#ভালোবাসিবো_খুব_যতনে
#Ayrah_Rahman
#part_07
সাঁঝের সকাল , বসন্তের দক্ষিণা বাতাস শা শা করে ঢুকছে হসপিটালের জানলা দিয়ে , সেই বাতাস কে যেন আহবান করতে জানলার ধারে রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নির্লিপ্ত ভঙিতে দাড়িয়ে আছে বাসন্তী রঙের সাড়ি পরিহিতা এক রমনী, সাড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ যেন শুকিয়ে আছে , চুলের খোঁপা টা অনেকাংশে খুলে যাওয়ার ফলে কিছু অবাধ্য চুল পিঠ ময় আছড়ে পরে আছে , চোখে তার ঘুমু ঘুমু ভাব, ক্লান্তি তবুও যেন ঘুমুতে নাড়াজ সে , ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ঘড়ির দিকে দৃষ্টি তাক করলো , ঘড়ির কাটা সাত টা পেরিয়ে গেছে সেই আধ ঘন্টা আগে , পুনরায় তাকালো বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকা হাত পায়ে ব্যন্ডেজ করা ছেলেটার দিকে , ছেলেটার পরিচয় এখনো অজানা , জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত পরিচয় জানা অসম্ভব ,
কেবিন নাম্বার ২০৪ , বেডে শুয়ে থাকা ছেলেটার গোঙানির আওয়াজে পিছনে তাকালাম, জ্ঞান ফিরেছে তার ,
আমি ধীর পায়ে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলাম কপালে আর গালে হাত দিয়ে দেখলাম এখন জ্বরের অবস্থা , এখন কিছুটা কম হলেও একেবারে যে নেই তা কিন্তু না , বেডের পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে পানির বোল টা নিয়ে তাতে ভিজানো রোমাল টা ভাজ করে কপালে রাখলাম ,
ছেলেটা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো ,
চোখের সামনে অপরিচিত একটা মেয়েকে দেখে হয়তো বেশ চমকেও গেছে হয়তো , তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলে আমি বাধা দিলাম ,
” উঠো না শুয়ে পড়ো , , সারা শরীরে তোমার আঘাত , ব্যথা আছে আর কথা বলো না কষ্ট হবে তোমার , যা লাগবে ইশারায় বলে দিবে আমি এনে দিবো ”
বলেই মাথা থেকে জলপট্টি টা সরিয়ে আবার ভিজিয়ে রাখলাম ,
ছেলে টা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে , আমি সেদিকে পাত্তা দিলাম না , অবাক তো হবার ই কথা ,
এমন সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ডাক্তার নুর ,
” কেমন আছো মাই বয় ”
আমি আর ছেলেটা ডক্টর এর দিকে তাকালাম,
” আসলে ডক্টর , ওর কথা বলতে প্রবলেম হচ্ছে ”
আমার কথা শুনে ডাক্তার হাসলেন ,
” ওই যে বললাম না গলায় বেশ আঘাত পেয়েছে তবে চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে কিছু দিন রেস্ট নেক ”
ছেলেটার কাছে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলল ,
“জ্বর তো এখন আর তেমন নেই , ডোন্ট ওয়ারি মাই বয় , তোমার বোন থাকলে তোমার আর কিছু হবে না এটা আমার বিশ্বাস ”
ডাক্তারের কথা শুনে ছেলেটা আবারো অবাক দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকালো ,
ডাক্তার কিছু টা থেমে বলল ,
” ভেইরি ব্রেভ গার্ল তোমার বোন , কালকে ও সময় মতো না নিয়ে আসলে তো তোমাকে বাঁচানো ই যেত না , আর সারা রাত জেগে মেয়েটা তোমার সেবা করেছে , মাঝ রাতে তো হঠাৎ ই তোমার প্রচন্ড জ্বর আসে আর ও তোমার মাথার পাশে সারা রাত থেকে জেগে জেগে তোমার মাথায় পানি দিয়েছে আর শরীর মুছিয়ে দিয়েছে , ভাগ্য করে একটা বোন পেয়েছো তুমি চিন্তা র কোন কারণ নেই , ঔষধ নাও আর রেস্ট করো ইনশাআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে ”
বলেই ডাক্তার চলে গেলেন ,
ডক্টর এর কথা শুনে ছেলেটা আমার দিকে অশ্রুশিক্ত দৃষ্টিতে তাকালো , আমি গিয়ে ওর পাশে বসলাম ,
ছেলেটা আশফাস করছে হয়তো কিছু বলবে ,
” তুমি কি কিছু বলবে ? ”
সে মাথা নাড়ায় ,
” কিভাবে বলবে ? তোমার গলায় তো ব্যথা! ”
ছেলেটা আমাকে টেবিলের দিকে ইশারা করে , আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখি , একটা খাতা রাখা আছে , আমি কিছুটা ভেবে বলি ,
” তোমার তো হাতে তো ব্যথা লিখবে কিভাবে ? ”
ছেলেটা আবারো ইশারা করতেই আমি আর কিছু না বলে টেবিল থেকে একটা খাতা আর কলম এগিয়ে দিলাম ,
খুব কষ্ট করে ছেলেটা কাগজে কিছু একটা লিখলো ,
আর আমার দিকে এগিয়ে দিলো ,
” আমার বাসায় একটু যোগাযোগ করবা ? নাম্বার 017******09 ”
লেখা টা পরে আমি হাসলাম , খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বললাম ,
” তোমার নাম কি লেখ ”
সে নাম লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলো ,
” তানজিম ”
লেখাটা পড়ে আমি হাসলাম ,
” বাহ্ বেশ সুন্দর নাম ”
আমাদের কথার মাঝে পিছনে থেকে হঠাৎ কেউ বলে উঠলো ,
” কি ব্যপার বাছাধনের জ্ঞান ফিরলো তাহলে ? ভয় ই পেয়ে গিয়েছিলাম ”
আমি ইলুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম , হাতে একটা শপিং ব্যগ নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ,
ইলু খানিকটা এগিয়ে এসে আমার হাতে শপিং ব্যগ টা দিয়ে বেডে বসে পড়লো ,
আমি শপিং ব্যগ থেকে ড্রেস খুলে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে , মাইয়ার কাজ দেখছো , আবার আমার জন্য এই সাড়ি ই আনছে , কেমন ডা লাগে !
” ওই ফহিন্নি , দুনিয়ায় কি আর কোন ড্রেস নাই ! তুই সাড়ি আনলি কোন বুঝে ? ”
” তো কি ওয়েস্টার্ন আনতাম ? ”
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো , তানজিম ও আমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে হাসলো, আমি ওর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম , এই মেয়েকে কিছু বলে লাভ নাই , ঘাড় ত্যাড়া কোথাকার !
আমি ইলুর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে খাতা টা ধরিয়ে বললাম ,
” তানজিমের বাড়ি তে ফোন কর আমি ততক্ষণে চেঞ্জ করে আসছি ”
সাড়ি যে আমি একদম ই পড়তে পারি না তা কিন্তু না , আমি সাড়ি পড়তেও পারি সামলাতেও পারি , কিন্তু এই মূহুর্তে সারি টা কম্ফোর্ট বলে আমার মনে হচ্ছে না , সে যায় হোক এখন আর কি করার , অগত্যা এসব নিয়েই আমাকে ওয়াসরুমে ঢুকতে হলো ,
নীল রঙের সাড়ি আর সাদা রঙের ব্লাউজ পড়ে চুল থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে দেখি কেবিনে বেশ অনেক লোকের ভীড় ,
একজন মহিলা তানজিমের মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আরেকজন মাঝ বয়সী লোক বেডের সাথে ই চেয়ার নিয়ে বসে কথা বলছে ,
আমি পলক ঘুরিয়ে ইলুর দিকে তাকালাম, ইলু চোখের ইশারায় বোঝালো এনারাই তানজিমের বাবা মা,
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম , যাক ছেলে তার মা বাবার কোলে ফিরে গিয়েছে , আমার দায়িত্ব শেষ,
তানজিমের বাবা তানজিম কে বিভিন্ন কিছু জিজ্ঞেস করছে কিন্তু বেচারার তো কথা বলতে পারে না আর সেটা বোঝাতে ও পারছেনা ,
” আঙ্কেল , তানজিম তো গলায় ব্যথা পেয়েছে তাই কথা বলতে ওর প্রবলেম হবে , আবাদত ওকে কিছু জিজ্ঞেস না করলেই ভালো হবে ”
অচেনা কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে আঙ্কেল আর আন্টি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো ,
উনাদের অব্যক্ত কথা টা হয়তো আমি বুঝতে পেরেছি তাই হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে বললাম ,
” আমাকে আপনারা চিনবেন না , আমার নাম মিফতাহুল পূর্ণা , পেশায় একজন সাংবাদিক , তানজিম কে কাল আমরাই পেয়েছিলাম রাস্তায় , আঘাত প্রাপ্ত অবস্থায় ”
আমার কথা শুনে আঙ্কেল বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকলেন , আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে ,
উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন ,
” কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দিবো ভাষা নেই আমার , তুমি নিজেও জানো না তুমি আমাদের কত বড় একটা উপকার করেছো ”
” এভাবে বলবেন না আঙ্কেল , এটা আমার কর্তব্য আজ তানজিমের জায়গায় আমার ছোট ভাই কিংবা বোন হতে পারতো , আমার ভাই হলে কি আমি এভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে আসতে পারতাম? কখনোই না ”
” তোমার মতো এভাবে কেউ চিন্তা করে না মা ”
প্রতুত্যরে আমি হাসলাম,
কথার মাঝে হঠাৎ মেহরিন শিকদার বলে উঠলো ,
” মেয়ে তুমি সারা রাত তানজিমের পাশে ছিলে তোমার বাবা মা টেনশন করেননি ? ”
উনার কথায় আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম ,
” নাহ আন্টি , টেনশন করার মতো কেউ নেই আমার , আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি , ভাড়া বাসায় থাকি , আমার পরিবার বলতে এখন শুধু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ইলমি আছে , আর কেউ নেই ”
বেশ হাসি মুখেই কথা গুলো বললাম , মিসেস শিকদার আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ,
হয়তো ভাবছে , এত কঠিন কথা গুলো মেয়েটা কত সুন্দর সাবলীল ভাষায় অবলীলায় বলে দিলো ,
ঠিক তখন ই কথা বলতে বলতে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো কেউ…
চলবে…