#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫৪(বর্ধিতাংশ)
রাতুল এসেছে বউ নিয়ে হাসপাতালে। এই তো আট মাসের প্রেগন্যান্ট দিশা। এসেছে চেক আপ করতে। আস্তে করে দিশা’র হাতটা ধরে রাতুল ওকে নামালো গাড়ি থেকে। বড় পেট নিয়ে দিশার একটু অসুবিধাই হয় চলাফেরা করতে। কিন্তু কেন জানি কোন কষ্টই গায়ে লাগে না। রাতুলের ভালোবাসার গহীনে এই সকল কষ্ট খুবই নগন্য। ওরা গিয়ে ডুকলো ড.মিহা’র কেবিনে। আজকে ওরা বাবু দেখবে আবারও। আলট্রা’তে এর আগেও বাবু দেখেছে ওরা। সমস্যা একটাই প্রচন্ড মুডি এই পেটে’র ভিতর থাকা পুঁচকে। চেহারা দেখায় না সে। এত বার তাকে দেখার চেষ্টা করা হলো। অপেক্ষা করা হলো। লাভ হয় না। চেহারা লুকিয়ে রাখে সে। তাই আজ দিশা জেদ ধরেই বলেছে প্রয়োজনে সারাদিন হসপিটালে থাকবে তবুও বাবু দেখেই যাবে। রাতুল দিশার মতো ম্যাচুরিটি সম্পূর্ণ একটা মেয়ে’র এমন কথায় শুধু হাসে নিঃশব্দে। রাতুলের কোন চাওয়া পাওয়া নেই। একটা সুস্থ সবল সন্তান হলেই হয়। বউ বাচ্চা ঠিক ঠাক রাতুলের বাহুতে আসলেই হয়।
ডক্টরের সাথে কথা বলে হসপিটাল থেকে বের হচ্ছিলো ওরা। দিশা রেখেছে মুখ গোমড়া করে। এমন মুখ করে যদি বউ থাকে সেটা কি মানা যায়? মোটেও না। রাতুল দিশাকে এটা ওটা বলছে মুড ঠিক করতে। দিশা’র মুড খারাপ আর ঠিক হচ্ছে না। পাঁজিটা আজও মুখ ঘুরিয়ে ছিলো। কি আশ্চর্য এত মাসেও সে দেখা দিতে নারাজ। রাতুল দিশাকে নিয়ে গাড়িতে বসালো স্বযত্নে। পাশে বসে ড্রাইভার’কে বললো গাড়ি স্টার্ট দিতে। গাড়ি যখন সাই সাই শব্দ করে ছুটছে তখন ক্লান্ত দিশা মাথা এলিয়ে দিলো সিটে। রাতুল দিশার মাথাটা নিলো নিজের কাঁধে। এক হাতে রাখলো পেটে। স্পষ্ট টের পায় রাতুল নিজের অস্তিত্বের। নড়াচড়া করে ওর অস্তিত্ব। কেমন যেন সুখ সুখ লাগে তখন। ভিন্ন একটা অনুভূতি হয়। ভিন্ন ভিন্ন রং এর প্রজাতি উড়ে বেড়ায় পাল্লা দিয়ে ওর বক্ষপটে। রাতুল ভাবতে লাগলো ছয় মাস আগের সেই দিনটির কথা যেদিন ও এই সুখের খবর পেয়েছিলো।
এই তো তখন দুই মাস পার হয়ে কিছুদিন গিয়েছে। তিন মাসে পরবে এমন একটা সময়। রাতুল রোজকার ন্যায় বাসায় এসেছিলো রাতে। আশ্চর্য ঐ দিন দিশা দরজা খুলে নি। ওর মা খুলেছিলো। রাতুল মা’কে সরাসরি বউয়ের কথা জিজ্ঞেস ও করতে পারে নি। কেমন একটা লজ্জা লাগছিলো। স্বাভাবিক ভাবে মায়ের সাথে দুই একটা কথা বলে রুমে ডুকেছিলো। যাহ্! দিশা রুমে ও ছিলো না। রাতুলের মেজাজ তখন খারাপের পথে। বাসায় নেই দিশা এরমানে নিশ্চিত বাবা’র বাসায়। একই গলিতে শশুর বাড়ী হওয়ার জ্বালা এটা। হুট হাট বউ চলে যায়। দিশা যদিও কদাচিৎ ই এমন করে। তাই বলে এত রাতে রুমে থাকবে না? বউ থাকবে বউয়ের মতো। স্বামীর কাছে কাছে থাকবে। পাশে পাশে থাকবে। নতুন নতুন প্রেম করে তখন রাতুল বউয়ের সাথে। মনে মনে ভাব হয়েছিলো। তখন কি আর বউ ছাড়া এক বেলা চলে? তীব্র অভিমানে লাল হয়ে ঠাস করে আলমারি খুলে খুলে নিজের কাপড় বের করতে নিলেই দেখলো বেডে অলরেডি ওর কাপড় রাখা। ঠুস করে আলমারি লাগিয়ে গটগট পায়ে ওয়াসরুমে ডুকে পরে রাতুল। জোয়ালামুখী’র ন্যায় মেজাজা ঠান্ডা করতে তখন পানি যদিও যথেষ্ট ছিলো না তবুও প্রায় ঘন্টা খানিক সাওয়ার ন্যায় রাতুল। চুল মুছতে মন চায় না ওর। বউ মুছে দিয় বলে কথা। যেই না ভেজা চুলে বেডে বসে পা ঝুলাচছিলো ওমনিই কেউ পেছন থেকে ওকে ঝাঁপটে ধরে। বেগ পেতে পাশের চাদর খাঁমচে ধরেছিলো রাতুল। রাতুলের উন্মুক্ত পিঠে নিজের গরম গরম গাল লাগিয়ে ছিলো দিশা তা বেশ টের পেয়েছিলো রাতুল। এতক্ষণের শক্ত, রাগী পুরুষ’টা গলে গিয়েছিলো বউয়ের সানিধ্য পেয়ে। গরম গলায় প্রশ্ন করেছিলো,
— কোথায় ছিলে?
— বাবুর আব্বুর জন্য খাবার গরম করছিলাম।
— ওহ্। দরজা খুলা যেত না?
আনমনে কথাটা বলেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো রাতুল। ভয়ে ছিটকে সরে গেল দিশা। মাথা গিয়ে লাগলো খাটের হেট বোর্ডে। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে মুখে উচ্চারণ করেছিলো,
— আহ্।
রাতুল তারাতাড়ি বউ ধরলো। মাথায় হাত দিয়ে ঢলতে ঢলতে অনুনয়ের সুরে বলতে লাগলো,
— সরি সরি জান। ব্যাথা পেলে কিভাবে?
বোকা প্রশ্ন গাধা রাতুলের। দিশা কটমট করে তাকিয়ে বললো,
— আবার পেয়ে দেখাই?
থতমত খেলো রাতুল। বউ রেগেছে। বউকে ঠান্ডা করতে নিজেকে এগিয়ে নিলো। ঘনিষ্ঠ হলো কিছুটা। যখন দিশাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিলো তখন হঠাৎ দিশা নীভু নীভু স্বরে বলেছিলো,
— বাবু এসেছে।
হঠাৎ দিশার গলা থেকে মুখ তুললো রাতুল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো দিশার দিকে। দিশা তখনও জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রাতুল ঢোক গিলে বললো,
— কিসের বাবু? কোথায় এসেছে?
— আপনার আমার বাবু। পেটে এসেছে।
এতটা সুন্দর করে বললো দিশা। ভাবলো হয়তো এখন রাতুল আরেকটু বেশি আদর করবে কিন্তু হলো কি গাঁধা’র মতো কেঁদে ফেলেছিলো রাতুল। দিশাকে জড়িয়ে ধরবে কি উল্টো দিশা ওকে থামিয়েছিলো ঘন্টা লাগিয়ে। ওর মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করেছিলো। ছাগল রাতুল এরপর ও বউকে না ধরে দৌড়ে মা-বাবা’র কাছে গিয়ে জানায়। কত পাগলামি করে। দিশা অবাক হয়ে নতুন রাতুলকে দেখেছিলো। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দেখেই যাচ্ছে। পাগল করা স্বামী। হাজার মান অভিমান মিটিয়ে আজকের এই দিন ওদের। রাতুলের রোজ রোজ এত এত কেয়ার,যত্নে আর পাগলামি’তে এখন ও মেতে থাকে দিশা।
কে বলে দিশার কপালে সুখ নেই? এই তো সুখী দিশা। আরো সুখ আসবে। দিশা আরো সুখী হবে। স্বামী সন্তান নিয়ে দিশাও সুখ পালন করবে। ডুবে থাকবে ভিজা ভিজা শীতল ভালেবাসায়।
__________________
বাড়িতে ধুম পরলো জারবা’র বিয়ের। শপিং এটা ওটা নিয়ে একদম হৈ হুল্লোড় পরে গেলো। রোদ আদ্র আর বাকি দুই বাচ্চা’কে সামলাতে সামলাতেই জান যায় যায় অবস্থা। সেখানে আবার বাড়ির মেয়ে’র বিয়ে। সবাই হাজার না করুক বসে তো থাকা যায় না। রোদ এগিয়ে গিয়ে কাজে হাত লাগায়। নাহলে নিজের কাছেই কেমন লাগে। ও কাজ করতে আসলেই আদ্র জেগে উঠবে আবার দৌড়ে উপড়ে যাবে ছেলেকে থামাতে। কোন বাচ্চা যে এতটা বাবা-মা পাগল হয় তা এই ছেলেকে না দেখলে বুঝাই যাবে না। যত বড় হচ্ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার দুষ্টামি।
আজকে ইয়াজদের বাসায় ডালা পাঠানো হবে। না চাইতেও রোদকে যেতে হচ্ছে। সবাই বারবার বলছে। দুই ভাবী’কে যেতেই হবে। আদ্রিয়ান প্রথমে না করলেও পরে ভাবলো রোদ এখন যথেষ্ট সুস্থ। একটু যাক। এমনতেই আদ্রিয়ান ওকে তেমন একটা বের হতে দেয় না। বাসা থেকে তো না ই।
রেডি হচ্ছে রোদ। রেডি বলতে বোরকা ওরে হালকা সাজবে ভেবেছিলো কিন্তু কপাল তা হলো কই? আদ্র,মিশি, মিশানকে তৈরি করেই ও শুধু বোরকাটা পরেছে ওমনি আদ্র কেঁদে যাচ্ছে। রোদ হিজাব পড়া বাদ দিয়ে এগিয়ে এসে কোলে নিতেই চুপ। মায়ের ঘ্রাণ ই তাকে থামাতে যথেষ্ট।
আদ্রিয়ান ছেলেকে রোদ থেকে নিয়ে বললো,
— তারাতাড়ি করো। সবাই রেডি।
রোদ হিজাব বাঁধতে বাঁধতে প্রশ্ন করলো,
— আপনি কেন চলছেন না?
— একটা জরুরি মিটিং আছে সোনা।
— ওহ।
রোদ রেডি হতেই আদ্রিয়ান ওদের নিয়ে নিচে নামলো। গাড়িতে সব তুলে দিয়ে বারবার সাবধান করে দিলো বাচ্চাদের নিয়ে। বিশেষ করে আদ্র। সাবা আদ্রিয়ানকে নিশ্চিয়তা দিলো। কিন্তু হলো উল্টো’টা। আদ্র’র এখন বাবা চাই। বাবা’র বুক থেকে সরাতেই সে কান্না জুড়ে দিলো। চোখ বুজে ঠোঁট কাঁপিয়ে তার কান্না। আদ্রিয়ান বুঝি ছেলে কাঁদাবে? নিজেও উঠলো গাড়িতে। রোদ হেসে বললো,
— যেটা আমরা তিন মা, মেয়ে, ছেলে মিলে পারলাম না তার জন্যই এই পুঁচকেই যথেষ্ট।
.
ওদের নামিয়ে দিয়েই আদ্রিয়ান চলে গিয়েছে। আদ্র তখন ঘুম তাই আর সমস্যা হয় নি। সব ডালা ঠিকঠাক করে ওরা বিদায় নিলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হবে হবে। গাড়িতে হঠাৎ করেই আদ্র কান্না জুড়ে দেয়। সাথে এসি হওয়া সত্ত্বেও ঘামছে। রোদ ওর ব্যাঙ্কেট সরিয়ে শুধু পাতলটা নিমা আর প্যান্ট রাখলেও কান্না থামলো না। অগত্যা গাড়ি থামিয়ে আরিয়ান বললো,
— তোমরা বাসায় যাও। আমি ওদের নিয়ে রিকশায় আসি বাকিটুকু। আব্বা আজকে থামবে না।
বলেই রিকশা ডাকতে সামনে গেলো আরিয়ান। আদ্র’কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদ৷ তখনই নজর গেলো পাশের ক্যাফেতে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আদ্রিয়ানের সাথে এক নারীকে। নারীটির যদিও বয়স ৩০ পেরিয়ে বেশি তবুও দেখে ততটা বুঝা যায় না। নিজেকে যথেষ্ট মেইনটেইন করে রেখেছে। অথচ রোদ তার থেকে এতটা কম বয়সী হয়েও এক বাচ্চার মা হয়ে কেমন হয়ে গিয়েছে এখন। বুকে মোচড় অনুভব করলো রোদ। আদ্রিয়ান মাইশার সাথে বসে আছে। এটাই কি তার জরুরি মিটিং?
আরিয়ান রিকশা আনতেই তাতে চড়ে বসলো রোদ। সারারাস্তায় চোখের সামনে ঐ দৃশ্যটাই ভেসে উঠছে।
#চলবে….
[ জানি ছোট হয়েছে। ইচ্ছে ছিলো আজই শেষ করে দিব। সম্ভব হলো না। আপনাদের এত এত কমেন্ট, ম্যাসেজ দেখে আমি তো পুরাই অবাক। এত ভালোবাসেন এই গল্পকে? সামনে যেহেতু মিড এক্সাম তাই আপাতত লাস্ট পর্ব দিয়ে শেষ করে দিব। ইনশাআল্লাহ ২৮ তারিখের পর “রুদ্রিয়ান” নাম দিয়ে ওদের নিয়ে লিখব যেখানে আদ্র সহ কিছু পর্ব থাকবে৷ এবার খুশি?]