ভালোবাসার তুই পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
3504

#ভালোবাসার_তুই
#Last_Part
#Writer_NOVA

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো।সারা বাড়ি সাজ সাজ রব।আজ আমার বিয়ে।বাসায় হৈ চৈ,চিল্লাচিল্লিতে আমার মাথা ধরে আছে।বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। আজই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো ভাবতেই দুচোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে।নিজের রুমে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। হঠাৎ মাথায় কারো আলতো পরশ পেলাম।মাথা উঁচু করতেই আব্বুকে দেখতে পেলাম।আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো।

আব্বুঃ কান্না করিস না মা।আমি জানি তোর অনেক খারাপ লাগছে।তবে তোকে শক্ত হতে হবে।আমি তো জানি আমার মা কিছুতেই ভেঙে পড়বে না।তুই না আমার স্ট্রং ডটার। তুই যদি কাঁদিস তাহলে কি আমার ভালো লাগবে বল।মা রে, এনাজ অনেক ভালো ছেলে।আমি সত্যি চিন্তামুক্ত হবো ওর হাতে তোকে তুলে দিলে।ও তোকে অনেক ভালো রাখবে।ওর চোখে আমি তোকে হারানোর ভয় দেখেছি।যার চোখে আমার মেয়েকে হারানোর ভয় আছে তাকে কখনও কষ্ট দিয়ে দূরে সরিয়ে দিস না।তাহলে হয়তো নিজে জীবনেও সুখী হতে পারবি না।

আমিঃ আমি তোমাদের ছাড়া কোথাও যাবো না আব্বু। আমি যে তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।এই বাড়ির সবকিছু ছেড়ে যেতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।(কিছুটা ভেবে) আমি একা একা কি করে সামলাবো সব?আমিতো কিছুই করতে পারি না।রাত ১২ টায় ঘুমিয়ে দিন ১২ টায় উঠি।উঠেই দেখি মুখের সামনে খাবার হাজির।বাসায় কোন কাজ করতে হয় না।আমার জামাই বাড়ি গিয়ে তো কত কাজ করতে হবে।এসব ভেবেই আমার বুক ফেটে চিৎকার আসছে।

আব্বুঃ এই রে বজ্জাত মেয়ে। আমরা চিন্তা করছি তোর।আর তুই চিন্তা করছিস শ্বশুর বাড়ি গিয়ে কাজ করতে হবে বলে।তার জন্য এতোদিন তুই বিয়ে করতে রাজী হসনি।আল্লাহ কি পাঁজি মেয়ে দিলে আমায়।

আব্বুর কথা শুনে আমি কান্নার মাঝেও খিলখিল করে হেসে উঠলাম।আমি ইচ্ছে করে এসব কথা বলেছি।কারণ আমি স্পষ্ট আব্বুর চোখে পানি দেখেছি।আমি চাই না আব্বু কান্না করুক।

আব্বুঃ মা রে ঐ বাড়িতে গিয়ে আর যাই করিস ছেলে দুটোর সাথে কোন অশান্তি করিস না।তোর শ্বশুর, শ্বাশুড়িও নেই যে তোকে জ্বালাবে।ওদের সাথে মিলেমিশে বাস করিস।তাতেই আমি খুশি হবো।আমি তো আজ আমার কলিজার টুকরো টাকে অন্যের ঘরে পাঠাচ্ছি। বড় মেয়ে সব বাবার আদরের।

আমিঃ আব্বু তুমি একটুও চিন্তা করো না।তোমাদের সম্মানহানী হয় এমন কাজ তোমার মেয়ে কখনোই করবে না।তুমি দেখো তোমার এই দুষ্ট মেয়েটা ঠিক সংসারী হয়ে যাবে।সবার খেয়াল রাখবে।সবকিছুর সাথে ঠিক খাপ খাইয়ে নিবে।

ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি।কিন্তু কিছুতেই পারছি না।একসময় ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।আব্বু শক্ত করে আমার মাথাটা তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।আমি ও আব্বু দুজনেই কাঁদছি।কারো চোখের বাঁধ ভাঙছে না।অনেকক্ষণ কান্না করার পর আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে, চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।আব্বু চলে যাওয়ার পর রুমে ঢুকলো আমার তিন বান্দরনী। এসেই দুষ্টামী শুরু করলো।

ইভার মুখটা আজ ফোলা ফোলা। দেখে মনে হচ্ছে অনেক কান্না করছে। যেই বোনটা আমাকে সবসময় বলতো, তুমি কবে শ্বশুর বাড়ি যাবা আর কবে আমি তোমার থেকে শান্তি পাবো।সেই বোনটার চোখেও আজ পানি।রুমের এক কোণে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাত বাড়িয়ে ডাকতেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো।

ইভাঃ বোইনে আর কিছু দিন থেকে যাও না।তুমি না থাকলে আমার একটুও ভালো লাগবে না।আমি সারাক্ষণ কার সাথে ঝগড়া করবো।আম্মুর কাছে কার নামে বিচার দিবো।রাতে ঘুমের ঘোরে কাকে কোল বালিশ বানাবো।তোমায় অনেক মিস করবো।প্লিজ তুমি আজকে যেও না।(কাঁদতে কাঁদতে)

আমিঃ ধূর,বোকা মেয়ে। কাঁদছিস কেন?আমি তো আগামীকালই চলে আসবো।আমি না থাকলে একটুও দুষ্টুমী করিস না।আম্মু, আব্বু কে দেখে রাখবি।আমার পছন্দের খাবারগুলো বানিয়ে রাখবি।আমি হুট করে তোর দুলাভাই কে নিয়ে খেতে চলে আসবো।একদম কান্না করিস না।আমার ভীষণ খারাপ লাগে।

দুই বোন দুজনকে শক্ত করে ধরে রেখেছি।আজ তো ছেড়ে না দিলেও চলে যেতে হবে।পার্লারের মেয়েরা সাজাতে চলে আসায় ইভা বের হয়ে গেলো।ওকেও তো তৈরি হতে হবে।শতহোক বড় বোনের বিয়ে বলে কথা।সিফা,মৌসুমি ও শারমিন আমার পাশে বসে মন ভালো করার চেষ্টা করতে লাগলো।

🍂🍂🍂

নিজের বিয়ে হলে কি হবে?কাজ তো কম নয়।সবকিছুর তদারকি করছে এনাজ।এনামের ভরসায় যে কাজগুলো রেখেছিলো সেগুলো লাটে উঠেছে। উঠবে না কেন? এনাম তো সারাক্ষণ কানে মোবাইল গুঁজে নিতুয়ার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।গাড়ি সাজানোর লোকের কাছে কল করে তাদের জলদী আসতে বললো এনাজ।জিসান রুমে ঢুকে জোরে একটা চিৎকার দিলো।কারণ এনাজ এখনো বরের বেশে তৈরি হয়নি।

জিসানঃ এনাজ তুই তো এখনো কিছুই করিস নি।আমাদের কিছু সময়ের মধ্যে বের হতে হবে।

এনাজঃ আস্তে চেঁচায় ভাই।গতকাল থেকে কাজ করতে করতে আমি টায়ার্ড।প্রচন্ড মাথা ধরেছে।এখনো কত কাজ বাকি।গাধা(এনাম) টাকে বলেছিলাম যে কাজ তুই করতে পারবি সেটা কারো আশায় না রেখে করে নিবি।গাধায় আমার জন্য সব কাজ রেখে দিয়েছে। আগে যদি জানতাম নিজের বিয়ে তে এতকাজ করতে হবে তাহলে এত ভেজাল না করে ঘরোয়াভাবে করে নিতাম।

জিসানঃ আরে প্যারা নিস না ভাই।যাস্ট চিল কর।আজকে ভাবী এসে মাথায় ঔষধ দিয়ে টিপে দিবে।দেখবি ভালো হয়ে যাবে।আরে আজকেই শুধু কষ্ট করে নে।কাল থেকে তো তোর জন্য ভাববার মানুষ হয়ে যাবে।ভাবীর ভালোবাসায় সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস তুই। (এক চোখ মেরে)

এনাজঃ তোর এসব নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা দূরে রাখিস।ভালো হয় যা।ভালো হতে টাকা-পয়সা লাগে না।আর আমার বউ নিয়ে তোর এতো মাথা না ঘামালেই চলবে।

জিসানঃ আমি পজিটিভলি বলেছি কিন্তু তুই যদি নেগেটিভ নিস আমার কিছু করার নেই।

এনাজঃ তুই কি এখন বাইরে যাবি?

জিসানঃ হ্যাঁ,কেন?

এনাজঃ তুই বাইরে গেলে পাঠা-টাকে কান ধরে আমার রুমে দিয়ে যাস তো।একটু পর বরযাত্রি বের হয়ে যাবে।কিন্তু ওর তৈরি হওয়ার কোন নাম-গন্ধও নেই। নিশ্চয়ই কোন চিপাচিপায় বসে নিতুয়ার সাথে প্রেম করছে।এই গাধাটাকে নিয়ে আমার আরেক জ্বালা।দিনকে দিন শুধু গর্ধব হচ্ছে। কমোন সেন্সগুলো ওর মাথা থেকে ছুটি নিয়ে পালিয়েছে।

জিসানঃ তোর মাথা ব্যাথার সাথে সাথে কি পুরোই গেছে নাকি।কখন থেকে এনাম কে বকেই যাচ্ছিস।

এনাজঃ ওকে এখন সামনে পেলে পিটুনি দিবো।বকাটা তো কম হয়ে গেছে। আজকের দিনেও কি ওর এসব নিয়ে পরে থাকলে হবে।আমি একা কয়দিক সামলাবো বল।তোর ওপর তো চাপ পরে যাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে একটা কাজ করলে একটাই কমে।সেটা ওকে বোঝাবে কে?

জিসানঃ আচ্ছা তুই হাইপার হোস না।আমি খুঁজতে যাচ্ছি। পেলে তোর কাছে পাঠিয়ে দিবো।

এনাজ জিসানের সাথে কথা বলতে বলতে আলমারি থেকে বিয়ের যাবতীয় কাপড়চোপড় বের করলো।গাঢ় লাল রংয়ের শেরওয়ানি,পায়জামা,পাগড়ি,
মোবাইল আরো বেশ কিছু জিনিস বিছানার উপর রেখে ওয়াসরুমে গোসল করতে চলে গেল।জিসান রুম থেকে বের হলো অন্য কাজ ঠিকমতো চলছে কিনা তা দেখার জন্য ও এনামকে খুঁজে আনার জন্য। এনাজ গোসল শেষ করে বের হয়ে শেরওয়ানি পরছে।হঠাৎ মনে হলো ওর শেরওয়ানি কেউ ঠিক করে দিচ্ছে। পেছন ঘুরে দেখতে পেলো এনাম একটা শুকনো হাসি দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাস, এনাজের রাগ পানি।ভাইয়ের হাসি মাখা মুখটা দেখলে এনাজ রাগ করে থাকতে পারে না।

এনাজঃ এই তোর আসার সময় হলো।তুই এখনো রেডি না হয়ে কি করছিস?
এনামঃ আসলে ইয়ে মানে ভাইয়া।
(আমতা আমতা করে)
এনাজঃ হয়েছে আর মাথা চুলকাতে হবে না।আমি জানি তুই এতক্ষণ নিতুয়ার সাথে কথা বলেছিস।বিয়ের ভেজালটা চলে গেলেই আমি নিতুয়ার বাবার সাথে কথা বলে তোদের বিয়েটা সেরে ফেলবো।এখন দয়া করে জলদী রেডি হয়ে আমাকে উদ্ধার কর।
এনামঃ ধন্যবাদ ভাইয়া।(এনাজকে জড়িয়ে ধরে)
এনাজঃ হয়েছে আর ভাব নিতে হবে না।ছাড় আমাকে।অলরেডি দেরী হয়ে গেছে।
এনামঃ ভাইয়া আমি একটা জিনিস চিন্তা করছি🤔।
এনাজঃ কি?
এনামঃ তুমি ভাবীর মতো লিপস্টিক পাগলীকে সামলাবে কি করে?না মানে যা উড়নচণ্ডী স্বভাবের।
এনাজঃ মুখে লাগাম দে তুই। বড় ভাবী মায়ের সমান।তাই ওকে মিন করে এসব কথা না বললেই তোর মঙ্গল।
এনামঃ তবে তুমি যাই বলো ভাইয়া।ভাবীকে দেখলে আমার বাদশাহর একটা গান মনে পরে যায়।
এনাজঃ কি গান?(চোখ দুটো ছোট ছোট করে)
এনামঃ এ লাড়কি পাগল হে, পাগল হে, পাগল হে।
এনাজঃ দাঁড়া ফাজিল। তোর একদিন কি আমার একদিন।পিঠের মধ্যে মারবো কষিয়ে একটা।

এনাজ হাত উঁচু করে মারতে উদ্যত হলেই এনাম দৌড়ে পালালো।এনাজ ভাইয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো। এনাম অবশ্য গানটা খারাপ বলেনি।লিপস্টিক পাগলীর পাগলামি ও তার মায়াবী চোখ দুটো দেখেই তো সে তাকে ভালোবেসেছে। অনেক অপেক্ষা করেছে এই দিনের জন্য।অবশেষে আজ তার ভালোবাসার পূর্ণতা পাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার_তুই টাকে স্বকৃতি দিয়ে ঘরে তুলছে।কয়জন এমন ভাগ্যবান আছে যে তার ভালোবাসার_তুই টাকে আপন করে পায়।

🍂🍂🍂

যথানিয়মে আমারও এনাজের বিয়ে হয়ে গেল।আমি ভাবতেই পারছি না যাকে আমি মাত্র একমাস আগে চিনতাম না সে আজ আমার স্বামী।গাঢ় লাল রং-এর ভারী লেহেঙ্গা পরে,বিশাল বড় একটা ঘোমটা টেনে বাসরঘরে বসে আছি। বাড়ির জন্য মনটা অনেক আনচান করছে।খুব খারাপ লাগছে।আম্মু,আব্বু, ইভাকে ছাড়া এখন থাকতে হবে।
সবাইকে জরিয়ে ধরে ইচ্ছে মতো কান্না করেছি।ইভাতো আমাকে ছাড়তেই চাইছিলো না।পোটকা মাছকে আজ বিয়ের দিনও মন মতো জালিয়ে এসেছি।আসার আগে বলেও এসেছি ভাবিস না সাইফ আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে তোকে জ্বালাবো না।বরং আগের থেকে আরো বেশি জ্বালাবো।বাপের বাড়ি ছারছি পড়াশোনা তো নয়।এক আকাশ বিষন্নতা ঘিরে রেখেছে। রুমের চারিদিকে গোলাপের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে।

আমিঃ ধূর ভালো লাগে না।ঐ ধলা ইন্দুর আসে না কে?আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে। মোবাইল থাকলে এখন এরকম করে বোরিং সময় পার করতে হতো না।আল্লাহ এতো মশা কেন?একটা কয়েলও জ্বালায়নি এরা।এনাজ সাহেব যে এত কিপ্টা আমার জানা ছিলো না।মশার বাচ্চা, তোদের আমি ভর্তা বানামু।নীরিহ, অবলা একটা মেয়েকে একা পেয়ে তোরা এমন রক্তের পার্টি দিচ্ছিস।তোদেরও আমি দেখে নিবো।বুঝি না এই মশার সাথে আমার কোন জন্মের শত্রুতা।পুরো রুমে একটা থাকলেও আমাকেই কামড়াবে।আজ যদি ঐ ধলা ইন্দুর আমার সাথে স্বামীর অধিকার খাটাতে আসে তাহলে মাথা ফাটিয়ে দিবো।

আমি বিরবির করে মশার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলছি।ঘোমটা টা টেনে ফেলে দিয়েছি বহু আগে।ভীষণ গরম লাগছে।সাথে অস্বস্তি তো আছেই। শরীরের মধ্যে মনে হচ্ছে লেহেঙ্গার পাথরগুলো চুলকাচ্ছে। বিরক্তিকর লাগছে আমার।এতক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পান্তা ভাত হয়ে যেতাম।কিন্তু এনাজের কোন চাচী না মামি আমায় বারবার সাবধান করে দিয়েছে আমি যেনো ঘুমিয়ে না যাই।মশার ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে বিরক্ত। আমার কাছে অপেক্ষা করতে সবচেয়ে বেশি জিদ লাগে।আমি কারো জন্য অপেক্ষা করতে রাজী নই।কিন্তু অন্যকে অপেক্ষা করাতে ভীষণ পছন্দ করি।বসে বসে রাজ্যের কথা ভেবে ফেলেছি।খট করে দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকালাম।তাকিয়ে দেখলাম মহারাজ এসেছে। আমি রেগে দুই হাতে লেহেঙ্গা উঁচিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমিঃ এই যে মিস্টার। সমস্যা কি আপনার?এত সময় লাগে রুমে আসতে।আমি সেই কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।আর আপনি এখন এলেন।আপনাকে যদি এরকম ভারী লেহেঙ্গা, সাজ,জুয়েলারি পরিয়ে মশার ঘ্যান ঘ্যানানির মধ্যে রেখে দিতাম তাহলে বুঝতে পারতেন কেমন লাগছে এতক্ষণ।আমি অপেক্ষা করতে করতে বোর হয়ে যাচ্ছি আর উনি এখন এলেন।

এনাজ আমার অনেকটা সামনে এসে স্লো ভয়েজে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো।

এনাজঃ আমার থেকে বেশি অপেক্ষা করেছো সুইটহার্ট। আমি তো তোমার জন্য সেই দুই বছর আগের থেকে অপেক্ষা করেছি।আমি এই দুইটা বছর যে ঠিক কতটা অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো।তোমাকে মনে হয় আমি পাবো না।আমার ক্যারিয়ার দাঁড় করাতে করাতে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে।আমি সত্যি অনেক ভয়ে ভয়ে ছিলাম এতদিন।আজ আমার ভয়ের অবসান ঘটলো।

কথাগুলো বলে এনাজ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এতটা জোরে ধরেছে মনে হচ্ছে আমার হাড্ডিগুলো সব ভেঙে যাবে।ভীষণ অস্বস্তি লাগছে।একে তো ভারী লেহেঙ্গা তার ওপর জড়িয়ে ধরছে।আমি আজকে শুটকি মাছ হয়ে যাবো।তাছাড়া এনাজের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝি নি।আমি কোনমতে নিঃশাস নিয়ে বললাম।

আমিঃ ছাড়ুন আমাকে।আমার অনেক অস্বস্তি লাগছে।প্রচুর গরম লাগছে তো।আপনি এভাবে ধরে থাকলে আমি গাইল্লা যামু।

এনাজ আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো।

এনাজঃ তুমি এখনো এগুলো পড়ে আছো কেন?জলদী গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও।

🍂🍂🍂

আমি কথা না বাড়িয়ে সুতি থ্রি পিস নিয়ে ওয়াস রুমে ঢুকে পরলাম।আমাকে যখন এনাজ জড়িয়ে ধরেছিলো তখন অন্য রকম একটা ভালো লাগা প্লাস অস্বস্তি ছিলো।আমি মুচকি হেসে ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে তাকে কোথাও পেলাম না।হঠাৎ রুমের লাইট বন্ধ হয়ে গেল।ডিম লাইট জ্বলে উঠলো।সামনে তাকিয়ে দেখি এনাজ এক বক্স লিপস্টিক নিয়ে আমার সামনে আজও হাঁটু গেড়ে বসে আছে। আমি তো লিপস্টিক দেখে খুশিতে আত্মহারা। আমি দৌড়ে গিয়ে লিপস্টিকের বক্সটা নিতে নিলে তিনি অন্য দিকে সরিয়ে ফেললো।

আমিঃ কি হলো এটা?

এনাজঃ আমি কিন্তু সেদিন উত্তর পাইনি।উত্তর দিলে এই পুরো বক্স লিপস্টিক তোমার।

আমিঃ কি উত্তর দিবো😒?

এনাজঃ তোমার মন যা চায় তাই।

আমিঃ দেখুন আপনি আমার স্বামী। এখন হাজার চেষ্টা করলেও এটা আমি অস্বীকার করতে পারবো না।সুতরাং আমি সত্যি কথাই বলবো।আমার একটু সময় লাগবে।তবে হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়ি আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলবো।কারণ আমার সব ভালোবাসা আমার স্বামীর জন্য তুলে রেখেছি।ততদিন আমাকে আমার ওপর ছেড়ে দিন।আমার বিশ্বাস আপনাকে আমি খুব শীঘ্রই মানিয়ে নিতে পারবো।

অন্য দিকে ঘুরে কথাগুলো বলে একটা বড় দীর্ঘ শ্বাস ছারলাম।আমি ভয়েও এনাজের দিকে তাকাইনি।যদি রেগে গিয়ে সেদিনের মতো ডেসিং টেবিলের কাচ ভেঙে ফেলে।চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকাতেই আবছা আলোতে দেখতে পেলাম এনাজ আমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার সামনে এলো।সামনে এসে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো।তার স্পর্শে আমি পুরো জমে গেছি।আমার হাতে পুরো লিপস্টিকের বক্সটা দিয়ে বাম হাতের অনামিকায় একটা হার্ট শেপ আংটি পরিয়ে দিলো।

এনাজঃ তোমার এই সহজ সরল স্বীকারক্তিতে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।আমি কথা দিচ্ছি তুমি যতদিন পর্যন্ত আমার সাথে মানিয়ে না নিতে পারবে ততদিন তোমার,কাছে স্বামীর অধিকার চাইবো না।গত দুই বছর অপেক্ষা করতে পেরেছি এই কয়েকটা দিন আর কি সমস্যা।

আমিঃ আপনি তখন থেকে গত দুই বছর, দুই বছর কেন বলছেন?আপনার সাথে আমার দেখা হলো মাত্র কিছু দিন ধরে।(চোখ মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে)

এনাজ আমাকে গত দুই বছরের যাবতীয় ঘটনা সংক্ষেপে খুলে বললো।কিভাবে আমাকে প্রথম দেখেছে,কলেজ ফাঁকি দিয়ে আমার পিছু নিয়েছে।আরো নানা কথা।ডায়েরির কথাও বাদ যায়নি।তাছাড়া দুজনের নামের সাথে কানেকশন জুড়ে রেখে “নোভানাজ” নামের কথাও বললো।আমি তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। আমাকে কেউ দুবছর আগের থেকে ভালোবাসতো আর আমি তা ক্ষুণেরঘরেও টের পাইনি।তবে আমার কাছে তার রাখা “নোভানাজ” নামটা অনেক অনেক পছন্দ হলো।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। তার কথায় আমার অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছি।আমি বোধ হয় জলদী তাকে ভালোবেসে ফেলবো।আমাকে কোলে করে খাটে বসিয়ে দিলো।লিপস্টিক বক্স থেকে লিপস্টিক বের করতে লাগলো।

আমিঃ আপনি লিপস্টিক বের করছেন কেন?
(অবাক হয়ে)

এনাজঃ আমি নিজ হাতে তোমার ঠোঁটে দিয়ে দিবো তাই। আমাদের কাছে আসাটা কিন্তু এই লিপস্টিকের কারণেই হয়েছে সুইটহার্ট।

আমিঃ আপনি তো লিপস্টিক দেওয়া পছন্দ করেন না।আমি যতদূর জানি।

এনাজঃ আগে করতাম না এখন করি।তাও আমার লিপিস্টিক পাগলীর জন্য।

এনাজ হাতের লিপিস্টিক টা রেখে হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো।

এনাজঃ অনেক ভালবাসি তোমায় লিপস্টিক পাগলী।প্লিজ কখনো আমায় ছেড়ে যেও না।আমি যে ভালোবাসার_তুই টাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।

আমি আলতো করে তার পিঠে আমার হাত রাখলাম।এনাজ আমাকে ছেড়ে পাশে থাকা একটা গোলাপ কানের কাছে গুঁজে দিলো।তারপর লিপস্টিক নিয়ে আমার ঠোঁটে দিতে লাগলো।আমি মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি। হালকা গ্রে কালার টি-শার্টে তাকে আজ অপূর্ব লাগছে।হয়তো আগে এতটা কাছ থেকে তাকে দেখা হয়নি বলে এমনটা মনে হচ্ছে। আমার নিজের ওপর আস্থা আছে খুব দ্রুত তাকে ভালবেসে, আমার ভালোবাসার_তুই হিসেবে গ্রহণ করে নিবো।কারণ তার ব্যক্তিত্ব আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমি যে এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছি সে দিকে তার খেয়াল নেই। তিনি খুব মনোযোগ সহকারে আমার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে ব্যস্ত।

__________________(সমাপ্ত)___________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে