#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৭
.
উনি একটা একটা করে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে আসছেন। আমারতো গলা শুকিয়ে পুরো কাঠ হয়ে আছে। আমার জানা মতে আমি তো এখন কিছুই করিনি। তাহলে? রেগে আছেন কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি শার্টের লাস্ট বোতাম টা খুলছেন। আমি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না, কথাগুলো সব গলাতেই আটকে যাচ্ছে আমার। উনি শার্ট টা খুলে সোফার ওপর ছুড়ে মারলেন। থ্যাংকফুলি নিচে চিকন স্লিভস এর হোয়াইট গেঞ্জি পরে আছেন। উনি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে টেনে বেড থেকে নামালেন। তারপর দুই বাহু ধরে নিজের কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— ” ফোন কোথায় তোমার?”
আমি একটু অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি এবার জোরেই বললেন,
— ” হোয়ার ইজ ইউর ফোন?”
আমি চমকে গেলাম। তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে দিলাম। উনি ফোনটা চেক করে বললেন,
— ” ফ্লাইটে করে কোথা থেকে এসছো? ইউ কে? ইউএসএ? নাকি ইন্ডিয়া? বলো?”
আমি ওনার কথার কোনো আগামাথা খুজে পাচ্ছিনা। তাই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললাম.
— ” ম্ মানে?”
উনি ফোনের স্ক্রিনটা সামনে ধরে বললেন,
— ” মানে ফোনটা যখন ফ্লাইট মুডে দেওয়া নিশ্চয়ই কোনো জায়গা থেকে ফ্লাইটেই এসছো? বলো?”
আমি আবার মাথা নিচু করে ফেললাম। ফোনটা ফ্লাইট মুডে কখন গেলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এতোক্ষণ গেমস খেলছিলাম আমি খেয়াল ও করিনি এসব। নিশ্চয়ই উনি কল করেছিলেন। এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বললেন,
— ” তোমাকে কী বলেছিলাম আমি?”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি বাহু চেপে ধরে রাগে কটমট করে বললেন,
— ” স্পিক আপ? কী বলেছিলাম আমি? একা বেড়োতে নিষেধ করেছিলাম না?বলেছিলাম না হয় আমি পিক করব নয়তো গার্ড পাঠিয়ে দেবো? বলেছিলাম?”
এবার বুঝলাম ওনার রেগে যাওয়ার আসল কারণ। শিট! আমার তো মাথাতেই ছিল না। ঐ কূপ না রূপ এর জন্যেই তো ওখান থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গেলাম। কিন্তু আমার তো মনেই ছিলোনা ওনার কথা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি ধমকে বললেন,
— ” কী হলো বলো বলেছিলাম?”
হালকা কেঁপে উঠলাম আমি। কাঁপাকাঁপা কন্ঠেই বললাম,
— ” জ্বী বলেছিলেন।”
— ” তাহলে আমাকে কিছু না বলেই একা একা বেড়িয়ে এলে কোন সাহসে? বলো!”
আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাই উঁচু আওয়াজে কেউ কথা বললে। কেউ আমাকে ধমকালে আমার ভয়ে হাতপা কাঁপতে থাকে। একটা ফোবিয়ার মতো হয়ে গেছে এটা। আর উনি যেভাবে ধমকাচ্ছেন তাতে আমার অবস্থা করুণ হয়ে যাচ্ছে। আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম,
— ” ব্ বেড়িয়ে আপনাকে দেখতে পাইনি তাই।”
— ” তাই ড্যাং ড্যাং করে চলে এলে? ওয়াও, অসাধারণ।”
আমি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে রেখেছি। এভাবে বকছেন কেনো আমায়? মানছি যে না বলে চলে এসছি। তাই বলে এভাবে বকাবকি করবে? খুব বেশি দূর তো না। আর আমি তো বাচ্চাও না যে এটুকু রাস্তা নিজে আসতে পারবোনা। উনি আমাকে ঝাকিয়ে বললেন,
— ” এখন চুপ হয়ে আছো কেনো বলো? নিজের খেয়াল খুশি মতো চলার ইচ্ছে হয়েছে তাইনা? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া আমার কতোটা টেনশন হচ্ছিলো। খুব মজা পাও অন্যকে টেনশনে ফেলে?”
আমি এতোক্ষণ ভয়ে মাথা নিচু করে রাখলেও এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আমাকে ছেড়ে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে উল্টে ধরলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” জানো কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? কারণ আমি জাস্ট দশ মিনিট লেট করেছি। তোমার যে এইটুকু লেট সহ্য হবেনা কে জানতো? তোমাকে এইজন্য আগেই ফোন করেছিলাম যে একটু ওয়েট করো আমার মিনিট দশ লেট হবে। কিন্তু তোমার ফোন তো লাগছিলোই না। লাগবে কীকরে? ওটাতো তখন উড়ছিল তাইনা? স্টুপিড কোথাকার।”
আমি মাথা নিচু করে মুখ ফুলিয়ে হাত কচলে যাচ্ছি। উনি আবারও বললেন,
— ” যখন গিয়ে দেখলাম তুমি নেই তখন তোমার নম্বরে কল করেও পেলাম না। বাড়ির নম্বরে কল করবো তখনই শুনলাম সামনে একটা রিকশা আর গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে। কোচিং এরই একজন মেয়ে স্টুডেন্ট। তখন আমার অবস্থা কী হয়েছিল জানো? ছুটে গিয়েছিলাম ওখানে। কিন্তু থ্যাংকফুলি ওটা তুমি ছিলে না। এরপর বাড়িতে ফোন করে জানলাম ম্যাডাম বাড়িতেই আছেন। বাড়িতে এসছো সেটা অন্তত আমায় জানাতে পারতে? মিনিমাম কমনসেন্স তো থাকে মানুষের তাইনা?”
আমার এবার একটু খারাপ লাগল আসলেই অন্তত জানানোটা উচিত ছিলো আমার। উনি জোরে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
— ” কী এমন তাড়া ছিলো শুনি?”
আমি একবার ওনার দিকে তাকিয়ে আবার মাথাটা নিচু করে বললাম,
— ” আসলে কালকের ঐ আঙ্কেল ছেলে এসে কথা বলছিল আমার ভালো লাগছিল না তাই…”
এটুকু বলে থেমে গেলাম। উনি এবার হাত ধরে নিজের একটু কাছে এনে বললেন,
— ” আজকের পর যদি আমার পার্মিশন ছাড়া কোথাও বেড়িয়েছো তাহলে যেটা করতে চাইনা সেটাই করতে বাধ্য হবো। বাড়িতে টিউটর রেখে কোচিং যাওয়াটাই বন্ধ করে দেবো। আর বাড়ি থেকে বেড়োনোটাও। ঘরবন্দি হয়ে থাকতে না চাইলে নেক্সট টাইম থেকে কেয়ারফুল থাকবে।”
এটুকু বলে আমার হাত ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে উনি হনহনে পায়ে বেড়িয়ে চলে গেলেন। রোজ আমাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে তবেই ওনার কাজে যায়। এখন হয়তো ওখানেই যাচ্ছেন। আমিও কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে একটা বই নিয়ে বেডে বসে পরলাম। ভীষণ রেগে আছে আমার ওপর। থাক গে তাতে আমার কী? কিন্তু খুব বেশিই রেগে আছে কী? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা। ধ্যাত। এইটুকু মাথায় এতো প্রেশার আর ভালো লাগে না।
__________________
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেড়ে একেবারে আপির রুমে চলে গেলাম। আপি বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে। আমি আপির পাশে বসে আপিকে জরিয়ে ধরে কাধে মাথা দিয়ে রইলাম। আপি ফোনটা রেখে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
— ” কী ব্যাপার মন খারাপ?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। আপি আড়চোখে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
— ” কেনো কী হয়েছে?”
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগের সুরে বললাম,
— ” তোমার দেবর বকেছে আমায়।”
— ” বকার মতো কাজ করলে তো বকবেই।”
আমি আপিকে ছেড়ে দিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বললাম,
— ” তুমি ওনার পক্ষ নিচ্ছো? আচ্ছা আমি কী বাচ্চা বলো যে এইটুকু পথ ও আমাকে রোজ রোজ ধরে ধরে নিয়ে যেতে হবে?”
আপি আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে আমার হাত ধরে নিজের কোলে শুইয়ে দিয়ে চুলে বিলি কাটতে লাগল আমিও চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,
— ” একটা জিনিস কী জানিস ? আমাদের সমাজে এমন অনেক স্বামী আছে যারা নিজের স্ত্রীর দিকে ঠিক করে তাকায়ও না। অনেকেই আছে স্ত্রী খেলো কী খেলোনা, কী হলো না হলো এসব নিয়ে মাথাই ঘামায় না। তাদের শুধুমাত্র রাতের বেলাতেই নিজের স্ত্রীকে প্রয়োজন পরে। কঠিন হলেও এটাই সত্যি। কিন্তু সেদিক দিয়ে আমাদের হাজবেন্টরা তো কতো আলাদা তাইনা? যারা আমাদের কতো কেয়ার করে। আর আদ্রিয়ান তো তোকে চোখে হারায়। কী খেলি, কতটুকু ঘুমালি, এমনকি এইটুকু পথও একা ছাড়েনা। তোর তো নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করা উচিত তাইনা?”
আমি চোখ বন্ধ করে রেখেই বললাম,
— ” হ্যাঁ বাট ডোন্ট ইউ থিংক কী উনি একটু বাড়াবাড়ি করেন। কিছু ক্ষেত্রে?”
আপি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— ” ওনেস্টলি বললে হ্যাঁ। তোকে নিয়ে একটু বেশিই প্রটেক্টিভ ও। মানে যেমন কোনো বাচ্চাকে কেউ একা ছাড়তে চায়না হারিয়ে যাবে বা কেউ নিয়ে যাবে সেই ভয়ে ঠিক সেইরকম ভাবেই ও তোকে চোখে চোখে রাখে। কিন্তু তোকে নিয়ে এতোটা ইনসিকিউর ফিল করার কারণ কী? আচ্ছা ওকে কী তুই বলেছিস ওসব?”
আমি এবার চোখ খুলে আপির দিকে ঘুরে না বোধক মাথা নাড়লাম। আপি চিন্তিত মুখ করে বলল,
— ” তাহলে সমস্যা কোথায়? আর তাছাড়াও অনেক দিন তো হয়ে গেছে। প্রথমে তো আমরাও তোকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। কিন্তু এতোদিনেও যখন কিছু করেনি তারমানেতো..”
— ” আপি প্লিজ বাদ দাও না আ্ আমার ভালো লাগছেনা।”
আপি একটা শ্বাস ফেলে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
— ” আচ্ছা। কিন্তু একটা জিনিস কিন্তু সত্যি আদ্রিয়ান কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে। এইজন্যেই এতো কেয়ার করে তোর।”
আমি একটা মলিন হাসি দিয়ে বললাম,
— ” ওগুলোতো সব উনি দায়িত্ববোধ থেকেই করেন আপি। উনি তো আমায় পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন উনি ওনার সব দায়িত্ব পালন করবেন কিন্তু আমি জেনো এরচেয়ে বেশি কিছু এক্সপেক্ট না করি।”
— ” আরে সেতো শুরুতে বলেছে। কিন্তু এখন আমি অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছি ওর চোখে।”
আমি একটু হেসে বললাম,
— ” দূর। এমন কিছু হলে উনি নিশ্চয়ই বলতেন আমাকে।”
— ” দিনতো পরে আছে সুইটহার্ট। দেখ কবে হুট করে বলে দেয়।”
— ” তাহলেই হয়েছে।”
আপি আমার চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বলল,
— ” এবার চুপচাপ ঘুমা তো? বিকেল হয়ে এসছে। তোমার বর এসে যদি দেখে ঘুমাও নি আবার রেগে যাবে। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে তোকে বিকেলে ঘুম পাড়ানোর।”
আমি চোখ বন্ধ করে হেসে দিলাম। আপিরও হাসির আওয়াজ পেলাম। কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করেই রইলাম। কিন্তু মনের মধ্যে হাজারটা ভাবনা আসছে। সেদিন পার্টিতে যা দেখেছিলাম সবটাই কী আমার চোখের ভুল ছিলো? তাই হবে হয়তো নইলে এতগুলো দিন পরেই কেনো আসবে? আমারই দোষ ওসব মাথা থেকে ঝাড়তে পারছিনা। আর আদ্রিয়ান? আচ্ছা সত্যিই কী উনি যা করেন সব দায়িত্বের খাতিরে? নাকি ভালোবাসেন আমায়? কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব? ধ্যাত! উনি কেনো আমায় হঠাৎ আমায় ভালোবাসতে যাবেন? আমিই বরাবরের একটু বেশি বেশিই ভাবছি। এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে আপির কোলেই ঘুমিয়ে পরলাম।
#চলবে…
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৮
.
কারও আলতো ডাকে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়া আমার মোটেও পছন্দের কাজ নয়। তাই একগাদা বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুচকে পিটপিটিয়ে চোখ খুলে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি দুই হাতে বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসলাম। দু-তিনবার একটানা চোখ ঝাপটা দিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বেডে বসে বললেন,
— ” বিকেলে ঘুমাতে বলেছি বলে কী সন্ধ্যা ভরে ঘুমাবে নাকি? ”
আমি কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে মনে পড়ল যে আমি আপির রুমে ছিলাম। তাহলে এখানে কীকরে এলাম? ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি? উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” কী হলো? যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি মিনুকে কফি আনতে বলেছি। কফি খেয়ে পড়তে বসবে। গো ফাস্ট।”
ওনার কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলাম ওয়াসরুমে। সকালে যেই ধমকি দিয়েছেন তারপর ওনার কথা অমান্য করার সাহস নেই আমার। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখি কফি চলে এসছে। আমাকে দেখে উনি হাতের ইশারায় ডাকলেন। আমি চুপচাপ গিয়ে বেডে উঠে আসাম করে বসে পরলাম। উনি কফির মগটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমিও ভদ্র মেয়ের মতো কফির মগটা নিয়ে বসে রইলাম। উনি আমার একটা বই নিয়ে দেখছেন আজকে কী পরাবেন। আর আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আর কফির মগে চুমুক দিচ্ছি। সকালে এভাবে বকলেন, কতগুলো কথা শোনালেন অথচ এমন একটা ভাব করছে জেনো কিছুই হয়নি। একটাবার সরি বলারও প্রয়োজন মনে করছেন না? একটা ভেংচি কেটে আবারও কফিতে কনসেনট্রেট করলাম। উনি বই মার্ক করে আমার দিয়ে বললেন,
— ” কম্প্লিট করো, ইন ওয়ান ইয়ার।”
আমিও কথা না বলে বইটা নিয়ে পড়তে বসে গেলাম। ওনার প্রতি ভীষণ রাগ লাগছে আমার। এমন কেনো লোকটা? এতোটা রুড? আমি শুনেছি তাড়াই শাসন করেন যারা ভালোবাসেন। যেমন বাবা, মা,আপি,ভাইয়া। কিন্তু এই ছেলেটা সবসময় আমাকে শুধু আমাকে শাসনই করে। একটু তো ভালোবাসতেও পারেন। অন্তত একবার তো বলতে পারত যে,.” সকালে রাগের তোমার সাথে ওরকম ব্যবহার করে ফেলেছি। আ’ম সরি।” তা বলবে কেনো ইগোতে লাগবে তো ওনার । এসব ভাবছি আর মুখ ফুলিয়ে পড়ছি। প্রায় আধঘন্টা পর হঠাৎ উনি নরম গলায় বললেন,
— ” অনি..”
আমি একটু চমকে উঠলাম। এখন কী সরি বলবেন সকালের ঘটনার জন্যে? এসব ভাবতে ভাবতেই উনি বলে উঠলেন,
— ” কালকে তো কোচিং নেই তাইনা?”
উফফ ইচ্ছে করছে ফ্লাওয়ার ভ্যাস দিয়ে লোকটার মাথাটাই ফাটিয়ে দেই। উনি যখনই আমার সাথে কথা বলেন, যেটুকুই বলেন সব কথা ঘুরেফিরে সেই লেখাপড়াতেই এসে থাকে। অদ্ভুত! আমিযে ওনার বউ সেটা ভাবতে গেলে এখন নিজরই হাসি পায়। উনি আবার বললেন,
— ” কী হলো বলো?”
আমি এবার বিরক্তি নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম তারপর বললাম,
— ” না আজ ছিলোতো, কাল নেই।”
— “তোমাদের বাড়ির সবাইকে ইনভাইট করা হয়েছে। ওনারা সবাই কাল সারাদিন এখানেই থাকবেন।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে জোরে চেচিয়ে বললাম,
— ” সত্যিই?”
উনি ভ্রু কুচকে নিজের কানে হাতে দিয়ে বললেন,
— ” চুপ! আমার কান! এতো চিৎকার করার কী আছে?”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে গলা ঝেড়ে বললাম,
— ” নাহ মানে বলছিলাম যে অর্ণব ভাইয়া, সজীব ভাইয়া, কাব্য সবাই আসবেন? সারাদিন থাকবেন?”
— ” হ্যাঁ রে বাবা সবাই থাকবেন। আসলে কদিন যাবত তোমার পড়ার খুব প্রেশার পরছে। সেই বিয়ের পর দুদিনের জন্যে গিয়েছিলে আর তো যাওয়া হয়নি। ওদের সাথে একটা দিন কাটালে তোমারও মাইন্ড ফ্রেশ হবে আর ওনাদেরও ভালো লাগবে।”
আমি এতোই খুশি হয়েছি যে হুট করেই হাটুতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে ওনার গিয়ে একটু এগিয়ে ওনার কাধে থুতনি রেখে ওনাকে জরিয়ে ধরে বললাম,
— ” থ্যাংকিউ। থাংকিউ সোওও মাচ।”
ওনাকে টাইট করে জরিয়ে ধরে আছি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম যে কী করছি তাই তাড়াতাড়ি ছেড়ে একটু দূরে সরে বসলাম। ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনিও একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। হয়তো আমি এমন কিছু করবো সেটা উনি ভাবতেই পারেননি। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে উনি একটা টেডি স্মাইল দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলেন। আমি সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিলাম। আমি লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে নিজের দিকে টান মারলেন। আমি সোজা ওনার।বুকের ওপর গিয়ে পরলাম। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাল কোমর ধরে ঘুরিয়ে বেডে শুইয়ে দিয়ে। আমার পাশে নিজের কুনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে পরলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি আমার সামনের চুলগুলো কানের পিঠে গুজতে গুজতে বললেন,
— ” তোমাকে তো আমি বাচ্চা মেয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি যে এতোটা এডভান্স জানতাম না তো?”
উনি এইটুকূ স্পর্শ করাতে আমি এমনিতেই সব গুলিয়ে ফেলেছি, নিশ্বাস হালকা ভারী হয়ে আসছে। উনি নিজের মুখ আমার দিকে এগিয়ে আনতেই আমি চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললাম। ওনাল নিশ্বাস আমার গলায় মুখে এসে পরছে আস্তে আস্তে সেটা গাড়ো হচ্ছে আর ততোই বিছানার চাদর খামচে ধরছি। কিন্তু অনেকটা সময় পার হওয়ার পরেও কোনো কিছুই অনুভব করতে পারছিনা। তখন পিটপিট করে চোখ খুলে দেখি উনি বিছানায় হেলান দিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন। আমি হকচকিয়ে উঠে বসে ওনাকে কিছু বলবো তার আগেই উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
— ” কী হ্যাঁ? সবসময় উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় ঘোরে তাইনা?”
আমি ভ্রু কুচকে ফেললাম। উনি হালকা ধমকের সুরে বললেন,
— ” আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে পড়াটা কম্প্লিট করো তাড়াতাড়ি। কালকে এমনিতেই পড়া বেশি হবেনা। সো ফাস্ট? আমি আসছি একটু।”
আমি আহম্মকের মতো ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী লোকরে বাবা? কোথায় ভাবলাম আমার বরটার হয়তো একটু সুমতি হয়েছে। কিন্তু আমার কপাল কী আর এতো ভালো নাকি। ব্যাটা নিরামিষ সারাজীবন নিরামিষই থাকবে। কী ভাবলাম আর কী হলো?নিজেই তো ওমন অদ্ভুত বিহেভ করলো আমার নিজেই ধমকালো। খাটাশ কোথাকার।এক্সাক্টলি সমস্যাটা কোথায় এর? মাথার তার কী সবগুলো ছেড়া না কী? আব্বু বেছে বেছে অবশেষে একটা পাগলের সাথে বিয়ে দিলো আমাকে? আল্লাহ আমার সহায় হও। আমার এই তারছেড়া বরটার তারগুলো একটু জুড়ে দাও প্লিজ। হেল্প মি।
__________________
সকালের রোদের আলো চোখে পরতেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। একটা হাই তুলে আস্তে আস্তে উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে ন’টা বাজে। কাল রাতে অনেক্ষণ পর্যন্ত পড়িয়েছেন উনি আমায়। যেদিন আমার কোচিং থাকেনা সেদিনের আগের রাত অনেক রাত অবধি পড়ান আর সকালে বেশিক্ষণ ঘুমাতে দেন আজ হয়তো তাই এখনও ডাকেন নি। আমি বিছানা ছেড়ে ওয়াসরুমে গেলাম ওখান থেকে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলাম। আর নিচে গিয়ে আমি অবাকের চরম সীমায় পৌছে গেছি। আব্বু, আম্মু, মামা, মামী, ভাইয়ারা, সুলতানাপ্পি মানে আমার ছোট ফুপ্পি, ফুপা, ওহি, অন্ত সবাই এসছে। ওরা আজ আসবে আমি জানতাম কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে সেটা আশা করিনি আমি। অবাক হয়ে দেখছি ওদেরকে। আব্বু আম্মু আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন আমি ছুটে গিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলাম আব্বুও ধরলো আমায়। আমি কেঁদেই দিয়েছি পুরো। আব্বু আমার মাথায় হাত রাখতেই আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম। আম্মুও কাধের ওপর দিয়ে হাত দিতেই আমি আম্মুর দিকে ঘুরে আম্মুকেও জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। বাবা বললেন,
— ” দেখো মেয়ে কীভাবে কাঁদছে? আরে তুই এভাবে কাঁদলে তো ওরা মনে করবে আমরা এখানে এসে ভীষণ টর্চার করছি।”
মামনীও সায় দিয়ে বললেন,
— ” ঠিকই তো এভাবে কাঁদতে আছে?”
