ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-১২
রোকসানা আক্তার
দু’পা গুঁজে জেলের শিকের সাথে হেলিয়ে ফ্লোরের উপর উবু হয়ে বসে আছি।চোখের অশ্রু ঝরঝর বেয়ে পড়ছে গালের দু’পাশ দিয়ে।
মাথায় কত ভাবনার ছেদ বিচরণ করছে। যে ছেলে কখনো কারো সাথে গায়ে পড়ে তর্কে যায়নি,আজ সে দু’দুটো খুন করে চারদেয়ালে বন্ধি!
হুট করে, আমার সামনে একটা পএিকার পেপার এসে ধপসে পড়ে।হদিস করতে না পেরে সামনের দিকে তাকাই।কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হিংস্র প্রাণীর মত আমার দিকে চেয়ে আছেন থানার ওসি যেন এখনি খপ্পাস করে আমার মাথা মুচড়ে দিবেন।
আমি উনাকে দেখা মাএই উঠে দাড়াই।উনি আমায় হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন পএিকার কাগজের লেখার দিকে।
পএিকার কাগজে মোটা অক্ষরে লিখা আছে-“এবার নিদু হত্যার সাথে আরেকটা হত্যা যোগ হলো দিবানির।”
আমি চোখবুঁজে উনার সামনে দাড়িয়ে আছি।উনি ফ্লোর থেকে পএিকাটি হাতে নিয়ে বলেন,
-এবার বল,দিবানিকে কেন খুন করলি?মেয়েতো কোনো দোষ করেনি!!ও’তো তোকে জাস্ট ভালোবেসেছে।লাইফে এই প্রথম দেখলাম,কোনো হিরো প্রেমিকার প্রপোজাল রিজেক্ট করে তাকে হত্যা করতে।হা হা হা হা!!বিষয়টা খুবই বেমানান!!
–
–
-কি হলো কথা বলছিস না যে??(ধমকের সুরে)
-আপনাদের যদি এতই সন্দেহবসর,তাহলে এখনো গলায় দড়ি দিচ্ছেন না কেন!!??(জোরে)
আমার কথায় উনি খিলখিল করে হেসে উঠেন।উচ্চ তড়িত আওয়াজে পুরো বিল্ডিং যেন কাঁপতাছে। তারপর হাসি থামিয়ে উপহাসের ইঙ্গিতে বলেন,
-তোকে দেখলে আমার মাকাল ফলের কথা ধুমসে মনে পড়ে যেটির বাহিরে সুন্দর,ভেতরে ছাই।খুনীদের চোখগুলো লাল,চুলগুলো উসকোখুসকো,মুখে জানোয়ারের ছাপ থাকে,কিন্তু তোর ব্যাকগ্রাউন্ড ভদ্রতার পরিচায়ক।মনে হয়না তোর মতো ছেলে কাউকে খুন করতে পারে।তাও দু’দুটো।অবাক হচ্ছি বটে।হিহিহিহি
মনটাকে সংযত রেখে বলি,
-হ্যাঁ আমি খুনী!!আমি গ্লোবাল ক্রিমিনাল।আর কিছু জানতে চান??
-তুই এসব বলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেছিস নাকি,বলতো!
-আপনারাই যদি দোষী বলেন তাহলে নিজেকে কিভাবে নিরপরাধী বলবো!?
-তোর নামে অনেকগুলো সাক্ষ্য পেয়েছি,বুঝলি??এখন কোর্টে প্রমাণ ফ্রেশ হওয়ার পালা।
স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসছে।
দারোগার কথায় মাথা ঘুরিয়ে তাকায় ওসি।
-আচ্ছা আসতেছি।
এ বলে ওসি আমার দিকে কটুভাবে তাকিয়ে বলেন,
-তোকে আমি পরে দেখতেছি।।
তারপর তড়িঘড়ি স্থান ত্যাগ করেনন।।এভাবে জেল জীবন চলতে থাকে।কোর্টে কাঠগড়ায় আমার বিপক্ষের উকিল টেকনিক খাটিয়ে বার বার আমাকে হেয় করে শাস্তির দরখাস্ত করতে থাকেন এবং আমার সাঁঝাও বাড়তে থাকে।।আমার পক্ষের উকিল উনাদের চাটুকারিতায় পেরে উঠতে না পেরে অতঃপর আমার পক্ষে লড়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন।একমতে,আমার কেইসটা ক্যান্সেল করে ফেলেন।।
একরাত জেলখানার আনাচে-কানাচে নিবুনিবু হলুদ বাতির আলো জ্বলতেছে,চারদিকটা নিঃশব্দ।আমি ব্যর্থমনে বসে আছি মৃত্যুর প্রহর গুণতেছি।কারণ,আমার বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যে সাক্ষ্য সবই সত্যপ্রমাণ সবার কাছে।পৃথুলী,তানহা সবাই আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিল এবং নিদুর বাবা,অন্যান্যরাও।
এতে জজ মৃত্যুর রায় যেকোনো মুহূর্তেও দিয়ে দিতে পারে।আমার মা-বাবা,ফ্যামিলির সবার সাথে দেখাশুনা বন্ধ। আগে যা-ই দেখাশুনা করতে পারতাম,এখন থানা কর্তৃপক্ষ তাদের ছায়াটুকুকে আসতেও কড়া নিষেধ আমার এখানে।
একদম আশাহত জীবন আমার।এই পৃথিবীর বুকে আমি খুব একা।মাঝে মাঝে নিজের মাঝে খুব একাকীত্ব অনুভূতি হয়।আগের সেই প্রতিটি আনন্দের মুহূর্তকে ভীষণ মনে পড়ছে।মনে পড়ছে সাথীর কথা,মনে পড়ছক শিমলার সেই কটকটি দুষ্টমির কথা,মনে পড়ছে অতি অতীত ভালোবাসার মানুষটির কথা,মনে পড়ছে মায়ের সেই হাসিমাখা মুখটির কথা,বাবার সেই কটু দৃষ্টির আড়ালে নিরবতা ভালোবাসা।আবার সেই কালোদিনের বিষণ্ন মুহূর্তগুলোর কথা যাদের জন্যে আমি আজ জেল জীবন পার করছি।যে মুহূর্তগুলো সুখের মাঝে অতি দুর্দশা,আক্ষেপ,কষ্ট নিয়ে এসেছে।সবগুলো স্মৃতির পাতাই যেন আমাকে ক্ষণে ক্ষণে বিষণ্ন করে তোলে।মন বলে,আমার মতো অভাগা এই পৃথিবীতে আর কেউ বুঝি নেই!!!আজ ৭টা মাস জেলে!!!
কারো গলার হালকা কাশির শব্দে আমার এসব ভাবনার ছেদ ঘটে।।
তাকিয়ে দেখি একজন কোট,টাই পড়া লোক সামনে দাড়িয়ে আছে।দেখতে অনেকটা লম্বা,চুলগুলো মাথায় গুছানো,মুখটা সুদর্শন,গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি।বয়স প্রায়ই পঞ্চাশ হবে।লোকটির মাঝে ভদ্রতা আভাস।আমার দিকে তাকিয়ে মুঁচকি হেঁসে দেন।
আমি কিছু বুঝে না উঠতে অনেকটা জিজ্ঞাসু বাক্যে বলে উঠি,
-ক-কে আ-আপনি??
-কুল সন,কুল!!উওোজিত হয়ো না!!জানতে চাচ্ছো আমি কে হতে পারি??
জ্ব-জ্বী!!
উনি আমার পাশে এসে বসেন অতি পরিচিত মানুষের মতন।গলাটা ছোট করে বলেন,
-আমি তোমার পক্ষে লড়তে এসেছি। মানে আমি তোমার উকিল।।
আমি অনেকটা ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে উঠি,আর বলি,
-আমার পক্ষে লড়ে আর কোনো লাভ নেই স্যার।কারণ,অলরেডি আমি খুনী!!
-মানুষ খুনী বললেও আমি যে তা বিলিভ করবো এমনত নয় শাওন!!
-আমার মা আপনাকে পাঠিয়েছেন??
-নাহ!!
অবাকের উচ্চ মাএায় উঠে যাই।
-তাহলে কে পাঠিয়েছেন??
-কেউ না!!আমি নিজেই এসেছি।তোমাকে নিয়ে নিউজে বার্তা দেখেছি,তাই আমি নিজেই ডিসিশন নিয়েছি তোমার কেইসটা সলভ করবো।এজন্যই ঢাকা থেকে আসা।
উনার কথায় কেনজানি আমার বিলিভ হতে চাচ্ছে না।কারণ,কোনো অপরিচিত মানুষ দোষীর জন্যে এরকমটা সাপোর্ট নিয়ে কেউই আসবে না।পৃথিবীতে যদি এতই ভালো মানুষ আজও থাকতো তাহলে আমি আর এতটা মাস জেলে কাটাতাম না।মানুষ মানুষের জন্যে হলে মিথ্যে মামলায় আমায় ফাঁসানো হতো না।সো,এসব বিশ্বাস করার কোনো মতে প্রশ্নই আসে না।
-কি?তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না??
-প্লিজজ আপনি আসতে পারেন, স্যার!!ক’দিন পর আমায় ফাঁসিতে ঝুলানো হবে,খামোখা মিথ্যে মামলায় লড়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করার কোনো মানে হয় না।
-আমি জানি শাওন,তুমি এসব অতিকষ্টে বলতেছ।মানুষ যখন ভীষণ কষ্ট পায় তখন আাশাগুলোকে মাটিতে চাপা দিয়ে দেয়।অতিকষ্টে জর্জরিত মন আরো আঘাত পেতে চায়,এমনকি নিজের জীবনটাকেও জীবন মনে হয়না।শাওন,আমি বুঝতেছি তোমার মনের অবস্থা।মনকে শক্ত করো।পৃথিবীতে কি মিথ্যেরাই আধিপত্য করে যাবে??আমরা কি সত্যকে সত্যতা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না?।মিথ্যের কি এতই শক্তি যে সত্যকে হারিয়ে দিয়ে নিজে জিতে যায়!?এমন নড়বড়ে হলে,জীবনটা দুঃখের স্রোতেই বয়ে যাবে,বুঝলে??
-দেখুন স্যার,আমি আর পারতেছি না।আর কত্ত,আর কত!!!
এ বলে চুল মুচড়ে ধরি।
-তোমার একটাই সমস্যা!!তুমি প্রতিবাদ করতে জানো না!!সবকিছু নিরবে সয়ে নিজেই কষ্ট পাও।।
-ঠিক বলছেন আমি প্রতিবাদ জানি না।আমি একটা কাপুরষ। এ কাপুরুষদের পৃথিবীতে বাঁচার কোনো অধিকার নেই।প্লিজজ,আমার কেইসে লড়বেন না।প্লিজজ আপনি চলে যান।।
-শান্ত হও সন।সবকিছু ভালোই হবে।তুমি আমায় বারণ করলেও তোমার কেইসটা আমি ছেড়ে দিবনা।আমি প্রতিবাদ করেই যাবো। লক্ষ যেথায় সফলতা সেথায়, আমি হাল ছাড়বো না।ভালো থেকো।।
উনি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে চলে যান।।
আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি।আর হট্র হাসি দিয়ে বলি,
-এরকম কত্ত উকিল আসলো আর গেলো!!কেউ কিছুই করতে পারলো না।এডভোকেট শোবের খান-এর কাছে খ্যাতিমান অনেক উকিলই ফেইল।আর এডভোকেট শোবের খান-ই আমার বিরুদ্ধে লড়ছেন।।
তারপর অন্ধকার চারদেয়ালে সারাক্ষণ বসে বসে থাকি।কখন মৃত্যুর সংবাদ আসবে।এক প্রকার ভেবেই নিই যে মুক্তি আর আমার কপালে কখনোই মিলবে না।
ওই উকিলের সাথে শেষ দেখা হওয়ার পর আর কোনো প্রাণীকে আমার আশপাশ দেখতে পাইনি।কোউ কোনো রকম খবর নিয়েও হাজির হয়নি।যে উকিল কথা দিয়েছিল তাকেও আর পরবর্তীতে দেখতে পাইনি।দিনকে দিন সবকিছু কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে।।
আমার মুখটা যেন কথা বলাও ভুলে গেছে।দু’ঠোঁট সবসময় এখন মিলিত,একটু নড়েও না।।
এভাবে অনেকটা মাস পেরিয়ে বছর গড়িয়ে যায়।।তবুও,ফ্যামিলির অপেক্ষা!!তারা যদি হুট করে একদিন আমার সাথে দেখা করতো, একটুর জন্যে হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম।মনকে মানাতে পারতাম,যাক আমার এইতো আপনজন আছে!!কে বলছে আমার আপনজন নেই??
এভাবে আরেকটা বছর কেটে যায়।এ নিয়ে দু’দুটো বছর শেষ।তারপরও আমি বেঁচে আছি।মনের মৃত্যুতে দেহটা এখনো প্রাণ আছে।সেও যদি কখনো নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়,তখন মনটাও পৃথিবী থেকে বিলীনন।।।।
জেলের কোণে বসে বসে হাঁফ ছেড়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছি।।এরইমধ্যে কেউ লোকাবের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে।।
আমায় উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-আপনি মুক্তি পেয়েছেন।।
আমার ক্লান্ত দিশাহীন চোখগুলোয় হালকা পলক খুলে লোকটিকে দেখতে দৃষ্টিগোচর। কে এই কথাগুলো বলছে!?
তারপর,ঘোর ঘোর চোখে দেখতে পাই জেলখানার কর্তৃপক্ষ বলছেন।আমি এখনে ভালোভাবে বুঝতেছি না উনি কি বলতেছেন!
-ম-মানে বুঝি নি।।
খুব ক্লান্তভাবে প্রশ্ন করি।কারণ আমার শরীরটা একদম নিস্তেজ।কথা বলার শক্তিটুকু যেন শরীরে নেই।।
-মানে হলো আপনার জেলজীবন শেষ।আপনাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হলো।আপনি নিরপরাধ, তাই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।।
আমি উনার কথাগুলো শুনে অনেকটা অবাক হয়ে যাই।আসলে কি আমার মুক্তি হয়েছে?আর উনি সত্যি বলছেন তো??
-সত্যি!!
-হু,কেন আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না??
আমি হালকাভাবে দু’পাশে মাথা নাড়ি।।
-তাহলে চলুন আমার সাথে।।
এ বলে উনি আমার হাতটা ধরে ফ্লোর থেকে উঠে তুলেন।আমি আস্তে আস্তে জেল থেকে বের হয়ে আমার গন্তব্যে চলতে থাকি।হয়তো,বাহিরে আমার জন্যে অনেকগুলো প্রিয় মানুষ খুব আকাঙ্খিত ভাবে অপেক্ষা করছেনন।কতগুলো মাসের পর আজ আমায় খুব কাছ থেকে দেখবেন।
চলবে…