#বেলা_শেষে। [২৫]
ধোয়া উঠা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের চাদর গায়ে মুড়ানো শহরটাকে দেখছে ভূমিকা। দিনের আলোতে শহরটাকে যতটা ব্যাস্ত মনে হয় রাতের আধারে ঠিক ততটাই নিস্তব্ধ। দিনের শেষে ক্লান্তিমাখা শহরটাও ঘুমিয়ে পরে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আকাশ ছোয়া বিল্ডিং গুলো ঝলঝল করছে।চায়ের কাপে অধরোষ্ঠ ছোঁয়ালো ভূমিকা। এমন একটা নিরব মনোরম পরিবেশে আদা লেবুর সংমিলিত চা খাওয়ার মজাই আলাদা। দু-চোখ বন্ধকরে চায়ের স্বাধ উপভোগ করলো ভূমিকা। তার অধরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো নিতু এখনো তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেমালাপ চালিয়ে যাচ্ছে।নয়না এখন আর তাদের সাথে থাকে না। রাকিবের সাথে রাকিবের বাসাতেই ঠাই হয়েছে তার। মনে মনে একটু বিরক্ত হলো ভূমিকা। এই মেয়েটা এত কথা বলতে পারে। ওই ভালো জানে এত কিসের কথা বলে। একটু পর পর মিছ ইউ লাভ ইউ ছাড়া তো আর কিছুই শুনতে পায়না সে। পাহার সমান মিছ করে তাহলে বিয়ে করে নিলেই পারে। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানেই দেখতে পায় না ভূমিকা। যত্তসব নেকামো।
ভূমিকার চা খাওয়া শেষ হলে সে আরো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর রুমে এসে শুয়ে পরে।
নিতু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ভূমিকার দিকে তাকায়। রাতের বেলা কোন না খেয়েই ঘুমিয়ে পরবে সে। ইভানকে বলে কল কেটে দেয় সে। ভূমিকাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে বলে,
-না খেয়েই শুয়ে পরছিস। ক্ষিদে পেয়েছে তো উঠ না??
ভূমিকা উঠে বসলো। উত্পাত দৃষ্টিতে নিতুর পানে তাকালো সে। তারপর কড়া গলায় বলল,
-বস্তা বস্তা মিছ খেয়েও পেট ভরে নি তোর বোন। ভাত খাওয়ার কি দরকার। ইভান ভাইয়ের মিছ খেয়েই তো তোর পেট ভয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
নিতুর বুঝতে বাকি রইলো না ভূমিকা তার উপর রেগে গেছে। আসলে তার এত সময় কথা বলাটা ঠিক হয়নি। ওই ইভানও না একবার কল ধরলে আর রাখতে চায়না। নিতু ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
-কি করবো বল। একজন পিউর লাভার তো তাই এমন হচ্ছে। তুই যেদিন কারো প্রেমে পড়বি সেদিন বুঝতে পারবি। নিতুর কথা শুনে চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো ভূমিকার। সত্যিই কি তাই, না তা হবে কেন?? আমি তো দিগন্তকে ভালোবেসেছিলাম, আমার তো মনে হয়নি আমি ওর সাথে কথা বলতে না পারলে থাকতে পারবো না। আমি তো ভালো আছি। দিগন্তকে ভুলে গিয়ে নিজের মতো করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। কই আমার তো কষ্ট হয়না।মাথা নাড়ালো ভূমিকা। এসব কি ভাবছে সে। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
-সেটা হয়তো কোন দিন সম্ভাব হবে না।
বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেল ভূমিকা। রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে নিতুর সামনে সাজিয়ে রাখলো। তারপর সেই বসে পড়লো। নিতু বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভূমিকার মুখশ্রীর দিকে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই মুখটা আমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।
-এভাবে হা করে কি দেখছিস? খাওয়া শুরু কর। এক লোকমা ভাত মুখে পুরে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা।
-হ্যাঁ হ্যাঁ খাচ্ছি। নিতু ব্যাস্ত হয়ে পরে খাবার খাওয়ায়। কয়েক লোকমা মুখে দেওয়ার পর নিতু বলে উঠে,
-ভূমি তোর মনে হয়না মাহিন ভালো হয়ে গেছে।
-কুকুরের লেজ কখনো সোজা হতে দেখেছিস?
-মানে!!!!
-এটা মাহিনের কোন নতুন প্ল্যান। শহরে আসার পর থেকে চিনি ওকে। অনেক সুযোগ দেওয়ার পরেও নিজেকে শুধরাই নি সে। ঠোঁটে চেপে হাসলো ভূমিকা। অতঃপর বলল,আসলে সেদিনের মার কম হয়েছিল কি-না। তাই সে চাইছে আবারও কিছু উত্তম মাধ্যম পেতে। এটা আবার আমি খুব ভালো পারি। অধর প্রসারিত করে হাসলো ভূমিকা। ভূমিকাকে সঙ্গদিয়ে নিতুর হাসলো। এই মাহিনের কপালে দুঃখ আছে।
বিছানায় বসে আছে আরাভ। আরাভের সামনে বসে আজহার মাওদুদ ওর হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। আরাভের হাত কেটেছে সেই কখন। রক্ত শুকিয়ে হাতেই সাথে লেপ্টে আছে। সেই রক্ত স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলেন আজহার। আজহার হাতে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে বললেন,
– হকি খেলতে গিয়ে হাত কেটেছে, এই বয়সে এসে এটাও দেখতে হলো। সত্যি করে বলতো দাদুভাই, হাত কিভাবে কেটেছে। আজহারের কথার কোন জবাব দিলো না আরাভ। তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-হকি স্টিকে ব্লেড লাগানো ছিলো মনে হয়।
-ওহ দাদু রিডিকিউল করছো আমার সাথে। নট ফেয়ার।
-দেখো দাদুভাই, আমার মাথার চুলে পাক ধরেছে। এই চুল কিন্ত এমনি এমনি পাক ধরেনি। অভিঙ্ঘতায় পেকেছে মাথার চুল। আরাভের দিকে ঝুকে বসলেন আজহার। আজ কার অপারেশন করেছো দাদুভাই। ভ্রু নাচিয়ে বললেন আজহার। আজহারের কথায় কিছুটা বিব্রত হয় আরাভ। হাত গুটিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আরাভের মৌনতা দেখে আজহার উঠে ওর কাদে হাত রাখে। বড় করে শ্বাস ফেলে বলে,
-জোড় করবো না তোমাকে দাদুভাই। আমার হেল্প লাগলে অবশ্যই জানাবে ওকে।
-ইউ আর বেষ্ট দাদুভাই। মৃদু হেসে বলে আরাভ। তারপর আজহারের সাথে আলিঙ্গন করে নেয়।
ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিলে তিন বন্ধু। এমনি সময় মাহিন এসে ওদের পাশে বসে। মাহিনকে দেখে অটোমেটিক সবার মুখের রিয়্যাকশন বদলে যায়। রাতুল পানি খেতে খেতে বলে,তোদের ক্লাস নেই?? নিতু আর ভূমিকা ওর কথায় সায় দিয়ে বলে, আছে তো। চল ক্লাসে যাই। সবাই চলে যেতে চাইলে মাহিন ভূমিকাকে থামিয়ে বলে,
-তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে??
-আপনার কথা শুনার মতো সময় আমার কাছে নাই।
-তোমার ভালোর জন্যে বলছি। আমার কথাটা শুনো। নাহলে পরে আফসোস করবে। মাহিনের কথা শুনে ভ্রু কুচকালো ভূমিকা। তারপর বলল,
-কি এমন কথা??
মহিন ও উঠে দাঁড়ালো। দু-হাতের তালু ঘসে বলল,
-আরাভের সাথে তোমার কিসের রিলেশন??
-আমি ওনার অফিসের একজন স্টাফ মাত্র।
-ইউ আর রঙ।
-মানে। কপালে কয়েকটা চিন্তার ভাজ ফেলে বলল ভূমিকা। অতঃপর মাহিন বলল,
-আই থিংক, আরাভ তোমাকে লাভ করে। মাহিনের কথা শুনে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো ভূমিকার। মাহিনের গালে চড় মারতে চেয়েও মারলো না।শক্ত গলায় বলল,
-নিজের মতো করে সবাইকে কেন ভাবেন বলুন তো। আমার চোখে স্যার একজন আদর্শ মানুষ। আর আপনি এসেছেন তার নামে কুটনিতি করতে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে এক চড় মারি।কিন্ত এই মুহূর্তে আমি আমার হাতটাকে নষ্ট করতে চাচ্ছি না। ভূমিকার কথা মাহিনের গায়ে লাগলো বলে তো আমার মনে হলো না। সে আগের মতোই অধরে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে দাড়িয়ে আছে। রাগে কটমট করে ভূমিকা চলে যাওয়ার জন্যে সামনে পা বাড়াবে এমনি সময় মাহিন পিছন থেকে বলে উঠলো,
-আর যদি আমার কথাটা সত্যি হয় তাহলে বন্ধুত্ব করবে আমার সাথে।
পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ভূমিকা। মাহিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে দাতে দাত চেপে বলে, আসমান যদি জমিনেও নামে তবুও আপনার সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে না। আর আরাভ স্যারে নামে কোন কথা বললে আমি কিন্ত আপনাকে ছেড়ে দিব না। বিকজ স্যারকে আমি যতটা সম্মান করি ঠিক ততটাই শ্রদ্ধা করি। তার নামে কোন বাজে কথা শুনা মানেই তো অপরাধ। মাহিন কে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় ভূমিকা। ভূমিকার চলে যাওয়ার পর অধরোষ্ঠ কামড়িয়ে শয়তানি মার্কা হাসি দেয়। আরাভকে থেকে তো দূরে সারাবোই তোমাকে ভূমিপাখি। নাহলে যে আমার কাজ সহজ হবে না। আমার গায়ে হাত তুলেছে তুমি। সেদিন সময় তোমার হাতে ছিলো। একবার, একবার শুধু সুযোগ পাই।তারপর তোমাকে বুঝাবো মাহিন কি জিনিস। মাহিনের গায়ে হাত উঠানোর ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে। আমার খাচায় তোমাকে বন্ধি হতেই হবে ভূমিপাখি। শয়তানি মার্কা হাসি দেয় মাহিন।
কলেজের পিছনের দিকটায় সচরাচর কেও আসেনা ।খুব দরকার না হলে এদিকে কেও আসেই না বললেই চলে। মাঝে মাঝে দু-একজন প্রেমিক প্রেমিকা আসে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করতে। তাছাড়া এদিকে কারো সমাগম নেই। এমন একটা নিরিবিলি জায়গায় মাহিন অপেক্ষা করছে আরাভের জন্যে। মাহিন নিজে থেকেই আরাভ কে এখানে ডেকেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাভ এখানে উপস্থিত হয়।
মূলত আরাভকে এখানে ডাকার কারন হলো ওর কাছ থেকে সত্যিটা জেনে নেওয়া। ভূমিকা আর আরাভের সম্পর্কের সত্যিটা জেনে নেওয়া। আরাভ তো সেটা এমনি এমনি মাহিনকে বলবে না। আর মাহিনও জানে কি করে সত্যিটা আরাভের পেট থেকে বের করতে হবে। তাই সে শয়তানি মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
-ভাই ভূমিকা মালটা কিন্ত হেব্বি হট। ওকে আমার চাই। এক দিনের জন্যেও হলে ওকে চাই আমার। তুমি আমাকে হেল্প করবে এই কাজে। মহিনের কথা শেষ হতে না হতেই আরাভ ঝাপিয়ে পরলো ওর উপর। মাহিনকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো সে। তোর সাহস হয় কি করে, ভূমিকার দিকে নজর দেওয়া। আজ চোখ উপরে ফেলবো আমি। মাহিনও কম কিসে সেও মারছে আরাভকে। কেন রে ভূমিকা কি তোমার সম্পত্তি নাকি ওর যে নজর দিলে তুমি চোখ উপরে ফেলবে। আরাভের নাক বরাবার ঘুসি দেয় মাহিন।
-হ্যাঁ ভূমিকা আমার সম্পত্তি। ও শুধু মাত্র আমার। ভালোবাসি ওকে আমি। ওর দিকে যে চোখ তুলে তাকাবে তার চোখ আমি উপরে ফেলবো। আরাভের কথা শেষ হতেই মাহিন এত জোড়ে ওকে ধাক্কা দেয় যে টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পরে যায় আরাভ। মাহিন বিজয়ী হাসি দিয়ে সামনে দিকে তাকায়। মাহিনের দৃষ্টি বরাবর আরাভ ও তাকায়। আর যা দেখে তাতে যেন ওর পুরো দুনিয়া থামকে যায়।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা। [লেখিকা-]