ভবঘুরে পর্বঃ১৫
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ
মেম্বারের নির্দেশে সালিশ শুরু হল৷ মাতব্বরটা শুরু করল বিভিন্ন মতামত ছোঁড়াছুড়ি। এক ফাঁকে আবিদ এসে বসল ইশতিয়াক সাহেবের পাশে। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে আবিদকে গ্রামের কমবেশি মানুষ চিনে, যারা প্রতিনিয়ত ঘর থেকে বেরোয় নানা কাজে। কেউ কেউ এরিমধ্যে আবিদের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছে। আবিদ সন্তর্পণে মজমায় উপস্থিত হতেই লোকজন তার দিকে ট্যারা দৃষ্টিপাত করল। তবু সালিশ শুরু হয়ে যাওয়ায় কেউ কিছু বলতো পারল না। নইতো এই গ্রামের নিয়মানুসারে বাইরের এলাকার লোক সালিশে বসা নিষেধ। প্রথম মাতব্বর আবুল হোসেন উরবির দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘কও,তুমি হ্যারে খালপাড়ে মারছ ক্যান?’
উরবি মুখ জনকোলাহল আর ভ্যাপসা গরমে ঘর্মাক্ত। মাথার চুল চুইয়ে ললাট বেয়ে দরদর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে তার। ছোকরাটা ফ্যান আনতে গিয়ে গিয়ে বোধহয় নিজে ফ্যান হয়ে বসে আছে। সে মুখে একটা বিরক্তি রেখা টেনে বলল,
– সব তো জানেন। বুইড়া আমারে ডিস্টার্ব করছিল। তাই মারছি। এই নিয়ে তিন তিন বার মারছি। লজ্জায় বলে নাই বুইড়া।…
উরবি আরো কিছু চাইলে মেম্বার সাহেব হাতের ইশারায় তার বাক-রোধ করে চোখ ঘুরিয়ে মনসুরকে বলল,
– ঘটনা সত্য মনসুর?
মনসুর ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ে মাথা নেড়ে অস্বীকার করল,
– না মেম্বার সাব, এই মাইয়্যা আমারে অফদস্ত করবার লাইগ্গা এসব কইতাছে। ও আমারে একবারই মারছে।
তৎক্ষনাৎ উরবি বাবার গায়ে খোঁচা দিয়ে সবাইকে শুনিয়ে বলল,
– বাবা তুমি বল না। আমি ওরে তিনবার মারছি না? ও তোমার কাছে বিচার দিছে না?
ইশতিয়াক সাহেব নিশ্চুপ। পাশে আবিদ অন্যজনের পিঠে মুখ লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
এবার দ্বিতীয় মাতব্বর লতিফ তর্জনী দিয়ে জিবে চুন লাগিয়ে উরবির উদ্দেশ্যে বলল,
– হইছে তিনবার মারছ ভালো কতা। সে শাস্তি তুমি পাইবা। এহন হেইলোক তোমার বাপের বয়সী। তুমি তারে মারতে গ্যালা কেন? কারণডা তো জানা দরকার।
উরবি আবার বিরক্তমিশ্রিত গলায় বলল,
– ‘আরে মুশকিল। কয়বার বলব? এই লোকটা প্রতিদিন আমাকে রাস্তার মাঝখানে ডিস্টার্ব করে। বিয়ের কথা বলে। সে নাকি আমাকে বিয়ে করবে। এটা কোনো কথা? আমি যে তাকে পুলিশে দেই নাই সেটা তার সাত কপালের ভাগ্য৷,
এবার মনসুর উত্তেজিত হয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দাঁত খিঁচিয়ে ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল,
– আরে এ…এই এইডা ডাহা মিচা কতা। আমি আমার ভাইপোত জিসানের বিয়ের কথা কইতে গেছিলাম ওরে।
কয়জন শক্তিমান যুবক ক্ষ্যাপাটে মনসুরকে জোর করে বসিয়ে দিল আবার।
মেম্বার শ্লেষাত্মক হেসে বলল,
– মনসুর, এই মেজাজ লইয়া গেরামের মেম্বার অওনের স্বপ্ন দেহো?… তুমি বিয়ার কথা বলছ তা তার বাপেরে গিয়া কইতা৷ মাইয়্যারে কেউ বিয়ার কথা কয়?
মাতব্বর হোসেন বলল,
– যা অওনের অইছে। এহন তারে যে মারছে সেটার কী অইব?
মেম্বার বলল,
– শাস্তি অইবো। মনসুর,তোমার কিছু কওয়ার আছে?
মনসুর বলল,
– আছে।
– বল
– ঐ মেয়ে মিচা কতা কইতেছে। আমি তারে বলছি তুমি আমার ভাতিজারে বিয়া করো। সুখে থাকবা। এডা কওয়া মাত্রই হে আমার মাথায় থপ করে চড় বসাইয়া দিলো। আমি দুনিয়াদারি আন্দার দ্যাখলাম… সব দেখছে আমার ভাতিজা জিসান। ও সাক্ষী আছে।
জিসানও সায় দিল চাচার কথায়। সে-ই এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
এতক্ষণ পর উরবি কথা বলল,
– মেম্বার সাহেব, আমার কাছেও প্রমাণ আছে। বুইড়া আমাকেই বিয়ে করতে চাইছিল।
এমন উত্তেজনাকর অবস্থায় মজলিসে একটা মৃদু গুঞ্জন পড়ে গেল। সবাই ভাবল এই মেয়ে আবার কী প্রমাণ দেখাবে! একটু পরেই আবার সবাই উৎসুক হয়ে পরের ঘটনা দেখার জন্য চুপ করে গেল।
লতিফ মাতব্বর উৎসাহী হয়ে বলল,
– দেহাও দেহি কী প্রমাণ আচে তোমার।
উরবি নিজের ফোন ঘেঁটে একটা অডিও প্লে করে মেম্বারের হাতে দিল। মেম্বার সেটাকে উঁচু করে কানের পাশে ধরলেন। যদিচ কানের কাছে ধরার বিশেষ প্রয়োজন ছিল না। উরবি ফুল ভলিউমেই দিয়েছিল। অডিও প্লে হল। ফোনের স্পিকার গলে তারস্বরে বেরিয়ে এলো মানসুরের কর্কশ কণ্ঠ। মনসুর বলছে,
– উরবি,তুমি আমারে বিয়া করো। রাজরানী করে রাখমু তোমারে।
পরক্ষণেই উরবির গনগনে কণ্ঠ,
– আপনার মতো বুইড়া লোকরে আমি বিয়া করব? এবং পরমুহূর্তেই ঠাস করে একটা আঘাতের শব্দ। এরপর অডিওটি শেষ।
উপস্থিত লোকজন ঠিকি সহজে বুঝে নিল ঠাস করে চড়টা ধুরন্ধর মনসুরের টেকো মাথায় গিয়ে হেনেছিল সেই সময়। অডিওটা শেষ হতে না-হতেই কেউ হো হো করে হেসে উঠল আবার কেউ মৃদুহাস্যে পাশাপশি কানাকানি শুরু করল। মনসুর খাপছাড়া-বিস্ময়ে লোকগুলোর দিকে অসহায়ভাবে চোখ ঘুরাতে লাগল। যখন দেখল সবাই তাকে নিয়ে জবর আমোদে ব্যস্ত তখন সে ভেতরে ভেতরে রোষে ফেটে পড়ে মাথা নত করল। পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত তার কাছে আবছায়ার মতো ঠেকছে। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না, সে এসব কখন বলল! মাথাটা চরকার মতোন ঘুরছে তার। মনে হচ্ছে পুরো বিশ্ব নিখিল নাগরদোলার মতোন উপরে উঠছে আর নামছে। উঠছে আর নামছে…
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
উরবির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। সে আর তর না সয়ে বলল,
– মেম্বার সাহেব এখন তো সব প্রমাণ হয়ে গেল এখন তাইলে যাই? খিদে লাগছে খুব। খাবার অনিয়ম হলে সমস্যা। আমার মোটা হতে হবে। নাহলে নাকি বিয়ে হবে না।
সালিশের মজলিসে একযোগে ছিঃ ছিঃ আর উচ্চহাসির রোল পড়ে গেল। আমোদপ্রিয় মানুষেরা মন উজাড় করে হাসল আর গম্ভীরবেদী মানুষেরা নাক সিঁটিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ছিঃ ছিঃ নির্লজ্জ মাইয়্যা!
মেম্বার সাহেব উরবিকে হাতের ইশারায় আরেকটু বসার ইঙ্গিত দিয়ে অবনত মনসুরকে বলল,
-তোমার আর কিছু কওয়ার আছে মনসুর?
মনসুরের পূর্বের ন্যায় নত মস্তকে বসে রইল। কোনো বাকস্ফূর্তি হল না তার। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে মেম্বার সাহেব আর দ্বিরুক্তি করলেন না। সবাইকে শোরগোল থামাতে বলে উচ্চকণ্ঠে রায় দিলেন। উরবি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এবং মনসুর দোষী৷ কারণেই মনসুরকে কিছু সংবিধিবদ্ধ নিয়ম আর জরিমানা গুনতে হল। বিচারকার্য এখানেই শেষ হল৷ কিন্তু কিছু লোকজন এই রায়ে তুষ্ট হল না। সবাই ধারণা করল মনসুর আগামী নির্বাচনে মেম্বার হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে বিধায় বর্তমান মেম্বার রহিম শেখ এই একপাক্ষিক রায় দিয়েছেন। মনসুর না-হয় মেয়েটাকে টিজ করেছেই,কিন্তু মেয়েটাও তো কম যায়নি। সেও তো শোধ নিয়েছে মনসুরকে মেরে। তবে এই একপেশে রায় কেন? মেয়েটার ঘাড়েও তো কিছু শাস্তি পড়তে পারতো! হায়রে— আস্তে আস্তে গোটা মেয়ে জাতি খেয়ে নিচ্ছে এই দেশ! এমন আরো কত কথা তার ইয়ত্তা নেই—। ঘরে ফিরতে ফিরতে এই নিয়ে গ্রামের লোকজনের মধ্যে নানান আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের জন্ম দিল।
মজলিস ভেঙে যাওয়ার পর আবিদ কোন ফাঁকে উরবির নজর এড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল তা বোঝার সাধ্যি নেই। মিনিট কতক আশপাশে খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে আবিদের দেখা মিলল বাড়ি যাওয়ার ঠিক উল্টো পথটাতে। ইশতিয়াক সাহেব অবশ্য মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করেছিল কিন্তু উরবি রাজি হয়নি। সে তো আর কচি খুকি না যে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে! সে একাই যেতে পারে! মনে মনে এমন মনোভাব উরবির৷— আবিদ দুইহাত পকেটে পুরে আনমনে হাঁটছিল গ্রাম্য মেটো পথে আছড়ে পড়া ম্লান চাঁদের আলোয়। সেদিনের কালবৈশাখী ঝড়ে মেটো পথের গায়ে আঁকানো জলের নকসা এখনো কিছুটা বিদ্যমান রাস্তার মাঝবুকে। স্যাঁতসেঁতে জায়গাগুলো এড়িয়ে হাঁটছে সে। স্তব্ধ,গুমোট গাছপালার বুক চিরে হঠাৎ বেরিয়ে আসছে গা জুড়ানো শীতল বাতাস; এরপর আবার ভ্যাপসা গরম। এই একটু আগেই সন্ধ্যাতারাটা চাঁদের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল, সময় গড়াতেই তা কোথায় যেন গা ঢাকা দিল। বদলে তারকালোকিত হলো সমগ্র আকাশ। হঠাৎ টকটক জুতার আওয়াজ তুলে উরবি আবিদের পথ রোধ করল। খুশিতে ঈষৎ লাফ দিয়ে দুইহাত এক করল উরবি। উল্লাসিত গলায় বলল,
– থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনি অডিওটা এডিট করে না দিলে হয়তো সব দোষ আমার ঘাড়েই পড়তো। উফ্ বাঁচালেন আমাকে।
আবিদ নিঃশব্দে হাসল। বলল,
– ইটস ওকে। এতো থ্যাংক্স দেওয়ার কিছু নেই।
সঙ্গ দিয়ে হাঁটা শুরু করল দু’জনে। চন্দ্রিমায় আনকো আলোয় দেখা যায় আবিদের ঘাড় অবধি সুবঙ্কিম চুল আর আলুথালু খোঁচা দাঁড়ি। উরবি বলল,
– কিছুই নেই বলতেছেন? আমিতো ধরেই নিছিলাম যে আমার কোনো শাস্তি হবে। শেষ মুহূর্তে আপনি বাবার পেছন দিকে এই অডিওসহ ফোনটা ধরিয়ে দেবেন কে জানতো?
– আপনিই তো দিয়েছিলেন অডিওটা। না জানার কী আছে?
– ওমা,আপনি যে এতো তাড়াতাড়ি সেটাকে এডিট করে নিয়ে এসে ঘটনা কাহিনি করে দিবেন সেটা কে জানতো? আমি তো ভাবছি আপনি আহাম্মক কোথাকার কে।…পারবেন না ভাবছিলাম আরকি।
আবিদ একবার সামনে কিছুদূর তাকিয়ে আবার নিচে দেখে পথ হাঁটতে লাগল। গম্ভীর গলায় বলল,
– হুমম। এরপর থেকে এসব বিটলামি ছেড়ে দেন। আমি নাহয় আজ আপনাকে দয়া করে বাঁচালাম। অন্যদিন কে বাঁচাবে?
উরবি তাকাল আবিদের দিকে। একদৃষ্টে। আবিদ কিন্তু আগের মতোই নির্বিকার। উরবি ক্লেশিত গলায় বলল,
– দয়া করে বাঁচাইছেন?
– নয়তো কী?
উরবি হঠাৎ টট্টর করে বলল,
– তাহলে মেম্বারকে বলে আসুন যে ঐ অডিওটা মিথ্যা ছিল।
– আমার দরকার পড়েনি আবার ফিরে গিয়ে এই কথা বলার। আপনার ইচ্ছে হয় তো আপনি গিয়ে বলুন।
উরবি চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে জেদি গলায় বলল,
– ঠিক আছে যাচ্ছি। এখনই গিয়ে বলব। এখনই… আমার ফাঁসি হোক।
বলতে বলতে ধুপধাপ করে গা নাচিয়ে কিয়দ্দূর হেঁটে গিয়ে কি মনে করে আবার ফিরে এলো সে। পুনরায় আবিদের পাশ ধরে হাঁটতে শুরু করল। এই উল্টোপথে কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। তবুও তার একাকী হাঁটছে ইচ্ছে করছে এই জনমানবহীন রাস্তায়। অনেক্ষণ নিঃশব্দে হেঁটে যাওয়ার পরও আবিদ জানতে চাইল না যে, সে আবার ফিরে এলো কেন? আবিদের স্থিত নিশ্চেষ্টতা উরবির ভেতরে ঢিমে খচখচানির উদ্রেক করল। অনেক্ষণ অবধি সেই খচখচানিটা রয়ে সয়ে আঘাত করতে লাগল আজানা স্থানে। এই আঘাত সম্পূর্ণ নতুন। একেবারে আনকোরা! হঠাৎ করেই কিছু ভালো লাগছে না তার। কিছুই না! পৃথিবীটাই যেন নীল নীল বেদনায় বিষিয়ে উঠছে তার কাছে। সে ভরপুর চোখে তাকাল আবিদের দিকে। কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পেল না আবিদের মুখ। চাঁদ লুকিয়েছে বিশাল একখণ্ড মেঘের আড়ালে। এরপর উরবি কেমন অন্যরকম গলায় বলল,
– আচ্ছা আপনি এমন কেন? আমার না কিছু ভালো লাগতেছে না।
অন্ধকারে দেখা যাবে না জেনেও একপলক তাকাল আবিদ। ক্ষীণ শব্দ করে হাসল। বলল,
– ব্যাপার নাহ্। মেয়েদের মুড সুইং হয়। এই মন ভালো এই খারাপ। কিন্তু আমাকে জড়াচ্ছেন কেন? আমি আবার কেমন?
আবিদের কথা শুনে উরবির মনে হল সে স্বকীয়তা ফিরে পেয়েছে। একটু আগের খারাপ লাগাটা আর নেই। সে বলল,
– আপনি কি মেয়েদের ঘৃণা করেন?
আবিদ ছোট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
– দেখুন, মেয়ে জাতি ঘৃণার বস্তু নয়। শ্রদ্ধার, স্নেহের, ভালোবাসার,কোমলতার। হাজার হোক, মায়ের জাতিকে ঘৃণা করার অধিকার আমার নেই। কিন্তু একথা কেন?
– কেন জানি না। এম্নেই মনে হল। বললাম। দ্যাট্স ইট। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় আপনি মেয়েদের ব্যাপারে একটু উদাসীন।
– পুরুষ কখনো মেয়েদের ব্যাপারে উদাসীন হয় না। এটা মিথ্যা কথা। যারা এই কথা বলে নিজেদের সারবত্তা প্রমাণ করতে চায় তাদের হয়তো শারিরীক কিংবা মানসিক সমস্যা আছে। একান্ত যদি কিছু থেকেই থাকে সেটা হলো আত্মসংযম, আর নিজ কল্যানে নারী থেকে দূরে থাকা। এখানে আত্মসংযম আর উদাসীনতা ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে৷ সুতরাং আমি উদাসীন নই। কিন্তু দূরে দূরে থাকি৷ কারণ ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। বুঝলেন?
উরবি শব্দ করে হেসে রগুড়ে গলায় বলল,
– সবই বুঝলাম। কিন্তু আপনি কখন ন্যাড়া হইছিলেন আর বেল তলায় গেছিলেন কখন। সেই কাহিনি কি শুনতে পারি না?
– আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদে অন্যকিছু জিজ্ঞেস করুন।
উরবি থুতনিতে তর্জনী ঠেকিয়ে ভাবল,
– উমম,— আপনি কতদূর পড়ালেখা করেছেন।
– ফের ব্যক্তিগত প্রশ্ন! যাক, এটা বলা যায়। মাস্টার্স করেছিলাম। পিএইচডি করতে গিয়েছিলাম আউট কান্ট্রিতে। না করেই ফিরে এসেছি।
-‘ কেন?’ উরবির কণ্ঠের ঔৎসুক্য প্রকাশ পেলেও চোখে-মুখের ঔৎসুক্য আলো-ছায়ায় বাঁধাপ্রাপ্ত হল।
আবিদ এড়িয়ে যাওয়া গলায় বলল,
– যাক।সেদিকে না যাই। লম্বা কাহিনি। শুনুন, মনসুর লোক ভাল না। সাবধানে থাকবেন। এই ঘটনার পর আপনার ক্ষতি করতে চাইবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
– কী করে জানলেন লোক ভালো না?
– মানুষ চিনতে পারি বলে।
– তাই? আমি কীরকম বলুন তো?
আবিদ ভাবুক দৃষ্টিতে শূন্য তেপান্তরে চোখ রাখল। মাথা নেড়ে মটমট করে ঘাড় ফুটিয়ে তাকাল উরবির দিকে। বলল,
– আপনি? এককথায় বলি,আপনি হলেন টক-ঝাল-মিষ্টি। তবে নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইনই পার্সেন্টই ঝাল।
উরবি উচ্চরবে মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। এই নিভৃতে আবিদের কানে বাজল সেই তীক্ষ্ণ হাসি। দিকবিদিকে বারকয়েক অনুনাদিত হয়ে ভয়ংকর শোনাল হাসির শব্দটা। দূরের বাঁশ ঝাড়ের লক্ষ্মীপ্যাঁচাটা ধ্যান ভেঙে শশব্যস্ত হয়ে তাকাল আশেপাশে। রাস্তার ডানপাশের খাড়া অর্জুন গাছের ডাল থেকে নাম না জানা কোনো নিশাচর পাখি ভয় পেয়ে পতপত ডানা ঝাপটে করে উড়ে গেল। মেটে রাস্তার দু’পাশে গজানো নিবিড় দূর্বাঘাসের ওপর খসখস করে দৌড়ে গেল কোনো সরীসৃপ প্রাণী। মুহূর্তেই কিছু একটা মনে করে উন্মনা হয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল সে। সেই দীর্ঘশ্বাসের তোপে উরবির হাসি টিকল না। অনবরত ডাকতে থাকা ঝিঁঝি পোকা যেমন বিকট কোনো শব্দে থমকে যায় উরবির কাছেও তেমনি আবিদের দীর্ঘশ্বাস সেরূপ ঠেকল। সহসা চুপ করে গেল সে। ক্ষীণ-কণ্ঠে বলল,
– আপনার এই দীর্ঘশ্বাসের কারণটা আমি শুনতে পারি না? লুকোচুরি করে লাভ কী? কয়দিন পর তো চলেই যাবেন।
আবিদ ওর কথার সুত্র ধরেই বলল,
– সেটাই তো কয়দিন পর তো চলেই যাব। অন্যজায়গায়। তাই জায়গায় জায়গায় গিয়ে আমার জীবন কাহিনি শোনানোর তো মানে হয় না!
– সবজায়গার মানুষ কি আমার মতো কাছাকাছি এসে আপনের মতো কথা বলে? শখ্যতা হয়? খোঁজখবর নেয়? আর আপনিও তাদের কাউকে হেল্প করেন? যেভাবে আজকে আমার হেল্প করছেন।
সুমুখে জমাটবদ্ধ পানিতে কাদামাটি। চাঁদের আলোয় তা আধো আধো মূর্তিমান হয়। আবিদ একলাফে কাদামাটি ডিঙিয়ে গেল। উরবিও একইভাবে আত্মরক্ষা করল ক্লেদাক্ত মাটি থেকে। কিন্তু আবিদের পিছে পড়ে গেল সে৷ আবিদ সামনে এগোতে এগোতে বলল,
– তা করা হয় না অবশ্য। তবে আমি চাই না কেউ আমার কাছাকাছি আসুক। আমার মায়ায় জড়াক।
উরবি পেছন থেকে বলল,
– আপনি পাষাণ, আমার মতো। যাইহোক প্রসঙ্গ ঘুরায়া লাভ নাই। আপনার কী কাহিনি আছে তাই বলেন।
আবিদ মিনিট দুই কথা বলল না। রাত্রির নৈঃশব্দ্য চিরে চিরে ধীরপায়ে এগোতে লাগল। এরপর কি মনে করে হেসে বলল,
-শেষমেশ বলিয়েই ছাড়বেন মনে হচ্ছে। ঠিক আছে বলব। কিন্তু আজ না। বলতে গেলে সময় লস হবে অনেক। আজকে তো থানায় যাচ্ছি৷ খুন হয়েছে ওটার ব্যাপারে জানতে। আপনিও চাইলে যেতে পারেন। যাবেন?
আবিদ আশা করেছিল উরবি ধেইধেই করে আহ্লাদিত হয়ে রাজিসূচক বুলি আওড়াবে। কিন্তু পেছন থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
– কী? যাবেন না?
পুনশ্চ কথাটা বলেই হাঁটা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আবিদ। তার দৃষ্টি গিয়ে হুমড়ে পড়ল দূরের আবছা নিরালোকের সাপের মতো বেঁকে যাওয়া পথের বাঁকে। নিমেষে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে গেল তার। দৃষ্টিশক্তি হয়ে উঠল তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণধার। আশেপাশে কোথাও উরবি চিহ্নমাত্র নেই! চারিদিকে শুধু জ্যোৎস্নার গুড়িগুড়ি বৃষ্টি!
চলবে