ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব-৪৩

0
1266

#ভালোবাসার_ভিন্ন_রং
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৩

রোদ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালো আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলার কিন্তু লাভ হলো না। আবার কিছু একটা ভেবে আদ্রিয়ানকে এটা ভেবে তেমন একটা জ্বালালো ও না। রোদের মনে হঠাৎ ই কুচিন্তা এলো। ভাবলো আদ্রিয়ান হয়তো বাচ্চা চাইছে না এখন তাই এমন চুপ করে আছে। কথা বলছে না। পরক্ষণেই নিজের এমন বাজে চিন্তা’কে শয়তানের ওয়াসওয়াসা ভেবে ভুলে গেল। তখনই মিশি ছোট ছোট পা ফেলে রুমে ডুকলো। আদ্রিয়ান কপালে হাত ঠেকিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। রোদ কাউচেই বসা ছিলো। মিশি এসেই কাঁদো কাঁদো মুখে মায়ের কোলে হাত রাখলো। রোদ টেনে ওকে নিজের পাশে বসাতেই মিশি মুখটা ছোট করে মা’য়ের বাহুতে লুকালো। রোদ ভ্রু কুচকালো। বাপ-বেটির একসাথে মন খারাপ হওয়ার কোন কারণ রোদ খুঁজে পাচ্ছে না। কি হলো এদের? রোদ মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে ডাকলো,

— মা?

মিশি এই আদুরে ডাকে একটু মায়ের কাছে ঘেঁষে বসলো। রোদের হাসি পেলো। এই মেয়ে একটা আহ্লাদী। রোদই বানিয়েছে এমন। একদম আদুরে বিড়াল একটা রোদের। যাকে হাজার বোকেও যদি গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দাও ওমনি শরীর ঘেঁষে বসে থাকবে সারাদিন। মিশিও ঠিক তেমনই। এবার রোদ বলে উঠলো,

— আমার কিশমিশের কি হয়েছে?

মিশি একচোখ খুলে মাকে দেখলো। রোদ এবার মিশিকে বুকে টেনে নিলো। গালে অসংখ্য আদর করে চুমু খেয়ে বললো,

— বলুন আম্মাজান কি হয়েছে?

— মামা, নানু আর নানাভাই এসেছিলো। মিশি তো ঘুম ছিলো। কেন ডাকে নি কেউ মিশিকে? মিশি স্যাড স্যাড।

রোদ জিহ্বায় কামড় দিলো। ওর মাথায়ই ছিলো না। নিশ্চিত জারবার কাছে শুনেছে। রোদ ওকে আদর করে দিয়ে মানানোর স্বরে বললো,

— সরি মা। এই মা মাম্মা কানে ধরেছি।

মিশি তাকালো একটু। মুখটা এখনও ছোট করে আছে৷ এত অভিমানি এই মেয়ে। রোদ বেশ সময় ধরে আদর করে বললো,

— মাম্মার কাছে তার কিশমিশের জন্য একটা গিফ্ট আছে। সেটা চাই নাকি নানু বাড়ী চাই?

মিশি চট করে মুড ঠিক করে নিলো। রোদ বাঁকা হেসে বললো,

— ঢংগি মেয়ে আমার।

— মিশি গিফ্ট চাই মাম্মা।

রোদ মিশির হাতটা নিজে পেটে দিয়ে বললো,

— এখানে আছে গিফ্ট। ছোট্ট একটা পুতুল। তোমার জন্য মা৷

— আরিয়ানার মতো?

— একদম।

মিশি বেশ খুশি হলো। আরিয়ানা আসার পর থেকেই আলিফ ওকে পাত্তা কম দেয়। এ নিয়ে দু’জনের ঝগরা ও হয়েছে বেশ। কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলে না। এখন তো মিশিরও ছোট্ট কেউ আসবে তখন আলিফ’কে মিশিও পাত্তা দিবে না। এটা ভেবেই যেন খুশি দ্বিগুণ হলো। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।
আদ্রিয়ান চোখ বুজে সবই শুনে যাচ্ছে। নিজের ভেতরের ঝড়টা কাউকে বুঝাতে অক্ষম সে। এত খুশি রোদ যাকে ঘিরে সে কি আসবে কখনো? এই ধরণীতে নিজের মা-বাবার কোল আলোকিত করবে? আর রোদ? তার কি হবে? এই রোদের কিছু হলে আদ্রিয়ান না বাঁচবে না ম’রবে। জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে ও।
মিশি একটু পরই আলিফকে বলতে চলে গেল। তারও ছোট্ট পুতুল আসছে এটা এখন আলিফকে জানানো দরকার তাহলেই না পাত্তা পাবে। মিশি যেতেই রোদ দরজা লাগিয়ে ধীর পায়ে আদ্রিয়ানের কাছে এলো। বাসায় আসার পর থেকেই আদ্রিয়ানের কিছু একটা হয়েছে। না প্রকাশ করতে পারছে আর নাই এরিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু কি? আদ্রিয়ান কেন এমন করছে? এত এত প্রশ্ন রোদের মনে। উত্তর দাতাও সামনে অথচ উত্তর পাওয়া যেন দুষ্কর।
রোদ এবার আদ্রিয়ানের মাথার কাছে বসলো। কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে আদ্রিয়ান। রোদ আসার আভাস মিলেছে ওর আরো আগেই। রোদের ঘ্রাণ দূর থেকেও পায় সে। অদ্ভুত এক ঘ্রাণ আসে রোদ থেকে। উহু রোদের লাগানো কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ না এটা বরং রোদ যে মাইল্ড সুগন্ধি লাগায় তার সাথে রোদের শরীরের ঘ্রাণ মিলেই এমন ঘ্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। আদ্রিয়ান সব ঘ্রাণ ভুললেও এই ঘ্রাণ ভুলবে না। নারী শরীরের ঘ্রাণ যে বরই মাদকতাময়। পুরুষের সত্তা নাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এই ঘ্রাণ। সেখানে আদ্রিয়ানের এতটা কাছাকাছি থাকার পরও আদ্রিয়ান কোন রেসপন্স করছে না। চুলের ভাজে ঘ্রাণময়ী সেই নারীর আলতো হাতের ছোঁয়া পেলো। তবুও নড়লো না আদ্রিয়ান। রোদ বেশ সময় নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আস্তে করে আদ্রিয়ানের কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে দিলো। নরম হাতে ছুঁয়ে দিলো আদ্রিয়ানের কপাল, গাল পরপরই ছুঁয়ে দিলো ঠোঁট, থুতনি। হাত বুলালো দাঁড়িতে। রোদের বেশ পছন্দ এই দাঁড়ি। মাথা ঝুঁকিয়ে চুমু খেলো প্রসন্ন কপালে। গালে। থুতনিতে। ঠোঁটের উপর নিজের কম্পমান ঠোঁট জোড়া বাসতেই আদ্রিয়ান ভেজা অনুভব করলো। এটা আর কিছু না রোদের চোখের পানি। এই মেয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছে। কারণ টা কি? আদ্রিয়ান।
রোদ উঠে না। আদ্রিয়ান চোখ মেললো। চোখের সামনে রোদের মাথার তালু। হাত রাখলো সেই প্রাণেস্বরী নারীর মাথায়। নড়লো রোদ। আদ্রিয়ানের উপর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ানের হাতটা নিজের নরম হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো অবিরত। আদ্রিয়ানের চোখ গড়িয়ে পানি পরছে। রোদ এবার অস্থির হলো। আদ্রিয়ানের চোখ পড়ার ক্ষমতা আছে ওর। ব্যাস্ত হাতে আদ্রিয়ানের চোখ মুছে দিলো। আবারও চোখ জমে উঠলো পানিতে। রোদ ঝুঁকলো। চুমু খেলো চোখের পাতায়। আদ্রিয়ান তবুও কিছু বলছে না। এই জ্বালা কোথায় রাখবে রোদ? আদ্রিয়ান কথা কেন বলে না?
রোদ গলায় আটকানো কথাগুলো গিলে ফললো। জিজ্ঞেস করলো,

— শরীর বেশি খারাপ লাগছে?

আদ্রিয়ান মাথা এদিক ওদিক নাড়ালো। মানে খারাপ লাগছে না। এটা কি মুখে বলা যেত না? রোদের কানদুটো যে এই পুরুষের পুরুষনালী স্বরের অভ্যস্ত। রোদ আদ্রিয়ানের হাতটা চেপে ধরলো নিজের বুকে। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

— আমার সাথে কথা বলেন না কেন? আমি কি করেছি?

আদ্রিয়ান নির্বাক রইলো। এবার নিজেকে সামলাতে ব্যার্থ হলো রোদ। শক্ত হওয়া মস্তিষ্ক আর শক্ত রইলো না। দূর্বল হয়ে পরলো। কান্নারত কন্ঠে আদ্রিয়ানের দু’গালে হাত রেখে প্রশ্নগুলো করেই বসলো,

— কি হয়েছে? আমার দোষটা কি? বাচ্চা চাইছেন না আপনি? এমন কিছু? বলুন? নাকি আমার মা-বাবা কিছু বলেছে? কিছুতো বলুন? আমার সাথে এমন কেন করছেন? দোষটা বলুন। বকুন কিছু করে থাকলে তবুও কথা বলুন। আল্লাহর ওয়াস্তে কথা বলুন।

আদ্রিয়ান রোদের রাখা গালে হাত দুটির উপর নিজের হাত রাখলো। রোদের ততক্ষণে অস্থির লাগছে। আদ্রিয়ান কিছু বলবে এর আগেই রোদ চিৎকার করে উঠলো। হাত ছাড়িয়ে নিলো আদ্রিয়ান থেকে। পেট চেপে ধরলো। “আম্মু” “আম্মু” বলে কেঁদে উঠলো। আদ্রিয়ান তড়িৎ গতিতে উঠে ধরার আগেই রোদ ফ্লোরে বসে পরলো পেট চেপে। রোদের কান্নার শব্দে বাকিরাও ছুটে এলো। আদ্রিয়ান ততক্ষণে অস্থির হয়ে রোদের দেহটাকে নিজের বাহুতে পুরে নিলো। কাঁপা হাতে রোদকে জড়িয়ে ধরে বলে যাচ্ছে,

— রো..দ? এই ক..কি হ’য়ে…ছে?

বাকিটুকু বলার আগেই দ্বিতীয় বারের মতো জ্ঞান হারায় আদ্রিয়ান। সবাই দৌড়ে এসে এমন পরিস্থিতি দেখে আঁতকে উঠল। জ্ঞানহীন আদ্রিয়ানের বুকে রোদ ব্যাথায় ছটফট করছে। আরিয়ান তারাতাড়ি ধরলো। মিশান এককোনায় গুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন ছোট্ট কোন বাচ্চা ভয় পেয়ে আছে। আদ্রিয়ানকে বেডে শুয়িয়ে মায়ের কাছে দিয়ে রোদকে কোলে তুলে ছুটলো হসপিটালে। আরিয়ানের সাথে গেলো ওর বাবা আর জারবা। এদিকে সাবা আর আদ্রিয়ানের মা আদ্রিয়ানের জ্ঞান ফিরাতে ব্যাস্ত। ভদ্রমহিলা কেঁদেই যাচ্ছেন। তার ছেলেটার সুখ গুলো তুলার মতো?এই আসে এই দক্ষিণা বাতাসে উড়ে পালায়। সাবা মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মিশান আমার রুমে যাও বাবা। ওখানে বাচ্চা গুলো আছে। তাদের কাছে যাও। তারাতাড়ি।

মিশান যন্ত্রের ন্যায় তাই করলো।

_________________

দিশা বাসায় এসেই দেখলো রাতুল হাত পা ছড়িয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে। রুমের অবস্থা দেখে করুণা হলে ওর। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো,

— আহারে বেচারা ফার্চিনারগুলো কি অবস্থা করেছে তোদের। যদি তোদের যৌতুক হিসেবে আনতাম তাহলে অবশ্যই তোদের আঘাত কারীকে ছেড়ে দিতাম না কিন্তু আফসোস এগুলোর মালিকই তোদের এই দশা করেছে। আহ্! মন খারাপ করিস না। এই বেচারা’কে অভিশাপও দিস না। এমনিতেই গভীর আঘাত পেয়েছে।

আনমনেই এগুলো বলতে বলতে হাতে তুলে তুলে সব ঠিক করছে দিশা। মুখে ভর করে আছে একরাশ তাচ্ছিল্য। না আফসোস। না দুঃখ। সব ঠিক করে ছাড়ু দিয়ে কাঁচগুলো একত্রে করে পরিষ্কার করে নিলো। হঠাৎ রাতুলের পায়ের কাছে একটা কাঁচের টুকরোকে পরিষ্কার করতে গেলেই দেখলো র*ক্ত। ভ্রু কুচকালো দিশা। হাত দিয়ে রাতুলের পা টেনে ধরতেই দেখলো পায়ের কোণে ডুকেছে কাঁচ। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দিশা ছোট্ট কাঁচটা বের করে ওমনিই গলগলিয়ে বেশ কিছু র*ক্ত বের হলো। তুলা আর স্যাভনল দিয়ে সেটা পরিষ্কার করে ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। হাতের কাঁচ টুকুর দিকে তাকিয়ে বললো,

— তুই তো শুধু কারো পায়ে আঘাত করে ব্যাথা দিয়েছিস। র*ক্ত বের করেছিস। তাই চোখে দেখা যায় অথচ আমি? আমার হৃদয়ে রোজ ছুরি আঘাত হয়। র*ক্ত ক্ষরণ হয়। শুধু দেখা যায় না বলে মূল্যায়ন করে না কেউ।

কাঁচটুকু ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে গেল দিশা। এই সাস্থবান পুরুষকে এখন টেনে কে তুলবে? দিশার দ্বারা তো সম্ভব না। তবুও হাত ধরে টানলো। এতেই যেন হাফিয়ে গেলো। হাল ছেড়ে দিয়ে রাতুলের শরীর ঝাঁকিয়ে ডাকতে লাগলো,

— এই উঠেন। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরুন।

রাতুল নড়েচড়ে আবারও শুয়ে পরলো। দিশা মুখ বাকিয়ে বলে উঠলো,

— আসছে দেবদাস।

রাতুল’কে বেশ সময় ডেকে কোনমতে ধরে বেডে উঠালো দিশা। রাতুল শুয়েই কেঁদে উঠলো। দিশার বড্ড মায়া হলো। আহারে ছেলেটা। ভালোবাসা পেলো না। পরক্ষণেই ভাবলো একদম ঠিক হয়েছে। বিচ্ছেদের জ্বালায় দিশা একা কেন জ্বলবে? একজন সঙ্গি হওয়া তো মন্দ নয়। তাও সেই সঙ্গি যদি হয় নিজের বিয়ে করা বর।
রাতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিশা বলে উঠলো,

— এখন ঠিক আছে রোদ। কান্না থামান। খাবেন? নিয়ে আসব?

রাতুল দিশার হাতটা ধরে বললো,

— দিশা আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি কি করব? রোদ…।ও মা হচ্ছে। আম্মু ভালো করলো না এটা।

দিশা রাতুলের কথায় কান দিলো কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এক কথা বলে উঠলো,

— আপনি না বাচ্চা চেয়েছিলেন বাসর রাতে? নিবেন? দিব আমি।

রাতুল বুঝে উঠার আগেই দিশা ওর কলার টেনে দু’জনের ওষ্ঠাধর এক করে দিলো। এর পরিণতি যে কতটা ভয়ংকর হতে চলছে তা টের পেলো না এই নব দম্পতি।

______________

অবিন্যস্ত ভাবে হসপিটালের করিডরে ছুটে যাচ্ছে জারবা। আরিয়ান আছে রোদের কাছে। ওর বাবা গিয়েছে পরিচিত ডক্টরের কাছে। জারবা যাচ্ছে পাশের ফার্মেসীতে ইমারজেন্সি মেডিসিনের জন্য। রোদের পেইন হচ্ছে মাত্রা ছাড়িয়ে। মেডিসিন হাতে ছুটে আসতেই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো। পরে যাওয়ার আগেই কেউ আগলে নিলো নিজের প্রসস্থ বুকে। জারবা কাঁপছে। কারো কষ্ট দেখতে পারে না বোকাসোকা মেয়েটা। সেখানে কি না প্রিয় ছোট ভাই আর ভাবির এহেন অবস্থা। ইয়াজ জারবার কাছেই আসছিলো। তখনই ধাক্কাটা লাগে। জারবাকে ধরে বসিয়ে দিলো করিডোরের চেয়ারে। হাতের মুঠোয় ধরা মেডিসিনের প্যাকেটটা নিজে নিয়ে নার্সের হাতে দিয়ে পুনরায় ফিরে এলো। জারবা মাথা নিচু করে বসে আছে। ইয়াজ এসে ওর হাত ধরতেই খেয়াল করলো জারবা কাঁপছে। সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা জানা নেই ইয়াজের। শুধু জারবার মাথায় হাত রেখে ভরসার স্বরে বললো,

— ইনশাআল্লাহ রোদ ঠিক হয়ে যাবে।

— ছোট ভাইয়া আবারও জ্ঞান হারিয়েছে। ছোট ভাবী কাঁদছিলো ব্যাথায়। আমি ভুলতে পারছি না।

— রোদ এখন ঘুমিয়ে যাবে। মেডিসিন পুশ করলেই ঠিক হয়ে যাবে। এবার ব্লিডিং হয় নি। বেবি ঠিক থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

— ছোট ভাইয়ার সাথেই কেন এমন হয়? কেন সারাজীবনের জন্য সুখ পাচ্ছে না?

— জীবনটা তো ক্ষুদ্র জারবা। সুখ, দুঃখ মিলিয়েই থাকবে।

হঠাৎ ডাক পরতেই জারবাকে ভরসা দিয়ে ইয়াজ পা চালালো দ্রুত।
.
আদ্রিয়ানের জ্ঞান ফিরলো মাত্র। ফ্যামিলি ডক্টর ওর পাশেই বসা। স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন তিনি অধিক উত্তেজিত হলে দ্বিতীয় বার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভবনা আছে। আদ্রিয়ানের মা একাধারে কেঁদেই যাচ্ছেন। আদ্রিয়ান চোখ খুলেই এদিক ওদিক তাকিয়ে “রোদ” বলে ডেকে উঠলো। পাগলের মতো বলতে লাগলো,

— আম্মু আম্মু রোদ….আমার রোদ কোথায়? ও…ওর না পেটে ব্যাথা করছিলো? আ…আমার এই বাচ্চাটা ও ক..কি…

আর বলতে পারলো না। আদ্রিয়ানের মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। শান্ত করতে চাইলেন। লাভ হলো না। সাবা আরিয়ানকে কল করছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। আদ্রিয়ান ওর মা’কে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। দূর্বল শরীর এখনও। সাবাকে জিজ্ঞেস করলো,

— ভাবী রোদ কোথায়?

— আদ্রিয়ান ভাই তোমার ভাইয়াকে কল করছি। শান্ত হও। রোদকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে।

— কোন হসপিটাল?

নাম শুনতেই ছুট লাগালো আদ্রিয়ান। ওর মা মুখ চেপে বসে পরলেন। সাবার চোখেও পানি। কি হতো এই ছেলেটার সুখগুলো দীর্ঘ স্থানী হলে?
.
হসপিটাল জুড়ে পাগলের মতো ঘুরছে আদ্রিয়ান। কিভাবে এসেছে আল্লাহ জানে। এদিক ওদিক পাগলের মতো খুঁজছে। রিসিপশনে গিয়ে আর বলতে পারছে না পেসেন্টের নাম। বারবার বলছে,

— আ….আমার র…রোদ। আমা…র বাচ্চা কি চ…চলে গেছে?

এমন হৃষ্টপুষ্ট একজন তাগড়া জোয়ান এভাবে পাগল পাগল হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক। বড়লোকের সন্তান। রিসিপশনের মেয়েটি কল করে জানার চেষ্টা করলো সদ্য এডমিট হওয়া প্যাশেন্টের নাম কিন্তু লাভ হলো না। আরিয়ান এখানকার ডাক্তার হওয়াতে রেজিষ্ট্রেশন করা হয় নি। হঠাৎ জারবা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে এগিয়ে আসে। নিজের ভাইকে এভাবে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,

— ছোট ভাইয়া তুমি ঠিক আছো?

— রো..দ কোথায়?

জারবাকে ওকে নিয়ে কেবিনের সামনে যেতেই আরিয়ানের সাথে দেখা হয়। আদ্রিয়ান ভাইকে জড়িয়ে ধরে। আরিয়ানের কথা বলার ভাষা নেই। আদ্রিয়ান কাঁপা গলায় বললো,

— ভা..ই আমার এই বাচ্চা…টাও কি চলে গেলো?

আরিয়ানেরও কান্না পাচ্ছে কতটা অসহায় হয়ে আজ কি না আদ্রিয়ান ওকে ভাই ডাকছে। ছোট থেকে অনেক চেষ্টা করেও কেউ আদ্রিয়ান’কে দিয়ে আরিয়নকে ভাই ডাকাতে পারে নি। আজ সেই ভাই এমন হয়ে ওকে ভাই ডাকছে।

— তোর বাচ্চা আর রোদ দু’জনই আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছে।

আদ্রিয়ান জোরে দম নিলো। শরীর ছেড়ে দিলো। এতক্ষণ হয়তো মনের জোরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আরিয়ান হঠাৎ এত ভর সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাহায্য নিলো। আদ্রিয়ানকে চেয়ারে বসাতেই জারবা পানি খাওয়ালো। আরিয়ান আদ্রিয়ানকে শান্ত করলো। বেশ সময় পর বলা শুরু করলো,

— তুই ভেঙে পরলে কিভাবে হবে আদ্রিয়ান? রোদ যদি এভাবে স্ট্রেসে থাকে তাহলে সেটার প্রভাব পরবে বাচ্চার উপর। আজ বেবি ড্রপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো অনেক। আল্লাহ রহম করেছে না হলে কিছু একটা হয়ে যেত। যেখানে তুই ওর সাহস হবি সেখানে তুই ওর দূর্বলতা হচ্ছিস। নিজের কি অবস্থা করেছিস ঘন্টার ব্যবধানে? ওর শরীরের অবস্থা তো জানিস? তাহলে কেন এমন করছিস? বল? রোদকে আগলে রাখার সময় এটা। ওর সাহস যোগা। ওকে ভরসা দে। ওর হাত ধর। তুই কি না ওকেই এভয়েড করছিস? রোদের তোকে প্রয়োজন আদ্রিয়ান। আজ ওর মা নিতে চাইলেও মেয়েটা নড়লো না। কার জন্য? তোর জন্য। পাগলের মতো ভালেবাসে তোকে। তুই ওর সাথে থাক। সবটুকু আল্লাহর কাছে ছেড়ে দে। নিশ্চিত আল্লাহ উত্তর পরিকল্পনাকারী।

আদ্রিয়ান শুনলো সবটা। উঠে দাঁড়িয়ে গেল। পা বাড়িয়ে কেবিনে ডুকলো। চোখ বুজে ঘুমাচ্ছে তার রোদ। হাসলো আদ্রিয়ান। ঝুঁকে চুমু খেল রোদের কপালে। থামলো না। সারামুখ জুড়ে চুমু দিলো। সবটুকু আদর দিলো সেই মায়াময় চেহরায়। গালে হাত বুলিয়ে বললো,

— আমার জান তাকাও। এই রোদ? তাকাও। সোনাপাখি। সরি অনেক। কষ্ট পেয়েছো অনেক? ব্যাথা কমেছে?

একা একা কথাগুলো বলে আবার পেটে হাত বুলালো। মিনতির সুরে বললো,

— এই বাবা-মা। যেই হোও না কেন প্লিজ আসো। বাবা অনেক কষ্ট পাচ্ছি। যেও না। বাবা অনেক ভালোবাসব। সত্যি বলছি। বাবার বুকে ঘুমাবে না সোনা? বাবার বুকে ব্যাথা করে তো পাখি। আসো তারাতাড়ি। মায়ের পেট থেকে সোজা বাবার বুকে ঠিক আছে? প্রমিজ করো। করলে তো? প্রমিস কিন্তু ভাঙতে নেই। কেউ নিতে আসলে বলবে, “যাব না,আমার বাবা অপেক্ষা করছে”। তোমার বড় ভাই আর বোনও অপেক্ষায়। তুমি আসো। অনেক ভালোবাসব জান। বাবা’র কলিজা, বাবার বুকে এসো হ্যাঁ? বাবা অপেক্ষায় আছি বাবাই। অনেক ভালোবাসি আব্বু।

নিজের অনাগত অস্তিত্বের সাথে আলাপ করলো আদ্রিয়ান। রোদ চোখ খুলে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। এ কেমন আকুতি আদ্রিয়ানের? এভাবে বলতে হয়? বুঝলো না রোদ। জানলো না তার একটা অংশ যে অনেক আগেই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে। তারজন্যই আদ্রিয়ান নামক বাবাটা এতটা আকুল হয়ে আছে।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে