বে রঙিন পাতা পর্ব-০৭

0
636

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৭

আমি অবাক হয়ে নিহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি মায়ের হাতটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মা আরও রেগে গেল। নিহান ভাই মায়ের হাত ঝাড়া মেরে ফেলে দিল। এতে মা ধাক্কাটা খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে কিছুটা দূরে সরে গেল। মা দ্বিতীয় হাত দিয়ে আঙ্গুল তাক করে আমার উদ্দেশ্যে তেড়ে এসে বলে উঠল,

‘বোনের মতো নিজেও আরেকটা না’গ’র জুড়িয়েছিস তাই না? আমার বাড়িতে আমারই খেয়ে আমারই স’র্বনা’শ করছিস? মা তো ম’রে দুইটারে আমার ঘাড়ে দিয়ে গেছে।’

এরপর তিনি আবারও থা’প্প’ড় উঠাতে নিলে নিহান ভাই রেগে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল,
‘আপনি নিজের সীমা লঙ্গন করছেন। আমাকে বাধ্য করবেন না যাতে একটা মুরুব্বি মানুষকে অসম্মান করি!’

নতুন মা রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
ততক্ষনে বাবা উঠে তাড়াতাড়ি আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। নতুন মা আরও কিছু বলতে নিতেই বাবা থামিয়ে দিল,
‘রহিমা, বাড়ি যাও।’ বলেই বাবা নিহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বুঝানোর চেষ্টা করলো,
‘আসলে লতা কোথায় চলে গেছে তাই তার মা সহ্য করতে না পেরে ফুলকে এভাবে মে’রে’ছে। আমারও মাথা ঠিক নেই। তুমি কিছু মনে কইরো না বাপ্।’

নিহান ভাই বাবার দিকে তাকালো,
‘আমার কাছে এতো আন্তরিক না হয়ে আপনার মেয়ের সাথেই এভাবে কথা বলুন। সে তো আপনারই র’ক্ত।’ এরপর নতুন মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘বাইরের যে তে এসে আপনার মেয়েকে এভাবে মারছে আর আপনি কিছু না বলে তাকিয়ে আছেন! আপনাকে তো এতো পা’ষা’ন ভাবিনি আঙ্কেল!’

নিহান ভাইয়ের কথা শুনে নতুন মা এগিয়ে এসে বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘শুনছো কী বলছে এই ছেলে? আমি না-কি যে তে! বাইরের মানুষ? আর তুমি ওর কাছে ক্ষমা চাচ্ছ?’

নিহান ভাই হাসলো,
‘বাইরের মানুষ নয়তো কী! আসলেই কী মেয়ের নজরে দেখেছেন?’
নতুন মা বোধহয় চমকে গেলেন। তিনি আমার দিকে আরেকবার রাগী চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে আমার কপালে আরও শনি আছে। তিনি বোধহয় ভেবেছেন সামনের মানুষটাকে আমিই সব বলে দিয়েছি। তিনি নিহান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘এই ছেলে এই ছেলে কে তুমি? এখনই চলে যাও। নাহলে কিন্তু খারাপ হবে।’

বাবা তাড়াতাড়ি নতুন মাকে চুপ করতে বলে বলে উঠল, ‘ও চেয়ারম্যান সাহেবের পোলা।’

মা ওখানেই চুপ হয়ে গেল। আশেপাশে পাড়া প্রতিবেশি সবাই তাকিয়ে আছে। চারপাশে ছোটোখাটো ভীড় জমে গেছে। এতক্ষন তেমন একটা হেলদোল দেখা দিল না তাদের মাঝে কিন্তু নিহান ভাইকে দেখার পর সবার ফিসফিস বেড়ে গেছে। হয়ত এখন আমাদের পরিবারের খবর বাদ দিয়ে নিহান ভাইকে নিয়েই সব আলোচনা-সমালোচনা হবে।

———-
সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি জানালার গ্রীল ধরে পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আপা আর ফিরেনি। এতকিছুর মাঝেও আপার জন্য চিন্তা হচ্ছে। আপা ভালো আছে তো! কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সব চিন্তা বিলীন হয়ে গেল কারণ রাসেল ভাইয়ের উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে, এমনকি বাবার চেয়েও বেশি ভরসা আছে। উনি ঠিকই আপাকে আগলে রাখবেন। সেটা ভেবেই নিশ্চিন্ত হলাম।
ভেতর থেকে একটা চাপা মলিন শ্বাস বেরিয়ে এলো। আজকে এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটে যাবে তা গতকাল ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি।

বিকালের ঘটনাটা এখনো বারেবারে চোখের উপর ভাসছে। নিহান ভাই আমার প্রথম ভালো লাগার মানুষ। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে আমাদের দুইবোনকে পড়িয়ে আসছে। এমন না যে, উনাদের টাকা পয়সার অভাব। উনি বড়ো ঘরের ছেলে। চেয়ারম্যানের ছেলে। মা যখন আমাদের পড়াশোনা নিয়ে দিক-বেদিক হারিয়ে ফেলছিল ঠিক তখনই নিহান ভাই কেন জানি আমাদের আগ বাড়িয়েই বলেছিল পড়াবে। আম্মা আর বারণ করেনি। নিহান ভাই কোনো টাকাও নিতো না। তবুও মায়ের অনুরোধে কিছু টাকা রাখতো। আমার থেকে চার পাঁচ বছরের বড়ো হবে। আপার চেয়ে দুইবছরের মতো সিনিয়র হবে কিন্তু পড়ার ধরণটা ভীষণ ভালো। সম্পূর্ণ এলাকায় উনার অনেক নাম-ডাক কারণ উনি পড়াশোনাতে ভীষণ মেধাবী নাম-করা এক ছাত্র। তখন তিনি সবে মাত্র ইন্টার শেষ করেছে।

ওই মানুষটা পড়াতে আসলেই আমার ভীষণ ভালো লাগতো। উনার পড়ানোর ধরণ, না পারলে সুন্দরভাবে হেসে বুঝানো, বেশি দুষ্টমি করলে ধমক দিয়ে শাসন, মোটকথা উনার সবকিছুতেই আমার ভালো লাগা জন্মে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে আরেকটু বড়ো হতেই বুঝতে পারলাম মানুষটার প্রতি আমি ভীষণভাবে দুর্বল। যেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠা সম্ভব না। আমার সব বই জুড়ে উনারই আনা-গোনা। যেই বইটাই নিয়ে পড়তে বসি না কেন উনার চেহারা বইয়ের পাতায় ভেসে উঠে। আমার প্রতিটা বই-খাতাতেই উনার নামে কিছু না কিছু থাকবেই। কিন্তু একদিন এসবে ধরা খেয়ে নিয়েছি তাও একদম মানুষটার সামনেই। উনি একটা খাতাতে এসব খেয়াল করে আমার ব্যাগ টেনে প্রতিটা বই-খাতা চেক করে যখন একই কারবার দেখলো তখন উনার আর বুঝতে বাকি রইল না। উনি সেদিন আর পড়ায়নি। শুধু বই খাতা সব বন্ধ করে বুঝানোর চেষ্টা করে বলেছিল,
‘দেখো রজনী,তোমার বয়সটা আবেগের। এমন কিছু ভুল করিও না যাতে পরে পস্তাও।’

আমার আরও ভাইয়ের বিভিন্ন সম্বোধনে ডাকা দেখে ভালো লাগা কাজ করতো। আমার ভাবনা আসতো যে ভাই যদি আমাকে ভালোই না বাসে তাহলে অন্যদের মতো ফুল কেন ডাকে না! কেন অন্য অন্য নাম দিয়ে ডাকে! কেন ভাইয়ের পছন্দ ফুলের নাম ধরে ডাকে!
কিন্তু নিহান ভাইয়ের বুঝানোর পরও যখন আমার এসব কমলো না তখন সেই থেকে নিহান ভাই আর তেমন একটা ভালো করে কথা বলতো না।
বেশি আবেগ দেখিয়ে ফেলার পরে একদিন হুট্ করে জানতে পারি ভাই শহরে চলে গেছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ভাই কয়েকমাস না-কি এমনি পড়িয়েছে। ভাই চলে যাওয়ার পরও আমি জানতে পারিনি অথচ আমার মা আপা সবাই জানতো। একদিন দুইদিন পেরিয়ে গেলেও ভাই পড়াতে আসেনি দেখে আমি স্কুল পালিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে ভাইয়ের বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম কিন্তু ভাইয়ের দেখা পেতাম না। চেয়ারম্যান আঙ্কেলও কয়েকবার দেখেছে, আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে বলতে আমি উনাদের বাড়িও চলে যেতাম কিন্তু এক ফলকের জন্যও ভাইকে দেখতাম না । এরপর কয়েকদিন কেটে যেতে মাকে জিজ্ঞেস করতেই শুনি নিহান ভাই চলে গেছে পড়াশোনার জন্য। একবার আমি জানতেও পারলাম না। তারপর আজ তিনমাস পরে দেখা।

রাত গড়াতেই আরেকটা ঘটনা সামনে আসলো। রাসেল ভাই আর আপা ফিরে এসেছে কিন্তু এইবার ফিরেছে বন্ধন হয়ে। আপা বিয়ে করে ফিরেছে। আমি রুম থেকে বের হতেই আপাকে দরজার বাইরে রাসেল ভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বাবা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত দরজা খুলে আপাকে দেখে ঐভাবেই থমকে গেছে। আপা আর রাসেল ভাই মাথা নিচু করে আছে। আপার বধূ রূপ দেখে মনে মনে খুশিই হলাম, আপার পাশেই রাসেল ভাই সাদামাটা পাঞ্জাবী পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা মাথা নিচু করে রেখেছে কিন্তু রাসেল ভাই আপার হাত মুঠোবন্ধি করে নিয়ে ঠিকই পাশে থেকে ভরসা দিচ্ছে। আমি মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম কিন্তু বাবাকে সামনে দেখে ভয় হলো। আপাকে বের করে দিবে না তো! আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম বাবা নামক ওই মানুষটার দিকে। বুঝাই যাচ্ছে আপাও ভয় পাচ্ছে। বাবা কিছুসময় আপার দিকে তাকিয়ে রইল। পাশেই নতুন মা বেশ স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তিনি আগে থেকেই সব জানতেন!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে