ভালোবাসি তোকে পর্ব-২+৩

0
5923

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩
.
আমি ধীরপায়ে ওনার দিকে একটু এগিয়ে গেলাম। উনি এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি একটু কেশে আমার উপস্থিতি জানান দিলাম। কিন্তু উনি কোনো রিঅ্যাকক্ট করলেন নাহ। আমি জানি যে উনি সকালে ঘুম থেকে উঠে কফি খান। জিজ্ঞেস করবো? না বাবা পরে আবার বকলে? এসব নানারকম কথা ভাবতে ভাবতেই ভেতরে চলে এলাম। খাটে হেলান দিয়ে বসে ব্যালকনির দরজার দিকে তাকিয়ে আছি, যদিও ওনাকে দেখা যাচ্ছে না তবুও দরজার দিকে তাকিয়েই এক অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছি। ওনাকে ডেকে পরে সেই রাম ধমক খাওয়ার শখ আমার একদমই নেই। সেই প্রথম দিন থেকে ওনার রাম ধমক খেয়ে খেয়েই অভ্যস্ত আমি। আমার বাবা মার কাছেও এতো ধমক খাইনি যতোটা ধমক আমি এই লোকটার কাছে খেয়েছি। এইতো আপির বিয়ের কিছুদিন আগের কথা-

টেস্টের রেসাল্ট দেবে আজকে সেই নিয়ে এমনিতেই ভীষণ টেনশনে আছি। রেসাল্ট বিকেল তিনটায় দেবে। আমি সকাল থেকেই চিন্তায় কোনো কাজ ঠিককরে করতে পারছিনা। মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক পাস করবো তো? রি-টেইক দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আপি বসে আছে। আমাকে দেখেই বলল,

— ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”

আমি টাওয়েলটা রেখে বললাম,

— ” যাবো তো কলেজে তাতে আবার রেডি হওয়ার কী আছে? যেটা পরে আছি তাতেই হবে।”

আপি নিজের ইয়াররিং পরতে পরতে বলল,

— ” আরে আজ বিয়ের শপিং করতে যাবোতো। ও বাড়ি থেকে জাবিন, আদ্রিয়ানরা এসছে। আর তোর জিজুও এসছে।”

শেষের কথাটা আপি লজ্জায় লাল হয়েই বলল। মাঝখানে এই কথা দিনে ফোনে টুকটাক কথায় ওদের দুজনের খুব ভালো বন্ডিং তৈরী হয়ে গেছে। আমার সাথেও। ইফাজ ভাইয়া আমাকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে। প্রথমে শপিং এর কথা শুনে খুশি হলেও আদ্রিয়ান ভাইয়ার কথা শুনে যাওয়ার ইচ্ছেটাই শেষ হয়ে গেলো। প্রথম দিনেই যেভাবে ধমকেছিলো আমাকে ওনার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে আমার আর নেই। তাই মুখ গোমড়া করে বললাম,

— “তোমরা যাও। আমি যেতে পারবোনা আমার টেস্টের রেসাল্ট দেখতে যেতে হবে।”

আপি আমার মাথায় একটা চাটা মেরে বলল,

— ” আরে গাধি আগে তোর রেসাল্ট দেখবো তারপর শপিং এ যাবো।”

আমি চোখ বড় বড় করে আপির দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” মানে কী? মানে ইফাজ ভাইয়ারা ওবাড়ির ওরা সবাই মিলে যাবে আমার রেসাল্ট দেখতে।”

আপি নিজের ওড়নাটা সেট করে নিয়ে বলল,

— ” আরে রেসাল্ট তো টানানোই থাকবে। জাস্ট দেখে চলে আসবো বাস। তুই তাড়াতাড়ি আয়।”

বলে চলে যেতে নিলেই আমি হাত ধরে আটকে নিয়ে বলল,

— ” আপি! আপি! আপি! প্লিজ আমার কথাটা শোনো, একটু শোনো। ওনাদের সামনে যদি আমার রেসাল্ট এসে পরে তারওপর যদি ফেইল করি তাহলে আমার মান সম্মান আর কিছুই থাকবে না।”

আপি কিছুক্ষণ বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,

— ” তুই ফেইল করবি? সেটাও আবার সম্ভব? এমন হয়েছে কোনোদিন?”

— ” হয়নি কিন্তু তাই বলে হবেনা তারতো কোনো মানে নেই তাইনা?”

আপি এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল,

— “বেশি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রেডি হয়ে আয়তো। লাঞ্চ করব সবাই একসাথে। ময়নাপ্পি বকতে শুরু করবে নইলে।”

বলে বাইরে চলে গেলো। আমি অসহায় এর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোনো উপায় না পেয়ে রেডি হয়ে নিলাম। রেডি হয়ে বাইরে এসে দেখি ডাইনিং টেবিলে সবাই বসে আছে। ইফাজ ভাইয়া, জাবিন, আর ঐ খবিশটাও আর ওনার সাথে যেই দুজন ছেলে বসে থাকে তারাও আছেন। সেদিন ওনাদের নামও জানতে পেরেছি একজনের নাম আদিব আরেকজনের নাম ইশরাক। আমি চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াতেই জাবিন উঠে এসে আমায় জরিয়ে ধরল। মেয়েটা এমনিতে খুব ভালো। যেমন সুন্দর দেখতে ঠিক তেমনই সুন্দর ব্যবহার। ও মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,

— ” কেমন আছো? জানো কতোটা মিস করেছি তোমাকে?”

আমি একটু অবাক হলাম। আমাকে দেখেছেই তো এনগেইজমেন্ট এর দিন এরমধ্যেই মিস করেছে? অদ্ভূত! আমিও মুখে একটা মুচকি হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— ” ভালো। তুমি ভালো আছো?”

— ” ভীষণ।”

কথাটা বলে চেয়ারে বসে পরল। আমি আপির পাশের চেয়ারটায় বসে ইফাজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ভ্রু নাচিয়ে বললাম,

— ” কী জিজু? কেমন আছো?”

ইফাজ ভাইয়া হেসে বলল,

— ” সকাল সকাল যদি শালিকার মিষ্টি চেহারাটা দেখতে পাই তাহলে আর খারাপ থাকি কীকরে?”

আমি একটু হাসলাম। তারপর আদ্রিয়ান ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনিও আমার দিকে তাকালেন আমি মুচকি হেসে বললাম,

— “ভালো আছেন?”

উনি মুখে হালকা একটু হাসি ফুটিয়ে মাথা দুলিয়ে খাওয়ায় মন দিলেন। খবিশ আমাকে জিজ্ঞেস করলে কী হতো? বাট হাসতে দেখে একটু অবাক হলাম উনি হাসতেও পারে? অারে বাহ! পরে আদিব আর ইশরাক ভাইয়ার সাথে একটু কুশল বিনিময় করে খাওয়া শুরু করলাম খেতে খেতে সবাই বেশ ইনজয় করেছি মজার ব্যাপার আদ্রিয়ান ভাইয়াও আমাদের জয়েন করেছেন। যেটা দেখে খুব বেশিই অবাক হয়েছি আমি। তবে ইশরাক ভাইয়া মানুষটা খুব মজার ছিলেন। এই অল্প সময়ের সবার সাথে দারুণভাবে মিশে গেছেন।এরপর সবাই মিলে বেড়িয়ে গেলাম। আমি, আপি, আদ্রিয়ান ভাইয়া, ইফাজ ভাইয়া, ইশরাক ভাইয়া, আদিব ভাইয়া, অর্নব আর সজীব ভাইয়া। কাব্য স্কুলে আছে তাই ও এখন যাবেনা ও আমার কলেজের স্কুলেই পরে তাই ওখান থেকে পিক করে নেবো। সবাই বিভিন্ন কথা বলে মজা করতে করতে যাচ্ছে কিন্তু আমিতো ভীষণ টেনশনে আছি। মনে মনে একটা কথাই বলছি আল্লাহ প্লিজ আমার প্রেজটিজটা এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও। এসব ভাবতে ভাবতেই ইফাজ ভাইয়া ফ্রন্ট সিট থেকে বলে উঠলো,

— ” কী ব্যাপার অনি ম্যাডাম এতো চুপচাপ যে।”

আমি অসহায়ভাবে তাকালাম ইফাজ ভাইয়ার দিকে। আপি হাসতে হাসতে বলল,

— ” আরে ওর রেসাল্ট নিয়ে টেনশনে আছে। ওর ধারণা ও ফেইল করবে।”

এটা শুনে সবাই আমায় সাহস দেওয়ার মতো কথা বললেও আদ্রিয়ান ভাইয়া ড্রাইভ করতে করতে বললেন,

— ” ফেইল করার মতো পরীক্ষা দিয়েছে তাই এমন মনে হচ্ছে। যদি ঠিকঠাক পরীক্ষা দিতো তাহলে অন্তত পাশ করার মতো কনফিডেন্স টা থাকতো। ”

যেটুকু সাহস সঞ্চার করেছিলাম আদ্রিয়ান ভাইয়া তার রফাদফা করে দিলো। ইফাজ ভাইয়া ওনাকে ধমকে বলল,

— ” তুই চুপ করবি। বেচারী এমনিতেই টেনশনে আছে।”

আদ্রিয়ান ভাইয়া মুচকি হাসতে হাসতে বললেন,

— ” ভুল কী বললাম? এটুকু কনফিডেন্স যখন নেই তখন সিউর ফেইল করবে।”

এবার সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। সবাই বুঝতে পারলো উনি আমাকে জ্বালানোর জন্যেই এমন করছেন। আমি কিছুই না বলে হাত ভাজ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। ওনার ওপর খুব বেশিই বিরক্ত আমি এই মুহূর্তে। কলেজের সামনে আদ্রিয়ান ভাইয়া গাড়ি থামিয়েছেন। কিন্তু আমি কিছুতেই নামছি না। সবাই বলছে নামার জন্যে কিন্তু আমি এতোটাই টেনশনে আছি যে নামতেই পারছিনা। আপি বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” অনি প্লিজ চল দেখিস ভালোই হবে।”

আদ্রিয়ান ভাইয়া এবার রেগে আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,

— ” এখানে কী তোমার নাটক দেখতে এসছি আমরা? আচ্ছা হিয়া ওর রোল টা বলো আমি গিয়ে দেখে আসছি আর কাব্যকেও নিয়ে আসছি।”

আপি ওনাকে আমার রোলটা বলার সাথেসাথেই উনি গাড়ি থেকে নেমে চলে গেলেন। আমার এবার আরো টেনশন হচ্ছে উনি দেখতে যাচ্ছেন? না জানি কী হয়েছে রেসাল্ট। টেনশনে শক্ত হয়ে বসে আছি। প্রায় দশ মিনিট পর উনি ফিরে এলেন সাথে কাব্যও। চোখে মুখে একরাশ গাম্ভীর্যতা। আমার এবার ভয়ে কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। আপি বলল,

— ” কী হলো কী হয়েছে রেসাল্ট?”

সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ান ভাইয়ার দিকে। উনি একটা গম্ভীর শ্বাস ফেলে বলল,

— ” কী আর হবে যা হওয়ার তাই হয়েছে।”

আমিতো এবার কেঁদেই দিয়েছি। আপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আদিব ভাইয়া বলল,

— ” এই দেখ আদ্রিয়ান একদম দুষ্টুমি করবি না মেয়েটা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে।”

সবাই আদ্রিয়ান ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করছে। আমি এবার শব্দ করেই কেঁদে দিলাম। নির্ঘাত ফেইল করেছি তাইতো এভাবে বলছে। আদ্রিয়ান এবার একটু ধমক দিয়ে বললেন,

— ” এই চুপ। এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে হবেনা। ফেইল করেননি আপনি আবার ফার্স্ট ও হননি। থার্ড হয়েছেন।

সবাই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো। আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি। ওনার ধমকে এমনিতেই ভয় পেয়ে গেছি। বাদর ছেলে একটা আমাকে এভাবে ভয় দেখালো? আপি হেসে জরিয়ে ধরলো আমাকে। ইফাজ ভাইয়া আদ্রিয়ানের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল,

— ” বান্দর। মেয়েটাকে কাঁদিয়ে ছাড়লো।”

আদ্রিয়ান ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট করতে করতে বলল,

— ” একচুয়ালি যারা একটু ভালো স্টুডেন্ট হয় রেসাল্টের সময় অলওয়েজ একটা নেকামি করতেই থাকে। ফেইল করবো,ফেইল করবো। পরে দেখা যায় এনারাই ফার্স্ট,সেকেন্ড,থার্ড হয়ে বসে আছে। আরে এতো ভালো এক্সাম দিয়েও ফেইল করবো এটা কীকরে মনে হয়? লজিকটা কী ভাই? আমিও তো কলেজ টপার ছিলাম এমনতো কখনো মনে হয়নি।”

ইশরাক ভাইয়া বললেন,

— ” তুমিতো হানড্রেট পার্সেন্ট সিউর থাকতা মামা। অবলা তো ছিলাম আমরা কী হবে সবচাই ধোঁয়াশা ছিলো।”

অর্নব ভাইয়া আমায় পিঞ্চ করে বলল,

— ” ও এরকমি ভাইয়া ছিচকাঁদুনি।”

আমি রেগে তাকালাম অর্নব ভাইয়ার দিকে। কাব্য তাল মিলিয়ে কিছু বলবে তার আগেই সজীব ভাইয়া বলল,

— ” এই চুপ করো সবাই ওকে আর কেউ জ্বালিয়োনা এমনিতেই অনেক ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা।”

কেউ কিছু বলল না। আমি নাক ফুলিয়ে বসে আছি একটু পর পর ফোঁপাচ্ছি। ব্যাটা খবিশ আমাকে ইনডিরেক্টলি নাটকবাজ বলল। সবাই মোটামুটি খুশি আমার রেসাল্টের কথা শুনে, আমিও খুশি কিন্তু কান্না থামাতে পারছিনা তখন খুব বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে এভাবে ফোঁপাতে দেখে আদ্রিয়ান ভাইয়া বললেন,

— ” থাক কাঁদেনা বাবু। সামনের আইসক্রিম পার্লার থেকে আইসক্রিম কিনে দেবো। এবার চুপ করো।”

সবাই হেসে দিলো ওনার কথায়। আমি কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থেকে নিজেও হেসে দিলাম। এরপর সবাই মিলে অনেক মজা করে শপিং করেছি। ইশরাক ভাইয়ার মজাগুলো তো আছেই। আদ্রিয়ান ভাইয়াকেও নতুনভাবে জেনেছি। প্রথম দেখায় ঠিক যেমন ভেবেছি উনি পুরোটা তেমন না। উনি বেশ রাগী হলেও বোরিং আর একঘুয়ে নাহ। পরিস্থিতি অনুযায়ী বিহেভ করতে জানেন। সবার সাথে মিশতে হাসিমজা যেমন করতে পারেন, আবার রেগে যাওয়ার সময় ভীষণ রাগতেও পারেন। একদম পার্ফেক্ট পার্সোনালিটি যাকে বলে আরকি।

হঠাৎ দরজা নক করার শব্দে কল্পনা থেকে বেড়িয়ে এলাম। দরজার ওপাশ থেকে মামনী মানে আমার শাশুড়ি মা নিচে যেতে বলে চলে গেলেন। আদ্রিয়ান ভাইয়া এখনো রুমে আসেননি। আমি কোনোরকমে তৈরি হয়ে নিচে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি মা আর বড় মা কিচেনে কাজ করছেন। কাল বাড়িতে আসার পরেই ওনারা করা নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন এসব আন্টি ফান্টি বলে ডাকা যাবেনা। আদ্রিয়ান ভাইয়া যেমন ওনাদের মা বা মামনী আর বড় মা বলে ডাকেন আমাকেও ওই নামেই ডাকতে হবে। আর আপিও ওনাদের হেল্প করছে। এই কয়েকমাসে এই বাড়িটাকে নিজের করে নিয়েছে আপি। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে নিজের সংসার। আসলে ও বরাবরই খুব রেসপন্সিবল একটা মেয়ে তাই এটাই স্বাভাবিক। সেদিক দিয়ে আমি একেবারেই অগোছালো আর খাপছাড়া। আমি যেতেই মামনী এসে আমাকে ধরে ভেতরে কিচেনের নিয়ে গেলো তারপর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,

— ” কীরে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো তোর এখানে?”

আমি উত্তরে একটা মলিন হাসি দিলাম। মামনী হয়তো এই হাসির অর্থ বুঝতে পারলেন তাই আমাকে বুকে জরিয়ে ধরে বললেন,

— ” জানি মা আমরা তোর ওপর অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়েছি। এই ছোট্ট কাধে অনেক বড় দায়িত্ব ঝুলিয়ে দিয়েছি কিন্তু চিন্তা করিসনা দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বড় মাও একি কথা বললেন। আপির দিকে তাকাতেই দেখি আপির দৃষ্টি আমার কাটা হাতটার দিকে। ওর চোখ ছলছল করছে হয়তো অনুমান করে ফেলেছে যে কাল রাতে আমার সাথে কী হয়েছে। আমি আপির দিকে তাকিয়ে একটা শান্তনার হাসি দিলাম ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরোটা বেলায় মন দিলো। হয়তো এখন আমার মনের অবস্থা জানে তাই কিছু বলতে চাইছেনা। মামনী আমার হাতে একটা কফির মগ ধরিয়ে আদ্রিয়ান ভাইয়াকে দিয়ে আসতে বললেন। আমিও ভাবছিলাম বলবো তার আগেই মামনী দিয়ে দিলো। কফিটা নিয়ে রুমে গিয়ে দেখি উনি খাটে হেলান দিয়ে কপালে এক হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে উনি ঘুমান নি। তাই ওনার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম,

— ” শুনছেন।”

বলার সাথে সাথে উনি ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। আবার আমার হাতে বা গায়ে কফি ছুড়ে মারবে না তো? মনে অনেকটা সাহস জুগিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” আপনার কফিটা।”

উনি ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই কফির মগটা হাতে নিলেন। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হঠাৎ ছুড়ে ফেলে দিলেন কফির মগটা। আমি সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম। না আমার গায়ে মারেনি। এমন এঙ্গেলেই মেরেছে যেদিক দিয়ে আমার গায়ে লাগার কোনো সম্ভাবনা নেই। উনি চট করেই উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো আমিও ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। উনি চেঁচিয়ে বললেন,

— ” কতোবার বলতে হবে স্টে এওয়ে ফ্রম মি? কতোবার? সহজ কথা বোঝোনা বলো? বোঝোনা? ”

ওনার একেকটা ধমকে কেঁপে উঠছি আমি। উনি এখন এগোচ্ছেন আর আমার এখনও কান্না পাচ্ছে কিন্তু আমি কাঁদবোনা ওনার সামনেতো একদমি নাহ। উনি এবার আমার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে বললেন,

— ” কে বলেছিলো আমার জন্যে কফি আনতে? বউ সাজতে এসছো? এই বয়স কতো তোমার? একটা বাচ্চা মেয়ে এখনো আঠারো পেরিয়েছে কী পেরোয় নি আমার বউ হতে এসছে। তোমাকে বলেছিনা একদম বউগিরি দেখাতে আসবেনা? আরেকবার যদি দেখি তো..”

উনি বুঝতে পারছেন কীনা জানিনা তবে উনি আমার সেই কাটা হাতটাই চেপে ধরে আছেন।অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। অবাধ্য একফোটা জল গড়িয়ে পরলো চোখ দিয়ে। উনি এবার একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” কেনো আমার পেছনে পরে আছো হ্যাঁ? কেনো? কেনো চলে যাচ্ছোনা? কাল রাতে ওরকম ব্যবহার করার পরেও কেনো সকালে উঠেই চলে গেলেনা? এতুটুকু আত্নসম্মান নেই তোমার? কেনো বুঝতে পারছোনা আমি যা বলছি তো.. আমাদের ভালোর জন্যে বলছি। আমি তোমাকে কোনোদিন নিজের বউ হিসেবে মানবোনা। কতোদিন থাকবে এভাবে তুমি? খুব দেরি হয়ে যায়নি এখনো। নিজেও মুক্ত হয় আর আমাকেও মুক্তি দাও তোমার কাছ থেকে। জাস্ট গেট লস্ট।”

বলে উনি একটা টাওয়েল নিয়ে হনহনিয়ে ওয়াসরুমে গিয়ে ধরাম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। আমিও ধপ করে সোফায় বসে পরলাম। ওনার সামনে নিজেকে শক্ত রাখলেও এখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। উনি হয়তো সজ্ঞানে আমার ওপর শারীরিক কোনো টর্চার করছেন না কিন্তু মানসিকভাবে যেই আঘাতগুলো দিচ্ছেন সেটার মাপটাও কী বুঝতে পারছেন না?

#চলবে…

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪
.
আমার চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কখনো ভাবিনি যে আমার সাথে এরকম হবে। আমার কাছে আমার আত্মসম্মান অনেক কিছু কিন্তু তবুও শুধুমাত্র আব্বু আম্মুর কথা ভেবেই চুপচাপ সবটা সহ্য করছি। কিন্তু কতোদিন? কেনো করছেন উনি আমার সাথে এরকম? উনি কী অন্যকাউকে ভালোবাসেন? তাহলে সেটা ওনার বাবা মাকে কেনো বলেন নি? আমি বাবা আর মামনীকে যতোটা চিনি তাতে ওনাদের একবার বললেই রাজী হয়ে যেতেন আদ্রিয়ান ভাইয়ার পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে দিতে। তো সমস্যাটা কোথায় হলো? আর সবাই মিলে আমায় বলির পাঠা কেনো বানালো? তবে যাই হোক আমাকে শক্ত হতে হবে। বিয়ে যখন হয়েই গেছে আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার। এসব ভাবতে ভাবতেই ওয়াসরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে নিলাম। উনি শাওয়ার নিয়ে এসছেন। আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আফটার শাওয়ার লুকে চরম লাগছে। একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর নীল চিকন স্লিভস এর গেঞ্জি পরে আছেন, শরীরে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে, এমনিতেই সবসময় ওপার চুল কপালে পরে থাকে আর ভিজে চুলগুলো আজ আরো বেশি করে পরে আছে। উফ এতো সুন্দর কেনো উনি? সবসময় ঘায়েল করে ছাড়ে। ফোনের রিংটোনে ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। ওনার ফোন বাজছে। উনি হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ফোনটা হাতে নিয়েই স্ক্রিনে কী দেখলেন জানিনা ওনার চোখে মুখের বিষন্নতার ছাপ আবারও দেখা দিলো। আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। কে ফোন করেছে যে আমার সামনে কথা বলতে পারছেননা। যা খুশি করুক আমার কী? আমি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে ওয়াসরুমে ঢুকে দেখলাম ওনার পোশাক ভিজিয়ে রেখে দিয়েছেন। ভাবলাম ধুয়ে একটু রোদে দিয়ে আসি। নিজের জামাও কোনোদিন ধুই নি আমি কিন্তু আজ ওনার পোশাক ধোয়ার জন্যে কাউকে বলতেও হলোনা, এমনিতেই সেই ইচ্ছে চলে এলো মনের ভেতর। কেনো সেটা নিজেও জানিনা। মাত্র একটা গেঞ্জি আর প্যান্ট এটুকুর জন্যে ছাদে যেতে হবেনা তাই ওগুলো ধুয়ে ব্যালকনি শুকোতে দিতে যাবো কিন্তু ওনাকে ফোনে কথা বলতে শুনে থেমে গেলাম। উনি ফোনে বলছেন,

— ” আরে এভাবে কান্নাকাটি কেনো করছো? প্লিজ কান্না থামাও। তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আমার ভালো লাগছে? আমি আসছি আজ দেখা করতে।”

ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। উত্তরে উনি বললেন,

— ” না আমি এই বিয়ে মানি, আর না ওকে আমার বউ হিসেবে মানি। এসব কথা বাদ দাও।”

আমার এবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আমার সাথে কতো রুডভাবে কথা বলে আর কোথাকার কোন শাকচুন্নির সাথে কতো নরম করে কথা বলছে। নিশ্চয়ই গার্লফ্রেন্ড। এই মেয়ের জন্যেই আমাকে মেনে নিচ্ছে না। হুহ। উনি ফোন রেখে পেছন ঘুরে বেড়োতে নিয়ে আমাকে দেখে থেমে গেলো আমিও একটু চমকে গেলাম। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে সাইড কাটিয়ে গিয়ে রেলিং এর ওপর ওনার গেঞ্জি আর প্যান্ট মেলে দিলাম। উনি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওগুলো মেলে আমি ওনার পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,

— ” কী চাই তোমার? যতো করে বলছি আমার বউ হওয়ার চেষ্টা করোনা ততোই তুমি যেচে পরে অধিকার ফলাতে চলে আসছো। যতোই বলছি চলে যাও আমার লাইফ থেকে ততোই তুমি জেকে বসছো এই বাড়িতে। এবার বলোতো ঠিক করে কী চাই তোমার? ব্লাঙ্ক চেইক তো ধরিয়ে দিয়েছিলাম তোমার হাতে আর কী চাই? আমার নামের যতো প্রপার্টি আছে সব লিখে দেবো তোমার নামে? তাহলে ছাড়বে আমায়? তাহলে বলো সেটাই করবো আমি। আজকেই করবো। তবুও প্লিজ চলে যাও আমার লাইফ থেকে।”

এবার আমার কষ্টের চেয়ে বেশি রাগ লাগছে। কান্না করছি আমি তবে কষ্টের চেয়ে বেশি রাগে। সবকিছুরই একটা সীমা থাকে, যেটা এখন পার হয়ে গেছে। আমি হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে ওনার বুকে একটা ধাক্কা মেরে বললাম,

— ” কী পেয়েছেনটা কী হ্যাঁ? যা ইচ্ছে তাই বলবেন ? কাল রাত থেকে সহ্য করছি আমি। কারণ আপনি এখনো ডিপ্রেসড আছেন। বাট এভ্রিথিং হ্যাজ আ লিমিট। আর আপনি আপনার লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন। বারবার টাকা প্রপার্টি এসব বলে কী বোঝাতে চাইছেন? আমি লোভী? টাকার লোভে বিয়ে করেছি আপনাকে? আপনার ক্যারিয়ার সম্পত্তি দেখে বিয়ে করেছি? আপনি কোথাকার সাধু হ্যাঁ ? বিয়ে তো আর একা একা করা যায়না তাইনা? এখন আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি কেনো বিয়ে করেছেন আমাকে? আপনার ভাষ্যমতে একটা বাচ্চা মেয়েকে? আমার তো টাকা প্রপার্টি তেমন কিছুই নেই। তাহলে কী শরীরের জন্যে?”

উনি অনি বলে চিৎকার করে আমাকে চড় মারতে গিয়েও থেমে গেলেন। তবে আমি আজ ভয় পাইনি কেনো জানিনা এক অদ্ভুত সাহস চলে এসছে আমার মধ্যে। আমি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,

— ” থামলেন কেনো? কাল রাত থেকে তো কম করেননি আমার সাথে। এটা আর বাকি থাকবে কেনো? মারুন?”

উনি হাত নামিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে চলে যেতে নিলেই আমি ওনার হাত ধরে আটকে নিয়ে বললাম,

— ” দাঁড়ান! আমার কথা শেষ হয়নি এখনো। ইশরাক ভাইয়ার ব্যপারটা নিয়ে আপনি ডিপ্রেসড আমি জানি সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার সাথে আপনার পরিবার, বিয়ে এসবের কী সম্পর্ক? কেনো একটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আপনি নিজের সাথে নিজের পরিবারের জীবনটা দুর্বিষহ করে দিচ্ছেন? ইশরাক ভাইয়া চলে গেছেন, কিন্তু আপনি কেনো থেকেও নেই বলবেন? উনি ওনার পরিবার, স্ত্রীকে যেই কষ্টটা না চাইতেও দিয়েছেন, আপনি কেনো ইচ্ছে করে জেনে শুনে আপনার পরিবারকে অাপনার স্ত্রীকে সেই একি কষ্ট দিচ্ছেন? নাকি এগুলো সব বাহানা? এক্চুয়ালি আপনার মনে অন্যকেউ আছে তাই ইচ্ছে করে সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে ফ্রি হতে চাইছেন। যাতে আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে নিয়ে আসতে পারেন তাইতো?”

উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

— ” তার কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেবো না।”

আমি একটা শ্বাস ফেলে বললাম,

— ” দিতে হবে না। আর আমি চাইছিও না। কিন্তু কাল থেকে এই বিয়েটার জন্যে আপনি আমাকে ব্লেম করে যাচ্ছেন। আমি যাতে চলে যাই, আমাকে বউ হিসেবেই কখনো মানবেন না। আচ্ছা কাবিননামায় যখন সই করেছিলেন তখন কেউ আপনাকে জোর করে সই করিয়েছিলো নাকি কবুল বলার সময় কেউ আপনার মাথায় বন্দুক ধরে রেখেছিল?বলুন? বিয়েটাতো আপনিও করেছেন ? এই বিয়েটা করে যদি আমি অপরাধ করে থাকি তাহলে সমান অপরাধ তো আপনিও করেছেন তাইনা? যেখানে আপনি নিজেও সমান অপরাধী সেখানে আমাকে ব্লেইম করার কোনো অধিকার আপনার নেই। আর হ্যাঁ আপনি যদি এখন এটা বলেন যে আপনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন দেন ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচতে নাচতে আপনাকে বিয়ে করিনি, তখন আপনার কথায় জেদ করে সবার সামনে ওমন ড্রামা করলেও পরে আমি আব্বুকে বলেছিলাম আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা কিন্তু.. যাই হোক আমিও বাধ্য হয়েই আপনাকে বিয়ে করেছি। তাই পরেরবার আমার সাথে মিসবিহেভ করার আগে ভেবেচিন্তে করবেন যে সেটা কতোটা যুক্তিসঙ্গত।”

উনি একটু অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাত ভাজ করে চোখ সরিয়ে নিলাম। উনি কিছু না বলে ভেতরে গিয়ে গেঞ্জির ওপর একটা শার্ট পরে চলে গেলেন বাইরে। উনি চলে যেতেই আমি জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম। বাপরে! আমার এতো সাহস? কবে থেকে হলো? আমি ওনার চোখে চোখ রেখে এতোগুলো কথা বললাম? আর এমন বলা বললাম যে ওনার বলতি বান্ধ? বাহ! কেয়া বাত হ্যাঁ। এসব ভেবে খুশি মনে নিচে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি নাস্তা প্রায় রেডি। আমাকে দেখে মামনী বললেন,

— ” আরে তুই নেমে এসছিস। তোকেই ডাকতে পাঠাচ্ছিলাম। আয় বসে পর।”

আমি মুচকি হেসে আপির পাশে গিয়ে বসলাম। আমি দাদী শাশুড়ি বললেন,

— ” কীগো নাত বউ আজ তো তোমার নিচে নামার নামই নিচ্ছিলে না। আমার নাতী ছাড়ছিলো না বুঝি?”

আমি দিদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম কিন্তু কিছু বললাম না আসলে খুব লজ্জা লাগছে। আপির দিকে তাকাতেই আপি চোখের ইশারায় কিছু বলতে চাইছে কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ দীদা বলে উঠলেন,

— ” বাহবা এতো লজ্জা? আমার নাতী তো আদর করে তোকে একেবারে লাল নীল বানিয়ে ফেলেছে রে।”

আমি চমকে গেলাম। দীদার হঠাৎ এসব বলার কারণটা বুঝতে পারছিনা। বাকি সবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আপির দিকে তাকাতেই আপি চোখের রাঙিয়ে ইশারায় আমার ঘাড় গলা ঢাকতে বলল। আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম তাড়াতাড়ি শাড়ির আচল আর চুল দিয়ে ঢেকে নিলাম। জাবিন একটু হেসে বলল ,

— ” এখন আর ঢেকে কী হবে ভাবী। যা দেখার সবতো আমরা দেখে..”

হঠাৎ করেই বড় আব্বু একটু কেশে এটা জানান দিলেন যে আমরা বড়রাও এখানে আছি মুখে একটু লাগাম দাও। আমি তো লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছিনা। কোনোরকম খেয়ে উঠে চলে এলাম ওখান থেকে। রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম গলায় হাতে লাল লাল র‍্যাশ হয়ে আছে। আসলে রাতে গহনা পরে ঘুমানোর জন্যেই এমন হয়েছে। হয়তো গয়নাগুলো মাঝরাতে উঠেই খুলেছিলাম। গায়ে র‍্যাস হলো গয়নার জন্যে আর সবাই ভাবলো যে উনি আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছেন আমাকে। হাহ্ কতো আদর করেছে তাতো আমি জানি। আমার স্কিন একটু সেনসিটিভ। তাই গহনার ঘষা বা যেকোনো রকম প্রেশার পরলে র‍্যাস উঠে যায়। এই র‍্যাস এর জন্যে যা হয়েছিলো। সেদিনের কথা মনে পরলেই ওনার ওপর যেমন রাগ হয় তেমন হাসিও পায়-

আপির গায়ে হলুদ ছিলো সেদিন। মাঝখানে একয়েকদিনে আদ্রিয়ান ভাইয়ারা অনেকবারই যাওয়া আসা করেছেন। ওনাদের সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে আমাদের। আদ্রিয়ান ভাইয়া সবসময়ই আমার পেছনে পরে থাকেন। মানে সুযোগ পেলেই লেগ পুল করা শুরু করেন। এতে যে উনি খুব মজা পান সেটা বোঝাই যায়। বাকিরাও ইফাজ ভাইয়া, আদিব ভাইয়া, ইশরাক ভাইয়া, জাবিন, আপি, ভাইয়ারা সবাই বেশ ইনজয় করে এটা। শুধু বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে রাখি আমি। তবে একটা জিনিস ভালো লেগেছে আদিব, ইশরাক আর আদ্রিয়ান ভাইয়ার অটুট বন্ধুত্ব। ওনাদের বন্ধুত্ব দেখে সত্যিই হিংসা হতো আমার। এতো ভালো ফ্রেন্ডশিপ জীবণে প্রথম দেখেছিলাম আমি। ছেলেদের পক্ষ থেকে লোক এসে গেছে হলুদ আর বিভিন্ন কিছু নিয়ে। হলুদের পুরো অনুষ্ঠানে আদ্রিয়ান ভাইয়াদের সাথে দেখা হলেও তেমন কথা হয়নি। যা হয়েছে পরেও একটু হয়েছে। তো প্রোগ্রাম শেষে আপিদের সহ সকলকে নিয়ে একটা রুমে বসে উনি ফোন দেখছেন। আমার গলার হারটার কারণে র‍্যাস হয়ে গেছে অলরেডি তাই খুলে ফেলেছি। হঠাৎ করে খেয়াল করলাম আদ্রিয়ান ভাইয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি একটু অবাক হলেও সেদিকে পাত্তা দিয়ে আড্ডায় মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ উনি আপিকে বলে উঠলেন,

— ” হিয়া তোমার বোনকে যতোটা বাচ্চাটাইপ মনে হয় অতোটাও কিন্তু নয়।”

আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আপি অবাক হয়ে বলল,

— ” কেনো কী করেছে?”

উনি ওনার ফোনটা সাইডে রেখে বললেন,

—- ” না আসলে তোমার বোন এইযে এতো ভদ্র সেজে ঘোরে। তলে তলে কিন্তু ঠিকই ট্যাম্পু চালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই অনুষ্ঠানে বি এফ ও এসছে। ওর গলা ঘাড় দেখো?”

আপি একবার আমার গলার দিকে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিলো। বাকি সবাই তাল মিলিয়ে হেসে দিলো। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,

— ” আমি মোটেও তলে তলে টেম্পু চালাই না। আর এগুলো হার পরার কারণে র‍্যাস হয়েছে অন্যকিছু একদমি না। আর কোনো বি এফ টি এফ নেই।”

উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,

— ” যেটা পরলে স্কিনের এতো প্রবলেম হয় সেটা পরার কী দরকার?”

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।উনি তারপর আপির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,

— ” দেখেছো? আমি যা বলেছি তা কিন্তু ইঙ্গিতেই বলেছি কিন্তু উনি সব বুঝে গেছেন। এবার বুঝেছো এই পিচ্ছির মাথায় কী কী চলে।”

আমি একটা মুখ ভেংচি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম। ইশরাক ভাইয়া হেসে বললেন,

— ” বাট ভাই আজকাল তোর নজর এতো দিকে যাচ্ছে কেনো বলতো? আগে এতো দিকে তাকানোর সময় পেতি না? কেস কী?”

আদ্রিয়ান চোখ গরম করে ইশরাক ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি চুপ হয়ে গেলেন। সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। আর উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফোন দেখছেন। আমি পুরো লজ্জায় লাল হয়ে চুপ করে বসে ছিলাম তখন।

ঐদিনের কথা ভেবেই আনমনে হেসে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মামনী এসে আদ্রিয়ান ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করলো আমি অনেক অস্বস্তি নিয়েই বললাম জানিনা। সারাদিন ওনার কোনো দেখা পাইনি। কেউ আমায় ওনার কথা জিজ্ঞেস করে আর বিব্রত করে নি। কারণ নতুন বউ বাড়িতে রেখে হাজবেন্ট যদি সারাদিন বাইরে থাকে সেটা কোনো স্ত্রীর কাছেই ভালো লাগে না। আমার সারাদিন যে খুব খারাপ কেটেছে তাও নয় আপি, ইফাজ ভাইয়া সবার সাথেই খুব মজায় কেটেছে।

রাতে শুয়ে শুয়ে ওনার জন্যে অপেক্ষা করছি। সারাদিনে বাড়ি ফেরেননি ঠিক আছেন তো? নাকি যেই শাকচুন্নির সাথে সকালে কথা বলেছিলো তার কাছেই গেছে? যেখানে খুশি যাক আমার কী? হঠাৎ কিছুর আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দ‍েখি উনি। আমিও কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে রাখলাম যাতে উনি মনে করেন আমি ঘুমিয়ে গেছি। উনি চুপচাপ ওয়াসরুমে চলে গেলেন আমি ঘুরে একবার দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর উনি বেড়িয়েও এলেন। চোখ বন্ধ করেও আলাপ পেলাম উনি আমার পাশ থেকে বালিশ আর চাদর নিলেন। হয়তো এখনি সোফার দিকে যাবে। আমি এবার নিজেকে প্রস্তুত করলাম। তারপর মনে মনে কাউন্ট ডাউন শুরু করলাম, থ্রি, টু, ওয়ান। কিন্তু আফসোস, আমি ভেবেছিলাম উনি চেঁচিয়ে উঠবেন কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। একটু পর আলাপ পেলাম উনি আমাকে আস্তে করে ডাকছেন,

— ” অনি? অনি?”

আমি কিছুই জানিনা এমন একটা ভাব করে ঘুরে তাকিয়ে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললাম,

— ” কী হয়েছে কী এভাবে ডাকাডাকি করছেন কেনো? এখন কী ঘুমোতেও দেবেননা নাকি?”

আমাকে আরো অবাক করে নিয়ে উনি নরম কন্ঠেই বললেন,

— ” আমি বেডের একসাইডে ঘুমোলে তোমার কোনো প্রবলেম হবে? আসলে সোফাটা কীভাবে যেনো ভিজে গেছে।”

আমি ভুত দেখার মতো তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আসলে সোফায় পানিটা আমিই ফেলেছি যাতে করে উনি বাধ্য হয়েই বেডে এসে শোয়। কিন্তু আমিতো ভেবেছিলাম উনি রেগে যাবেন চেঁচামেচি করবেন বাট এতো শান্ত কীকরে? কোনো প্লান নেই তো? হঠাৎ আমার প্রতি এতো নরম হওয়ার কারণ? মনে একরাশ সন্দেহ নিয়ে আমি মুচকি হেসে বললাম,

— ” আগেই বলেছি বাকি অর্ধেক খাট আপনার। যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। আমাকে বলার কী আছে?”

উনি কিছু না বলে বেডের ওপর সাইডে শুয়ে পরলেন। কিন্তু মাঝখানে কোলবালিশের একটা বর্ডার দিতে ভোলেননি। ব্যাটা খবিশ বর্ডার দেওয়ার কী আছে আমি তো তোর বিয়ে করা বউ নাকি? আমি বলেছি বর্ডার দিতে? বেশি বেশি ফর্মালিটি হুহ। কতো স্বপ্ন ছিলো বরের বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো কিন্তু এই বেটা নিরামিষ তো মাঝখানে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার বানিয়ে বসে আছে। যত্তোসব।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে