বে রঙিন পাতা পর্ব-০৮

0
623

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

বাবা মাথা তুলে একবার ওই মা নামক মহিলাটির দিকে তাকালো। মা কী জানি ইশারা করলো। তিনি চোখ দিয়েই বাবাকে আস্বস্ত করলো। আমার খারাপ লাগলো এই ভেবে যে বাবা এখন সামান্য মেয়ের সিদ্ধান্ত নিতেও ওই মহিলাটির উপর নির্ভর করছে অথচ আমাদের মা থাকতে কোনোদিন এমন প্রাধান্য দেয়নি মাকে।
বাবা শান্ত দৃষ্টিতে আপার দিকে তাকালো।

‘বিয়ে করে ফেলেছো?’

আপা ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ালো। পরিবেশ একদম নিস্তব্ধ যেন কেউ হাঁটলেও সেই হাঁটার মৃদু আওয়াজটা এখন সবার কানে বাজবে। মনে হচ্ছে যেন এটা ঝড় আসার পূর্বাবাস। আমিও ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকালাম। বুঁকের মধ্যে ড্রিম ড্রিম শব্দ হচ্ছে যে এই বুঝি বাবা আপাকে ঘর থেকে বের করে দিবে।

বাবা আবারও আপার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘তোমার কী মতামত! তুমি কী চাও এখন?’

আপা জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। রাসেল ভাই আপার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে ভরসা দিচ্ছে। আপা ভয়ে জবাব দিতে পারছে না তাই রাসেল ভাই বলে উঠল,
‘আঙ্কেল, লতা …’ বাবা রাসেল ভাইকে হাত দিয়ে থামিয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘আমি তোমার থেকে জিজ্ঞেস করিনি।’ বলতেই নতুন মা তাড়াহুড়ো করে বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে হেসে বাবার হাতে চি’ম’টি কা’ট’লো।

বাবা নতুন মায়ের দিকে তাকিয়ে তারপর আপার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই নতুন মা রাসেল ভাইয়ের উদ্দেশ্যে হেসে বলে উঠল,
‘আসলে, তোমার আঙ্কেল মেয়ে চলে যাওয়ায় একটু রেগে তো তাই এমনভাবে কথা বলে ফেলেছে। কিছু মনে করিও না। এখন তো তুমি আমার মেয়ের জামাই। না চাইলেও এই সত্যিটা মেনে নিতেই হবে।’

আমি অবাক হয়ে নতুন মায়ের দিকে তাকালাম। উনি কী আসলেই অতো ভালো! আজ আপাকে একদম নিজের মেয়ে বলে ফেলছে! আজকে উনাদের দুইজনকেই বুঝতে কষ্টকর লাগছে।

এইবার বাবা মুখ খুলল,
‘তুমি চাও, আমি যেন এই বিয়েটা মেনে নিই তাইতো?’

আপা মাথা নাড়তেই বাবা আমাদের অবাক করে দিয়ে আপাকে বললো,
‘ঠিক আছে, বিয়ে যখন করে ফেলেছো আমাদের তো আর কিছু করার নেই। শত হলেও তুমি আমার মেয়ে, না মানতে তো পারি না। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় তো নেই। আমাদেরও একটা অনুষ্ঠানের ব্যাপার স্যাপার আছে না? এভাবে কিভাবে মেয়েকে পাঠিয়ে দিই। তুমি কয়েকদিন এখানে থাকো, রাসেল বাবাকে ওদের বাসায় পাঠিয়ে দাও। তারপর আমার মেয়েকে অনুষ্ঠান করে ধুমধাম করে শশুরবাড়ি পাঠাবো।’

আমি অবাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালাম। আমার ঠিক হজম হচ্ছে না যে এই মানুষটা কিছু সময়ের ব্যাবধানে এতো ভালো কিভাবে হয়ে গেল!
এই মানুষটাই তো এই সন্ধ্যার আগে আপা চলে যাওয়াতে আমাকে এভাবে ওই মহিলাটার হাতে মা’র খাইয়েছে আর সেই মানুষটা এখন এতো ভালো! তার উপর ওই মহিলাটার কিভাবে এমন পরিবর্তন! তবুও সবকিছু বাদ দিয়ে ভালোই লাগলো যে আপাকে মেনে নিয়েছে। আপা তো খুশিই থাকবে সেই ভেবে নিজেরও খুশি লাগলো।

আপার মুখ-ভঙ্গিমা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে বিষয়টি হজম করতে পারেনি। বেশ কিছু সময় সে পলকহীন চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর হুট্ করে চিৎকার করে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বাবাও হাসিমুখে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিল।

আপা খুশি মনে বাবার কথায় রাজি হলো। রাসেল ভাইকে বলে আপা উনার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওরা কিছুসময় নিজের করে কাটিয়ে তারপর রাসেল ভাই ফিরে গিয়েছে। ফেরার সময় রাসেল ভাইয়ের চেহারাটা দেখার মতো ছিল। বাবা বলেছে, রাসেল ভাইকে একেবারে আরেকবার বিয়ের সময়ই বাসায় আসতে, জামাই আদর করবে।
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খুশিও হলাম বটে, যাক বাবার ভালোবাসা এখনো আছে। মেয়েকে তো মেনে নিয়েছে এর চেয়ে বড়ো আর কী আছে!

আপা রুমে এসেই শাড়ি খুলে আমাকে কাছে টেনে নিল।
‘আমাদের বাবা অতো খারাপ না। শুধু শুধু বাজে ব্যবহার করে আসছি। মা টাও ভীষণ ভালো রে। না রে ফুল?’

আপার কথা শুনে আমি মনে মনে হাসলাম। আপা তো আর মায়ের ডায়রি পড়েনি, আপা তো আর আজকে বিকালের ঘটনা জানে না। শুধুমাত্র নিজেকে মেনে নিয়েছে তাই আপা বাবাকে ভালো বলে দিল।
আমিও আপার কথার সাথে তাল মিলালাম হেসে। আপাকে আর আজকের বিকালে ঘটে যাওয়া কিছু বললাম না। হয়ত আপার অপরাধবোধ হবে।

———-
এরইমধ্যে একদিন কেটে গেল। আজ আপা আর মায়ের জোরাজোরিতে স্কুলে আসলাম। আজ ওই মা নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়েছে। আমার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে যে ইনিই সেই মহিলাটা! রাতারাতি একটা মানুষের মধ্যে এতো পরিবর্তন কিভাবে হয়! উনি খাইয়ে দেওয়ার সময় বলে উঠল,’ফুল, কালকের বিকালের ঘটনাটা তোর আপাকে বলিস না। কালকে আমারও মাথা ঠিক ছিল না, শত হলেও আমি তোদের ভালোবাসি। এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে না পেরে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তোর আপাকে বললে ও হয়ত কষ্ট পাবে, মন খারাপ করবে।’
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মায়ের এই কথাগুলোতে একটু আধটু সন্দেহ হচ্ছিল কিন্তু অতো পাত্তা দিলাম না। তবুও ভালো লাগলো এই ভেবে যে উনার মনে হয়ত মায়া এসেছে। এই-ই বা কম কীসে!

স্কুলে এসব ভাবতে ভাবতে দিনটি পেরিয়ে গেল। আসার সময় মোড়ের ওই গলিতে ঢুকতেই পেছন থেকে কেউ একজনের ডাকে পা থেমে গেল। এই ডাকটার জন্য কত রাত যে অপেক্ষায় ছিলাম!

‘রজনী!’

আমার নিহান ভাই। আমি ফিরে তাকালাম না। ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মানুষটাকে আমি ভুলতে চাই। যখনই ভুলতে চেষ্টা করি তখনই সে মানুষটাকে দেখে আবারও আগের অনুভূতি জেগে উঠে।
‘ঠিকমতো স্কুলে যাস না ক্যান তুই?’

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। নিহান ভাইকে নিয়ে আমার এতো স্বপ্ন অথচ উনি সামনে আসলেই সব কথা ফুরিয়ে যায়।

‘বলতে না চাইলে সমস্যা নেই কিন্তু একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবি আবেগকে প্রশ্রয় একদম দিবি না। এই সময়টা তোর পড়াশোনার সময়। জীবন কারোর জন্য থেমে রাখিস না। ঠিকমতো পড়ে উচ্চ পর্যায়ে যাবি দেখবি এমন কতজন আসবে আর যাবে।’

‘কিন্তু আমার যে কতজনকে চাই না, আমার শুধু আপনাকেই যে চাই!’ হুট্ করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। মনকে বাধা দিয়ে রাখতে পারলাম না। কথাটা বলতেই উপলব্ধি করলাম আমার বুক কাঁপছে। আমি পেছনে ফিরে তাকালাম।

নিহান ভাই হাসলো। বাঁকা হাসি, উনার এই হাসিটা দেখেই প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলাম। মানুষটা কী কোনোদিন আমাকে বুঝতে পারবে না না-কি বোঝার চেষ্টা করে না! উত্তরটা জানা নেই কিন্তু আমি জানি নিহান ভাইয়ের এই কথাগুলো সত্যি নই, আমি কোনোদিনও নিহান ভাইকে ভুলে থাকতে পারবো না।

‘আল্লাহ চাইলে তোর এই ইচ্ছেটা হয়ত পূর্ণ হবে কিন্তু…’

‘কিন্তু কী নিহান ভাই!’ আমার বুক কাঁপতে লাগলো। নিহান ভাইয়ের এই একটা কথায় যেন আমার সব খুশি উপচে পড়ছে।

‘তোর যে অনেক বড়ো হতে হবে। ভালোমতো পড়াশোনা করতে হবে।’

‘আমি রাজি।’

‘তবে তাই হোক। যদি তোর এটা আবেগ না হয় তাহলে দুইবছর পরে আমাদের দেখা হলে হয়ত তোর ইচ্ছে পূর্ণ হবে।’

আমি থমকে দাঁড়ালাম। এতক্ষন যে খুশি খুশি ভাব ছিল তা নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল। নিহান ভাই কী বলছে এসব!

‘ দুইবছর পর কেন! আমাদের তো সবসময়ই দেখা হবে।’

নিহান ভাই চমৎকার ভাবে হাসলো।
‘সেটা দেখা যাবে। যদি দুইবছর পরও তুই একই থাকিস তাহলে তোর মনের ইচ্ছেটা পূর্ণ হবে রজনী।’
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। নিহান ভাই কয়েক পা এগিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমার কপালে উপচে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
‘জানিস? তোকে আমি রজনী কেন বলি?’

‘কেন!’

‘কারণ রজনীগন্ধা আমার প্ৰিয় ফুল। এই ফুলের একটা স্নিগ্ধ ঘ্রান থাকে যেটা কাছ থেকে ঘ্রান না নিলে বুঝা যায় না। আর এই ফুলে কোনো দাগ থাকে না। সাদার মায়ায় ঘেরা।’

আমার শরীর কাঁপছে। আজকে একদিনে এতকিছু সহ্য করার ক্ষমতা পাচ্ছি না। সবকিছু এখনো স্বপ্নের মতো লাগছে।

কিছু বুঝে উঠার আগেই নিহান ভাই পাশে এসে দাঁড়ালো। আমি দূরে সরে গেলাম। এই গলিতে মানুষজন খুব কমই আসে। তবুও ভয় হচ্ছে।

নিহান ভাই মাথায় পরম আবেশে হাত বুলিয়ে দিল। আমি চোখ বন্ধ করে উনার স্পর্শ অনুভব করলাম।
‘ভালো থাকিস রে আমার রজনী।’

আমার মনটা মুহূর্তের মধ্যে নেচে উঠল। নিহান ভাই আমাকে তার সম্বোধন করেছে এই-ই বা কম কীসে!

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে