ে গেছিলাম। রোদের তাপে বেশ বুঝতে পারছি যে বেলা হয়ে গেছে অনেক। কেউ এখনও আমায় ডাকলোনা কেন? একটা ছোট্ট হাই তুলে উঠে বসে আড়মোড়া দিয়ে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলাম। এতই চমকালাম যে লাফানোর স্টাইলে পিছিয়ে গেলাম। নিজের দুচোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? আদ্রিয়ান আমার পাশে বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখছে। একটা কালো রং এর চিকন স্লিভস এর গেঞ্জি, আর কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছেন। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, চোখেমুখে একরাশ ক্লান্তির ছাপ।নিশ্চিয়ই আমি স্বপ্ন দেখছি। নইলে এটা কীকরে সম্ভব? আদ্রিয়ান এখানে কীকরে আসবেন? আর কেনই বা আসবেন। আমি প্রথমে চোখ কচলে দেখলাম যে না সেই একই দৃশ্য, এবার হাতে হালকা করে চিমটি কাটলাম। আর মুখ দিয়ে হালকা “আহ” টাইপ শব্দ করে উঠলাম। আমার এমন আওয়াজে উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে। ওনাকে দেখে হালকা চমকে উঠলাম আমি। ওনার চোখ মুখ সব লাল হয়ে আছে। দাঁড়িগুলো একটু বড় হয়েছে। এই দুদিন সেভ করেন নি নাকি? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ফোনটা রেখে। বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

— ” ওহ ম্যাডাম তাহলে উঠে গেছেন নাকি? আপনারই ওঠার অপেক্ষা করছিলাম।”

বলে উঠে গিয়ে দরজাটা লক কর দিলেন। আমি এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম। উনি দরজা বন্ধ করা মানেই আমার বারোটা বাজাবে। আমিও উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” অ্ আপনি এখানে? আপনি এখানে কী করছেন হ্যাঁ? কেনো এসছেন এ বাড়িতে ? কী চাই?”

উনি আমার কথাটা শুনে ঠোঁট কামড়ে ধরে আমার চোখ সরিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” আরে বাহ। মুখেতো বুলি একেবারে খইয়ের মতো ফুটছে।”

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ওনার চোখে মুখে তীব্র রাগ স্পষ্ট। তাই ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস করে উঠতে পারলাম না। উনি আমার কাছে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন,

— ” কার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে এখানে এসছো তুমি?”

আমি মাথা তুলে ওনার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি এবার আগের থেকে একটু উচ্চস্বরে বললেন,

— ” কী হলো বলো? আমাকে কিচ্ছু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে চলে এলে তাও একা একা। তারপর এখানে চলে এসছো সেটা নিজেতো আমাকে জানাওই নি। উল্টে নিজের বাবা মাকে বলে এসছো ভুল করেও যাতে আমায় না জানায় তুমি কোথায় এসছো? সিরিয়াসলি? ভাগ্যিস বউমনি আমায় বলল যে তুমি এখানে থাকতে পারো। নইলে এতক্ষণে মেন্টাল হসপিটালে থাকতাম আমি।”

আমি ওনার দিকে আর তাকানোর সাহস পাচ্ছিনা যেভাবে রেগে আছেন না জানি কী করে বসেন। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু হাত কচলে যাচ্ছি। উনি এবার বেড থেকে আমার ফোনটা তুলে হাতে শক্ত কন্ঠে বললেন,

— “ফোন সুইচড অফ করে কেনো রেখেছিলে হ্যাঁ? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া কতোবার কল করেছি তোমায় আমি? তোমার সাহস কীকরে হয়।”

বলে ফোনটা ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দিলেন। ওনার আচরণে যথেষ্ট ভয় পেলেও মনের মধ্যে একটু সাহস জুগিয়ে হালকা তুতলিয়ে বললাম,

— ” অ্ আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই এসছি। আপনা..”

কথাটা শেষ করার আগেই।আমার হাত ধরে এক টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে গিয়ে কোমর খুব জোরে চেপে ধরে দাঁতেদাঁত চেপে বলল,

— ” খুব বেশি ইচ্ছে হচ্ছে তোমার আজকাল? ডানা গজিয়ে গেজে? তোমার যা ইচ্ছে হবে করবে তাইনা? কানের নিচে জোরে কয়েকটা পরলে সব ইচ্ছে বেড়িয়ে যাবে। এতো সাহস তোমার যে আমাকে কিচ্ছু না জানিয়ে এখানে চলে এসছো?”

আমি এবার নিজের ভয়টাকে দমিয়ে দিয়ে ওনার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে বললাম,

— ” কেনো বলবো আপনাকে? কে হন আপনি আমার? কীসের জোর খাটাচ্ছেন আমার ওপর?”

উনি ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আরেকহাত আমার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে বললেন,

— ” অা’ম ইউর হাজবেন্ট। স্বামী হই আমি তোমার। বিয়ে হয়েছে আমাদের। তোমার ওপর সমস্ত রকমের জোর খাটানোর অধিকার আছে আমার। আর সবকিছুই তোমার আমার সাথে ডিসকাস করেই করা উচিত।”

আমি ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

— ” অধিকার নয়। বলুন দায়বদ্ধতা। আমাকে সবাই জোর করে আপনার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে তাই হয়তো আপনি নিজের দ্বায় সারতে চাইছেন? আমি আপনার দায়িত্ব তাই এখানে দেখতে এসছেন আমি ঠিক আছি কী না তাইতো? যদি সেটাই হয় দেন ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আপনাকে এই দায় থেকে মুক্ত করে দিলাম। আজকের পর আপনাকে আর আমায় নিয়ে ভাবতে হবেনা। আপনি আপনার মতো ফ্রি লাইফ লিড করতে পারেন।”

বলে আমি ওনার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে উনি আমায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,

— ” একলাইন বেশি বেশি না বুঝলে তোমার হয়না তাইনা?”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

— ” বেশি বুঝেছি তাও আমি? কিন্তু এজ পার আই নো। আমি কোনোকিছু বেশি বা কম বুঝিনি। আমি সেটুকুই বুঝেছি যেটুকু আপনি আমায় বলেছেন। আপনি বলেননি আমি শুধুই আপনার দায়িত্ব? বলেন নি যে আমার জায়গায় অন্যকেউ মানে আপনার পছন্দের কেঊ থাকলে আপনি এরকম করতেন না। তাহলে আপনার দয়া নিয়ে কেনো থাকবো আমি আপনার কাছে? আমার কী কোনো সেল্ফরেস্পেক্ট নেই?”

কথা গুলো বলার সময় আমার গলা ধরে আসছিল। আর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কেঁদে দিয়েছি আমি। উনি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে তারপর মুচকি হেসে আলতো হাতে আমার চোখের জল মুছে দিয়ে আমার দুই বাহুতে হাত রেখে বললেন,

— ” বলেতো ছিলাম ঠিকই। কিন্তু কী বলোতো? এখন ভেবে দেখলাম বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন আর এসব করে কী লাভ? এরকম.. কী জেনো বলো তুমি? হ্যাঁ সুইট কিউট ভোলিভালি একটা বউ যখন পেয়েছি তখন আর নো ছাড়াছাড়ি। সোজা তুলে নিয়ে গিয়ে বুকের পিঞ্জিরায় বন্দি করে রেখে দেবো।”

আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কী বলতে চাইলেন উনি? উনি কী সত্যিই আমায় মেনে নিতে চাইছেন? নাকি এটাও দায়বদ্ধতা মনে করেই করছেন? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,

— ” এবার যাও তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে রেডি হয়ে নাও। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পরবো।”

আমি কিছু একটা ভেবে হকচকিয়ে বললাম,

— ” নাহ আমি কোথাও যাবোনা। আপনি চলে যান।”

উনি ওনার সেই বিখ্যাত স্টাইলে ভ্রু বাকিয়ে বললেন,

— “যেতে তো হবেই বেইবি। সেটা আজ যাও বা কাল। তুমি যদি তোমার মামাবাড়িতে কয়েকটা দিন বেড়াতে চাও তো বেড়াও কে বারণ করেছে? কিন্তু আমিও আমিও আমার মামা শশুর বাড়িতে ততোদিন থাকবো যতোদিন আমার বউ থাকবে।”

আমি বিরক্তি নিয়ে কোমরে দুই হাত রেখে বললাম,

— ” নতুন করে কী ড্রামা শুরু করলেন বলুন তো? মতলব কী আপনার?”

আদ্রিয়ান আমার চুল নেড়ে দিয়ে বললেন,

— ” মতলব তো অনেক কিছুই। কিছু বাকিটা রাতে বলবো। আপাতত চলো খিদে পেয়েছে কাল রাত থেকে না খেয়ে আছি জানো? প্লিজ বাকি প্রশ্ন পরে করো এখন খেতে চলো। ”

উনি না খেয়ে আছে শুনে একটু খারাপ লাগলো। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ডাইনিং এ গেলাম।

____________________

ডায়নিং টেবিলে মুখ ফুলিয়ে বসে বসে ব্রেকফাস্ট করছি আমি। আদ্রিয়ান আমার পাশেই বসেছেন। মামী বলল,

— ” বাপরে বাপ। কী বউ পাগল ছেলে রে বাবা।একটা রাতের জন্যেও বউকে ছেড়ে থাকতে পারলোনা? জানিস সেই ফজরের আজানের সময় এসছে এখানে। আরে সকালেও তো রওনা দেওয়া যেতো তাইনা। কিন্তু না পাগল ছেলে রাতেই বেড়িয়ে গেছে।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। ভোররাতে এসে পৌছেছে এখানে পাগল নাকি ছেলেটা? নানু বলল,

— ” কীরে অনু আমার নাতজামাই তো তোকে চোখে হারায়। এমন করে একা ফেলে চলে এলি? বেচারা একটা রাতও থাকতে পারেনি দেখলি।”

আমি কিছু বলল তার আগেই আদ্রিয়ান,

— ” আসলে কী বলোতো সুইটহার্ট ? তোমার নাতনি একটু বেশিই বাচ্চা। একটু বেশিই বোঝে। দেখো আমি ওর মন মতো একটু কাজ করতে পারিনি তাই বলে আমার মতো একটা অসহায় অবলা ছেলেকে একা ফেলে চলে এল।”

আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি অসহায়? অবলা? আর এখন সব দোষ এই নন্দ ঘোষের? বাহ রে ভাই বাহ। আর কী কী দেখতে হবে। নানু বলল,

— ” অনু এটা কিন্তু একদম ঠিক করোনি তুমি। ছেলেটার সারারাত জেগে চোখ মুখের কী অবস্থা হয়েছে দেখো?”

মামা হেসে বলল,

— ” আমিতো আগেই বলেছিলাম নিশ্চয়ই তোমার নাতনি ছেলেটার সাথে ঝগড়া করে এসছে। তাইতো ওই মাঝরাতেই ছেলেটা চলে এলো”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

— ” কে বলেছে কে আসতে? চলে যেতে বলোনা? আমি এখান থেকে যাবোনা। আর আমি আমার মামা বাড়িতে কতোদিন থাকবো সেটা আমার চয়েজ। উনি বলার কে?”

আদ্রিয়ান খাবার চিবুতে চিবুতে বললেন,

— ” হ্যাঁ আমিও থাকছি তাহলে?”

— ” কেনো আপনি কেনো থাকবেন?”

উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

— ” আমি আমার মামাশশুর বাড়িতে কতোদিন থাকবো সেটা আমার চয়েজ। তুমি বলার কে? রাইট সুইটহার্ট?”

নানু হেসে বললেন,

— ” একদম। তোমারও তো পুরো হক আছে।

আমি অবাক হয়ে তাকালাম দুজনের দিকে। সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, মামা, মামী নানু সবাই মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। আদ্রিয়ানকে ভালো ভালো বেড়ে খাওয়াচ্ছে আর সে আরাম করে খাচ্ছেন। পুরো দমে জামাই আদর যাকে বলে সেটাই হচ্ছে। অথচ আমার ভ্যালুই নেই? আমি ভ্রু কুচকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি। আজব! তাছাড়া করবে না কেনো? মহান কাজ তো। সারারাত না ঘুমিয়ে জার্নি করে ভোররাতে বউয়ের কাছে চলে এসছে? এটাতো সম্রাট শাজাহানের তাজমহল তৈরীর চেয়ে কোনো অংশে কম কিছু মোটেই না। আহা! কেমন একটা মমতাজ মমতাজ ফিলিংস আসছে। যদি আমার মামার বাড়ির লোকেরা ঐতিহাসিক হতেন তাহলে নিশ্চিত আজকের এই ঘটনা নিয়ে তারা ইতিহাস রচনা করে ফেলতেন। এটা সত্যিই এক ঐতিহাসিক কান্ড। ফিলিং প্রাউড। হুহ যত্তোসব ধপের চপ। ডিসগাস্টিং।

#চলবে…

( রি-চেইক করার সময় হয়নি। টাইপিং মিস্টেকগুলো কষ্ট করে বুঝে নেবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে