#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫
সেদিন আর এতো কাহিনী করে আমাদের ভাত খাওয়া হলো না। আমি আপার সাথে রুমেই বসেছিলাম। হুট্ করে দেখি, আপার মোবাইলে মেসেজের টুং। আপা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে কিছুসময় নিয়ে কী জানি লিখলো। এরপর মোবাইল বেজে উঠতেই কল ধরে বলে উঠল,
‘জি বলুন।’
আপার কথার ধরণে বুঝেছি ঐপাশের মানুষটা আপার পরিচিত।
হঠাৎ আপার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
‘এই না না আমরা খেয়েছি।’
ওইপাশ থেকে বোধহয় আপার কথাটা বিশ্বাস না করে কিছুর জোর করতেই আপা আবারও দরজায় উঁকি মেরে বলে উঠল,
‘বাবা বাসায় আছে। আমরা খেয়েছি। আপনি শুধু শুধু করছেন এসব। ভুলেও বাসায় আসবেন না।’
বিপরীত পাশ থেকে কী বললো শুনিনি এরপর আপা মোবাইল কানে রেখেই উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ফুল চল, আমি আশেপাশে তাকিয়ে বাবা আসছে কিনা দেখবো আর তুই দৌড়ে গেটের পাশে রাসেল ভাই আছে, সেখানে যাবি।’
আমি এতক্ষনে যা বুঝার বুঝে ফেলেছি। তার মানে রাসেল ভাইই হচ্ছে আপার ভালোবাসার মানুষ। একদিকে ভালোই লাগলো যে আপারও খেয়াল রাখার একজন মানুষ আছে। নির্ধিদায় রাসেল ভাই অনেক ভালো মানুষ। আপার হয়ত আর দুঃখ থাকবে না।
আমি আপার সাথে সাথে এগিয়ে গেলাম। আপা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বাবার রুমে একবার উঁকি মেরে আমাকে ইশারা দিয়ে দৌড়ে যেতে বলল।
আমি দৌড়ে একদম উঠোন পেরিয়ে গেটের পাশে যেতেই রাসেল ভাইয়ের দেখা পেলাম। রাসেল ভাই আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলে উঠল,
‘বাবারে, তোমার আপাটাকে কত কষ্টে রাজি করিয়েছি তোমাকে এখানে পাঠাতে।’
এই বলে আমার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘এই নেও। গিয়ে খেয়ে নেও। কেউ দেখে ফেললে আবার তোমার আপা আমাকে নিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলবে।’
উনি আর কিছু না বলেই দ্রুতপায়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলেন আর আমাকেও তাড়া দিলেন যাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়।
আমি দ্রুত পায়ে উঠোন পেরিয়ে বাড়ি ঢুকে গেলাম। বড়ো বাঁচা বাচলাম। দুপুরের টাইম বিধায় সবাই ঘুমে, বাবাও বোধহয় ঘুমে আর রাস্তায়ও মানুষ ছিল না। গ্রামের দিকে সবাই দুপুরে বাসায় বসেই বিশ্রাম নেয়, সেজন্য তেমন একটা বেগ পোহাতে হলো না।
দরজার কাছে আপা চিন্তাগ্রস্থ চাহনিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। বোধহয় বাবা কোনসময় রুম থেকে বের হয়ে যেতে পারে সেজন্য চিন্তা করছিল। আমি যেতেই আপা দ্রুত আমার হাত টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিল।
আমি রাসেল ভাইয়ের দেওয়া প্যাকেটটা আপার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। তা দেখে আপা হাসলো,
‘তুই খুলে দেখ। তোর পছন্দের বিরিয়ানি।’
আমার আর তর সইলো না। আপা রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে দুইটা প্লেট নিয়ে এসে আবারও দরজা আটকে বসে পড়লো।
খেতে খেতে আপা রাসেল ভাইয়ের ব্যাপারে সব বলল। এই না যে আমি রাসেল ভাইয়ের ব্যাপারে জানি না। রাসেল ভাইয়ের ব্যাপারে সব জানি কিন্তু আপা আর রাসেল ভাই দুজন দুজনকে ভালোবাসে সেটা জানতাম না। একটু অভিমান হলো যে আপা এতদিন আমার থেকে লুকিয়ে গিয়েছে কথাটা কিন্তু পরবর্তীতে অভিমান ভেঙে গেল যে আপা সুখে থাকবে। রাসেল ভাইয়ের মতো মানুষ হয় না।
————
আজ অনেকদিন পর স্কুল গিয়েছি। স্কুল থেকে এসে ফ্যান ছেড়ে খাটে বসে পড়লাম। গরমে অবস্থা কাহিল। খাটে পা দুলিয়ে বসা অবস্থায় ঐভাবেই গা এলিয়ে দিলাম। দৃষ্টি ফ্যানের দিকে।
মাকে মনে পড়ছে ভীষণ। আজকের আগের বার স্কুল গিয়েছিলাম মা থাকাকালীন। এরপর আজই প্রথম। এখন আর স্কুল না গেলে কেউ ডাক দেয় না। এজন্যই তো এতদিনে মিলে এই প্রথম ক্লাসে গিয়েছি। লাস্ট যেদিন স্কুল গিয়েছিলাম সেদিনও মা ছিল। সেদিনও স্কুল থেকে এসেই এভাবেই শুয়ে পড়েছিলাম। মা এসে ঠান্ডা শরবত খেতে দিয়েছিলো, সেটা খেয়ে আবারও শুয়ে যেতে নিলে মা হাত ধরে টেনে গোসলে দিয়ে আসলো। আমি যেতে না চাইলে মা রাগী চোখে তাকিয়ে বলেছিল,
‘আগে গোসল তারপর সব।’
গোসল শেষে ঘরে আসতেই দেখি মা ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছিল, আমি খেতে না চাইলে মা টেনে-হিচড়ে বসিয়ে দিল। এরপর প্রথম লোকমা নিজেই খাইয়ে দিতে দিতে বলেছিল,
‘আমি না থাকলে তোরা এই অলসগুলোর কী যে হবে!’
সেদিন ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি যে সত্যিই তো মা না থাকলে আমাদের কী অবস্থা হবে! এখন বুঝতে পারছি সব।
আমি চোখ বন্ধ করে আবার খুললাম। চোখের দু’কোন বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন এইতো এখনই মা এসে রাগীচোখে টেনে তুলে বলবে,
‘কিরে এখনো গোসলে যাস নি? এক্ষুনি যা গোসল করে আয়। আমি ভাত বাড়ছি। আরেকবার যাতে আসতে না হয়।’
চোখ জ্বলছে ভীষণ করে। প্রায় এক ঘন্টা এভাবেই শুয়ে রইলাম কিন্তু মা তো আসবে না আর! এসব এখন অতীত! আমার মা শুধু কল্পনাতেই দেখা দিবে। ছুঁয়ে দেখতে পারবো না।
আমি আবারও চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চোখ বন্ধ করতেই সেদিনের মায়ের অশ্রুমাখা চেহারাটা আবারও চোখে ভেসে উঠল। মা! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ডায়রির কথা।
আমি দ্রুত উঠে বসলাম। আমাকে ডায়রি খুঁজতে হবে।
———-
সবাই ভাবলো, আমাদের বাবা বোধহয় মেয়েগুলোর চিন্তা করেই বিয়ে করেছিল কিন্তু এসবের ভিড়ে সত্যিটা ধামা চাপা পড়ে গেল।
বাবা শুধু অজুহাত দিয়েছিলো। আসল সত্যি আমি জেনেছিলাম মায়ের ডায়রি পড়ে।
মা-বাবার প্রেমের বিয়ে ছিল। দীর্ঘ কয়েকবছর প্রেমের সমাপ্তি হিসেবে বিয়ের প্রস্তাব দিলে কোনো পরিবারেই রাজি হচ্ছিলো না। তখন মা- বাবা সিদ্ধান্ত নিল তারা পালিয়ে বিয়ে করে পরিবারের সামনে আসবে। তখন উনারা ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্তু বিয়ে করে আসার পরও কারো পরিবারেই মানলো না। উল্টো তাদের তেজ্য করে বের করে দিল। দুই পরিবারেই মা-বাবা মুখের উপর দরজা আটকে দিয়েছিল।
এতে বাবা অনেক দূরে এসে মায়ের সাথে সংসার পাতে। সংসার কোনোমতেই চলে যেত কিন্তু কোনোদিন ভালোবাসার কমতি ছিল না।
মা-বাবার বিয়ের আগে বাবার এক দূরসম্পর্কের বোন বাবাকে পছন্দ করতো। বাবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সেই মহিলাটা বাবার সাথে যোগাযোগ করতো। বাবাও একজন আত্মীয়য়ের সাথে হলেও যোগাযোগ রাখতে পেরেছে ভেবে মহিলাটার সাথে কথা বলতো। পরিবারের খবর নিতো। এতে মা কোনোদিন সন্দেহ করেনি। হুট্ করে একদিন মা জানতে পারলো মহিলাটির স্বামী মারা গেছে। এতে বাবা সান্ত্বনা দিতে গিয়েছিল এরপর থেকে যাওয়া আসা শুরু কিন্তু মা কোনোদিন সন্দেহ করেনি।
বাবার বিয়ে করা ওই মহিলাটি হলো বাবার ওই দূরসম্পর্কের বিধবা বোন । অনেক আগেই উনার স্বামী অল্প বয়সে একটা দুর্ঘটনাতে মারা গিয়েছিল সেই থেকে ওই মহিলাটির সাথে বাবার ভাব। বাবা প্রায়সময় ওই বাসাতে যেত, আর যাওয়ার সময় অবশ্যই মাকেই বলে যেত যাতে মা বাইরের কারো থেকে কিছু শুনে সন্দেহ না করে।
বাবা যাওয়ার সময় এমনভাবে মাকে বলে যেত যে মায়ের অবিশ্বাস করার মতো কিছু ছিল না।
বাবা বাজার করলে একসাথে দুই ব্যাগ করে করে করতো। এক ব্যাগ আমাদের বাসায় রাখতো, আর অপর ব্যাগটা মাকে দেখিয়ে বলতো, ওই রহিমার বাসায় যাবে। ওর ছেলে কী খেলো না খেলো!
মাও বাবার কথায় সাঁই জানিয়ে আফসোসের সুরে বলতো,
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। কেউ দেখে কিনা কে জানে! কত অল্প বয়সে দুনিয়া চিনতে পারছে তার বাচ্চা ছেলেটা। তুমি ভালো মতো খাবার নিয়েছো তো!’
বাবা বোধহয় মায়ের এইসব দেখে মনে মনে হাসতো কিন্তু তিনি যে এমন খাঁটি একজন জীবনসঙ্গীকে ঠকাচ্ছে তা বোধহয় বুঝতে পারেনি।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।