#বেলা_শেষে। [৩২]
তালুকদার বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় আরাভ ভূমি। বসার ঘরের মিমিকে দেখে বড়োসড়ো শক খায় দুজনেই। কাল মিমিকে দেখে ভেবেছিল, দিগন্তের ভালোবাসায় নিজেকে বদলে ফেলেছে সে। হ্যাঁ মিমির জিবন বদলে গেছে তবে সেটা মিমি বদলায় নি। বদলিয়েছে দিগন্ত। দুজনেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মিমির দিকে। মিমিকে দেখে খুব খারাপ লাগছে ওদের। সাদা থান পরে খোলা চুলে ছেলেকে খাওয়াচ্ছিল মিমি। মিমির ছেলেটা অনেক বড় হয়েগেছে।ওদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে অদিতি বলে উঠল,
-কিগো তোমরা এভাবে দাড়িয়া রইলা কেন?? ভিতরে আহো। আরাভ আর ভূমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায় তারপর ধীরপায়ে ভিতরে যায় তারা। অদিতি ভিতরে ডুকতেই মিমিকে বলে,
-নতুন ভাবি দেখো কারে লইয়া আইছি। অদিতির গলার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায় মিমি। আরাভ আর ভুমিকে দেখে চমকে উঠে সে। সে হয়তো ওদের এখানে আশা করেনি। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-ভূমি তুমি এখানে? কখন এলে?? মিমির কথার কোন জবাব দিলো না ভূমি। সে নির্বিকায় তাকিয়ে আছে মিমির পরনে এই সাদা থানের দিকে। অদিতি মিমির ছেলের পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
-আমাগো এইখান দিয়াই যাইতে ছিলো তাই ধরইরা নিয়া আসলাম। কিগো নতুন ভাবি কাজটা ঠিক করি নাই। বড় চাচাও তো অসুখ তারেও একটু দেইখা যাইতে পারবো। বলা তো যায়না কবে আবার মইরা যায়।
-অদিতি। একটু শক্তগলায় বলল মিমি। কি বলছো তুমি এসব। বাড়িতে অতিথি নিয়ে আসছো আর তাদের সামনে এসব কথা বলছো। তোমার সেন্স কোন দিনও হবে না। অদিতিকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে ভূমির দিকে তাকায় মিমি। অধরে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-আরে ভূমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো। বসো না, বসো এখানে।
-মিমি আপু, তোমার গায়ে থান কেন?? অশ্রুসিক্ত নয়নে মিমির দিকে তাকিয়ে বলল ভূমি। ভূমির কথা শুনে হাসলো মিমি। তাছিল্যের হাসি হাসলো। অতঃপর সে তার থানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-দিগন্তের দেওয়া শেষ উপহার এটা। এখন এটাই আমার বস্র।তোমরা বসো এখানে। আমি তোমাদের জন্যে চা করে আনছি। হন হন করে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় মিমি। ভূমিও ওকে আটকায় না। যাক না যদি সে সেখানে গিয়ে চোখের জল আড়াল করতে পারে তাহলে ক্ষতি কি?
এদিকে মিমি ওদের জন্যে চা করতে যায় তখন ভূমি অদিতিকে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানের ঘরে। সেখানে গিয়ে চেয়ারম্যান ওর তার স্ত্রীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে আবার বসার ঘরে চলে আসে সে। ততক্ষণে মিমিরও চা বানানো শেষ। মিমি, আরাভ ও ভূমির হাতে চায়ের কাপ দেয়। ভূমি চায়ের কাপ রেখে মিমিকে জোড় করে ওদের পাশে বসায়। মিমি ওদের পাশে বসে মাথা নিচু করে রাখে। তখন ভূমি বলে উঠে,
-মিমি আপু কি হয়েছে দিগন্তের? কোথায় সে?? তুমি সাদা থান কেন পরে আছো?? আর চেয়ারম্যান কাকা তো তোমাদের মেনে নেয়নি তাহলে তোমরা গ্রামে আসলে কি করে?? ভূমির করা প্রতিটা প্রশ্ন মিমির মনে ঝড় বয়ে দিচ্ছিলো। সেই ঝড়ে ধুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিলো মিমিকে। তবুও নিজেকে সামলে নিলো সে। এখন আর কোন ঝড় মিমিকে ভাঙতে পারে না। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সমলে নিতে শিখে গেছে সে। দু-চোখ বন্ধকরে বড় করে শ্বাস নিলো সে তারপর মিমি ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে অদিতিকে বলে,
-অনন্তকে নিয়ে ঘরে যাও অদিতি। মিমির কথার দ্বিরোক্তি করে না অদিতি। সে মিমির ছেলে অনন্তকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। অদিতির চলে যাওয়ার পর ভূমি মিমির হাত দুটি শক্তকরে ধরে বলে,
-চেয়ারম্যান চাচা তোমাদের মেনে নিয়েছে??
-হ্যাঁ তিনি আমাদের মেনে নিয়েছেন। বিয়ের এক বছর পর্যন্ত তিনি আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ করেন নি। আমরা যোগাযোগ করতে চাইলে সে আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্ত একবছর পর যখন আমাদের কোল আলো করে অনন্ত আসে তখন বাবা আর রাগ করে থাকতে পারেন না। আমাকে মেনে নেন তিনি। বাবা কি বলে জানো, যখন কোন গাছে পোকা ধরে তখন মানুষ সেই পোকাটাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে, গাছকে নয়। আমরা ভুল করেছি তাই তিনি আমাদের দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের এক্কেবারে দূরে ঠেলে দিন নি। তারপর থেকেই আমাদের গ্রামে আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। দিগন্ত আণবিক সংস্থায় চাকরি করতো আর আমি আমাদের ছো্ট্ট সংসারটাকে সামলে রাখতাম। অনন্তকে নিয়েই দিন কেটে যেত আমার।বাবা মা মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন। অনন্তকে দেখে আবার চলে যেতেন। একদম সুখী পরিবারে পরিনিত ছিলাম আমরা। কিন্তু আমাদের পরিবারেই এই সুখ বেশী দিন টিকলো না। কথাগুলো বলেই চোখ থেকে দু-ফোটা জল ফেলল মিমি।
-কি হয়েছিল দিগন্তের। প্রশ্ন করলো আরাভ।
-ভূমির উপর যখন দ্বিতীয়বার এ্যটাক হয় মনে আছে সেই দিন কলেজ থেকে কিছুটা দূরে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আসলে সেটা এক্সিডেন্ট কোন এক্সিডেন্ট ছিলো না। জেনে বুঝে এক্সিডেন্টটা করানো হয়েছিল। আর এটা করেছিল মাহিন। আসলে সেদিন যে মাহিন সদলবল নিয়ে ভূমির উপর এট্যাক করবে সেটা জেনে গিয়েছিল দিগন্ত। আসলে সেদিন ছিলো দিগন্তের অফ ডে। তাই আমরা আমাদের ছেলেটাকে নিয়ে একটু বাহিরে গিয়েছিলাম। সারাদিন রুমে বসে থাকতে থাকতে আমরা মা আর ছেলে দুজনেই বোরিং হয়ে গিয়েছিলাম। তাই দিগন্ত সেদিন আমাদের নিয়ে আমাদের একটু বেড়াতে গিয়েছিলো। তখন পথিমধ্যে শাওন আমাদের মাহিনের এই ব্যপারটা বলে, শাওনের কাছ থেকে সব শুনে দিগন্ত আমাদের বাড়িতে রেখে মাহিনের কাছে যায়। সে মাহিনকে অনেক বুঝাতে থাকে যাতে এই রকম পাপ কর্ম সে না করে। কিন্ত মাহিন দিগন্তের কোন কথাই কানে তুলে না। উল্টে সে দিগন্তকে থ্রেড দিতে থাকে। দিগন্ত যদি ওদের বাধা দেয় তাহলে সে দিগন্তের প্রাণ নিয়ে নিবে। দিগন্ত থেমে থাকে না। সে মাহিনের সাথে লড়াই করে। মাহিন লড়াই করার সময়ই তার এক চামচাকে দিয়ে দিগন্তের বাইকের একটা তার ছিঁড়ে রাখে। মাহিনের সাথে ছিলো ওর চমচারা ছিলো। আর দিগন্ত ছিলো একা। তাই সেদিন দিগন্ত মাহিনের সাথে পেরে উঠে নি।মাহিন দিগন্তকে মেরে আধমরা করে রেখে চলে যায়। দিগন্ত ওই অবস্থাতে বাইক চালাতে থাকে। তখন ওর উদ্দেশ্য ছিলো ভূমিকে ইনফ্রোম করা। একদিকে রক্তাক্ত শরীর আর অন্যদিকে বাইকের একটা তার ছেড়া। কন্ট্রোল করতে পারছিলো না সে তার বাইককে। সামনে থেকে একটা ট্রাক এসে দিগন্তের বাইক ধাক্কা দিয়ে দূরে ছিটকে দেয়। যার ফলে সেদিন প্রান হারায় দিগন্ত। কথাগুলো একনাগাড়ে বলেই কেঁদে ফেলল মিমি। এবার ভূমিও কাঁদছে। দিগন্ত তার জন্যে প্রান দিলো। দিগন্তের মৃত্যর জন্যে দায়ি ভূমি। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ভূমির। ওর কারনে একটা সুখের পরিবার মুহূর্তেই ভেঙে চুড়মার হয়ে গেলো। মিমি তার চোখের পানি মুছে আবারও বলল,
-সেদিন দিগন্তের লাশ নিয়ে আমরা গ্রামে চলে আসি।দিগন্তকে এই অবস্থায় দেখে ব্রেন স্টোক করে বাবা। সেদিন থেকে বাবা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছে। আমাও ও আর শহরে ফিরে যাওয়া হয়নি। আমার বাবা আমাকে বলেছিল, সব ভূলে নিজের জিবনটাকে নতুন করে শুরু করতে। কিন্ত আমি তাকে বুঝাতে পারিনি, দিগন্তকে ছাড়া নতুন জিবন শুরু করতে পারবো না। দিগন্ত না থেকে সর্বক্ষণ আমার সাথে আছে। ও তো আমার অস্তিত্বে মিশে গেছে। আমি কি করে ওর জায়গায় অন্যকাওকে বসাবো। আমার বাবাও আমাকে ভুল বুঝে। তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। দিগন্ত চলে যাওয়ার আগে আমাকে একটা পরিবার দিয়ে গেছে। ও একটা উপহার দিয়েছে আমাকে যেটা আঁকড়ে ধরে আমি সারাজিবন কটিয়ে দিতে পারবো। তারপর থেকে এই পরিবারই আমার সব। সংসারের হাল ধরি। নতুন করে সব শুরু করি। এলাকার স্কুলে আমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন দিগন্তের ছোট চাচা। ভূমি, জানো আমি খুব খুশি। তুমি মাহিনকে শাস্তি দিয়েছো এটা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি।
ভূমি এবার আর নিজেকে আটকি কেঁদে দিলো সে। আরাভ ভূমিকে তার বুকে জড়িয়ে নিলো। ভূমি দিগন্তের বুকে মাথা রেখে কান্নারত অবস্থায় বলতে লাগলো,
-আমার জন্যে দিগন্তের প্রান চলে গিয়েছে। ছোট্ট অনন্ত ওর বাবাকে হারিয়েছে। বাবার আদর ভালোবাস কি হয় সেটা বুঝার আগেই বাবাকে হারিয়েছে সে। মিমি আপু তার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে। ভালোবাসার মানুষটাকে হাড়ানোর কষ্টটা আমি জানি আরাভ। দুই বছর তোমাকে ছেড়ে থেকেছি। কতটা যন্ত্রনা হয় সে আমি বুঝে গেছে। আর সেখানে মিমিআপু তিন বছর ধরে তার ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে বেচে আছে।তার কতটা কষ্ট হচ্ছে। তার এই কষ্টের জন্যে শুধুমাত্র আমি দায়ী।আরাভ তুমি কেন সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো বলো। আমি যদি সেদিন মরে যেতাম তাহলে এতকিছু হতো না। আমার বেচে থাকার কোন অধীকার নেই।
ভূমির বলা প্রতিটা কথা আরাভের বুকে বিষাক্ত তীরের মতো লাগছে। ভূমি নিজের মৃত্য কামনা করছে। এই কথাটা শুনার আগে তার মরন হলো না কেন?? আরভ শক্তকরে ভূমিকে তার বুকে চেপে ধরে। এদিকে আরাভ আর ভূমিকে দেখে মিমির অধরে হাসি ফুটে উঠলো। দু-জন ভালোবাসার মানুষকে একসাথে দেখতে ঠিক কতটা সুন্দর লাগে বলে বুঝাতে পারবো না। মিমি আনমনে বলে ফেলল,
-দিগন্ত, আমি জানি তুমি সবসময় আমার সাথে আছো।তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে সব সময় আমার পাশে থাকবে। আমাকে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে, তাহলে, আমাকে একা ফেলে চলে কেন গেলে। আমার খুব কষ্ট হয় জানো। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। কেন আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে গেলে।
#বেলা_শেষে চলে গিয়ে ছায়া রেখে গেলে। তোমার ছায়াটা আঁকড়ে ধরেই এখনো শ্বাস নিচ্ছি আমি।
চলবে,,,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।