#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২
আসরের পরপরই মায়ের দাফন-কাফন শেষ হয়ে গেল। সারাদিন আমি বাইরে বাইরেই ছিলাম। আজ কেউ আমাকে আর ডাকলো না। আজকে আমি নিজের মতো করেই ছিলাম। আস্তে আস্তে বাড়ি খালি হতে লাগলো। পাড়ার আশেপাশের কেউ কেউ আমাদের দুইবোনকে নিয়ে আফসোসের সুর তুলছিল। সবাই যাওয়ার সময় আমাদের দুইবোনকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল। কয়েকজন বাবাকে বিয়ে করার জন্য জোরও করতে লাগলো। ওরা বাবাকে আমাদের দিকে তাকিয়ে রাজি হতে বলে গিয়েছে। আমার মনে এটার কোনো প্রভাব পড়লো না কিন্তু বড়ো আপাকে দেখে বুঝলাম বড়ো আপা বাবার বিয়ে করার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে। সে উঠে রুমের ভেতর চলে গেল। এতেও প্রতিবেশীরা দমন হলো না, সবাই যাওয়ার আগে আরও একবার করে করে মনে করিয়ে দিয়ে গেল যে- আমাদের দিকে তাকিয়ে হলেও বাবা যেন বিয়ে করে নেয়। বাবা উত্তরে কোনো জবাব দিল না।
সারাদিন পর বাবা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে আমাকে ডাকলো। ভীষণ ক্ষুদা পেয়েছে বিধায় বিনা বাঁধায় খেয়ে নিলাম। মাকে মনে পড়ছে ভীষণ। কালকের এই দিনেও মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো আর আমি খেতে খেতে মাকে বিরক্ত করছিলাম। অথচ আজকে আর মাকে বিরক্ত করার জন্য পায়নি। আজ আর মাও তার মেয়েরা খেয়েছে কিনা অথবা মেয়ের পেছনে পেছনে খাবারের প্লেট নিয়ে দৌঁড়াতে হচ্ছে না। আজ থেকে আমার মা মুক্ত। সকালে উঠে কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও বেলা ফুটতে ফুটতে সব বুঝে গিয়েছিলাম। মাকে নিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে যেন কেউ আমার কলিজা টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আমার ঘুম আসে না। বাড়িতে সবাই আছে শুধু আমার মা নেই।
মায়ের খাটিয়া নিয়ে বাড়ির উঠোন পেরোলে আমি মায়ের পেছনে পেছনে চলে গিয়েছিলাম। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল,
‘তোমরা আমার মাকে নিয়ে যেও না। আমার মা আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে না।’
কিন্তু আমি বলতে পারিনি। মুখ দিয়ে আর কোনো আওয়াজ বের হয়নি। বড়ো আপা বেহুঁশ ছিল। সে দেখেওনি মাকে নিয়ে যাওয়ার সময়। মা চলে যাওয়ার সময় মাকে শেষবারের মতো একবার ছুঁয়ে দেখেছিলাম। ভাবতেই অবাক লাগছিলো যে আমার এই মা’কে আর কোনোদিন চাইলেও ছুঁয়ে দেখতে পারবো না। আমার মা আর কোনোদিন আমার নাম ধরে ডাকবে না।
সন্ধ্যা হতে হতে মায়ের অস্তিত্ব ভীষণ করে মনে পড়ছে। এইতো কালকে রাতেও মা এখানে বসে রান্না করছিল। আমি পড়া না পড়ে বারান্দায় দুষ্টমি করছিলাম বলে মা বড়ো করে ডাক দিয়ে বলে উঠেছিল,
‘ফুল,বাসায় ঢোকে বই নেয়। আমি আসলে কিন্তু খারাপ হবে।’
কিন্তু আজ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও কেউ এসে পড়ার জন্য ডাক দিল না। মায়ের গলা এখনো কানে ভাসে। আমি এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না যে মা কেন এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেল! কী হয়েছিল মায়ের! মাকে তো আমি রাতেই একদম সুস্থ দেখেছিলাম। আমার মায়ের কী হয়েছিল! সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দিলাম। পাশের রুম থেকে বাবা এসে বুকে জড়িয়ে নিল কিন্তু কেউ বুঝলো না যে আমার মাকে দরকার ভীষণ করে। মাকে জড়িয়ে ধরা দরকার। আমার মা একা একা শুয়ে আছে।
এরমধ্যে পাঁচদিন পেরিয়ে গেল। মা চলে যাওয়ার পরপর আমাদের পরিবার পুরোই অগোছালো হয়ে গিয়েছে। এখন আর আমাকে মায়ের মতো করে কেউ ডেকে ডেকে খাওয়াই না। আমি নিজে থেকেই নিজের কাজগুলো করা শিখে গিয়েছি। আগে দিন-দুপুরে বাইরে থাকলে মা বকা দিয়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে ফেলতো কিন্তু এখন আর সেইভাবে কেউ ঢুকাই না। মা থাকাকালীন সময়ে আমি তো এখনের মতোই দিন চেয়েছিলাম। যেন সারাদিন বাইরে বাইরে দৌঁড়াতে পারি, মা যেন কিছুই না বলে। এখন সেই দিন পেয়েছি কিন্তু সেই মন-মানসিকতা আর নেই। আমি তো মা-হীন জীবন চাইনি। কেন এমন হলো! মায়ের কথা ভাবতেই আবারও কান্না এসে গেল। বাড়ির পেছনে এই বাগানে দিন-দুপুরে আসলে মা কী বকাই না দিতো! অথচ আজকে ঠিক দুপুরেই বসে আছি কিন্তু মা বকা দিতে আসলো না। মায়ের কবরও দেওয়া হয়েছে এদিকটাই। সবাই বলে, আমার মায়ের মৃত্যু না-কি স্বাভাবিক ছিল না, মা না-কি বি’ষ’পান করেছিল তাই কবর আমাদের পেছনেই দেওয়া হয়েছে। এইতো এখানেই আমার মা শুয়ে আছে।
একমাস আগেও কত সুখী ছিলাম আমি! আম্মা ছিল। কী সুন্দরভাবে দিন যেত। একমাস আগের কথা ভাবতে গিয়ে আম্মার সাথে সাথে আরেকজনের কথা মনে পড়ে গেল। পরিবারের বাইরে নিহান ভাই-ই ছিল আমার সবচেয়ে প্ৰিয় ব্যক্তি। ভালো লাগার একজন মানুষ। আমার জীবন থেকেই কেন সব প্ৰিয় মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমার আম্মা! চাইলেও মাকে আর কোনোদিন দেখতে পারবো না, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারবো না। মাটি আঁকড়ে ধরে মায়ের জন্য কান্না করছি কিন্তু মা আসলো না। সবাই আছে, সবকিছু আগের মতোই আছে শুধু আম্মা নেই। আমাদের চারজনের সুখী পরিবারে এখন তিনজন। মায়ের অনুপস্থিতি বড্ড পোড়ায়।বাবা প্রায়সময় বাইরে থাকে। বড়ো আপা এখন পুরোপুরি রান্না করতে শিখে গিয়েছে। প্রথম প্রথম লবন-মরিচ কম হলেও পাশের এক চাচি এসে সব শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
এরইমধ্যে সবাই এসে এসে আমাদের দেখে যেত। বড়ো আপাকে এটা-ওটা শিখিয়ে দিতো। কোন কাজ কীভাবে করতে হয়, কোনটার পর কোনটা করতে হয়। আমার বড়ো আপাও যেন হুট্ করে দুইদিনে সংসারটা হাতে নিয়ে ফেলেছিল, দুইদিনের মধ্যেই ওর মধ্যে সংসারী সংসারী ভাব এসে গিয়েছিলো।
পাড়ার দাদি-চাচিরা আপাকে এটা-ওটা শিখিয়ে দিতে দিতে বাবার সাথে ওই আলোচনাটা করতে ভুলতো না। বাড়িতে যেই আসুক না কেন বাবাকে বিয়ে করতে বলবেই। সবাই বলতো, অন্তত মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে একটা বিয়ে করে নেয়। বাবা তখন আমাদের দুইজনের দিকে নীরব চোখে তাকাতো। সেখান থেকে আপা চুপচাপ উঠে চলে যেত। যতবারই বাবার বিয়ের কথা উঠতো ততবারই আপার মুখ মলিন হয়ে যেত। আপার মন খারাপের কারণটা বুঝে উঠতে পারতাম না।
মা চলে যাওয়ার আজ ছয়দিন। আজকে সকাল থেকেই বাবা বাড়ি নেই। আপাকে দুপুরে ফোন করে জানিয়েছে বাবা খাবে না আর আমাদের খেয়ে নিতে। বিকেল পেরিয়ে গেলেও বাবার আসার নাম নেই। এরমধ্যে পাশের দাদি দুইবার উঁকি দিয়ে আমাদেরকে দেখে গিয়েছে।
আমরা দুইবোন বারান্দায় বসে বসে বাবার অপেক্ষায় ছিলাম। হুট্ করে আপার দিকে তাকিয়ে সাহস আনলাম। আপাকে মা থাকাকালীন ভয় লাগতো না, তখন আপার কোনো কাজ করতে হতো না, প্রায়সময় আমরা একসাথে বসেই দুষ্টমি করতাম। কিন্তু এখন ভয় লাগে, এখন আপাকে মায়ের মতোই সংসারী মনে হয়, আপার সবকিছু এখন মায়ের মতোই হয়ে গিয়েছে। ধমক দেওয়া, খেতে বসানো,পড়তে বসানো। আমার আপা কয়েকদিনের মধ্যেই যেন বড়ো হয়ে গেল। আপার দিকে আবারও তাকালাম। আপা মলিন দৃষ্টিতে আমাদের উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বারবার তাকানো দেখে আপা উঠোনের দিকেই চম স্থির রেখে বলে উঠল,
‘কী, কিছু বলবি?’
আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। আপা আমাকে ভয় পেতে দেখে কাছে টেনে নিল। আপার হাসি হাসি মুখ দেখে সাহস এনে বললাম,
‘আপা,বাবাকে আবার বিয়ে করতে বললে তুমি মন খারাপ করো কেন! কালকেও দেখলাম, ওই চাচি কথাটা বলতেই তুমি মলিন হয়ে গেলে!’
‘তুই বুঝবি না। তুই এখনো অনেক ছোট ফুল।’ এই বলে আপার মুখটা আবার মুহূর্তের মধ্যে হাসি হাসি করে বললো,
‘আমার বিশ্বাস সবাই যাই বলুক না কেন আমার বাবা আর বিয়ে করবে না। এখন তো সংসারের সব কাজ আমি সামলে নিচ্ছি তাই বাবা বিয়ে করবে না। আমি জানি, বাবা আমাদের দুইজনকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে। আর বাবা মাকেও ভীষণ ভালোবাসে। বাবা কোনোদিনও বিয়ে করবে না।’
আমি কিছু না বলে আপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আফার হাসি হাসি মুখটা দেখে আমারও ভীষণ ভালো লাগলো। আমার এতো ইচ্ছে অনিচ্ছে না থাকলেও আপার কথাতে আমিও খুশি হলাম।
সন্ধ্যা নাগাদ বাবা ফিরলো। তবে উনি একা নই। বাবার সাথে আরেকটা মহিলা ছিল, আরেকটা বছর সাতেক এর ছেলে।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।