ভবঘুরে পর্বঃ১২

0
802

ভবঘুরে পর্বঃ১২
লেখাঃ আরিফুর রহমান মিনহাজ

উরবি যখন মহানন্দে চাচাদের ঘরে ঢুকল নিরু তখন পড়ার টেবিলে চিপস চিবোতে চিবিতো বইয়ে চোখ বোলাচ্ছে নিশ্চিন্তে। উরবি ঘরে ঢুকতেই সহসা পেছন থেকে নিরুর গলা প্যাঁচিয়ে ধরল। হতধী নিরু পলকে চমকে তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। উরবির পাতলা দুই হাত গলা থেকে আলগা করে নিতে নিতে বলল,
– কী রে? যে মেয়ে বারোমাসেও এখানে আসে না সে আজ স্বেচ্ছায় এখানে আসল? তাও আবার এতো খুশি! ঘটনা কী বলতো? জিসানকে বুঝিয়ে বলছস তো সব?
উরবি খুশিতে আটখানা হয়ে বলল,
– বলার আগেই কি কাণ্ড হয়েছে দ্যাখ না। শোন।… আজকে তোর পড়াশোনা বন্ধ। পরে পড়িস। সারাদিন এতো পড়া পড়া করিস ক্যান? ভার্সিটিতে এতো পড়া লাগে?
বলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে নিরুর বই-খাতাগুলো গুছিয়ে ভাঁজ করে রেখে দিল এবং পরক্ষণেই গদগদভাবে নিরুর হাত ধরে টেনে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল দু’জনে। এরপর চঞ্চলা উরবিকে আর থামায় কে! একে একে সমস্ত ঘটনাটি বেশ আহলাদের সঙ্গে খুলে বলল উরবি। নিরু পাক্কা সমঝদারের মতোন হাঁ করে সেসব কথা গিলল। হজম হয়ে যাওয়ার পর নিরু আহত গলায় বলল,
– একেবারে মেরে-ধরে চলে এলি? আহারে বেচারা…
উরবি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– তোমার সঙ্গে ওমন আচরণ করলে বোধহয় তুমিও কাছে গিয়ে…
– ধ্যাৎ, সেকথা বলছি নাকি। কিন্তু মারা উচিত হয় নাই। ছেলেটা নেশার ঘোরে ওমন আচরণ করছে৷
– তারমানে তুই নেশা করাটাকে সমর্থন করতেছস? আর নেশার ঘোরে মানুষের আসল মুখ বেরিয়ে আসে সেটা তো জানছ!
নিরু চুপ করে রইল। এই কথার জবাবে প্রয়োগ করার মতো অকাট্য যুক্তি তার কাছে মজুদ নেই।
…………….
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


দিন গিয়ে দিন আসে। আবিদও সুস্থ হয়ে নিজ কাজে লেগে পড়ে। বলা অসংগত নয়, এতাবৎ আবিদের শুশ্রূষার দায়িত্ব উরবি একাই বহন করেছিল। আবিদ গাঁইগুঁই করলেও সেদিকে কর্ণপাত মাত্র করেনি সে। পুনশ্চ, এতোদিন আবিদের আকস্মিক অসুস্থতার কারণে উরবির ঢাকা ঘুরে আসায় বিপত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছুকালের জন্য। এবার যখন আবিদ নির্দ্বিধায় আলায়-বালায় ঘুরে বেড়াতে লাগল আগের মতোন, তখন আর ঢাকা যাওয়ার পথে কোনো বাঁধাই রইল না। কিন্তু, তাবৎ পৃথিবীর মানুষের মন যা চায় ;উড়নচণ্ডী, চপলা মেয়েদের মন ঠিক তার উল্টোটা চেয়ে বসে। বাঁধ সাধল শুধু উরবির ইচ্ছেরা! কেন জানি অসময়ে ভাটা পড়েছে তার ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছের সাগরে। কিন্তু বাবার কাছে একবার বলে ফেলায় সে আর দ্বিরুক্তি করতেও রাজি হল না। কাজেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকা তাকে যেতেই হল। যাওয়ার সময়ে আবিদকে রহস্যভরে ছোট করে বলে গেল,
– ‘এসে যেন দেখতে পাই।’
সেদিন কথাটা পছন্দ হয়নি আবিদের। শুনেই চোখ ঘুরিয়ে, ঠোঁট কুণ্ঠিত করে অদ্ভুত এক ঢংয়ে অবহেলার ইঙ্গিত জানিয়েছিল সে। নিজের কানের কাছে কেমন অভব্য,বেয়াড়া আর চিন্ময়-হীন ঠেকেছিল কথাটা। সেই ছোট কথাটা যেন তার চলে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে অতল হতে ফেনিল করে তুলল। তবু সে সহসা এই মাঝপথে অন্যত্র গিয়ে ওঠার সুযোগও সে পেল না। কারণ, গ্রামের মানুষ ইতোমধ্যেই জেনে গেছে যে ছন্নছাড়া টাইপের ছেলে আবিদ ইশতিয়াক সাহেবের অতিথি। সে যে অস্থানে-কুস্থানে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরে মুসাফির একথাটা সেদিন চায়ের দোকানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে ইশতিয়াক সাহেবের কৃতিত্বে। বিধায়, এখন দু’চারদিন কষ্ট করে এখানে থাকাটাই শ্রেয়। বাইরে থাকতে হলে মাথার ওপর ছাদ নাও থাকতে পারে! ভাবল আবিদ। ভাবাভাবি শেষে এখানে থাকারই সিদ্ধান্ত নিল সে। একটা রণচণ্ডী মেয়ের জন্য সে বাড়ি ছাড়বে এমন কাপুরষও তো সে নয়!

সপরিবারে ঢাকা যাওয়ার পর বাড়িটা ধূধূ মরু প্রান্তরের মতো ফাঁকা হয়ে গেল একেবারে। অনেকটা বহুবছরের পুরোনো ধাড়ি ভূতের বাড়ির মতোন নির্জন। অবশ্য নির্জনতাকেই আবিদ ভীষণ ভালোবাসে। মনুষ্য হল্লায় তার দম আটকায়,প্রাণ হয় ওষ্ঠাগত। সে বিশ্বাস করে একজন মানুষ সুস্থ-সবলভাবে বাস করতে হলে নির্জনতাকে ভালোবাসা খুব দরকার। যারা নির্জনতাকে ভালো না বেসে ইচ্ছেকৃত কোলাহলকে আপন করেছে তারা মানুষ নয়, যন্ত্র! এঁদের অনুভূতির প্রগাঢ়তা পাতালে পড়ে রয়। সব পেয়েও প্রকৃত জীবনটা তারা উপভোগ করতে পারে না, ইত্যাদি…। এসব কেবল আবিদের উর্বর কিংবা অনুর্বর মস্তিষ্কের লাগামহীন কল্পনা। মূলত মানুষ যা ভালোবাসা তা নিয়েই বহুবিধ যুক্তির পসরা সাজায়। তা হোক কাট্য বা নিরেট।
এর মধ্যে দুইবেলা মকবুলের মা রান্না করে দিয়ে যায় আবিদকে। সকাল বিকালে নাশতাটা সে ঘরের সামনে টং দোকানেই করে নেয়। সামান্য চা-নাশতা খাওয়ানোর জন্য অন্য একজন নিজের বাড়ি থেকে ছুটে আসবে এটা তার পছন্দ নয়,বরং বিদঘুটে একটা ব্যাপার! দিন দু-এক পরে নিরু এসে হাজির। গতরাতে উরবি তাকে ফোন করেছিল,
– কীরে নিরু খবর কী?
– খবর ভালো। হঠাৎ খবর নিচ্ছিস যে। বাসায় কবে আসবি।
উরবি স্ব ঢংয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল,
– তোমার খোঁজে নেওয়ার জন্য বসে নাই আমি। শোন্, বাড়িতে গেছিলি আর তুই?
– নাহ্।
– ক্যান্ যাসনি? যা একবার খোঁজ নিয়ে আয়। জংলীটা আছে না গ্যাছে দেখে আয় একবার।
– ঠিক আছে, কাল যাব-নে।
– ওকে মনে থাকে যেন। আর শোন… নাহ থাক কিছু না। রাখি। বাই।
নিরু শেষের অসমাপ্ত কথাটা জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হতেই উরবি ফোন কেটে দিল। ভারি অদ্ভুত মেয়ে তো! উরবির ‘পরে রাগ হলো নিরুর। তবু উরবির কথা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ফেলে দিতে না পেরে আজ এসে আবিদের খোঁজে উপস্থিত হল সে।

অলস দুপুর। দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘাটলা পাড় সংলগ্ন চাতালে ক্যামেরা হাতে হাঁটাহাঁটি করছিল আবিদ। বসে থাকার মনন এবং ফুরসত কোনোটিই তার নেই। ঠিক এমন সময়েই এই বিজনে নিরুর অনভিপ্রেত আগমন।
নিরুকে দেখে আবিদ খানিক অবাকই হল। হঠাৎ এখানে তার আগমনের কারণটা তার জ্ঞাত নয়। তবুও হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে ভুলল না সে,
– আসুন আসুন, হঠাৎ? ওরা তো নেই।
নিরু চওড়া হেসে পাকা ঘাটে বসে বলল,
– আপনার কাছেই আসছি।
আলাপের উদ্দেশ্যে আবিদ ফুঁৎকারে গাবগাছ-ঝরা সরু পাতাগুলো সরিয়ে ঘাটে বসল সতর্কে। ক্যামেরাটা আলগোছে রাখল পাশে।
– আমার কাছে? অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল আবিদ,—কেন?
-উরবি… বলতে গিয়ে থেমে গেল নিরু। আবিদ চৌকস কটাক্ষে তাকাল। মুহূর্তেই নিরু আগের উদগত কথাটা গিলে নিয়ে সহজ হয়ে বলল,
– না মানে, উরবি তো নাই কয়েকদিন…। তাই ভাবলাম আপনার খোঁজ খবর নিয়ে যাই।
আবিদ বলল,
– উরবি কেন? কেউই তো নেই। ও বুঝি পাঠিয়েছে আপনাকে? ঘরে ডাকাতি করে পালিয়ে যাব বলে?
নিরু ব্যস্তভাবে অস্বীকার করে বলল,
– না না, কিসব বলেন৷ ও কেন পাঠাবে। আমিই আসছি৷
– ওকে। তারপর… ওনারা কবে আসবেন?
নিরু কৌতুক করে বলল,
– কেন? ওনাদের কী এতো দরকার শুনি?
– নাহ এমনেই।
নিরু টিপ্পনী কাটল,
– মিস করছেন নাকি কাউকে?
একথায় আবিদের চোখেমুখে আলাদা কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করল না নিরু। সে কেবল মৃদু হেসে বলল,
– পৃথিবীতে মিস করব এমন কেউ বাকী নেই আর। মিস শব্দটাই আমার অভিধানে অপ্রয়োজনীয়।
আবিদের কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে নিরু ছদ্ম-গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,
– আমিতো উরবিকে মিস করছি খুব।
– ঐ তো বললাম,আপনাদের মিস করার অনেকেই আছে। বাবা,মা,ভাই,বোন,প্রেমিক, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী… আমার কেউ নেই। হবেও না কোনোদিন।
– কেউ নেই? হবেও না? নিরুর চোখে সন্দেহ।
কিন্তু আবিদ প্রকারান্তরে এড়িয়ে গেল কথাটা।
– এনিওয়েজ, আমার একটু কাজ আছে। এড়িয়ে যাচ্ছি না। সত্যি সত্যিই কাজ আছে। আসি।
নিরু মৃদু-হাস্যে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। আবিদ চলে গেল ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে। নিরু সেখানে থ মেরে বসে রইল। একান্তে এই নির্জনে বসে ভাবনারা তার পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে তাকে ঘিরে ধরল, লোকটা এমন অদ্ভুত প্রকৃতির কেন? উরবির আচরণও ইদানিং এই লোকটার অনুকূলে। মেয়েটা যে নিজের অজ্ঞাতসারে কাটায় ছাওয়া পথকে সুগম্য পথ ভেবে নির্দ্বিধায় পা বাড়াচ্ছে—আবার ভাবে, হয়তো তার দেখার ভুল। একজন সাদাসিধে মানুষ পেয়ে উরবি বোধহয় স্বভাবসুলভ মজা লুটে নিজের মজার ভাণ্ডার পূর্ণ করছে। উরবিও কম দুর্বোধ্য নয়। কোনটা তার গুরুত্বপূর্ণ কথা আর কোনটা হেঁয়ালি,তা বোঝা শক্ত। এখন দুই দুর্বোধ্য মানুষের চিপায় পড়ে নিরু যেন নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না। থাক আর ভাবতে চায় না সে। ওতো ভাবাভাবি তার সয় না। একটা অকারণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাটলা থেকে উঠে এলো সে।

————
দিন তিনেক পর ওরা ফিরে এলো ঢাকা বেড়িয়ে। আবারো বাড়িটা আগের রূপে প্রত্যাবর্তন করল। কথাবার্তা, হাড়িপাতিলের টুংটাং, পুনরায় নিরুর আসা-যাওয়া, উরবির দুরন্তপনায় আমবাগানের অল্পদিনের শান্তি ভঙ্গ হল। এই কয়দিন আবিদ নিরুপদ্রবে বেশ ছিল,আরামে ছিল। এবার সে ভাবল, চটপটে মেয়েটার উৎপাতে জীবনটা বুঝি তার আবার অসহনীয় হয়ে উঠল। কিন্তু প্রথম একদিন যখন মেয়েটার কোনো দেখাই মিলল না আবিদ তখন মনে মনে বেশ খুশিই হল। আপদটা বুঝি কাঁধ থেমে নামল এবার! বলা উচিত, সীমান্তবর্তী সেই আস্তানায় একটা একাকী অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু ছবি দুরালভ ছবি সংগ্রহ করেছে সে। আজ আরো কিছু ছবি সংগ্রহ করে একযোগে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠাবে সে। এরপর সেখান থেকে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কোনো বাহিনী-সদস্য না হলেও দীর্ঘদিনের সহযোগিতা পাওয়া এ্যাজেন্টকে তারা সহজে বিস্মৃত হয় না। নিরস্ত্র অবস্থাতেই পরেরদিন সকাল সকাল ছবি সংগ্রহের অভিযানে বেরিয়ে পড়ল আবিদ। কিন্তু ভুলেও খেয়াল করল না যে, কেউ একজন তার পিছুপিছু অনুসরণ করে এগোচ্ছে আস্তানার দিকে!

গ্রামের মানুষজন ভোরে জেগে গেলেও তাকে সন্দেহ করবে এমন উচ্চমার্গের রাঘববোয়ালগুলো বিছানা ছেড়ে উঠে না এতো আগে। কাজেই সকাল সকাল নির্বিঘ্নে সীমান্ত পথে চলা যায় ভেবে নিশ্চেষ্ট ঢঙে আগায় আবিদ। কাছাকাছি গিয়েই সতর্ক হয় সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে আশেপাশে। সীমান্তের পাশেই রেললাইন। এবং রেললাইনের একপাশের ঢালু জমির অদূরে গভীর অটবির মধ্যে সেই আস্তানা। অনতিদূরত্বে দুইটি ঘর ওখানে। বাইরে থেকে গভীর চোখে না তাকালে ভেতরের মানুষের গতিবিধি বোঝা মুশকিল। আবিদ চারিপাশে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে ঢালু বেয়ে নেমে গেল। দিকবিদিকে সতর্ক দৃষ্টি এবং হালকা চালে পা চালিয়ে ক্যামেরা হাতে এগিয়ে গেল সে। এদিকটা তাদের আস্তানার পেছনের দিক। সামনের দিকটায় সবাই মিলে জুয়া খেলছে আর মদ গিলছে৷ ওদিকটা গেলে নিশ্চিত একটা হইচই পড়ে যাবে, অথচ কাজের কাজ কিছুই হবে না। সেটা মাথায় রেখেই পেছনের দিকে এগিয়েছে সে। আস্তানার ঘরগুলো পোক্ত বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। আবিদ পিছনের একটা দরজার হুঁক আলগে ভেতরে ঢুকে পড়ল। আবছা অন্ধকারে ক্যামেরা ফ্লাশ জ্বেলে ছবি উঠাল সারি সারি সাজানো ফেনসিডিলের বোতল। একই ঘরের সঙ্গে লাগোয়া আরেকটি ঘরের দরজা খুলে প্রবেশ করল সে। এই ঘরটা জনশূন্য। শুধু ঘরের কোণে কয়েকটা ভরপুর বস্তা দাঁড় করানো। দ্রুত এগিয়ে বস্তাগুলো ঈষৎ ফাঁক করে দেখে নিল ভেতরে। ইয়াবা! ফটাফট ছবি উঠিয়ে সে জায়গা ত্যাগ করল আবিদ। এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকাটা বোকামি। এই ঘরটাতে আরো কী কী আছে কে বলবে? দ্রুত সেগুলোর খোঁজ জানা আবশ্যক। পুনরায় পেছনে দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে অন্যঘরগুলোতে প্রবেশের বিকল্প পথ খুঁজতে ব্যস্ত হল সে।

হঠাৎ কাঁধে একটা কোমল স্পর্শে সচকিত হল আবিদ। আড়চোখে একবার পেছনে তাকানো বৃথা চেষ্টা করল। ঘুরে দাঁড়ালেই মুখের ওপর আশুগতিতে ঘুষি এসে পড়বে এতে সন্দেহ নেই।দুইহাতে ধরা ক্যামেরাটা বাঁ হাতে শক্ত করে ধরার পর দ্রুতবেগে ঘুরে আততায়ীর মুখে ঘা বসানোর আগেই অকস্মাৎ পরিচিত মুখ দেখে গতি শ্লথ হল তার। হাতের মুষ্টি শিথিল হয়ে আঙুলগুলো খুলে গেল বটে,কিন্তু অবাধ্য হাতটা অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ মানল না। ঠাস করে একটা অপ্রস্তুত চড় গিয়ে পড়ল মানুষটার গালে। মুহূর্তেকের মধ্যেই চপেটাঘাতে ক্ষীণাঙ্গী মানুষটা একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় আবির অভিভূত হয়ে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ধাতস্থ হয়ে দেখল উরবি মাটিতে চিৎপটাং শুয়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। তারই করা আঘাতে! কিন্তু এই মেয়েটা এখানে কীভাবে এলো! এদের সঙ্গে তার কী যোগসাজশ থাকতে পারে? উরবির রকমফের তো মেনে নেওয়ার মতো নয়! ভাবতে ভাবতে দ্রুত নতজানু হয়ে বসল আবিদ। ক্যামেরাটাকে পাশে যত্নসহকারে রাখল শুকনো পাতার ওপর। এরপর উরবির দুইগালে মৃদু মৃদু নাড়া দিয়ে অনুচ্চস্বরে নাম ধরে ডাকল তার। কিন্তু অচেতন উরবির কোনোপ্রকার উচ্চবাচ্য করল না আবিদের কথার। উপায়হীন হয়ে দুই পায়ের পাতার ওপর ভর করে বসে উরবির মাথাটাকে কোলের ওপর নিল সে। আবারো নাম ধরে ডেকে কাঁধ,মাথা, ঝাঁকাল। কিন্তু সাড়া নেই।
-‘মরে গেল নাকি’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে স্বগতোক্তি করল আবিদ। এরপর জ্ঞান ফেরানোর কোনো উপকরণ তাবাস করার উদ্দেশ্যে আশেপাশে একবার তাকাল।চোখ কাড়ল অনতিদূরে দুভাগ করা নারিকেলের শক্ত খোলসে জমানো নোংরা পানিতে। উরবিকে পুন মাটিতে শুইয়ে একদাপটে সেগুলো নিয়ে এল সে। অন্য কোনো উপায় নেই। এগুলো দিয়েই জ্ঞান ফেরাতে হবে। তার প্রাপ্যই নোংরা পানি। এসব ভেবে ভেবে নারিকেলের খোলসে জমানো পানিগুলো ছলাৎ করে ছিটিয়ে দিল উরবির সারা মুখে। পলকেই অসময়ে ঘুম-ভাঙা বাঘিনীর ন্যায় ভূতল থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল উরবি। শুরুতে একটু দুর্বল ভাব নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর কিছুটা আত্মস্থ হলে, আবিদের হাতের পঁচা নারিকেলের খোলসের দিকে তাকাল ভাসাভাসা চোখে। পরক্ষণেই নাক কুঁচকে দুইহাতে মুখের অবশিষ্ট নোংরা পানিগুলো নিংড়ে হঠাৎ আস্ফালন করে উঠল সে,
– ফাজিল,ইতর, বেয়াদব,অসভ্য,। থাপ্পর মারছস আবার ময়লা পানি মারছস। তোকে যে আমি কী করব…
রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে দাঁড়াল উরবি। এরপর হম্বিতম্বি করতে করতে আশেপাশে কি যেন খুঁজে, একটা মাটির ডেলা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারল আবিদের গায়ে। টপাস করে ক্লেদাক্ত ডেলাটা আবিদের মাথায় গিয়ে পড়ল। বিহ্বল আবিদ ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ধীরে ধীরে মাথার ময়লা সাফ করতে করতে বলল,
– এতোদিন শান্তিতে ছিলাম। এতোদিন পর দেখা হওয়ামাত্র মারামারি শুরু করে দিয়েছেন দেখি আপনি… অসভ্য কে সেটা ভেবে দেখুন তো।
একথার প্রতিউত্তরে উরবি আরেকটা মাটির ডেলা ছুঁড়ে মারল সবেগে।

চলবে…