বে রঙিন পাতা পর্ব-১১

0
649

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১১

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা বারবার জেরা করছে কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। সবাই জেনে গিয়েছে যে আমিই আপাকে পালাতে সাহায্য করেছি কারণ এই বাড়িতে আমি ছাড়া আপাকে পালাতে সাহায্য করার আর কেউ নেই।

হুট্ করে বাবা বলে উঠল,
‘তুই যেহেতু কনেকে ভাগিয়ে দিয়েছিস সেহেতু কপাল তোরই ফুরলো। তোর সাথেই বিয়ে হবে ওই লোকটার।’

আমি স্তব্ধ দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম। বাবার এমন রূপ হবে তা আমি কল্পনায়ও কোনোদিন আনিনি। আমার বাবা এতো খারাপ! নূন্যতম জ্ঞান থাকলেও এটা বলতে পারতো না কারণ ওই লোকটা আমার বাবারই বয়সী।

আমি কিছু সময় ঐভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছিলো যে এই কথাটা বাবা-ই বলেছে!
বেশ কিছু সময় যেতে আমার হুশ ফিরতেই বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরে অনুনয়ের সুরে বলে উঠলাম যে,’ বাবা বাবা এটা তুমি করিও না।’

‘এতো নাটক বন্ধ করে তৈরী হও।’ বলেই ছোট মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,’রহিমা মেয়েটাকে তৈরী করে দেও।’

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। বাবা ছাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ছোট মা এগিয়ে আসতেই উনারও পায়ে পড়ে গেলাম কিন্তু উনি সেটা তোয়াক্কা করলেন না। মাথায় কিছু আসছে না কী করবো আমি! শেষপর্যন্ত আমার জীবনটাই বুঝি শেষ হয়ে গেল! হার মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে আছি। চোখের জল বাঁধ মানছে না আজ। বারবার নিহান ভাইয়ের চেহারাটা ভেসে আসছে।

কবুল বলার সময়ে আর কান্না আটকে রাখতে পারলাম না। এই দুনিয়ায় আর কারো ভালোবাসার হাত এসে পড়লো না। আমার জীবনটা বুঝি এখানেই থমকে যাবে! বারবার আল্লাহকে স্মরণ করছি।হাতে চাপ অনুভব হতে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি ছোট মা রাগান্নিত চোখে কবুল বলার জন্য ইশারা করছে। আমার মনে হলো আর রক্ষা নেই। এইভাবেই বুঝি জীবনটা শেষ হয়ে যাবে!
কাঁপা কাঁপা স্বরে কবুল বলতে নিতেই কারো গম্ভীর আওয়াজে থেমে গেল সব। একটা অচেনা মানুষ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে,’ কী হচ্ছে এসব।’

বাবার দৃষ্টিতে অবাক করার মতো। বাবা কিছু না বলে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে,’ আপনি!’

‘হ্যাঁ, আমি।’

মুহূর্তের মধ্যে সবার দৃষ্টি দরজায় দাঁড়ানো সেই মানুষটার উপর নিবদ্ধ হলো। বাবাকে এতো অবাক হয়ে উনার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সবাই ঐদিকে তাকিয়ে রইল। আমরা কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না যে কে ইনি। আর বাবা ইনাকে দেখে এতো অবাকই বা কেন হলো!

বাবা দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুসময় থমকে তাকিয়ে রইল।
‘এতো বছর পর আপনি! আর আমার ঠিকানা, আর কেন আসলেন এখানে!’

লোকটি দরজার পাশ থেকে এগিয়ে বাবাকে সরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।

‘তোমার উপর আমার কোনোদিনও বিশ্বাস, ভরসা আসেনি কিন্তু আমার বোনটি আমাকেই অমান্য করে তোমাকে বিশ্বাস করে ভরসা করে পুরো পরিবারটাই ছেড়ে এসেছিল কিন্তু তুমি তার ভরসাটাও রাখলে না।’

‘আপনার বোনকে আমি অসুখী রাখিনি।’

লোকটি স্মিত হাসলো।
‘সুখেও তো রেখেছো বলে বলতে পারবে না।’

‘আপনার বোন বেঁচে থাকতে সুখেই ছিল।’

‘এতোই সুখে ছিল যে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যার পথই বেছে নিল!’

বাবা উত্তেজিত হয়ে রাগান্নিত কণ্ঠে উনার দিকে তেড়ে গেল,
‘এসব বলতে এসেছেন? আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বলছি। আজ একটা শুভদিন এমন অশুভ হোক আমি চাই না। কথা না বাড়িয়ে স্ব-সম্মানে চলে যান।’

‘কার সাথে মুখ উঁচিয়ে কথা বলছো তুমি?’

‘এটা আমার বাড়ি।’

‘তুমি বুঝতে পারছো তোমার এই উঁচু গলায় কথা বলার পরিনাম কতোটা ভয়ানক হবে?’

বাবা লোকটির কথায় সাথে সাথে নিবে গেল।

আমি বুঝতে পারলাম এটা হয়ত আমার মায়ের খুব কাছের। হয়ত আমার মামা। এই প্রথমবারের মতো দেখলাম উনাকে। ইসস, আজ মা বেঁচে থাকলে কতই না খুশি হতো!
আমার এতো সব ভাবনার মধ্যে লোকটি আমার দিকে এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কিছুসময় তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,
‘কেমন আছো মা? আমাকে চিনতে পেরেছো?আমি তোমার অকৃতজ্ঞ মামা। যে নিজের বোনটাকে এমন কু’লা’ঙ্গা’রের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো না।’

এতদিন পরে আমার মনে হলো কারো ভালোবাসার হাত আমার মাথার উপর পড়েছে।

‘কেন এসেছেন এখানে!’ বাবার কথায় মামা ফিরে তাকিয়ে চমৎকার ভাবে হেসে বললো,
‘আমার আদরের ছোট বোনের অস্তিত্বকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
‘আমার সাথে যাবে মা?’

মামার কথায় বাবা তেড়ে এসে রেগে বলে উঠল,
‘যাবে মানে কী? ও আমার মেয়ে। ও কোথাও যাবে না।’

মামা বাবার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
‘এখন তো মনে হচ্ছে মেয়েকে অনেক ভালোবাসো কিন্তু আধো কী তাই! নাহলে এতো ছোট মেয়েকে তোমার বয়সী একটা লোকের সাথে বিয়ে দিতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না?’

‘দেখুন, এটা আমাদের পারিবারিক বিষয়। আমার মেয়েকে আমি কী করবো সেটা আপনার ভাবার বিষয় না। আশা রাখি, আপনি কথা না বললেই ভালো হবে। আপনি চলে যান।’

‘আধো কী মেয়ে ভাবো? মেয়ের জন্য এতো দরদ উতলে পড়েছে যে আমার বোনটা মা’রা না যেতেই আরেকটা স্ত্রী ঘরে নিয়ে এসোছো?আর এতো ছোট বয়সেই মেয়েকে বোঝা মনে করে বিক্রি করে দিচ্ছ?’

বাবা সাথে সাথে তেড়ে আসলো,
‘বিক্রি মানে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’

‘টাকা নাওনি তুমি?’
মামার কথায় বাবা নিভু নিভু কণ্ঠে বলল,
‘এটা তো এমনি খুশি হয়ে দিয়েছেন উনারা।’

‘ওহ আচ্ছা, আজ পর্যন্ত তো শুনলাম না যে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার আগে ছেলেরা খুশি হয়ে টাকা দেয়।’ বলেই মামা লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল,’অবশ্য, এ তো ছেলের পর্যায়ে পরেই না, ইনি তো আমারই সমবয়সী। একটা আঙ্কেল বয়সী লোকের সাথে এত্তো ছোট একটা মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছ না কি বি’ক্রি করছো?’

মামা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘আমার সাথে যাবে?’

আমি বাবার দিকে তাকালাম। আমার সাথে চোখেচোখি হতেই বাবা দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। ভাবিনি বাবা এতটা খারাপ। শুধুমাত্র টাকার লোভে এমন একটা বয়স্ক লোকের সাথে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে!

মামা আমার দিকে তাকিয়ে আবারও সম্মতি জানার আগ্রহ করতেই আমি বাবার দিকে আরেকবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। এখানেই আমার মায়ের অস্তিত্ব। এটা আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে পারবো।

‘তুমি ভাবো মা। এখানে থাকলে হয়ত তোমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। তুমি জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে না। তোমার হাতেই সবকিছু এখন। তুমি যদি না চাও তাহলে আমি এখনই চলে যাবো। আর আসবো না। এই বাড়িতে পা রেখেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য।’

মামার কথা সব ঠিক। ঠিকই তো এই বাড়িতে থাকলে আমি কিছুই পাবো না। আমি বাবার দিকে তাকালাম। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ইনার দিকে তাকালে ইনাকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করবে না কিন্তু এখানে থাকলে আমি সুখে থাকবো না। আজকে না হলেও কালকে আরেকজনের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসে যেতে হবে। আজকে ভাগ্য ভালো ছিল তাই হয়ত বেঁচে গিয়েছি কিন্তু এমন ভাগ্য আর আসবে না। মায়ের পরিবারের কাছে অন্ততঃ মামার হলেও বাবার ভালোবাসার অভাবটা পূরণ হবে। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই মামা খুশি হয়ে গেল।

বললো,’রুমির কবরটা একটু দেখবো। তারপর বের হবো।’

আমি বললাম,’আমি কাপড় নিয়ে আসি?’

‘না, কোনো কাপড় লাগবে না মা। এই বাড়ির কিছুরই দরকার পড়বে না তোমার।’

আমি মামাকে পেছনে কবর দেখিয়ে চলে আসলাম। মামা একা কিছুক্ষন থাকুক ওখানে।

বাড়ি আসতেই ভয় লাগলো। কেন জানি এই মানুষগুলোর সাথে এখন এক সেকেন্ড থাকলেও ভয় হচ্ছে। কী জানি হয়ত এখন একটা ভালোবাসার হাত পেয়েছি বলেই।
বাবা বলে উঠল,’ তুমি কোথাও যেতে পারবে না।’

‘রেখে দেওয়ার অধিকার তোমার নেই। আজকের এটার জন্যও আমি চাইলে পুলিশ ডাকতে পারি কিন্তু কোনো লাভ হবে না। তুমি ঠিকই একই থেকে যাবে। তাই এসব বলে লাভ নেই। তুমি রেখে দিতে চাইলে ক্ষতি তোমারই হবে, একসাথে দুইদিক দিয়ে তোমাকে আমি জে’লে’র ভাত খাইয়ে ছাড়বো।’

মামার চোখে অশ্রু। হয়ত মায়ের কবর দেখে মায়ের কথা মনে পরে গেছে। মামা আমার হাত ধরে বেরিয়ে আসতে নিতে দরজার পাশে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,’ ভুলেও ওকে খোঁজার চেষ্টা করিও না। আজ থেকে মনে করবে তোমার কোনো মেয়েই ছিল না। রুমির অস্তিত্ব পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছো তুমি।’

বাবা হুট্ করে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। আমাকে ধরতে আসলেই মামা দ্রুত আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো। উঠোন পেরিয়ে গাড়িতে উঠিতেই দেখি বাবা একই ভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি ছেড়ে দিলে আমি জানালা দিয়ে শেষবারের মতো নিজের স্মৃতিটা দেখতে লাগলাম। দেখলাম ঠিক সেসময় বাবা দৌড়ে পেছন পেছন আসছে। আমি বাবার অপরাধবোধের চেহারাটা প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতেই উনার প্রতি মায়া অনুভব করলাম কিন্তু সাথে সাথে মাথায় আসলো ইনি আমার মায়ের খুনি। ইনি কোনোদিনও ভালো হবে না। আমাদের এলাকার রাস্তা শেষ হতেই হুট্ করে নিহান ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সবকিছু কী এখানেই শেষ! শুরু হওয়ার আগেই কী সব শেষ হয়ে যাবে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে