বে রঙিন পাতা পর্ব-০১

0
837

#বে_রঙিন_পাতা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১

মা মারা যাওয়ার কয়েকদিনের মাথায় বাবা যখন বিয়ে করে ফিরলো তখন আমি সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি আর আমার বড়ো আফা নবম শ্রেণীতে।
মা মারা যাওয়ার পর পরই আমাদের সুন্দর পরিবারটা অগোছালো হয়ে পড়েছিল। মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। মোটামুটি স্বচ্ছলই বলা যায়। মা কোনোদিন আমাদের দুইবোনকে কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। খুব সুন্দর ভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিন।

যেদিন মা মারা যাবে সেদিন বাবা বাড়ি ছিল না। বাবা কয়েকদিন আগে থেকে বাড়ির বাইরে ছিল। মা বলেছিল, বাবা উনার কাজের জন্য জেলার বাইরে গিয়েছেন। বড়ো আফা মায়ের কথা মেনে নিয়ে চুপ হয়ে যেত কিন্তু আমি হতাম না কারণ আমি বাবা ভক্ত ছিলাম আর দিনে যেমনই হোক না কেন রাতে বাবাকে দেখা লাগবেই। বাবাকে দেখা ছাড়া আমার ঘুম আসতো না। বাবাও বড়ো আফার চেয়ে আমাকেই বেশি ভালোবাসতো তাই আমিও বাবাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। রাতে আমার তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস ছিল কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে আমি ঘুমাতে পারতাম না কারণ রাতে বাবাই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। বাবা যাওয়ার দুইদিন পর্যন্ত আমাকে মা সান্ত্বনা দিয়ে রাখতে পারলেও এরপর আর পারেনি। আমার ভাবনা ছিল,বাবা কাজে বাইরে থাকলেও মোবাইলে তো আমার সাথে কথা বলতে পারতো!
বড়ো আফা এতকিছুর বায়না ধরতো না। সে সেদিন রাতে খাবার খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু আমি ঘুমাইনি। মায়ের কাছে বায়না ধরেছিলাম যে বাবাকে যাতে ফোন করে কথা বলিয়ে দেয়। মা সেদিন চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

‘কাল, তোর বাবা আসবে!’

মায়ের কথা শুনে আমি মুখ ফুলালাম। মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে অভিমানের সুরে বললাম,
‘তুমি তো বাবা যাওয়ার পর থেকে আমি যতবার জিজ্ঞেস করি ততবারই বলো যে এরপরেরদিন বাবা চলে আসবে কিন্তু একদিনও আসেনি। এভাবে করে করে আজ অনেকদিন কেটে গেল।’

মা মুচকি হেসে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল,
‘কাল ফিরবেই। কাল যে তোর বাবাকে ফিরতেই হবে।’

আমি বিশ্বাস করলাম না। মা একথা প্রতিদিনই বলে। মা আমাকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে আরও কী কী জানি বলেছিল কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলো আর আমিও চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রেখেছি। বাবার উপর অনেক রাগ জমেছে। আমার এতবছর জীবনে বাবাকে কোনোদিন আমাদের ফেলে বাইরে থাকতে দেখিনি। যতই দূরে কাজ পড়ুক না কেন বাবা কাজ সেড়ে গভীর রাতে হলেও ফিরে আসতো। আর সেদিন যাওয়ার সময় আমাদের দুইবোনকে জড়িয়ে ধরে বলে যেত কিন্তু এইবার বাবা এসবের কিছুই করেনি। আমরা দুইবোনকে বলেও যায়নি যে বাবা এতদিন বাইরে থাকবে! বাবার কথা ভাবতে গিয়ে অভিমানে চোখ ভরে উঠলো। যদি বাবা ফিরে বাবার কাছে যাবো না আর। মা হয়ত বুঝতে পারলো যে আমি কাঁদছি। তাই আমাকে মাঝখানে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পাশেই বড়ো আফা বেঘোরে ঘুমিয়েছিল। মায়ের আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দেয়াতে আমার ঘুম ঘুম ভাব। কিছুসময় পর মা উঠে গেল। তিনি একবার আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তিনি আমার কাছে এসে কপালে একটা চুমু খেলেন, একইভাবে বড়ো আফার কপালেও চুমু দিলেন। এরপর শব্দহীন পায়ে খাট থেকে নেমে রুমের লাইট বন্ধ করে দিল। টেবিলের কাছে এসে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালো। চেয়ার টেনে কী জানি লিখতে বসেছে। মা বোধহয় ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি কিন্তু আমি তখনো ঘুমাইনি। এই প্রথমবারের মতো মাকে কিছু একটা লিখতে দেখেছি কিন্তু আমি আর চোখ খুলিনি। আমার ছোট মনে ভাবনা এসেছে,যদি চোখ খুলি তাহলে মা হয়ত আমাকেও একসাথে পড়তে বসিয়ে দিবে কারণ আমি ছিলাম ভীষণ ফাঁকিবাজ। তাই মায়ের এই একা একা লিখতে বসা দেখে আমার মাথায় প্রথমেই এসেছিলো পড়ার ভাবনাটা।
আমার চোখ খুলে ভীষণ করে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল যে মা কী লিখছে! মাও কী আমাদের মতো পড়ালেখা করে! মাকে কেউ পড়তে বসতে বলেনি কিন্তু মা তবুও বসেছে। আচ্ছা, মা যদি পড়ালেখা করে তাহলে দিনে স্কুলে যায় না কেন! হয়ত বড়ো হয়ে গিয়েছে তাই। আমিও বড়ো হবো এমন। তখন আর দিনে স্কুলে যেতে হবে না।
সেদিন রাতে মাকে লিখতে দেখে এসবই ভেবেছিলাম। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চোখ খুলে আর মায়ের লেখা দেখা হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

ঘুম ভেঙেছিল বড়ো আফার চিৎকার শুনে। কাঁচা ঘুম ভাঙার কারণে আফাকে একটা ডাকও দিতে নিয়েছিলাম কিন্তু আফা সেদিকে কর্ণপাত করলো না। তাই আফার দিকে তাকিয়েই মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠেছিলাম,
‘মা দেখো, বড়ো আফা আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছে।’
কিন্তু রুমের কোথাও মায়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারিনি। আমার আশেপাশে পাড়ার কয়েকজন মহিলাকে দেখলাম। বড়ো আফাকে এতক্ষন এক চাচি বুকে জড়িয়ে রেখেছিল কিন্তু বড়ো আফা চাচির হাত ঝাড়া মেরে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেল।

আমি খাট থেকে নেমে গেলাম। আমার পাশে ওই পাড়ার সুন্দরী চাচিটা বসে আছে। উনাকে মকরুল চাচা বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না। আমরা কয়েকজন মিলে একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম। কী যে সুন্দর তিনি! মাকে এসে গল্পও করেছিলাম। আজ উনাকে মকরুল চাচা কিভাবে বের হতে দিল! অবাক লাগছে সবাইকে দেখে। এক দাদি আমাকে কাছে টেনে নিতে চেয়ে ক্ষনে ক্ষনে মুখ চেপে কান্নার সুর তুলছে। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে হুট্ করে আমাদের বাসায় এতো মানুষ কেন। তখন সবেমাত্র ফজর হয়েছে। অন্ধকার কাটিয়ে উঠে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছিল কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি সবাই আমাদের বাসায় কেন সেটা তখনো মাথায় আসেনি।

আর বড়ো আফা ঐদিকে কোথায় গেল! আর মা’ই বা কই! রাতে তো এই খাটেই বড়ো আফা আমার সাথে ঘুমিয়েছিল আর মা এইতো এই টেবিলে বসে পড়ালেখা করছিল। কিন্তু এখন এই রুমে পাড়ার চাচি-দাদীরা কেন! আমি খাট থেকে নেমেই আশেপাশে তাকিয়ে সামনের দিকে এগোলাম। আমাদের বাড়িটা বেশি বড়ো না। রুম থেকে বের হলেই সামনের বারান্দা। বড়ো আফার চিৎকার বারান্দা থেকেই আসছে, আরও কিছু আওয়াজ আসছে।
আমি বারান্দাতে পা রাখতেই দেখলাম, মাকে সবাই শুয়ে রেখেছে। সদ্য ঘুম ভাঙা আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
আশ্চর্য! মাকে সবাই এভাবে শুয়ে রেখেছে কেন! মনে মনে ভাবলাম,মা রাতে ঘুমাতে দেরি করেছে তাই হয়ত এখনো ঘুম থেকে উঠেনি আর এরা সবাই মাকে এভাবে খাট থেকে নিচে নামিয়ে কেন রেখেছে!

আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। মাকে সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছে। পাশে বড়ো আফাকে আওয়াজ করতে দেখে তাকে ধমকে উঠলাম,
‘এমন করছো কেন আফা? তুমি জানো না? মা ঘুমালে আওয়াজ সহ্য করতে পারে না!’

তারপর প্রতিবেশী এক দাদিকে বললাম,
‘দাদি, আমার মা নিচে শুতে পারে না। মা নিচে শুলে শরীরে ব্যথা করে। আজকেও ঘুম থেকে উঠে বলবে মায়ের শরীর ব্যথা করছে। তোমরা আমার মাকে রুমের খাটে রেখে আসো।’

কেউ আমার কথা শুনলো না। যেই দাদিটাকে কথাগুলো বললাম, তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে আমাকে কাছে টেনে নিলেন। আশেপাশে চোখ ঘুরাতেই দেখলাম, বাবা দরজার কিনারায় মাথা নিচু করে বসে আছে। বাবাকে দেখেই আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। মা তো তাহলে মিথ্যে বলেনি এইবার। আজকে ঠিকই বাবা এসেছে। মা জেগে থাকলে নিশ্চিত এখন মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতাম কিন্তু মা তো ঘুমে। এখন যদি জড়িয়ে ধরে ঘুম ভাঙিয়ে দিই তাহলে মা বকা দিবে। তাই ইচ্ছেটাকে দমন করে বাবার কাছে দৌরে গেলাম। বাবাকে গিয়ে ডাকতেই বাবা মাথা তুলে আমাকে একবার দেখে জড়িয়ে ধরলো। রাতে বাবার উপর করা শপথগুলো আমার আর মনে রইল না, বাবাকে কাছে পেয়ে সব রাগ ঝরে পড়লো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
‘এতদিন কই ছিলে! জানো বাবা? মা প্রতিদিন মিথ্যে বলতো যে তুমি আজকে আসবে কিন্তু দিন শেষ হয়ে গেলেও তুমি আসতে না। এভাবে করে করে প্রতিদিন রাতে বলতো যে তুমি এরপরেরদিন আসবে কিন্তু তুমি আসতে না। কালকে রাতেও মা বলেছিল কিন্তু আমি ভেবেছিলাম মা বোধহয় প্রতিদিনের ন্যায় মিথ্যে বলছে কিন্তু না কালকে তাহলে মা সত্যি বলেছিল। বাবা, তুমি জানো না? তোমাকে ছাড়া আমার রাতে ঘুম হয় না? তুমি আমাকে ফেলে কোথাও গিয়েছো!’

বাবা কোনো উত্তর দিলো না। ক্ষনে ক্ষনে বাবার ডুকরে উঠার শব্দ ভেসে আসছে। আমার অতকিছু মাথায় এলো না। বাবাকে কাছে পেয়ে মায়ের কথাটা ভুলেই বসেছিলাম। আমি জানি বাবা আমার কথা শুনবে, বাবা মাকে অনেক ভালোবাসে তাই তিনি মায়ের কষ্ট সহ্য করবে না। তাই বাবার উদ্দেশ্যে বললাম,

‘বাবা,মা তো খাট ছাড়া শুতে পারে না। কেউ আমার কথা শুনছে না। মা ঘুম থেকে উঠে কষ্ট পাবে, শরীর ব্যথা করবে। বাবা, তুমি বললে সবাই শুনবে। তুমি বলো না, মাকে নিচে থেকে তুলে নিতে!’

কিন্তু বাবাও আমার কথা শুনলো না। কেউ আমার মায়ের কষ্ট বুঝছে না। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। কী সুন্দর লাগছে আমার মাকে! একদম স্নিগ্ধ। এমন না যে আমি এই বয়সে কেউ মারা গেলে বুঝি না কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে আমার মা আর নেই। আমার মা আর আমাকে আদর করে কাছে টেনে নিবে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে