বে রঙিন পাতা পর্ব-১০

0
634

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০

নতুন মা আজ সুন্দর দামি শাড়ি পড়েছে। বাড়ির সবকিছুর চাবি একসাথে থাকে। ইনার শাড়ির আঁচলে সব চাবি একসাথে বাধা থাকে। এই চাবির মূলটা পেলেই হলো। এতে একসাথে আলমারির চাবিও থাকবে, আপার রুমের চাবিও আর ঘরের চাবিও। সুতরাং কোনোমতে এটা পেলেই সব পথ খুলে যাবে। এই শাড়িটা ওই লোকটা এনেছে তার শাশুড়ির জন্য না-কি! নতুন মায়েরও ভারী পছন্দ হয়েছে। শাড়িটা পড়ার পর থেকে উনি আর কোনো কাজ করছে না। আমাকেই বলছে এটা ওটা এগিয়ে দিতে। আমি শুধু বারবার উনার আঁচলে বাধা সেই চাবিটা দেখছি।

ছোট মা আমাকে শরবত বানাতে বললো। ওই লোকটির বাড়ি থেকে মেহমান এসেছে বোধহয়। আমিও সুযোগ বুঝে শরবত যা বানিয়েছি তা ঐদিকে পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভান করে উনার গায়ে পুরো জগটাই ঢেলে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। উনি রণ’চ’ন্ডি রূপ নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলো। আশেপাশে ওই লোকটির পরিবারের কয়েকজন মহিলা থাকায় উনি নিজেকে সামলালো।
লোকটি দুইটা শাড়ি এনেছে। তাই মা দ্রুত সেটা পাল্টাতে গেলে আমিও মায়ের পিছু পিছু গেলাম। গিয়ে মাথা নিচু করে অপরাধবোধের ভান করে চোখ মুখ কুঁচকে ছোট মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘আমি ইচ্ছে করে করিনি ছোট মা।’

মা শাড়িটা খুলেই আমার দিকে এগিয়ে ঠাস করে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল।

‘বিয়াদব মেয়ে। আমাকে সুন্দর লাগছে বলেই এমন করেছিস। একদম মিথ্যে বলবি না। আজ বাসায় মেহমান বলে বেঁচে গেছিস।’

মা শাড়িটা পাল্টিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারলো।
‘পুরো শাড়িটাই আবার শুকিয়ে আয়রন করে একই ভাবে নতুন করে যেন পায়।’

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সম্বোধন করতেই ছোট মা রেগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল।

মা আরেকটা শাড়ি পরে চলে গেল। আমি দ্রুত আমার কার্য সাধন করে ফেললাম। চাবিটা দ্রুত সরিয়ে ফেললাম। আমি জানি মা আবার আসবে চাবি খোঁজার জন্য তাই যা করতে হবে এর মধ্যে করতে হবে, চাবি লুকিয়ে ভান ধরবো আমি জানি না কিছু।

চাবিটা হাতে নিয়ে রুমের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে একবার দেখে নিলাম। বাড়িতে ওই লোকের বাড়ির মেহমান সহ সবাই গিজগিজ করছে। ছোট মা এদের তদারকি করতে ব্যস্ত। আমার মনে হল ছোট মায়ের এখন আর চাবির খেয়াল থাকবে না। কারণ এখন উনার লোকটাকে খুশি করতে হবে, লোকটা আর লোকটির পরিবারের মানুষ কিছু সময়ের মধ্যে ই খেতে বসবে, যা করতে হবে তা ওদের খাওয়ার সময়েই করতে হবে। কারণ তখন লোকটার পরিবারকেও যেমনই হোক খুশিতে রাখতে হবে তাই ছোট মা ভীষণ ব্যস্ত থাকবে এটা ওটা এগিয়ে দিতে আর এর ভেতর চাবির জন্য কোনো খেয়াল আসবে না। আমি দ্রুত চাবি একটা নিয়ে আলমারি খুলতেই আপার বাটন মোবাইলটা পেয়ে গেলাম। দ্রুত আপার মোবাইল খুলতেই রাসেল ভাইয়ের একের পর এক মেসেজ কল আসতে লাগলো। হয়ত তিনি ভীষণ চিন্তা করছে।

আমি কল রিসিভ করতেই ভাইয়ার উদিগ্ন কণ্ঠ কানে এসে বাজলো,
‘হ্যালো লতা, তুমি শুনতে পাচ্ছ? মোবাইল বন্ধ আর না তোমার সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় পাচ্ছি! কী হয়েছে তোমার! ফুলকেও দুইদিন ধরে দেখছি না। আর তোমার বাবা এসে বলেছে যোগাযোগ একেবারে বিয়ের পর, আর সাতদিন পর না কি আমাদের বিয়ে? এর মধ্যে আমাকে তোমাদের বাড়ি বা এলাকায় এসব রটাতে বারণ করেছে, এতে নাকি উনার মান সম্মান যাবে তাই একেবারে বিয়ের সময় সবাই জানবে। হ্যালো লতা, তুমি শুনতে পাচ্ছ?’

রাসেল ভাইয়ের সব কথা শুনে মনে মনে যা সন্দেহ করেছি তাই সঠিক হলো। তার মানে বাবা রাসেল ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে এসব বলে রাসেল ভাইকে থামিয়ে রেখেছে।
আমি ভাইয়াকে আর কথা বলতে সুযোগ না দিয়ে একনাগাড়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলে ফেললাম। এখন এতো কিছুর ভাবার টাইম নেই। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।

মোবাইলটা রেখে আলমারি বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত আপার রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। যা করতে হবে খুব সাবধানে করতে হবে।
বাড়ির পরিস্তিতি হেটে দেখলাম। এর মধ্যেই ছোট মা ওই লোকদের পরিবারকে খাওয়ানোর ব্যবস্থার তোড়জোড় চালাচ্ছে। তার মানে খেতে বসলে তখন ছোট মা তাদের খাওয়ার আশেপাশে থাকবে। আপ্পায়নে ব্যস্ত থাকবে। সেই সময়েরই অপেক্ষা করতে হবে আমার। এখন আপার রুমের দরজা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে।

উনারা খাওয়ার সময়ে আমিও ওখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। যখন ছোট মা এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে তখন আমি আস্তে করে সরে দাঁড়ালাম। এরপর সবার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে দ্রুত পায়ে আপার রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজা খুলেই আপাকে দ্রুত বোরকা পড়িয়ে দিলাম। আপা বেকুব বনে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি আপাকে তাড়া দিয়ে বললাম,
‘আপা যা বলছি মন দিয়ে শোন। এখন কোনো বাড়তি প্রশ্ন করবি না। আর কিছু সময় পড়েই তোরে বিয়ে দিয়ে দিবে। যত দেরি করবি ততো তোরই ক্ষতি। রাসেল ভাই পেছনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তুই দ্রুত চল।’

বলেই আপার হাত ধরে পেছনের দরজাটা দিয়ে আপাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। বাড়ির পেছনে এদিকটাই একদম অন্ধকার থাকে বিধায় কেউ আসে না। ঐতো পাশেই মায়ের কবর দেখা যাচ্ছে। আমি আপার হাত ধরে পেছনের মাঠটা পেরোতেই দেখলাম রাসেল ভাই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভেতর বোধহয় উনার মাও আছে। আপাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় আপার চোখ ছলছল করে উঠল। আপা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।
‘তুই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস রে ফুল।’
আমি আমার দুর্বলতা প্রকাশ করলাম না। এখন যদি আমিও কান্না করে দিই তাহলে আপার সুখে থাকা হবে না আর বাড়িতে যেকোনো সময়েই জেনে যেতে পারে যে আপা পালিয়ে গেছে আর সবাই বেরিয়ে খুঁজতে থাকবে।

রাসেল ভাই গাড়িতে উঠার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,
‘তুমি একদিন অনেক সুখী হবে ফুল।’

‘তাই যেন হয় ভাইয়া। আমার আপাকে কষ্ট দিবেন না। আপনার উপর পূর্ণ ভরসা আছে বিধায় আপাকে আপনার হাতে দিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে আর এই এলাকায় আসিয়েন না। অনেক দূরে গিয়ে সুখের সংসার করিয়েন।’

‘তোমার সাথে যেদিন আবার দেখা হবে সেদিন যেন তোমাকে অনেক সুখী পাই সেই দোয়াই করি বোন। খারাপ লাগছে তোমার জন্য।’

আমি কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে আপাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরলাম। ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু না ছেড়ে উপায় নেই। আপার সুখের জন্য এটা করতেই হতো আমাকে। আপা আমার হাতটা ছাড়তে চাইছিলো না কিন্তু যেকোনো সময় বাবারা চলে আসতে পারে। রাসেল ভাই পরম আদরে মাথায় হাত রেখে মন ভরে দোয়া করে দিল।

গাড়ি ছেড়ে দিল। যতদূর পর্যন্ত গাড়িটা দেখা গেল ততদূর পর্যন্ত ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এই বাড়িতে একমাত্র আপন ছিল আপা। সেই আপাকেও আজ থেকে আর পাবো না। কেউ আর আগলে নিবে না। কিভাবে থাকবো আমি! বুঝতে পারলাম বাকি দিনগুলো হয়ত খুব একটা সুখের হবে না আমার। ছোট মা এটার রেশ কী আধো ভুলবেন। উনি তো জেনে যাবেন যে আপার পালিয়ে যাওয়ার সাথে আমার হাত নিশ্চই আছে। আর বাবা! উনি কী আধো আমাকে আর বাঁচাবেন!

#চলবে ইন-শা-আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে