#বেলা_শেষে। [৩১]
ভূমিকে এমন ভাবে সামনে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভূমির দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায় আরাভ। সামনে তাকাতেই আরাভ ও বড়সড় এক ঝটকা খায়। ততক্ষণাৎ আরাভও ঠাউর করতে পারে না। আসলে এটা সে ঠিক দেখছে নাকি চোখের ভুল। অসহায় ফেস করে ভূমির দিকে তাকায় সে। ভূমিও আরাভের দিকে তাকায়। তাদের দু-জনের মনে এটাই প্রশ্ন,
-আমি যা দেখছি তুমিও কি তাই দেখছো।
দুজনেই মাথা নাড়ায়। তাদের উত্তর তারা পেয়ে গেছে।ভূমি অস্ফুটভাবে বলে, মিমিআপু,,, ততক্ষণে আরাভ ভূমির পাশে এসে দাঁড়ায়। আরাভ ভূমিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-এটা দিগন্তের ওয়াইফ না। ওনার এই অবস্থা কেন?? আর দিগন্তই বা কোথায়??
-আমিও সেটাই ভাবছি। তবে কি আমরা যেটা দেখছি সেটাই ঠিক। দিগন্ত,,, আরাভের দিকে তাকালো ভূমি।
ভূমি আর আরাভের থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে দাড়িয়ে আছে মিমি। পড়নে সাদা কালারের শাড়ি। মাথার চুলগুলো খোপা করে রাখা আছে তার। হাতের কয়েকটুকরা কাগজ। একদম খাটি বাঙালি মেয়ের মতোই লাগছে তাকে। কিন্তু মিমির মতো এত অত্যাধুনিক মেয়ে এরকম সাধারণ জিবন যাপন করছে কেন?? ভালোবাসা কি মানুষকে এততাই বদলে দেয়। দিগন্তকে ভালোবেসে শহর ছেড়ে গ্রামে এসে গ্রামের আর পাচটা মেয়ের মতো সাধারণ ভাবে জিবন যাপন করছে সে।কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর কয়েকজন ছেলেমেয়ে আসলো মিমির কাছে।তারা হয়তো এই স্কুলের ই শিক্ষার্থী । সে ছেলেমের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। হয়তো তাদের কোন কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে সে। তাদের সাথে কথা বলার সময় মিমি হাত দিয়ে এদিক ওদিক ইশারা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কিন্ত এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিমির এত কিসের ভাব। সে কি বলছে তাদের। আর দিগন্ত সে কোথায়?? চেয়ারম্যানকে ও দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভূমির মাথায়। আরাভ ভূমিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
-আমরা কিন্ত দিগন্তের ওয়াইফের সাথে কথা বলতেই পারি। আরাভের কথা শুনে ভূমি ভ্রু কুচকিয়ে ওর দিকে তাকালো। এসব কি বলছে আরাভ। শেষে কিনা প্রাক্তন স্বামির বউয়ের সাথে কথা বলবে।
-তোমার মাথা ঠিক আছে আরাভ। আমি এখন ওদের সাথে যাব কথা বলতে।
-প্রবলেম কি তাতে। আমি আছি তো তোমার সাথে। তোমার সম্মান রাখার দায়িত্ব আমার। আমার দেহে প্রান থাকতে তোমার সম্মানের উপর এতটুকুও আঁচ আসতে দিবো না আমি। আরাভের কথা শুনে ভূমি ছলছল নয়নে তার দিকে তাকালো। এই মানুষটার একটা কথায় ভরসা পায় সে।আমি আছি তো তোমার সাথে।এই থেকে ভরসার পাওয়ার মতো কথা আর কি হতে পারে।
-এভাবে কি দেখছেন, মেডাম?? আরাভের দুষ্টমি ভরা কন্ঠে মৃদু হাসলো ভূমি। সে তার দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। ততক্ষণে মিমি সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। আরাভ ভূমি দুজনে এদিক ওদিক মিমিকে খুঁজতে লাগলো কিন্ত কোথাও পেল না তাকে। তাই ব্যর্থ মন নিয়ে তাদের সিট গ্রহন করলো। আরাভ অভিকে কোলে নিয়ে বসে বসে অনুষ্টান দেখতে মনোযোগ হলো।
কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্টান শুরু হয়ে তারপর একে একে সঙ্গিত নৃত্য সবই হয়। বিদায়ী স্যারকে নিয়ে বক্তব্য দেয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তারপর কয়েকজন শিক্ষার্থী। এবার যে স্যারকে নিয়ে বক্তব্য রাখবে তার নামটা শুনে আরাভ ও ভুমি দুজনেই অবাক হয়। স্টেজে যখনি এনাউজমেন্ট করা হয়, এবার বিদায়ী স্যারকে নিয়ে বক্তব্য রাখতে আসছেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা মিসেস মিমি তালুকদার। মিমি তালুকদারের নাম শুনে বেশ অবাক হয় আরাভ ভূমি। মিমি এই স্কুলে শিক্ষকতা করে। কিন্ত কেন??দিগন্ত এত ভালো চাকরি করে তারপর সে একজন, দিগন্ত কোথায়? না কিছুই ভাবতে পারছে না ভূমি।
সেদিন কোন রকমে কেটে যায়। মিমির কথা দুজনেই প্রায় ভূলে যায়। পরের দিন সকালে আরাভকে নিয়ে ভূমি ওর ছোট চাচার বাড়িতে যায়। ভূমির ছোট চাচার মেয়ের বিয়ের পাকা কথা চলছিলো সেদিন। ভূমিকে দেখে ভূমির চাচি প্রথমে খুশি হলেও পরে বিরক্ত হলো। এই ভূমি না জানি তার মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দেয়। ভূমির যে স্বভাব, একটু এদিক ওদিক হলে দিবেবিয়েটা ভেঙে। বেশ ভয় লাগছে ভূমির ছোট চাচির। তীরে এসে আবারও নৌকা না ডুবে যায়। মনে মনে সে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় তার মেয়েটার বিয়ে যেন ভালোভাবে হয়ে যায়। কে জানতো ভূমির চাচির ভয়টাই সত্যি হয়ে উঠবে।
বিয়ের পাকা কথা চলছিলো এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় ভূমি। এতক্ষণ তার ছোট চাচি তাকে আটকিয়ে রেখেছিল। যাতে ভূমি এদিকে না আসতে পারে। কিন্ত কতক্ষণ আর আটকিয়ে রাখবে তাকে।ভূমি তার চাচিকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে উপস্থিত হয় এখানে।ভূমিকে দেখে তার ছোট চাচা হাসি মুখে মেহমানদের সাথে ভূমির পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর ভূমি তার ছোট চাচার পাশে বসে তাদের কথা শুনতে থাকে।
বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক ঠাক। বরপক্ষের তেমন কোন দাবি নেই। তারা বলেছে, আপনাদের মেয়ে এক্কেবারে খালি হাতে কিভাবে দিবেন। বুঝেন ই সমাজে আমাদের একটা সম্মান আছে। সবাই যখন জিগ্যেস করবে মেয়ের সাথে কি কি দিলো। তখন আমরা কি বলবো তাদের। ভূমির চাচা তাদের কথা মেনে নেয়। তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা মেয়েকে সাজিয়ে দিবে।ব্যস্ হলে গেলো এবার বরপক্ষের আরাকে দাবি,
-শুধু মেয়েকেই দিবেন? জামাইকে কিছু দিবেন না। আপনাদের বাড়ির জামাই এক্কেবারে খালি হাতে কি করে দিবেন। আমাদের ছেলের একটা বাইকে সখ। আপনারা একটা বাইক দিবেন। মেয়ে মেয়ের জামাই বাইকে করে আপনার বাড়িতে আসবে। আসে পাশে সবাই দেখবে।শুধু কি তাই। আজকাল গাড়ি ভাড়াটাও বেড়ে যাচ্ছে। বাইক হলে তো গাড়ি ভাড়ার টাকাটা বেচে গেলো।
বরপক্ষের কথা শুনে ভূমির ছোট চাচার মন খারাপ হয়ে গেলো। পন নিবে না তাও তাদের এত দাবি। কিন্ত কি করার, সর্বস্ব দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিবে। মেয়ের সুখের জন্যে এইটুকু করতেই পারে সে। সে কিছু বলবে তার আগেই ভূমি বলে উঠলো,
-আপনাদের ছেলের কেমন বাইক পছন্দ??
-suzuki, আব্বা বলেন suzuki হলেই হবে। পাত্র বলে উঠো। পাত্রের কথা শুনে ভূৃমি বিরবির করে বলল,
-সব ঠিক ঠাক করেই মাঠে নেমেছে দেখছি। দাঁড়াও নেওয়াচ্ছি তোমাদের বাইক।
-এই যে চাচা শুনুন, বলছি ছেলের শ্বাশুড়ি বাড়ি থেকে বাইক দিবো তাতে আপনার কোন বিনিফিট দেখছিনা। suzuki তে তো দুটো সিট। ছেলে আর ছেলের বউই বসতে পারবে। আপনি তো পারবেন না। ভেরী স্যাড। চাচা বলছিলাম কি, আমার কাছে না একটা দুর্দান্ত আইডিয়া আছে।বাইকের পরিবর্তে রিক্সা দিলে কেমন হয়। ছেলে ছেলের বউয়ের সাথে আপনিও চড়তে পারবেন তাতে। আপনার ছেলে রিক্সা চালাবে আর আপনি ছেলের বউকে নিয়ে রিক্সার পিছনে বসে বসে ঘুরবেন আর গান গাইবেন, এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো বলোতো। আপনার গ্রাম বাসিরা দেখে বাহবা দিতো। কথাগুলো বলে ইনোসেন্ট মার্কা হাসি দিলো ভূমি। ভূমির সাথে সাথে হেসে উঠলো, আরাভ। আর এদিকে, বরপক্ষ তো রেগে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করেছে। বরের বাবা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
-বাড়িতে ডেকে এভাবে অপমান করছেন আমাদের। হবে না এই বিয়ে, এমন ছোটলোক বাড়িতে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিব না। চলো সবাই। তারপর এক এক করে সবাই চলে যায়। সবার চলে যাওয়ার পর ভূমির ছোট চাচী একটু মন খারাপ করে কারণ সম্বন্ধটা ভালো ছিল। ছেলে সরকারি চাকরি করতো। আজকাল এমন সমন্ধ পাওয়া বেশ কঠিন আর সেখানে তারা পেয়েও হাতছাড়া করল। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় ভূমির ছোটচাচার কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ তার মেয়ে রাজি নয় এই বিয়েতে। হাদিয়া নামে পন চায় এমন বাড়ির বউ হতে চায় না সে।
ভূমি যখন আরাব কে নিয়ে তার ছোট চাচার বাড়ি থেকে ফিরছিল তখন পথিমধ্যে ওদের সাথে দেখা হয় অদিতির। এতদিন পর ভূমি কে দেখে অদিতি জড়িয়ে ধরে। অদিতিকে এতদিন পর দেখে ভূমিও আবেগপ্লুত হয়ে যায়।
-ভাবি প্লিজ বাড়ি ফিরে চল। বড় চাচার খুব অসুখ। ডাক্তার বলেছে বড় চাচা বেশি দিন আর বাঁচবো না। অদিতির কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় ভূমি। বড় চাচা মানে তো চেয়ারম্যান। অদিতি তাকেই বড় চাচা বলে ডাকে। ভূমি উত্তেজিত হয়ে বলল,
-কি হয়েছে চেয়ারম্যানের??
-বাড়ি ফিরে চল। নিজেই দেখতে পারবে। চেয়ারম্যান বাড়ি যাওয়া নিয়ে ভূমির প্রথমে আপত্তি থাকলেও, আরাভের কথায় ও বাড়ি যেতে রাজি হয় সে। কিন্তুু সেই বাড়িতে গিয়ে এমন একটা দৃশ্য দেখবে সেটা কল্পনার বাইরে ছিলো তার।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।