#ভালোবাসার বন্ধন
#পর্ব_০৫
#অধির_রায়
অনেকক্ষণ ধরে স্নান করছে। কিছুতেই বালি গা থেকে উঠছে না৷ তূর্জয় খুব রেগে আছে। কিছুতেই মিহু ওয়াসরুম থেকে বের হচ্ছে না৷
— মিহু। ওপেন দ্যা ডোর।
— কি বললেন? বুঝতে পারিনি। বাংলায় বলেন!
— “মিহু ভালোভাবে বলছি দরজা খোল। না হলে দরজা ভেঙে ফেলবো।” রেগে বলে উঠে তূর্জয়।
মিহু উপায় না পেয়ে ওয়াসরুমের দরজা খোলে দেয়৷ তূর্জয় ওয়াসরুমে প্রবেশ করে বলে উঠে, ” স্নান করতে কতোক্ষণ লাগে।”
— আমি কি করবো? গা থেকে কিছুতেই বালি উঠছে না?
— আরে বুদ্ধু এসব বালি একা তুলতে পারবে না৷ মানুষের গায়ের স্পর্শে এসব বালি উঠে যায়৷ কোনদিন হিন্দি মুভি দেখোনি৷ মানলাম তুমি সুইজারল্যান্ডে এর আগে আসো নি।
— মুখ বাংলার পাঁচের মতো করে, ” আমি জানলে এমন কখননোই করতাম না৷ সাবান দিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম। ” কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
— সাবান দিয়ে এসব বালি উঠবে না৷ আমি তোমার বালি তুলে দিচ্ছি। তুমি আমার বালি তুলে দাও৷
একে অপরকে সাহায্যের মাধ্যমে দেহ থেকে অনেক কষ্টে বালি দূরে করে।
মিহু কাভার্ড থেকে কম্বল নিয়ে ফ্লোরে শুতে যেতেই তূর্জয় বলে উঠে, ” ফ্লোরে ঘুমাতে হবে না৷ বিছানায় আসো৷”
— কিন্তু আপনি তো…?
— কোন কথা না বলে বিছানায় আসো৷ এখানকার ফ্লোরে অনেক জীবাণু থাকতে পারে৷ তুমি যদি অসুস্থ হও আমাকেই বিপদে পড়তে হবে৷
— আমার এত খেয়াল রাখতে হবে না৷ আমি এখানেই ঠিক আছি৷
মিহু ফ্লোরে শুয়ে পড়ে৷ মিহুর এমন ব্যবহার দেখে তূর্জয়ের খুব রাগ উঠে যায়৷ তূর্জয় মনে মনে বলতে থাকে, ” মন বলছে এই মেয়েটাকে থাপ্পড়িয়ে এখানে নিয়ে আসি৷ ” মেয়ে মানুষ মানেই ন্যাকা সাজে।
মিহু মনে মনে তূর্জয়কে বকে যাচ্ছে, ” এখন আসছে ভালোবাসা দেখাতে। দেখাতে হবে না এমন ভালোবাসা। আমি ভালো আছি৷”
হঠাৎ করেই মিহু শূন্যে ভাসতে শুরু করে৷ চোখ মেলে দেখে তূর্জয় মিহুকে কোলে তুলে বিছানা নিয়ে আসছে।।
— এই এই আমাকে কোলে নিচ্ছেন কেন? নামান আমাকে?
— এই মেয়ে কোন কথা বললে, এখনই ফেল তোমার কোমর ভেঙে দিবো৷ এত ন্যাকা সাজার দরকার নেই৷
ভূর্জয় মিহুকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। বিছানা থেকে মিহু নেমে আসতে নিলেই তূর্জয় মিহুকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়৷ মিহু তূর্জয়ের এমন কাজে অবাক৷ তূর্জয় তো মিহুকে সহ্য করতেই পারে না৷ তিনিই নিজ থেকে বুকে টেনে নিচ্ছে৷ মিহু ভাবতে ঘুমিয়ে যায়৷ মিহুর ঘুম আসার পর তূর্জয় মিহুকে বিছানার এক পাশে রেখে সেও নিজেও ঘুমিয়ে যায়।
সকাল বেলা তূর্জয় স্বান শেষ করে খালি গায়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ মিহু তূর্জয়ের গায়ে চাঁদর দিয়ে বলে উঠে, ” আপনি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
— মানে কি? আমি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার সমস্যা কি?”
— না! আপনি খালি গায়ে থাকবেন না৷
তূর্জয় দুষ্টু হাসি দিয়ে মিহুকে কাছে টেনে নিয়ে, “আমাকে খালি গায়ে দেখলে তুমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারো না৷ সেটা বলতেই পারো।”
— আমার তো কোন কাজ নেই আপনার উপর ক্রাশ খাবো। আপনি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন বলে অনেক মেয়ে আপনার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আপনি কি সেটা খেয়াল করছেন?
— ভাব নিয়ে, “তো কি হয়েছে?”
— আমি খালি গায়ে থাকবেন না ব্যাস। আমি যেমন আপনার কথা শুনে চলি। এখন থেকে আপনিও আমার কথা শুনে চলবেন।
— আমি কেন তোমার কথা শুনে চলবো৷
মিহু নিজেকে তূর্জয়ের স্ত্রী দাবি করতে নিয়েও থেমে যায়৷ পরক্ষণে বলে উঠে, ” আপনি তো আমাকে কোনদিন নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবেন না৷ তাই আমি আপনার একজন ভালো বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে বলছি৷ বেস্ট ফ্রেন্ডের কথা রাখতে হয়৷
— ওঁকে,,
সকালের খাবার শেষ করে তারা জলন্ত পুতুল মানে ক্লক টাওয়ারে চলে আসে৷ নিয়তির চোখ শুধু ক্লক টাওয়ারের জলন্ত পুতুল খুঁজছে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না৷ এই নিয়ে তার অনেক চিন্তা হচ্ছে। কেউ কি জলন্ত পুতুলটি চুরি করে নিয়ে চলে গেছে নাকি৷
— এই যে শুনেন!
— কথা না বলে এখানকার সব দৃশ্য দেখে যাও৷ কতো সুন্দর ভাবে সাজানো।লাইটিং গুলো কতো সুন্দর। দেখলে মন ভরে যায়।
— আরে আমি বইয়ে পড়েছিলাম এখানে জলন্ত পুতুল রয়েছে। যার জন্য এই ক্লক টাওয়ার আরও বেশি বিখ্যাত পৃথিবীর বুকে৷
— একদম রাইট৷ এখানেই জলন্ত পুতুল রয়েছে। আর ক্লক টাওয়ারের জলন্ত পুতুলকে Zytglogge বলে৷
— সবই বুঝলাম এখান জলন্ত পুতুল দেখতে চাই৷
তূর্জয় মিহুর হাত ধরে ক্লক টাওয়ারের নিচের দিকে নিয়ে যায়৷ উপরে থেকে ক্লক টাওয়ার নিচের দিকে আরও সুন্দর করে লাইটিং করা।
— এই মোমের পুতুলটির নামই জলন্ত পুতুল। চারিপাশে আগুনে শিখা দিয়ে ঘেরা৷ যার জন্য একে জলন্ত পুতুল বলে।
মোমের তৈরি জলন্ত পুতুল দেখে মিহু হেঁসে বলে উঠে, “আমাকে আপনার পাগল মনে হয় ? এটি যদি মোম হতো তাহলে গলে পড়ে যেত৷ ”
— এটি গলে না তাই এর নাম জলন্ত পুতুল। এটি ১৬ শতকে তৈরি করা হয়৷ এটি গলে না বিদায় এর নাম রাখা হয়েছে জলন্ত পুতুল।
— এখন কিছুটা বুঝতে পারলাম৷
তারা দুইজনে কিছু পিক তুলে নেয়। মিহু আবার বলে উঠে, ” আমি আর একটা কথা বলতে চাই।”
— তূর্জয় বিরক্তের সাথে বলে উঠে, ” কি কথা! ”
— আমাদের দেশে টাওয়ার বানানো হয় শুধু ফোনের নেটওয়ার্কের জন্য৷ কিন্তু সুইজারল্যান্ডের টাওয়ারে হোটেল, শপিং মল সব কিছু কেন?
— কারণ সুইজারল্যান্ড অনেক উন্নত দেশ৷ এখানে সব কিছু সম্ভব। তারা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে৷ আর হ্যাঁ আমাদের দেশেও এমন এমন বড় বড় ক্লক টাওয়ার হতে পারে।
— তাহলে আমাদের দেশে এমন টাওয়ার বানাই না কেন?
— কারণ আমাদের দেশ দূর্নীতিতে ভরপুর। সেজন্য এমন বড় বড় টাওয়ার সম্ভব নয়৷ আচ্ছা বাদ দাও। চল আমরা জেনেভায় যায়৷ জেনেভায় যাওয়ার পর দুপুরের খাবার খাবো৷ এখন খেতে গেলে লেট হয়ে যাবে৷
— জেনেভায় কেন যাব?
— সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে৷
সুইজারল্যান্ডের একটা গাড়ি হায়ার করে তারা দুই জনেই জেনেভার বুটানিক্যাল গার্ডেনে চলে আসে৷ নিয়তি এমন সবুজের সমাহার দেখে খুব খুশি৷ মনে হচ্ছে সবুজের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে৷ যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজের সমারোহ। মন ভয়ে যায়৷ পৃথিবীর প্রায় ১৪,০০০ হাজারও বেশি প্রজাতির গাছ এখানে রয়েছে৷ বিজ্ঞানীরা এসব গাছ থেকে অনেক মহা ওষুধ উৎপন্ন করে৷
— ওয়াও খুব সুন্দর জায়গা৷
— হুম সুন্দর। আর প্রতিটি গাছের পিক তুলে নাও৷ সাথে বৈজ্ঞানিক নামও দেওয়া আছে৷ শিক্ষার্থী এখানে এসে যেন শিক্ষা গ্রহন করতে পারে।
— আরে রাখেন আপনার শিক্ষা। শিক্ষার মাঝে সব দেশের সরকার লগ ডাউন দিয়েছে। তা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না৷
ঘুরাঘুরি শেষ করে তারা দুপুরের খাবার সন্ধায় খায়৷ মিহু হোটেলে বসে পড়েছে৷ সে আর কোথাও যাবে না৷
— এখন যেখানে নিয়ে যাব সেখান থেকে তুমি আসতে চাইবে না৷
— এখন আবার কোথায় নিয়ে যাবেন৷
— জেনেভা শহরটি জেনেভা লেকের জন্য বিখ্যাত। জেনেভার বুকের উপর দিয়ে বয়ে গেছে জেনেভা লেক৷ এখানে এসেছি আর জেনেভা লোক দেখবো না সেটা কখনো কি হতে পারে৷ চল জেনেভায় লেকে৷
— এখন তো রাত হয়ে গেছে৷ রাতে না গেলে হয়না৷
— জেনেভা লেকের সৌন্দর্য রাতের বেলায় ফুটে উঠে৷ চল তারাতাড়ি।
মিহু না চাওয়া সত্ত্বেও তূর্জয় মিহুকে জোর করে জেনেভার লোকে নিয়ে যায়৷ মিহু এখানে এসেই তার চোখ আকাশ পানে৷ জেনেভা লোক বৃহত্তর দ্বিতীয় পর্যটন কেন্দ্র। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এখানে দর্শনের জন্য উপযুক্ত সময়৷ তাছাড়া সারা বছর এখানে আসা যাওয়া চলে।
জেনেভার লেকের ঘাটে বাঁধা আছে ছোট ছোট অনেক ডিঙ্গি নৌকা। যা দিয়ে দুই জন প্রেমিক প্রেমিকা রাতের শহরে ঘুরতে পারে। লেকের দুই পাশ দিয়ে রয়েছে অনেক শপিং মল।
— মিহু বলে উঠে, “আমি নৌকায় উঠবো৷”
— অবশ্যই আমরা নৌকায় উঠবো৷ নৌকায় না উঠলে চলে কি? এখানে নৌকা দিয়ে ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখা যায়৷ জলের সাথে বন্ধুত্ব করা যায়৷
— অ আচ্ছা৷ তাহলে তারাতাড়ি চলেন৷
মিহুকে নিয়ে তূর্জয় একটা নৌকা দুই ঘন্টার জন্য হায়ার করে নদীর মাঝে ঘুরতে চলে যায়৷ রাতের আকাশের তারা নদীর জলে ঝলমল করছে৷ দেখে মনটা খুব ভয়ে যায়। মিহু তূর্জয়কে মাঝে মাঝে জল দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে৷ তূর্জয়ও মিহুকে মাঝে মাঝে জল দিচ্ছে। এরই মাঝে মনে পড়ে যায় ছোঁয়ার কথা৷ আজ যদি মিহুর জায়গায় ছোঁয়া থাকতো৷ তাহলে আমাদের হানিমুনটা এর থেকে আরও সুন্দর হতো৷ মন খারাপ করে তূর্জয় নৌকা ঘুরাতে বলে উঠে।
— মিহু তূর্জয়কে বলে উঠে, “এখনো তো দুই ঘন্টা হয়নি। চলে যাবেন কেন?”
— এমনি চলে যাবো। আমার শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না৷
অতীত পিছন ছাড়ে না৷ ভালোবাসার মুহুর্তে অতীতের কথা মনে এসে নাড়া দেয়৷ না পারছে ছোঁয়াকে ভুলতে না পারছে মিহুকে আপন করে নিতে৷ দুই টানায় ভুগছে তূর্জয়।
মিহুর কথার কোন জবাব না দিয়ে তারা রাত বারোটার দিকে হোটেলে ফিরে আসে। তূর্জয় মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল বেলা তূর্জয় ঘুম থেকে উঠে দেখে নিজের গায়ে কোন জামা না দেখে চিৎকার করে মিহুকে ডাক দেয়৷
চলবে…