ভাবিনি ফিরে আসবে
পর্ব-০৪
রোকসানা আক্তার
হোস্টেলে এসে কাঁধের ব্যাগটা বিছানার উপর ছিটকে ফেলে বাথরুমে ফ্রেশ হতে চলে যাই।বাথরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে মোবাইলের দিকে নজর পড়ে।কল হয় রিং বাঁজছে না,তারমানে ফোনটা সাইলেন্ট করা।তোয়ালে টা কাঁধের উপর আলতোভাবে রেখে ফোনটা হাতে নিই।শিমলা কল দিয়েছে।
-হু বল!কল দিয়েছিস কেন?না আসতেই কলের ছোটাছুটি!
-কল দিয়ে মনে হয় তোকে বিরক্ত করে ফেলছি!?
-আচ্ছা বাদ দে।কি বলবি তাড়াতাড়ি বল।আমার আবার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে কিছু খেতে হবে!.
-আমাদের না বলে চোরের মতো ঢাকায় চলে আসলি?বাসায় যে গুণগুণ কান্নার ছুটকী রেখে গেছিস তাকে থামাবে টা কে শুনি??
আমি স্পষ্টত বুঝতে পারি শিমলা এখন সাথীর কথা বলতেছে।
-তা আমি কি করে বলব?তুইতো একটা মালিশ, তোর মালিশে ওর কান্নাটা পালিশ করে দে।
-এই তুই আসলে এইরকম কেন বলতো আমাকে,শাওন?
হুট করে শিমলার কানের পাশ থেকে সাথী ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
-ভাইয়া,তুমি রাগ করে চলে গেলে?তোমাকে অনেক মিস করতেছি।ভাইয়া কিছু খেয়েছ?কেমন আছো?ঠিকমতো পৌঁছেছো?
আমি চোখগুলো বুঁজে বিরক্তিবোধ নিয়ে ওর কথাগুলো শুনতে থাকি। এমুহূর্তে এসব ফ্যানফ্যানানি শুনার মোড নেই আমার। তারপরও ছোট বাচ্চা তো বুঝিয়ে শুনিয়ে কিছু একটা বলি।
-দেখ আমাদের সাথী সোনা,কান্না করবে না একদম।যদি কান্না করো তাহলে আমি আজ সারাদিন উপোস থাকবো।এই বলে দিলাম।
-আচ্ছা আমি কান্না করবো না।আপনি আগে খেয়ে নিন ভাইয়া?
-এই তো লক্ষীমেয়ে,যদি পাশে থাকতি একটা চুমু লাগাতাম।
-সত্যি ভাইয়া,আপনি আমায় আদর করতেন?
-হু করতাম!সাথী মিষ্টিটাকে একটা মিষ্টি আদর দিতাম।
-য়ু,লজ্জ্বা পাচ্ছি ভীষণ।।
মুহূর্তে যেন প্রেমের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি। মাথাটা ঝাঁকানি দিয়ে ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসি,আর ওকে কড়া একটা ধমক দিয়ে উঠি।
-কাঁদবি না,একদম কাঁদবি না।রাখি।
এ বলে ফোনটা কেটে দিই।আজকে আর হোস্টেলের খাবার খাইনি,বাহিরে থেকেই দুপুরের লাঞ্চটা করে নিই।পথিমধ্যে ছোটকাকু কল দেন উনার বাসায় যাওয়ার জন্যে। খুব জড়োসড়ো রিকুয়েষ্ট আর না করে পারি নি।উনি উওরাতে থাকেন।উওরায় উনাদের বাড়ি।ছোট কাকুর সাথে আমার বাবার বিশাল ঝামেলা হয়েছিল।কারণ,কাকু গরীবের মেয়ে বিয়ে করাতে বাবা তা মেনে নিতে পারেননি।তাই বাবা আর কাকু-কাকি কে ঘরে তুলেননি।এতে কাকা বাধ্য হয়ে কাকিকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।আজ কাকিমার অধ্যবসায়ের সুফলে অনেক বড় একটা বাড়ি করতে পেরেছেন।কাকিমা বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের ম্যানেজার।তবে,কাকা-কাকিমার মনে সারাজনম একটাই দুঃখ থেকে গেল কাকিমা জননী এবং কাকা পিতা হতে পারেননি।এইজন্য,আমাকে ছেলের মতো স্নেহ করেন। বেড়াতে গেলে কখনো কোনোকিছুর কমতি রাখেন না।আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে আমার সাথেই উনাদের সম্পর্ক ভালো।মায়ের সাথে সম্পর্ক বাবার জন্যে বিচ্ছিন্ন আর বড় ভাই বাবার অনুগত। তাই ঢাকায় থাকলে উনাদের বাড়ি আমার প্রায়ই যাওয়া হয়।
আমি এসি গাড়িতে উঠে উওরায় নামি এবং কাকুর বাসায় এসে পৌঁছে যাই । আজ রাস্তায় জ্যাম খুবই কম ছিল,তাই কোনো রকম ঝামেলাহীনভাবে সহজে আসতে পারি।নাহলে,ঢাকার রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকতাম।
কাকা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন।কাকিমা ও হাসিমুখে দৌড়ে আমার হাতটা ধরে সোফার উপর নিয়ে বসান।
কাকা সানগ্লাসটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে কোনোমতে পানি মুছে বলেন,
-পরশু ফাহাদের বিয়ে গেল আর আমাদের যাওয়ার ভাগ্য হলো না।কত্ত আশা ছিল,ফাহাদ একদিন বড় হলে ওর বিয়েতে নাচবো, গাইবো। কিন্তু আশা যে কখনো অপূর্ণ থেকে যায়,তা তোমার ওই আউলা বাবার মুখটা না দেখলে বুঝতাম না।
-কাকা প্লিজজ,বাবার কথা ছাড়ুন।ইনসল্লাহ এই শাওনের বিয়ের প্রথম কার্ডটা আসবে এই বাড়িতে।
আমার কথা শুনে কাকা ও কাকি হেঁসে ওঠেন।
কাকা বলে উঠেন,
-ওটাতো অবশ্যই,বাবা।তোমার বিয়েতে যাওয়া আমার কিন্তু একদম মিস হবে না।ওই ত্যারা ভাইটাকে অন্তত তোমার বিয়ের সময় পরোয়া করবো না। কারণ,আমার ছেলে শাওনের বিয়েতে আমি থাকবো না এটা কেমন করে হয়!!.
-আচ্ছা কাকা, আচ্ছা।।
কাকিমা আমাদের কথার ফাঁকে বলে উঠেন,
-তোমরা ভবিষ্যৎ বিয়ের কথা বলতেছো,কিন্তু আমরাতো ইতোমধ্যেই একটা বিয়ের দাওয়াত পেতে যাচ্ছি।
আমি খুব উৎসুক হয়ে বলি,
-কার বিয়ে কাকি?
-আমার বোনের ছেলের।ও কানাডায় থেকে এসেছে এবং কাল এংগেইজমেন্ট।
-শাওন,মেয়েতো তোদের ভার্সিটির মনে হয়,নাহ শাহনাজ?(কাকা)
– কোন ভার্সিটির কথা বলেছিল আমার ঠিক খেয়াল নেই।
-কাকি মেয়ের নাম কি?
-সোহানা জাহান নিলা।রিয়াজুল সাহেবের একমাএ মাএ মেয়ে।বাড়ি ধানমন্ডিতে ওদের।মেয়ে তবে অনেক মাশাল্লাহ!!আর আমাদের শাহিদের জন্যে এরকম যে একটা মেয়ে পেয়েছি সত্যি তা ভাগ্যের ব্যাপার!!
ক্ষণিকে আমার দু’কান লাল হয়ে যায়,চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণতায় ছুঁয়ে যায়।এ’তো সোহানা নয়তো?বাড়ির ঠিকানা,পিতার নাম সবইতো মিলে গেছে!!এক মুহূর্তে এখানে থাকার ইচ্ছেটা মারা খায়।কাকা-কাকিকে তাগাদা দেখিয়ে বলে উঠি,
-কাকা-কাকি আমি এখন যাচ্ছি।আমার হোস্টেলমেট হৃদয় ঢাকায় নাকি ব্যাক করছে,তাকে একটু রিসিভ করতে হবে। আমার ঠিক খেয়াল ছিল না কাকা আপনাকে একথা বলতে।আপনাদের সাথে একটু দেখা হলো এতেই অনেক।
-সে-কি বাবা,না খেয়ে চলে যাবি?
-ইনসাল্লাহ, কাকিমা আরেকদিন আসবো।তখন খেয়ে যাবো।এখন আসি।
কাকিমা হাত বাড়িয়ে তাকিয়েই আছে,আর আমি উনাদের বাড়ি থেকে প্রস্থান করি।
রুমে গিয়ে পায়চারী করতে থাকি। বুঝতেছি না এসব কি হচ্ছে,সবটা তো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।নাকি, সোহানার সাথে কথা বলবো একবার!ও কি সত্যি সত্যিই তাহলে বিয়ে করতে যাচ্ছে!?
নাহ,নাহ এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি মাথাটা গরম হয়ে যায় আমার!!
আমি এখনই তড়বড়িয়ে সোহানাকে কল দিই। তিন,চারবার রিং বাঁজার পর কল উঠায়।
-হ্যালো,সোহানা?(অস্থির অনুভূতি নিয়ে বলি)
-জ্বী,কিছু বলবেন?মিস্টার শাওন?
-সোহানা আমায় এটা বলো, তোমার হবু বরের নাম কি?
-শাহিদ চৌধুরী হাসান।
নামটা শুনার পর পুরো পৃথিবী আমার চারপাশটা ঘুরতে থাকে।আমিও যেনো ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছি।।
-তুমি সত্যি উনাকে বিয়ে করতে চাচ্ছো?তুমি কি জানো?উনি আমার রিলেটিভ?!.
-ওতো কিছু জেনে আমার কোনো লাভ নেই,মিস্টার শাওন! আপনিতো এটা খুব ভালোকরে জানেন, সোহানা খান একবার যে সিদ্ধান্ত নেয়,সেটাতেই অটল। একদম নড়ছড় নাই।
-তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমিও আমায় ঠকালে!?বাহ,এতদিন পর তাহলে তোমার আসল চেহারাটা দেখতো পেলাম!ধন্যবাদ!!আসল চেহারাটা দেখানোর জন্যে!!
-বাজি ধরে যে ছেলে আমায় ভালোবাসে সে ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা বৃথা।আর আপনার ভাবীর সাথে বাজি ধরলেন না?ওই ভাবীকে জিতে যাওয়া টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিন।এতে,সোহানা নামের কোনো মেয়ের কথা কখনোই ভাবনায় আসবে না।রাখি।
-শুনো,তোমার কিন্তু ভুল হচ্ছে।তুমি প্রতিটি পদে পদে আমায় ভুল বুঝে এসেছ!তুমি বিলিভ করো,আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে বাজি ধরেছি!জাস্ট ইট!!এসব উদ্ভট কথা কেন বলো!বুঝাও আমাকে!
-কি বুঝাবো?কাল জিনুক আপনার ফ্রেন্ডের থেকে শুনে আমায় বলে দিয়েছে!আমিতো এসবের কিছুই জানতাম না আগে!!এমন একটা বেইমানকে আমি ভালোবেসেছি যে কি না আমার স-সাথে বাজি…
এই বলে থেমে যায় সোহানা। আর তড়িঘড়ি কলটা কেটে দেয়।
কথাটা নিশ্চয়ই আমার রুমমেট হৃদয় বলেছে!কারণ,ওর কাছেই শুধু জিনুকের নাম্বারটি ছিল!!
এছাড়া,এসব কথা ও ছাড়া আর কেউ বলবে না!!
সন্ধে হয়ে আসে।এরইফাঁকে হুট করে হৃদয়ের মেসেজ।ওর আর্জেন্ট একটা প্রবলেম হয়ে গেছে,ওর লিভারের রিপোর্টটা আজ হাতে পাবে সেইজন্যেই ঢাকা ব্যাক করা।
আমি শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুলে উঠি।আজ ওকে ইচ্ছেমতো মারবো।আমার অপেক্ষা,আর এখন শুধু ওর আসার পালা।
এশারের আযানের পর ও রুমে এসে উপস্থিত রিপোর্ট হাতে নিয়ে।আর ধুকধুকি বাঁজিয়ে বলে,
-ইয়াপ দোস্ত, আমি অনেক ভয় পেয়েছি। ভাবলাম রিপোর্টটা খারাপ আসবে।যদি খারাপ আসতো তাহলেতো প্রাণের সিগারেট খাওয়া অফ হয়ে যেত।এই দেখ,আসার সময় ২ টা প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসেছি,আজ প্রাণ খুলে খাবো,আর আনন্দ করবো।
আমি একপায়ের হাঁটু গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছি।
ও মনের নাচুনে বেলকনিতে যায়।আমি পা টা বের করে ধীরে ধীরে পা ফেলে ওর কাছে আসি।
ও আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-একটান নিবি, নে?
-তুই জানিস না আমি স্মক করি না?
এ বলে চোখগুলো আগুনের মতো লাল করে ওর নাকের ডগায় জোরে দুটো ঘুষি বসিয়ে দিই।মুহূর্তে ঝরঝর করে রক্তের স্রোত যেতে থাকে!!এখনই ওকে না পারি এক কামড়ে গিলে ফেলি।ওর শার্টের কলারে হাত দিয়ে বলি,
-তোর সাহসতো কম না? জিনুকের সাথে প্রেম করার ইচ্ছে জাগছে আর মিলিয়ে দিলাম আমি। আর তুই ঘরের ইদুর হয়ে ঘরের বাণ কাটছিস,শালা!!!একদম মেরে ফেলবো!! মেরে ফেলবো তোকে!
হৃদয়ের মুহূর্তে চোখগুলোর পলক ছোট হয়ে আসে। আর নড়বড়ে ফ্লোরে ধপ্পাস করে পড়ে যায় এবং
বাঁচাও বাঁচাও বলে আওয়াজ করে করে তুলে।আমি আর একমুহূর্তে দেরী না করে ওকে ছেড়ে দিয়ে মোবাইলটা নিয়ে তরহর করে রুম থেকে বেরিয়ে যাই।নাহলে বিপদ হতে পারে।জীবনের এই প্রথম কারো গায়ে হাত তুলেছি,তাই অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম।হয়তো,হৃদয় তা দু’চোখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি।
আমি হোস্টেলের কর্তৃপক্ষের চোখের আড়াল হওয়ার জন্যে কিছু না ভেবেই চলন্ত একটা বাসে উঠে বসে পড়ি।বাসটি এখন কোথায় যাচ্ছে আমি নিজেও তা জানি না।পুরো শরীর ঘামে ভেজে একাকার।।
ড্রাইভারের কথার আওয়াজে বাসটি থামে এবং পরে বুঝতে পারি বাসটি গুলিস্তান এসে পৌঁছেছে, সামনে আর যাবে না।আমি বাসটি থেকে নেমে পড়ি।এখন কোথায় যাবো,কোথায় থাকবো, কি করবো মাথায় কিছুই কাজ করছে না।
একটা দোকানের কিণারা ঘেষে বসে পড়ি, নিয়ন বাতির আলোয়তে রাতের ঢাকা শহর অন্যরকম লাগে।আজ মনে হয় সারারাত এখানেই কাটিয়ে দিতে হবে।কারণ,আপাতত কারো বাসায় যাওয়ার উদগ্রীব মনটা হারিয়ে ফেলছি,মস্ত বড় একটা বিপদ ঘটিয়ে এখানে মাথায় হাত দিয়ে ক্ষান্ত মন নিয়ে বসে আছি।রাত যত গভীর হতে থাকে,
চারপাশ লোকদের তত আনাগোনা কমতে থাকে।
একটা মুহূর্তে গাড়ি,রিক্সা,সি.এন.জি,ঘোড়ার গাড়ি চলাচল বন্ধ হয় যায় এবং সম্পূর্ণ স্থানটি মানুষ বিহীন ফাঁকা।।
এখানে বসেই নিবৃওি কেটে যায় আমার সারারাত।সকালের দিকে ১০ টাকা দিয়ে একটি খোলা বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি এবং চায়ের দোকানে গিয়ে মালাই করা একটা দুধ’চা খেয়ে নিই।
সকাল না হতে ব্যস্ত নগরের মানুষজন ব্যস্ততা নিয়ে যার যার কর্মস্থলে ছুটে চলে।সেদিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ভাবি,
মানুষের জীবনটা আসলেই অনেকটা কষ্টের!
এভাবে অনেকক্ষণ এদিক-ওদিকটা হেঁটে-হুঁটে স্থানটি যখন আর কোলাহলপূর্ণ হতে থাকে,তখনই বিরক্তিবোধ কাজ করতে থাকে।গুলিস্তান এলাকাটি এমনিতেই অনেক জনবহুল,তার উপর বাস স্টেশনগুলো।চিপা চাপা রাস্তা,একফাঁক জায়গা নিয়ে হাঁটতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।।
তিক্ত মন নিয়ে আবার আরেকটা কোণে জায়গা করে নিরবে দাড়িয়ে থাকি। এসব ব্যাপারে শিমলাকে জানানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে তৎক্ষনাৎ শিমলাকে কল দিয়ে উঠি,
-হ্যালো,শিমলা??বোন, আমি আজ অনেক বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি।
-কি বলছিস,শাওন। কিছুই বুঝছি না।আবার বল।
চারপাশের গাড়ির হর্ণে আমার কথার আওয়াজ ওপাশে পৌঁছায় না।
পরে,কলটা কেটে দিই।
এভাবে এখানে উঠা-বসা করেতো সময় কাটালে হবে না।হৃদয় যদি মারা গেলো?আর আমাকে পুলিশ দিয়ে যদি তাড়া করা হয়,নাহ এখানে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকার সুবিধে মনে হচ্ছে না।
মোবাইলটা ভালোভাবে হাতের মধ্যে আঁকড়ে ধরে বিকাশ দোকানে ঢুকি। বিকাশ থেকে কিছুটা টাকা তুলে নি।।
এরমধ্যে শিমলা কল দিয়ে উঠে,
-হ্যালো,শাওন??তুই কোথায়? একটু বাড়ি আসতে পারবি আর্জেন্ট?
আমি অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি,
-বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছে রে, শিমলা?
-হ্যাঁ-রে,তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আস।
আমি কলটা কেটে দিই তড়িঘড়ি ।
বাড়ির সমস্যা বলতে আমার মায়ের কিছু হলেই আমি মরে যাবো।প্রায়ই বাবা মায়ের সাথে ঝগড়া করে,মাকে উল্টাপাল্টা হাইপার করে দিলে মা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যান।প্রেশারের রোগীর জন্য এটি একটি বড় সমস্যা।
খুলনার টিকেট কেটে বাড়ি রওনা করি।অতঃপর খুলনা সদরে বাস এসে থামে আমি বাস থেকে নামতেই চোখপড়ে পৃথুলীর দিকে ।ও বুচকা-বুচকি হাতে নিয়ে একটি বৃদ্ধমহিলার সাথে দাড়িয়ে আছে।হয়তো বাসে উঠার ব্যাকুল আগ্রহে। আমি পৃথুলী বলে ওকে ডাক দিই। ও আমায় দেখে বৃদ্ধা মহিলার পেছনে মুখ লুকোতে আপ্রাণ চেষ্টা।
কিন্তু আমিতো ভয় পাওয়ার মতো কিছুই বলিনি।জাস্ট ওর নামটা ধরে ডাকছি।
আমি অনেকটা অবাক হচ্ছি। যে মেয়ে হাসিখুশি কথা বলেছে দু’দিন আগে, সে মেয়ে এখন আমায় এত্ত ভয় পাচ্ছে কেন!?
তবুও সাহস নিয়ে ওর একেবারে সামনে চলে আসি।বৃদ্ধা আমায় দেখে বলে উঠে,
-এই ছেলে তুমি আমার নাতনীকে তাড়া করছো কেন?.
অবাক দৃষ্টি দিয়ে বুড়ির কথা শ্রবণ করি
দেখতে তো বয়স আশি,কথার টনক তো তারুণ্যকেও হার মানাবে! তারপর বলি,
-নানী আমি আপনার নাতনী!শিপ্রা ইসলামকে তো চেনেন,না?
-কোন শ্রিপা?
এবার বুঝলাম বুড়ির বয়স আশিই ইজ পারফেক্ট। কারণ,বুড়ি ঠাহর করতে মনে হয় দাঁত ৩২ মড়মড়ে ভেঙ্গে যাবে,যাইহোক এখনতো গালে দুঃ’টো বাদে সবগুলো ফাঁকা।
-কিছুদিন আগে যে শিপ্রার বিয়ে হলো,ও।
-ও হ্যা,চিনতে পারছি। তো তুমি কে ভাই??
-নানু,চলো? আমরা চলে যাই,ও একটা খুনী!ও আমাদের মেরে ফেলবে!!!(পৃথুলী)
পৃথুলী আমাকে আর কথা বলতে না দিয়ে ভয়ে ভয়ে ওর নানুর হাত টেনে আমাকে অতিক্রম করে চলে যায়।হয়তো বৃদ্ধা কিছুই না বুঝে মুখটা হা করে পৃথুলীর সাথে চলে যায়।কিছু জানতে চেয়েও জানার সময়টুকু পাননি।
আর, আমি হতভম্বতার সহিত দাড়িয়ে থেকে ভাইয়ের বউ ডাইনীর কথা ভাবতে থাকি।ওই ডাইনীই ছোট এই মেয়েটির কানে উল্টোপাল্টা থিউরি সোপে দিয়েছে,এজন্য মেয়েটি হয়তো আমায় দেখে এত্ত ভয় পাচ্ছে৷।
কিন্তু কী এমন থিউরী ওর মেমোরীতে ঢুকিয়ে দেবে!?এসবের মানে বুঝতেছি না।ওই ডাইনী যতই চালাকি করুক না কেন,এই শাওনের সাথে ও যুদ্ধে কোনোদিনও জিতবে না।ইট ইজ মাই প্রমিজ !!
অবশেষে বাড়ি এসে পৌঁছাই।বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই ড্রাইনিং-এ মা,বাবা,ভাই এবং উনার বউ বসে আছেন।আর শিমলা মায়ের পাশে দাড়িয়ে আছে।
মায়ের মুখটায় বিষন্ন চিন্তার চাপ,বাবা ক্রুদ্ধতায় অন্যদিক তাকিয়ে আছে,ভাই-ভাইয়ের বউ শতানী মনোভাব নিয়ে একে-অপরের দিকে তাকাতাকি করছে।আমি বুঝতে পারি নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল ঘটেছে।
আমি হালকা গলা কেশে হাটিহাটি পা ফেলে উনাদের সামনে আসি।আমায় দেখে সবাই অনেকটা
চমকে যায়।কারণ বাড়িতে আজতো আমার আসার কথা না।শিমলা যে আমায় আসতে বলেছে এটা শুধু শিমলা এবং আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।এমনকি মাও না।পরক্ষণে ভাইয়া আমায় দেখে বলে উঠে,
-ওহ,তুই আসছিস ভালো করছিস।তোর সাথেও আমার কিছু হিসেব মিটমাট করার আছে!!
আমি ভাইয়ার কথা শুনে অনেকটা ভড়কে যাই,কি এমন কিছু মিটমাট করের জন্যে সবাই গোল বৈঠকে বসলো!!গলাটা পরিষ্কার করে বলে,
-আচ্ছা কি বলবে,বলো!
-আমারদের যে পুরনো বাংলোটা আছে ওটার ভাগ আমি তোকে দিতে চাচ্ছি না!আমি তোকে ওটার বদলে অন্যদিক দিয়ে ভাগ দিয়ে দিবো!!!কারণ,আমি ওটা বিক্রি করে ব্যবসায় শুরু করবো!বাবার এতে কোনো অসম্মতি নেই,বাবা মেনে নিয়েছেন।এখন,মা আর তুই কি বলতে চাস ক্লিয়ার কর!
আমি ভাইয়ার কথা শুনে অনেকটা ধাঁধায় পড়ে যাই।কারণ,এই বাংলোটা আমার নানা আমার মাকে বিয়ে উপলক্ষে গ্রিফট দিয়েছিলেন।কারণ,আমার মা নানার একমাএ মেয়ে ছিলেন এবং নানার সব সম্পওিই মায়ের।তাহলে,এটা ভাইয়া বিক্রি করতে যাচ্ছে কোন দুঃখে!! মা জীবিত থাকতে এসব হাঙ্গামা ভাইয়াকে দিয়ে এখনই শুরু করে দিল এই মহিলা!!
আমি টপকে ভাইয়ার কথার জবাব দি।
-আমার তাতে কোনো আপওি নেই যদি মায়ের আপওি না থাকে!!
মা আমার দিকে চেয়ে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন,চেহারাটা বলছে মায়ের মনটা ভীষণ ভার দুঃখে-ক্ষোভে।
-তোর মা কি বলবে?!এখানে আমি যা বলব তাই হবে!!(বাবা)
-বাবা,দেখো?এটা মায়ের শেষ স্মৃতি!মায়ের একটা স্মৃতি অন্তত তো টিকিয়ে রাখো?
-এখানে আমার ছেলে ব্যবসা করতে চাচ্ছে এটাতো খারাপ কিছু না।অকেজো বাংলো টা খালি খালি রেখে কোনো লাভ আছে বরং তা থেকে কিছু টাকা আসবে সে-ই ভালো।
-নাহ,বাবা এটা হতে পারে না!!
আমি যে-ই বাবার বিরুদ্ধে কথা বললাম ওমনি ভাই এসে আমার গালে ঠাস ঠাস দু’টো চড় বসিয়ে দেয়।শিমলা এ দৃশ্য দেখে মুখে হাত দিয়ে হতবাক হয়ে যায়,মা আঁচলের মধ্যে মুখটা গুঁজে চোখের পানি মুছে নেয়।
মনের অজান্তে আমার চোখ বেয়ে দু’ফুটো টপকে জল গড়িয়ে পড়ে।
-ছোট আছিস ছোটদের মতো থাকবি!বড়দের সাথে তর্ক করা মানায় না!আর কোনমুখে তুই কথা বলতে আসছিস?আমার বউয়ের মান-ইজ্জত খেয়ে?বেয়াদব!!সর আমার সামনে থেকে!!
বাবাও ভাইয়ের সাথে আমার উপর ক্রুদ্ধ ভাব এনে অন্যদিক মুখ করে তাকিয়ে থাকে।
আমি গালে হাত দিয়ে উনার কথা শুনে যাচ্ছি । ভাইয়ের বউ এরইমধ্যে বলে উঠে,
-ঠিক করলে ফাহাদ!!এসব কুলাঙ্গারকে কিসের বাংলোর ভাগ দিবে?এদের তো রাস্তায় জায়গা করে দেওয়া উচিত,ওখানে থালা পেতে ভিক্ষা করে খাওয়ায় এদের শ্রেয়!!
আমি দাড়িয়ে না থেকে তড়িঘড়ি আমার রুমে চলে আসি, আর হাতের কাছে যততএ যা পাচ্ছি সব ফ্লোরে সজোরে আঘাত করে ভেঙ্গেচুরে দিচ্ছি।শিমলা আমার রুমে এসে আমায় বাঁধা প্রদান করতে থাকে করতে!
-পাগল হয়ে গেছিস,তুই?এসব কি করছিস!?উনারা সব বলবে আর তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি নাকি?বরং প্রতিবাদের ঝড় তুলবি।কারণ,এটা তোর বাবার সম্পওি না যে কুওাকে বিলিয়ে দিবি,এটা তোর মায়ের সম্পওি!!
শিমলা ভাই-ভাইয়ার বউকে কুওা বলে সম্বোধন করাতে আমি অনেকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাই!!হাত দিয়ে ইঙ্গিত করি এরকমটি ও কেন বলছে,ও’কি সব জানে!?
-শাওন,তোর সাথে যা হয়েছে আমি সব জানি।দেখছিস?তুই আমায় বলিসনি কিন্তু আন্টি আমায় কালরাত সবটা কুলে বলেছেন!
শিমলার কথা শুনে কলিজাটা আমার অনেক বড় হয়ে যায়!শিমলাকে কাছে টেনে বলি,
-শিমলা শুধু আমার সাথে কেনই বা এসব হচ্ছে ? আমিতো কখনো কারো ক্ষতি করিনি!
-এসব হয়ে যায় রে! মনের অজান্তে!!তবুও নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখতে হয়।নাহলে,এই মিথ্যে পৃথিবীতে দুর্ভাগাদেরই ঢুকরে ঢুকরে মরতে হয়।
-শিমলা তুই জানিস? এই ডাইনীটা হচ্ছে সেই শিপ্রা ডাইনী যার জন্যে আমি আজ আমার সোহানাকে হারাতে বসছি!
–
-কী!???
শিমলা প্রায়ই হতবাক!!!
চলবে…..