#বেলা_শেষে। [২৩]
-ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা দেওয়াতেই বেশি আনন্দ। তাই অনলে পুড়লাম নাকি সুখের সাগরে ভাসলাম সেটা ভেবে কোন কাজ নেই। আমি ভালোবাসি আর ভালোবাসবো শুধু এটাই জানি।
আরাভের কথা শুনে একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো রাকিব। বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে চিবুকে ঘসে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল,
-এখন বুঝতে পারছিস না। যে দিন ভালোবাসার মানুষটাকে হাড়িয়ে ফেলবি সেদিন বুঝবি কত বড় ভুল তুই করেছিস। রাকিবের কথা শুনে মৃদু হাসলো আরাভ। অধরোষ্ঠ চেপে হেসে বলল,
-নয়না অপেক্ষা করছে। রাকিবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উল্টোদিকে ঘুড়ে দাঁড়ালো আরাভ। রাকিব ওকে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। ভূমিকার দিকে একপলক তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বলে উঠলো, জানিনা এই পরিণতি কি হবে? তবে কি আরাভের ভালোবাসা হেরে যাবে। এতটা ভালোবাসার পরেও যদি মানুষটা তাকে না বুঝে তাহলে সেই মানুষটা আপন না হোক। ভূমিকা কি কোন দিনও ভালোবাসতে পারবে আরাভকে। যাই হোক আরাভ যেন কষ্ট না পায়। রাকিব তার দৃষ্টি সড়িয়ে আরাভের দিকে দিলো। আরাভ এখনো তাকিয়ে আছে ওই চাঁদের দিকে।
কিছুটা সময় পর আরাভের মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। এত রাতে কে কল করলো। হয়তো দরকারি ফোন তাই সে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। মোবাইলটা সামনে ধরতেই স্কিনে আম্মু নামটা দেখতে পেলো। আরাভ একবার ভাবলো সে কল রিসিভ করবে না। পরক্ষনে ভাবলা, আজ বাসায় ফিরে নি। আম্মু টেনশন করছে তাকে বলে দেওয়া উচিৎ আমি কোথায় আছি। আরাভ কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় আরাভের মা বলে উঠলো,
-রিহা তিন ঘন্টা বসে থেকে চলে গেল। কোথায় তুই। বাসায় ফিরছিস না কেন? শুন এক সপ্তাহ পর রিহা ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে। তুই তাড়াতাড়ি রিহাকে বিয়ে করে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে আয় । ও একবার চলে গেলে আর ফিরবে না বলে দিয়েছে।
-আমি এক সপ্তাহ পরেই বাসায় ফিরবো মাই ডিয়ার আম্মু। রিহাকে চলে যেতে দাও।
-তুই কি কোন দিনও বিয়ে করবি না?? আমি কবে দাদু ডাকটা শুনবো। ছোটছোট নাতি নাতনীদের রুপকথার গল্প শুনাবো। ওদের নিয়ে ঘুরতে যাবো। বল কবে করবো এসব। জুবাইদার কথা শুনে ভূমিকার দিকে তাকালো আরাভ। তারপর আনমনেই বলে উঠলো,
-সে যেদিন চাইবে।
-কে চাইবে? কার কথা বলছিস তুই আরাভ?? জুবাইদার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে আরাভের বোধগম্য হলো সে কে বলেছে। কথা ঘুড়ানোর জন্যে বলল,
-ক-কেও না। আই উইল কল লেটার।বাই। আরাভ কল কেটে দিলো। মোবাইলটা পকেটে পুরে বড় করে শ্বাস নিলো। এ যাত্রায় বেঁচে গেলো সে। জুবাইদা আরাভের পছন্দের কথা জানতে পারলে তাকে পাগল করে দিবে।
দেখেছ ছেলের কান্ড। কথাটা শেষ না করেই কল কেটে দিলো। সুফার এক কোনে মোবাইল রেখে বলল জুবাইদা। আদনান সুফার বসে পায়ের উপর পা তুলে বই পড়ছে আর চা খাচ্ছে। জুবাইদার কথা শুনে বইয়ের পাতার ফাঁকে সে জুবাইদার দিকে তাকালো। জুবাইদার বিরক্তিমাখা মুখ দেখে আদনান বলল,
-তুমি পারোও বটে। কেন ছেলেটাকে এত বিরক্ত করো বলোতো। শোন তোমার ওই বান্ধুবির মেয়ে কি যেন নাম, রিয়া নাকি রিহা, সে যাই হোক তাকে আমার ছেলে কোন দিনও বিয়ে করবো না। ওই মেয়েটার সাথে আমার ছেলের বিয়ে হলে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। তারপর তোমার ওই বান্ধুবির মেয়েকে সুরাইয়ার মতো একা একা থাকতে হবে। আর বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার মতো অপেক্ষা করতে হবে। আর এদিকে আমার ছেলেটা হাওয়া হয়ে যাবে।
-বই পড়ে পড়ে তোমার মাথাটা এক্কেবারে খারাপ হয়ে গেছে। বিরক্তির সুরে কথাগুলো বসে চলে গেল জুবাইদা। আদনান তার হাতে থাকা বইতে আবার মনোযোগ দিলো।
আজ সারারাত উঠোনের কাটিয়ে দেয় সবাই। গল্পকরার এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায় নিলা নিতু আর ভূমিকা। আরাভ রাকিব ইভান আর নয়না জেগে থাকে সারারাত। পরের দিন সকলে নয়নার মা এসে ওদের সবাইকে ঘরে নিয়ে যায়। ভূমি নিতুর সাথে ওদের বাসায় চলে যায়। এদিকে আরাভ আর রাকিব ব্যস্ত হয়ে পরে নয়নার বাবার রাগ ভাঙানোর। শেষ পর্যন্ত নয়নার বাবা ওদের মেনে না নিয়ে থাকতে পারে না।
বিছায়নায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়ছিলো মিমি। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দিগন্ত রুমে প্রবেশ করলো। আর রুমে প্রবেশ করেই সে মিমিকে জড়িয়ে ধরে। মিমিও দিগন্তের পিঠে আলতো হাত বুলায়।
-আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। আমার স্বপ্ন পূরণের আরো একধাপ এগিয়ে গেছি আমি। দিগন্তের চাকরির কথা শুনে মিমির মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কিন্ত মুহূর্তেই দিগন্তের বলা কথা শুনে মিমির হাসি উবে গেলো,
-কিছুদিনের জন্যে আমাকে দেশের বাহিরে যেতে হবে। কোথায় যাব সেটা জানি না। তবে যেতে হবে। আরো ভালো টেনিং এর জন্যে।
-তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো আমি তোমার জন্যে খাবার নিয়ে আসছি। মিমি চলে যায় রান্নাঘরে। দিগন্ত চলে যায় ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। তখন তার চোখের সামনে পরে একটা বন্ধ ঘর। কিছুদিন আগেও এই রুমের দরজাটা সব সময় খুলা থাকতো। তার সামনে কেও একজন বকবক বকবক করতো সারাক্ষণ। এখন আর সেটা কেও করে না। আচ্ছা দিগন্তের চাকরির খবরটা কি ভূমিকাকে জানানো উচিৎ। দিগন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই বন্ধঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কেন তাকিয়ে রইলো সেটাও জানা নেই তার।
অফিসের কিছু ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে ভূমিকা। তিনদিন নিতুদের গ্রামে ছিল সে। এই তিনদিনে ম্যানেজারের করা গোলমাল গুলো ঠিক করতে করতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। ম্যানেজার ভূমিকার পাশেই বসা ছিলেন। সে বসে বসে তার বউয়ের হাতের রান্নার প্রশংসা করছে। এখন এগুলো শুনতে শুনতে ভূমিকা অভ্যস্ত তাই কোন প্রতিক্রিয়া করছে না। শুধু একটু পর পর বিরক্তি মুখে ম্যানেজারের দিকে তাকাচ্ছে।
অধরোষ্ঠ চেপে হেসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আরাভ। আরাভ ওর চেয়ারে বসে স্পষ্ট ভূমিকার বিরক্তিমাখা মুখ দেখতে পাচ্ছিলো। কাজের ফাঁকেফাঁকে সে ভূমিকার বিরক্তি মাখা সেই মুখটা উপভোগ করছে। আবারও কাজে মন দেয় আরাভ। রাকিব নেই। কাজেই এখন আরাভের উপর কাজের পেসার বেশী। কিছুক্ষণ পর ভূমিকা আরাভের দরজার টুকা দিয়ে বলল,
-স্যার আসবো??
-কাম-ইন। ভিতরে প্রবেশ করে ভূমিকা। তারাপর আরাভকে কয়েকটা ফাইল দিয়ে বলে,স্যার এগুলো একটু রিচেক করে নিন। দেখুন সব ঠিকঠাক আছে কি না। ভূমিকার কথামতো আরাভ ফাইলগুলোতে চোখ বুলালো। ততক্ষণাৎ কোন ভূলই তার চোখের সামনে পরলো না।
-গুড, প্লিজ সিট ডাউন। ইশারা করে চেয়ার দেখিয়ে বলল আরাভ। ভূমিকা বসলো না। সেখান থেকে চলে আসার জন্যে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে আসে সে। তখনি আরাভ পিছন থেকে ভূমিকাকে ডেকে দাঁড় করায়। তারপর সে ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-আপনি কলেজে যাচ্ছেন না কেন?? কলেজে যাওয়ার কথা শুনে ভূমিকা করুন চোখে তাকালো আরাভের দিকে। সে তো চায় কলেজে যেতে, পড়াশুনা করতে কিন্ত কিছু মানুষের বাজে মন্তব্যের জন্যে সে যাচ্ছে না কলেজে। এটা সে কিছুতেই বলতে পারবে না আরাভকে।
-দেখুন, আমি চাইনা আমার কাজের জন্যে আপনার পড়াশুনা উপর কোন ইফেক্ট পরুক। আমি আপনাকে পড়াশুনা করার সুযোগ দিয়েছি।তাহলে কেন যাচ্ছেন না কলেজে। আগামি কাল কলেজে যাবেন আপনি??
-সরি স্যার। কথাটা কোন রকমে বলে সেখান থেকে প্রস্থান করে ভূমিকা। ভূমিকা ভয়েজটা কেমন জানি রহস্যজনক মনে হয় আরাভের কাছে।তাই ভূমিকা চলে যেতেই সে কাকে যেন কল করে।
পরেরদিন সকাল সকালে অফিসে এসে উপস্থিত হয় ভূমিকা। যদিও তার কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো প্রবল। এখন আর কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করে না। তাই ইচ্ছে থাকলেও কলেজে যাওয়াটা হয়ে উঠবে না। অফিসে এসেই তার কাজে মনোযোগ হয় ভূমিকা। এদিকে আরাভ অফিসে ভূমিকাকে দেখে রেগে আগুন হয়ে যায়। কি অবাধ্য মেয়ে এটা। এক দিন কলেজে যেতে বলেছি তাও যাবে না। আরাভ বড় বড় পা ফেলে ভূমিকার কাছে যায়। আরাভকে দেখে ভূমিকা বলে উঠলো,
-স্যার আপনি এখনে? কিছু লাগবে??
-আপনাকে বলেছিলাম আজ কলেজে যেতে তাহলে অফিসে কেন এসেছেন??
-কোন জবাব দিলো না ভূমিকা।
-আপনাকে কিছু জিগ্যেস করছি। এ্যনসার মি।
– ভূমিকা করুন চোখে আরাভের দিকে তাকালো। আরাভ ভূমিকার জবাবের অপেক্ষাও করলো না। সে ভূমিকার হাত ধরে টেনে অফিসের বাইরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। ভূমিকা আরাভের থেকে নিজের হাত ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরাম। স্যার আমার হাতটা ছাড়ুন। আমি এখন কলেজে যাব না। প্লিজ আমার হাতটা ছাড়ুন।
-জাস্ট সাট আপ। থমকে দাঁড়িয়ে বলল আরাভ। আরাভের ধমকে কিছুটা কেপে উঠে ভূমিকা। অতঃপর আরাভ বলে,
-এতদিন জানতাম আপনি সব প্রবলেম ফেস টু ফেস সলভ করেন। প্রবলেম থেকে পালিয়ে বেড়ানো আপনাকে ঠিক মানায় না। সমস্যার মোকাবিলা না করলে সেটার সমাধান হবে কি করে। চলুন আমার সাথে।
আরাভ ভূমিকার হাত ধরে টেনে। গাড়ির কাছে নিয়ে আসে। ভূমিকাও আর কথা বাড়ায় না। সে আরাভের কথামত ওর সাথে চলে আসে।
চলবে,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।