কিন্তু আমি হালকা আওয়াজে কেঁদে যাচ্ছি। তখনই আদ্রিয়ান বলে উঠলেন,
— ” বাবা, মামনী তোমাদের এখানে ডেকেছিলাম কারও মন ভালো করার জন্যে এখন সে যদি এইভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে থাকে তাহলে কিন্তু আমিই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবো।”
ওনার কথা শুনে আমি কান্না থামিয়ে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। সবাই হেসে দিলো। আদ্রিয়ান এবার আব্বু আম্মুকে সালাম দিলেন। ভাইয়ারা ওদের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর কাব্যর দিকে তাকিয়ে হাইফাইভ করে বললেন,
— ” হাই চ্যাম্প। কেমন আছো?”
কাব্যও হেসে বলল,
— ” একদম। তুমি?”
— ” বিন্দাস।”
— ” কিন্তু ভাইয়া তুমি বলেছিলে আমাকে ক্রিকেটের ব্যাটিং এর নতুন কয়েকটা স্ট্রাটেজি শেখাবে?”
আদ্রিয়ান হালকা হেসে বলল,
— ” আপাতত একটু ব্যস্ত আছি ভাইয়া। সময় করে শিখিয়ে দেবো।”
বলাই হয়নি যে আদ্রিয়ান খুব ভালো ক্রিকেট খেলে। শুধু ক্রিকেট না ম্যাক্সিমান স্পোর্টস এ ভালো। শুনেছি বক্সিং চ্যাম্পিয়ন তাও ইউকে তে। এটা শোনার পর থেকেই ওনাকে আর ঘাটাই না। যেই মাসেল আর লোহার মতো হাত, তারওপর বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। একটা পাঞ্চ যদি মারে, এমনিতেই আমার নাক হালকা বোঁচা এরপর আর খুজেই পাওয়া যাবেনা। এবার উনি ওহির কাছে গেলো। ওহি সুলতানাপ্পির মেয়ে, এবার ক্লাস ফোর এ। খুব মিষ্টি আর দুষ্টুও। আদ্রিয়ান ওহির আছে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
— ” তো আপুমনি কেমন আছো?”
ওহি মুখ ফুলিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
— ” তোমার সাথে আড়ি আছে আমার।”
আদ্রিয়ান একটু অবাক হয়ে বলল,
— ” কেনো তা কেনো?”
— ” তুমি ছোট আপিকে নিয়ে চলে এসছো।”
আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,
— ” ওহ এই ব্যাপার? কিন্তু আমিতো তোমার ছোট আপিকে নিয়ে আসিনি। তোমার ছোট আপি নিজেই চলে এসছে আমার কাছে।”
আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম। কী লোকরে বাবা। মানছি আমি জেদ করে তখন একটু ড্রামা করেছিলাম কিন্তু তাই বলে এভাবে বলবে? ওহি একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” তবুও আড়ি। দুজনের সাথেই আড়ি।”
আদ্রিয়ান চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলল,
— ” হুমম। কী করা যায় কী করা যায়? রাইট। দেখোতো এটা পেলে আমার আপুমনির রাগ ভাঙ্গে কী না?”
বলে পকেট থেকে একটা চকলেটের প্যকেট বের করে দিলো ওহির হাতে। ওহি খুব খুশি হয়ে আদ্রিয়ানের গালে একটা কিস করে বলল,
— ” থ্যাংকিউ।”
আদ্রিয়ানও হেসে ওহির গালে কিস করলো। তারপর অন্ত মানে সুলতানাপ্পির ছেলে। দুবছর হয়েছে। ওকে আদর করল। আমি শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম। একটা মানুষ এতোটা পার্ফেক্ট কীকরে হয়। উনি যেনো সবার জন্যেই তৈরী। সবরকম পরিস্হিতিতে নিজেকে আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলে সেটা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ওনাকে দিয়েছেন। এরপর আমিও ওহি আর অন্তকে নিয়ে অনেকক্ষণ মজা করে সময় কাটালাম।
_________________
সকালের ব্রেকফাস্ট সেড়ে আমরা সব ভাইবোনরা একজায়গায় বসে গল্প করছি। আমি, আপি, কাব্য, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, ইফাজ ভাইয়া। শুধু নেই আদ্রিয়ান আর আদিব ভাইয়া। অর্ণব ভাইয়া বলল,
— ” কীরে পিচ্চি বিয়ে তো করেই নিলি। খুব তো বলেছিলি বিয়ে করবিনা এখনতো আঠারো পেড়োতেই করে ফেললি।”
কাব্যও পিঞ্চ করে বলল,
— ” আরে বোঝনা কেনো ভাইয়া? এরকম সবাই বলে। শেষে দেখা যায় তাড়াই সবার আগে বিদায় নিয়েছে।”
আমি ওদের দুজনের দিকে তাকিয়েই একটা ভেংচি কাটলাম।
সজীব ভাইয়া বলল,
— ” তো বুড়ি। আদ্রিয়ানের সাথে ঠিকঠাক হয়ে গেছেতো?”
আমি কিছু বলব তার আগেই অর্ণব ভাইয়া বলল,
— ” আরে বুঝছোনা? জিজুকে দেখোনি? যেই লেভেলের রোমান্টিক উনি। দেখো সারাদিন হয়তো রোমান্স করেই কাটে এদের।”
আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। কে বলবে এরাই আমার বড় ভাই? সো রিডিকিউলাস। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” রাখো তোমাদের রোমান্স। দেখে দেখে একটা নিরামিষের সাথে বিয়ে দিয়েছো আমার। হাজবেন্ট তো না আস্তো একটা টিচার। সারাদিন পড়া পড়া আর পড়া আর কিছুই নেই। আমার ওপর রীতিমতো অত্যাচার করে। শুধু পারে কথায় কথায় ধমকাতে আস্তো একটা বজ্জাতের হাড্ডি।”
আপি একটু মেকি হেসে বলল,
— ” অনি চুপ কর।”
আমি একটু রেগে বললাম,
— ” কেনো? চুপ কেনো করবো? তোমরা যা খুশি করবে আমি বললেই দোষ। আমার জীবণটাই তেজপাতা বানিয়ে দিয়েছো। আমার কী মনে হয় জানো? ঐ ওনার মধ্যে শিউর কোনো ডিফেক্ট আছে নইলে এমন নিরামিষ মানুষ হয়?”
খেয়াল করলাম ওরা ভীত চোখে আমার পেছনে তাকিয়ে আছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
— ” আরে আমি তোমাদের সাথে কথা বলছি তোমরা পেছনে কোন উগান্ডার দিকে তা..”
বলতে বলতে পেছনে তাকিয়েই থেমে গেলাম। গলাটা মুহূর্তেই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। একটু শুকনো ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করলাম কিন্তু আফসোস পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম।
#চলবে…
( রি-চেইক হয়নি। টাইপিং মিস্টেকগুলো একটু বুঝে নেবেন।)
#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৯
.
আদ্রিয়ান রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার পাশে আদিব ভাইয়া থুতনিতে হাত রেখে মিটমিটিয়ে হাসছেন। আদ্রিয়ান দরজায় হেলান দিয়ে জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার এখন নিজের ওপর ভীষণ রকমের রাগ হচ্ছে। আমি আসলেই একটা গাধা, মানে একেবারে নিম্নমানের গাধা। নইলে বারবার এভাবে ফাঁসার পরেও কথা বলার সময় একটু সতর্ক হতে শিখলাম না। ড্যাম! আচ্ছা সবসময় আমারই টাইমিং ভুল হয়? নাকি উনিই ভুল সময় ভুল জায়গায় এন্ট্রি নেন? না আমার কেনো দোষ হবে? আমি তো আর ভুল কিছু বলিনা? আসলে ওনার আসার টাইমিং গুলোই ভুল হয়। সব দোষ ওনার। এসব ভাবতে ভাবতেই অাপি একটু জোরপূর্বক হেসে বলল,
— ” আরে আদ্রিয়ান, আদিব তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো আছো? এসো ভেতরে এসোনা?”
আদিব ভাইয়াও একটু হাসার চেষ্টা করে ভেতরে চলে এলেন আর আদ্রিয়ান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়েই এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
— ” আসলে কী বলোতো বউমনি? শুরুতে ভেতরে আসতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু নিজের সম্পর্কে এতো এতো প্রশংসা শুনে আর শোনার লোভটা সামলে রাখতে পারলাম না। নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে বলো? আমারও ভীষণ ভালো লেগেছে। তাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।
তারপর মুখে সেই হাসি রেখেই বললেন,
— ” থ্যাংক ইউ সো মাচ বেবি।”
আমার চোখ সাথে সাথে বড় বড় হয়ে গেলো। ইফাজ আর আদিব ভাইয়া দুজনেই হালকা গলা ঝাড়লেন। তারপর সবাই চুপ। এক্চুয়ালি আমি যা যা বলেছি সেগুলো শোনার পর ওনার এরকম বিহেবে আমি ‘থ’। আর আমার মনে হচ্ছে বাকি সবারও একই অবস্থা। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো কথা বাড়াতে পারছেন না চুপ করে আছে। আমি নিচের দিকে হাত কোচলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরিবেশটা নিরব ছিলো। নিরবতা ভেঙ্গে আদ্রিয়ান বলে উঠল,
— ” আরে সবাই এভাবে চুপ করে বসে আছো কেনো? আমি থাকায় প্রবলেম হচ্ছে?”
ইফাজ ভাইয়া হেসে দিয়ে বলল,
— ” আরে প্রবলেম হবে কেনো? আমরা কথা বলছি তো?”
এরপর সবাই আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সজীব ভাইয়া আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— ” তো আদ্রিয়ান? কেমব্রিজ থেকে তো ইঞ্জিনিয়ারিং কম্প্লিট করে এলে। শুনেছি ল্যাবও আছে? কী করো ল্যাবে?”
আদ্রিয়ান বেডে হেলান দিয়ে বলল,
— ” তেমন কিছু না ভাইয়া। কিছু রিসার্চ, সফটওয়্যার এসব নিয়েই সবে কাজ শুরু করেছি।”
সজীব ভাইয়া একটু কৌতূহলী হয়ে বলল,
— ” এক্সাক্টলি এখন কী নিয়ে কাজ করছো?”
আদ্রিয়ান আদিব ভাইয়ার দিকে একবার তাকালো আদিব ভাইয়াও একটু মেকি হেসে সজীব ভাইয়াল দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” নাহ তেমন কিছু না। আসলে ইশরাকের মৃত্যুর পর আর নতুন কিছু শুরু করিনি পুরোনো কিছু কাজই কম্প্লিট করছি।”
ইশরাক ভাইয়া নামটা শোনার সাথে সাথেই আমার সবার মন ভার হয়ে এলো। সবার চেহারাতেই বিষন্নতা। আদ্রিয়ান শক্ত চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো ব্যাপারটা সামাল দিতে অর্ণব ভাইয়া বলল,
— ” আচ্ছা আদ্রিয়ান ভাইয়া তোমার তো ইউ কে থেকে বা বিদেশ থেকে অনেক ভালো ভালো কাজের অফার এসছে। আফটার অল কেমব্রিজ এর স্টুডেন্ট তুমি? ওখানে সেটেল হওয়ার ইচ্ছে হয়নি?”
আদ্রিয়ান নিজেকে সামলে বলল,
— “ছোটবেলাতে খেলেছি এই দেশের মাটিতে, এইদেশের খেয়েছি, এই দেশেই বড় হয়েছি তাই ফার্স্ট চয়েজ তো এই দেশটাই হবে তাইনা? এখানে থেকে যখন কাজ করা যাচ্ছে বিদেশ কেনো যাবো? তবে মাঝে মাঝে রিসার্চ এর কাজে ইউ কে তে যেতে হতে পারে।”
এভাবে নানা কথায় সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর আমি ভাবছি যে ছেলেটা এতো শান্ত কেনো আছে? আমি ওনাকে যতোটুকু চিনি এভাবে আমি এতকিছু বলার পর উনি সিউর আমার বারোটা বাজাবেন। এই শান্তি যে ঝড়ের আগের শান্তি সেটা আমি খুব বেশি করেই ফিল করতে পারছি।
বিকেলের দিকে আব্বু আম্মু ফুপা সুলতানাপ্পি চলে গেলেন। কিন্তু সবাল জোরাজুরিতে ভাইয়ারা, কাব্য আর ওহি থেকে গেলো।
_________________
রাতে আমি আমি করিডর দিয়ে পায়চারী করছি। ভাবছি রুমে যাবো? কিন্তু যদি রুমে গেলো উনি কিছু বলেন। আজ রাতে ওনার কাছে যাওয়াটা ভীষণ রিস্কি হয়ে যাবে। এতোটা রিস্ক নেবো? আপির রুমেও যেতে পারবোনা।কিন্তু যাবোটা কোথায়? জাবিনের রুমে। ইয়েস ওটাই একমাত্র বাঁচার জায়গা। এসব ভেবে জাবিনের রুমের দিকে পা বাড়ালাম ঠিক তখনই কেউ হুট করেই আমার হাত ধরে ফেলল। আমি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান। ওনার এক্সেপ্রেশন দেখে বুঝতে পারছি না উনি রেগে আছেন নাকি নেই। মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” কী ব্যাপার এতো রাত হয়ে গেছে এখনো রুমে আসছো না। কোথায় যাচ্ছো?”
আমি একটু হাসার চেষ্টা করে আমতা আমতা করে বললাম,
— ” অব্ জ্ জাবিনের রুমে যাচ্ছিলাম।”
— ” এতো রাতে ওর রুমে গিয়ে কী করবে?”
এখন কী বলবো? দূর এর এখনই এখানে আসতে হলো? আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে রেখে বললাম,
— ” আজ আমি জাবিনের রুমে গিয়ে শোবো।”
উনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “কেন?”
— ” আমার আজ ওর কাছে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।”
— ” হঠাৎ এমন উদ্ভট ইচ্ছে হওয়ার কারণ।”
আমি একটা শ্বাস ফেলে সাহস জুগিয়ে বললাম,
— ” আমার মন চাইছে আজ ওর কাছে ঘুমাতে তাতে আপনার কী?”
উনি এবার আমার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে ধমকে বললেন,
— ” কানের নিচে একটা পরলে আর কিছু মনেও চাইবেনা আর ইচ্ছেও করবেনা। চুপচাপ রুমে চলো।”
আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। উনি আমার হাত ধরে একপ্রকার টেনেই রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তাও আবার কি লক করে দিলেন। আমি একট অবাক হলাম। আমি মনে মনে ভাবছিলাম উনি একটু সরলেই আমি বেড়িয়ে যাবো। বুঝলেন কীকরে সেটা? তারপর আমার দিকে একপলক তাকিয়ে ওয়াসরুম চলে গেলেন। আমি খাটে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। আমি শিউর আজ এই ছেলে আমার ক্লাস নেবেই নেবে। কেনো যে এতো প্যাচাল পারি আমি। কিছুক্ষণ পর উনি বেড়িয়ে এলেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা বাঁকা হাসলেন সাথে সাথেই আমার গলা গুকিয়ে এলো। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। উনি আমার দিকে যতো এগোচ্ছেন আমার হার্ট ততো জোরে বিট করছে। আমি শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। উনি আমার কাছে এসে আস্তে করে আমার কোমরে হাত রাখলেন। সাথে সাথে আমার শরীরে জেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আমি চমকে তাকালাম ওনার দিকে। কোমরে আলতো হাতে স্লাইড করে ওনার হাত আমার পিঠের ওপর দিকে কোমরের ওপর পাশে চলে গেলো। উনি হালকা টান মেরে আমায় একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। পুরো ব্যাপারটাই আমার মাথা ওপর দিকে যাচ্ছে। উনি আমার চুলগুলো মুখের সামনে থেকে সরিয়ে থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরলেন। ওনার নিশ্বাস সরাসরি আমার মুখের ওপর এসে পরছে। উনি মুখটা আমার দিকে এগিয়ে আনতেই আমি মাথাটা হালকা পিছিয়ে তোতলানো গলায় বললাম,
— ” ক্ কী করছেন?”
