#বেলা_শেষে। [১৬]
আফনে ফুলগুলো না নিলে ওই ভাইয়ারে টাকা ফিরত দিতে অইবো। ছোট এই বাচ্চা ছেলেটার কথায় ভূমিকা আবারও একই প্রশ্ন করলো। তোমাকে কোন ভাইয়া ফুল দিয়েছে। ছেলেটা তার হাতের ইশারায় ওদের থেকে কিছুটা দূরে একটা দোকান দেখালো। ভূমিকা সে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো কিন্তু সেখানে কাওকেই দেখতে পেল না সে।
-ওখানে তো কেও নেই?? ছেলেটাও সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর বলল,
-কই গেলো ভাইয়াটা!!
নিতু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই পন করেছিল সে আজ ভূমিকার সাথে কথা বলবে না। কিন্তুু তার এই কথা রাখতে পাড়লো না সে। দ্রুত পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। তারপর ছেলেটাকে বলল,
-ফুলগুলো তুমি নিজের কাছেই রেখে দাও। পরে অন্যকারো কাছে বিক্রি করে দিও।
নিতুর কথা শুনে ছেলেটার মন খারাপ করলো। অতঃপর বলল,
-আফনেরা না নিলে আমি ওই ভাইয়াটাকে টাকা ঘুরাইয়া দিমু। ছেলেটার কথা শুনে অবাক হলো ভূমিকা। ছেলেটা ভিষন সৎ। আসলে বচ্চারা সৎ ই হয়। তাদের মন থাকে ফুলের মতো পবিত্র। কমল। পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে উঠে। একটা বাচ্চাকে ছোট থেকে সৎ ভাবে সঠিক শিক্ষায় লালন পালন করলে সেই বাচ্চাটি কখনো অন্যায় পথে পা বাড়াতে পারে না।
ভূমিকা ওর ব্যাগে রাত রাখলো। মাত্র চারশো টাকা আছে। সেখান থেকে একশো টাকা ছেলেটাকে দিলো। আসলে অজানা কারো জিনিস নিতে ইচ্ছুক নয় ভূমিক।। ছেলেটা টাকা নিবে না। অনেক বুঝিয়ে তাকে টাকা দিতে হয়েছে। তারপর ভূমিকা ফুলগুলো নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
দু-দিন অফিসে না আসায় অনেক কাজ জমা পড়ে আছে আরাভের। অফিসে আসার পর থেকেই ফাইলপত্র আর লেপটপে মুখ গুজে আছে সে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো অথচ এখনো এক কাপ কফিও মুখে তুলে নি সে। এদিকে ম্যানেজার সাহেব, লাষ্ট প্রজেক্টের হিসাবে গোলমাল পাকিয়ে রেখেছে। তিনি মাঝে মাঝেই এমনটা করেন। আরাভের ইচ্ছে করে ওনাকে বাদ দিয়ে নতুন ম্যানেজার রাখার। কিন্তু বাবার বন্ধু বলে সেটাও করতে পারে না আরাভের ধারনা তার ম্যানেজার কাকা টুকিয়ে পাশ করেছে। না হলে এত বড় একটা কোম্পানির ম্যানেজার হয়েও সঠিক হিসাব জানে না। ভাগ্যিস সে ম্যানেজার হয়েছিলো, ডক্টর হলে ওটিতেই রোগী মেরে ফেলতো। আর ইন্জিনিয়ার হলে রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে দিতো। এই ম্যানেজার কে নিয়ে দুটানায় পড়ে গেছে আরাভ। তাকে রাখতেও পাড়ছে না। আবার ছাড়াতেও পাড়ছে না।
-স্যার, মে আই কামিং? মেয়েলি কন্ঠ শ্রবণের পর লেপটপে মুখ গুজে রেখেই জবাব দিলো,
-ইয়েস। অতঃপর সে ভিতরে আসলো। আরাভের অপজিট পাশে দাঁড়ালো। আরাভ লেপটপ রেখে তার দিকে তাকালো,
-মিছ নয়না, প্লিজ সিট ডাউন। নয়না তার সিট গ্রহন করলো। তারপর আরাভের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল,
-স্যার আমার কিছু বলার ছিলো।
-প্লিজ সে,,,,
নয়না বুঝতে পারছে না সে কি করে বলবে। এভাবে সরাসরি বসের সাথে কথা বলাটা বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। যদিও আগে অনেক বার বলছে। তখন কাজের ব্যপারে কথা বলছে। এই প্রথমবার সে কাজ ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে কথা বলছে।
-মিছ নয়না, এ্যনি প্রবলেম?
– জ্বি-জ্বি না স্যার। আসলে আমার একটা চাকরি লাগবে।
-হোয়াট???
-আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, সে একটু সমস্যায় পড়েছে। তার জন্যেই বলছি।
-কি ধরনের প্রবলেম??
-স্যার এটা ব্যক্তিগত। তবে চাকরিটা পেলে ওর অনেক সুবিধা হবে।
-ঠিক আছে, কাল ওনাকে আসতে বলুন। কথাটা বলেই আরাভ লেপটপের দিকে তাকালো। নয়না উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো, আমি এখনি ভূমিকে জানিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটা খুব খুশি হবে।
ভূমি নামটা শুনেই আরাভের বুকের ভিতরে ছেদ করে উঠলো। দ্রুত নয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তারপর অস্ফুটভাবে জিগ্যেস করলো,
-কি নাম বললেন আপনি??
-ভূমি, আমাইরা ভূমিকা ওর পুরো নাম।
আরাভের চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে এলো। এতো সেই ভূমি। সেদিন কলেজে ভূমিকা ওকে এই নামটাই বলেছিল। ভূমি চাকরি করবে? কিন্ত কেন?? দিগন্তের মতো একটা স্বামি থাকতে ভূমিকে কেন চাকরি করতে হব? আর ওর কিসের প্রবলেম। নানা প্রশ্ন ঘুড়পাক খাচ্ছে আরাভের মাথায়। হাতদুটো শক্তমুঠি করে দু-চোখ বন্ধকরে নিলো। আরাভের বুকের ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। এখন খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে ভূমিকে।
এক কাপ কফি হাতে মাত্রই বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে দিগন্ত। বিকালের এই সময়টা বেশীরভাগ বেলকনিতে কাটায় সে। ব্যস্ত শহরের মানুষ জনের ছুটেচলা দেখে সে। কফির মগে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে কফির স্বাদ অনুভব করতেই তার ফোন বেজে উঠলো। টাওজারের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো তাতে আব্বা নামটা জ্বলজ্বল করছে। মাশহুদ তালুকদার কল করেছে। এখন কল রিসিভ করলেই ঞ্জানের কথা শুনাবে সে। আর ভূমিকাকে চাইবে। তাই এই মুহূর্তে কল রিসিভ করবে না সে। রিংটোন মিউট করে আবার মোবাইল পকেটে পুরে দিলো। অতঃপর সে কফির স্বাদ গ্রহন করতে লাগলো।
সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না আরাভের। দু-চোখ বন্ধ করলেই ভূমিকার সেই অসহায় কাঁদো মুখটা ভেসে উঠতো ওর চোখে পাতায়। আরাভের মনে হয়, সেদিন বৃষ্টিতে ভূমিকার কাছে না গেলেই হয়তো ভালো করতো।অন্ততপক্ষে তার রাতের ঘুমটা চলে যেত না। শান্তিতে দু- চোখের পাতা এক করতে পারতো।
পরেরদিন সকাল হতে না হতেই অফিসে হাজির হয় আরাভ। এত সকালে আরাভকে অফিসে দেখে সকলে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। সাধারণত আরাভ এগারোটার আগে অফিসে আসে না। আর সেদিন সকাল নয় টায় অফিসে হাজির হয় সে। নিজের কেবিনে বসে অপেক্ষা করতে থাকে কখন ভূমিকা আসবে। আর ওর থেকে সবটা জানবে। দিগন্তের মতো একটা স্বামি থাকতেও কেন তাকে চাকরি করতে হবে!!
এদিকে ভূমিকা লিফট থেকে নামার সময় তার উড়নাটা আটকে যায়। বাহিরে দাঁড়িয়ে উড়না নিয়ে টানাটানি করছে ভূমিকা। একটা সময় উড়না ছুটে যায় আর ভূমিকা কিছুটা পিছিয়ে যায়। পিছিয়ে যায় বললে ভূল হবে আসলো কারো গায়ের উপর পরে যায়। সে ভূমিকাকে ধাক্কাদিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
-এই বেয়াদব মেয়ে, চোখ নাই তোমার?? ভূমিকা লোকটার দিকে ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো। মাধ্যবয়স্ক একটা লোক। মাথার সবগুলা চুলই কালো। স্বাভাকিকের তুলনায় বেশী কালো। ভূমিকার বুঝতে অসুবিধা হলো না লোকটা মাথায় কলপ নিয়েছে। কালো প্যান্ট তার উপরে নীল নীল একটা শার্ট পরিধান করেছে। চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তার। মনে হয় তার উপর ভূমিকা নয় কোন এলিয়েন পরেছে। লোকটা শার্ট ঝাড়া দিতে দিতে বলল,
-দিলে তো আমার শার্টটা নষ্ট করে। কালই বউ আমার শার্টটা ধুয়ে আইরন করে দিয়েছে। চোখ নাই তোমার দেখে হাটতে পারো না। চোখ কপালে নাকি তোমার।
লোকটার কথায় ভূমিকা কেবলাকান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে ওনার শার্ট পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত। আসলে শার্টটা কোথায় নষ্ট হয়েছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভূমিকা ব্যর্থ,। লোকটাকে দেখে কেন জানি ভূমিকার মনে হলো তাকে একটু বিরক্ত করা যাবে। তাই সে বলে উঠলো,
-আমার চোখ তো কপালে। আপনার চোখ কোথায়?? আপনি কি চোখ পকেটে নিয়ে হাটছিলেন??
-আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো তুমি। আমার মুখের উপর কথা বলছো। তুমি জানো আমি কে??
-এমা, আপনি জানেন না কে আপনি?? ওকে আমি এখনি সোসাইল মিডিয়ায় আপনার একটা ছবি আপলোড করে দিচ্ছি। কেও যদি আমাকে চিনে থাকে তাহলে সে আপনার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করবে। মোবাইল বের করে মুখ টিপে হেসে বলল ভূমিকা।
-এই মেয়ে এই মেয়ে তুমি কিন্ত বেশী বকছো। ভূমিকা এবার দু-ঠোট প্রসারিত করে হেসে দিলো। আর লোকটা তার শার্ট ঠিক করতে ব্যাস্ত। তখনি পিছন থেকে কেও বলে উঠলো,
-ম্যানেজার কাকা আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?
পুরুষনালী কন্ঠশ্বর শুনে ম্যানেজার পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ভূমিকার সেই লোকটার দিকে দৃষ্টি দিলো। লম্বা শ্যামবর্ণের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা পকেটে হাতগুজে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে আছে। পড়নে কালো প্যান্ট, নীল শার্টের উপর কালো টাই ঝুলানো। ভূমিকা বুঝতে পারছে সবাই কেন নীল শার্ট পরে আছে। যাগগে বাধ দেই সে সব কথা। ওটা ভূমিকার চিন্তার বিষয় না। আজ তার একটা চাকরি পেলেই হলো।
-ম্যানেজার কাকা এখনো এখনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছে। যান, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করুন। নাহলে আজ কিন্তু আপনার ছুটি হবে না। আর বাড়ি ফিরে বউয়ের হাতে রান্না করা খাবারও খেতে পাড়বেন না । ছেলেটার কথায় ম্যানেজার বিরক্তি মুখ করে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-সব হয়েছে এই মেয়েটার জন্যে। আমি তোমাকে পরে দেখে নিবো।আগে কাজ শেষ করে আসি। কোন রকমে কথাগুলো বলে একপ্রকার দৌড়ে সে চলে গেলো সে। ম্যানেজার চলে যেতেই ছেলেটা বিকট শব্দে হেসে উঠলো। ভূমিকাও হাসলো তবে সেটা সামান্য। ম্যানেজার যে বউ পাগলা এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।
-বাই দ্যা ওয়ে। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। নতুন নাকি?? ছেলেটার ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে ভূমিকা নিজেকে কিছুটা সংযত করে বলল,
-আসলে আমি আজই প্রথম এলাম। চাকরি খুজে।
-ওও আচ্ছা, আপনি তাহলে সেই। আসুন। স্যার আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছে। অতঃপর ভূমিকা সেই ছেলের পিছুপিছু আরাভের রুমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
চলবে,,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।