উনি ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
— ” কই কী করছি। যেটা সবাই করে সেটাই করছি নিজের বউ কে আদর করছি।”
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। উনি সেই হাসি মুখে রেখেই বললেন,
— ” তাছাড়া তুমিই তো বলছিলে আমি কী জেনো? হ্যাঁ নিরামিষ? আমি নিরামিষ নাকি আমিষ সেটারই প্রুভ দিচ্ছি।”
বলে উনি আবার আমাকে কাছে টানতে গেলেই আমি বললাম,
— ” অব্ আমিতো মজা করছিলাম। বিশ্বাস করুন।”
উনি ভ্রুটা হালকা কুচকে বললেন,
— ” ওহ তাই? কিন্তু আমি তো সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছি সোনা। এখন কিছুই করার নেই।”
এটুকু বলে উনি হালকা করে ধাক্কা দিয়ে আমায় বেডে ফেলে দিলেন। আমি এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। উনি বেডের ওপর এক পায়ের হাটু রেখে উঠতে উঠতে বললেন,
— ” কী জেনো বলছিলে আমি আস্ত বজ্জাত? আনরোমান্টিক?”
আমি আধশোয়া অবস্থায় হালকা পিছিয়ে তাড়াতাড়ি হকচকিয়ে বললাম,
— ” না না আপনি কেনো ওসব হবেন। আমি তো এমনিই বলে ফেলেছি।”
উনি হাটু দিয়েই একটু এগিয়ে বললেন,
— ” ঠিকই বলেছো। সত্যিই ঘরে এমন সুন্দরী বউ থাকতে কী আর নিরামিষ হয়ে থাকা ঠিক? একদমি না?”
ওনার কথা শুনে গলাটা আরও শুকিয়ে গেলো। পাগল হয়ে গেলো নাকি লোকটা? হঠাৎ এমন বিহেভ করছে কেনো? উনি এবার আমার ঘাড়ের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— ” আমার মধ্যে ডিফেক্টস আছে না নেই সেটার প্রমাণও তো দিতে হবে তোমাকে তাইনা?”
আমি চোখ বন্ধ করে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
— ” অ্ আমার কোনো প্রমাণের দরকার নেই।”
উনি ঘাড়ের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে বললেন,
— ” কিন্তু তোমার মনে যখন প্রশ্ন আমাকে তো প্রমাণ দিতে হবে তাইনা। আমার প্রেসটিজ ইস্যু এটা। সো আমিতো প্রুভ দেবোই।”
বলে উঠে নিজের টি-শার্ট টা খুলে ফেললেন। আমি এবার প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম, যদিও নিচে নীল চিকন স্লিভস এর পাতলা গেঞ্জি আছে। সত্যিই কী এসব করবেন নাকি? হালকা ওঠার চেষ্টা করে আমি কাঁদোকাঁদো গলায়,
— ” প্লিজ ছেড়ে দিন আমি আর কোনোদিন এসব বলবোনা।”
উনি আমার কাধ ঠেলে শুইয়ে দিয়ে বেডের দুই পাশে হাত রেখে বললেন,
— ” বলে যখন ফেলেছো দাম তো দিতেই হবে। রাইট বেইবি?”
বলে আমার গা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নিলেন। আমার এবার শ্বাস আটকে আসছে। আমি ওসব মজার ছলে বললেও এসবের জন্যে মোটেও প্রস্তুত নই। মেন্টালি, ফিজিক্যালি কোনোভাবেই নয়। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আমি কাঁপাকাঁপা গলায় অস্ফুট স্বরে বললাম,
— ” প্লিজ..”
উনি পাত্তা না দিয়ে আমার ঘাড়ের কাছের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতেই আমি কেঁদে দিলাম। আমার কান্নার আওয়াজ পেয়ে উনি মাথা তুলে শক্ত কন্ঠে বললেন,
— ” এখন কাঁদছো কেনো? রোমান্স করার খুব শখ না তোমার? সেটাই তো করছি। এখন কষ্ট পাচ্ছো কেনো?”
আমি কিছু না বলে চোখ নিচে রেখে কাঁদছি। উনি উঠে বসে ওড়নাটা আমার গায়ে দিয়ে বললেন,
— ” আশাকরি এসব ফালতু চিন্তা মাথা থেকে পালিয়ে গেছে? এবার এসব ভুলে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। কাজে লাগবে।”
বলে উঠে দাঁড়িয়ে টি-শার্ট টা পরে ব্যালকনিতে চলে গেলেন উনি। আমি হাটু গুটিয়ে বসে নিরবে কাঁদছি। ভালো করে বললেও তো হতো। খুব কী দরকার ছিলো এরকম ব্যবহার করার?
#চলবে…