#বেলা_শেষে। [১২]
দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে অনুষ্ঠানের দিন। মাশহুদ তালুকদার তার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। দিগন্ত আর ভূমিকা দুজনে এখন আলাদা রুমেই থাকে। ভূমিকা এখন দিগন্তের সাথে প্রয়োজনের বাহিরে তেমন কথা বলে না। কি দরকার আছে শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে। সেদিনের পর থেকে ভূমিকাও এই সত্যিটা মেনে নিয়েছে। যার প্রতি মায়া বাড়িয়ে কোন লাভ নেই, সেখানে মায়া না বাড়িয়ে মায়া কাটাতে শিখতে হয়। ভূমিকার এখন একটাই লক্ষ মন দিয়ে পড়াশুনা করে অনেক বড় আইনজীবী হওয়া। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করছে ভূমিকা। আজ ওদের কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান। সবাই মিলে ঠিক করেছে মিষ্টি কালারের শাড়ি পড়ার। ভূমিকাও আজ মিষ্টি কালারের শাড়ি পড়েছে। শাড়ির আঁচল ঠিক করা শেষ হলে মাথার চুলগুলো বেনুনি করে কাদের এক সাইডে নামিয়ে দিলো। চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো। ঠোটে গাঢ় লিপস্টিক। তারপর দু-হাত ভর্তি চুড়ি পড়ে আয়নাতে নিজেকে একবার দেখে নিলো ভূমিকা। না মন্দ লাগছে না তাকে। বেশ ভালোই লাগছে। এখন তার মা থাকলে কত কি যে করতো। পুরনো দিনের লোকের মত করে শরীরের কোন এক অংশে কালি লাগিয়ে দিতো না হলে শুকনো মরিচ পুরো শরীরের চারিদিকে ঘুড়িয়ে সেটা পুড়িয়ে দিতো। যাতে ওর উপর কারো নজর না পরে। মায়ের সেই বাচ্চামোর কথা মনে পড়তেই মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর বিরবির করে বলল,
-খুব শিগগীরি তোমাদের কাছে ফিরে আসবো মা।
অতঃপর ভূমিকা কলেজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়। দিগন্ত ওর আগেই বেড়িয়ে গিয়েছে। যেহেতু দিগন্তদের উপর দায়িত্ব পড়েছে তাই ওকে আগেই যেতে হয়েছে।
দিগন্ত ও তার বন্ধুরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রধান অতিথির জন্যে। এই কলেজে প্রধান অতিথি হয়ে আছেন, বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী খন্দকার আজহার মওদুদ। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে স্যারদের সাথে কথা বলছে আরাভ। এই অনুষ্টানের সমস্ত ভালো মন্দ দেখভালের দায়িত্ব তার। সকলে মিলে যখন প্রধান অতিথির জন্যে অপেক্ষা করছে তখনি কলেজে আগমন ঘটে ভূমিকার। মিষ্টি কালারের শাড়ি আর গর্জিয়াছ সাজে ভূমিকাকে একদম পরির মতো লাগছে। ভূমিকাকে এই রুপ দেখে ভ্রু কুচকিয়ে ভূমিকার দিকে তাকালো দিগন্ত। এর আগে কখনো ভূমিকাকে এই সাজে দেখেনি সে। দিগন্তের নজর বারবারই তার প্রিয়সি মিমির দিকেই ছিলো। তাছাড়া অন্যকোন মেয়ের দিকে খুব একটা নজর দেয়না সে। এমনকি ভূমিকার দিকেও নয়। ভূমিকা দিগন্তের চোখের নজর এড়িয়ে চলে আসলো কলেজের ভেতরে। মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে নিতু আর রাতুলকে খুজছে ভূমিকা। এদিকে আরাভ কথা বলার ফাঁকে লক্ষ করলো মাঠের এক পাশে আসমানি পরি নেমে আসছে। সে কয়েকটা পা এগিয়ে গেলো সেই পরির দিকে। ততক্ষণে নিতু আর রাতুল এসে গেছে। রাতুল এসে ভূমিকার সামনে দাঁড়িয়েছে। যার কারনে আরাভ পরিটাকে দেখতে পারছে না। শুধু বাতাশে দোল খাওয়া শাড়ির আচল দেখতে পাচ্ছে।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েগেছে। আজহার মাওদুদ আসার দশ মিনিটের মধ্য অনুষ্ঠান শুরু হয়েগেছে। প্রধান অতিথী কে নিয়ে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।যারা যারা গানে নাম দিয়েছে তারা সকলে গাইছে। এবার ডান্স পারফরমেন্স হবে। ভূমিকা রাতুলকে নিয়ে মেকাপ রুমে চলে যায়। কারন তার ডান্সের জন্যে তাকে নতুন করে মেকাপ করতে হবে। এদিকে ভূমিকাকে ফলো করছে মাহিন। আজই সুযোগ, সকলে অনুষ্টানের জাঁকজমকে ব্যস্ত। এই সুযোগ মাহিন কিছুতেই মিছ করতে চায়না। রাতুল আর ভূমিকা মেকাপ রুমে যাওয়ার পর এদিকে সকলে ডান্স পারফরমেন্স করতে থাকে। দিগন্তের মিমির ডান্সও শুরু হয়ে যায়। সকলে মুগ্ধ হয়ে ওদের কাপল ডান্স দেখে। মিমি আর দিগন্তের সম্পর্কের কথা প্রায় পুরো কলেজের সকলের কাছে জানা। তিন বছরের রিলেশন ওদের। আজকের ডান্স পারফরমেন্সের পর ওদের সেরা কাপল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এবার একটা দলীয় নৃত্য পরিবেশন হবে। এটা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে মেয়েরা মিলে করছে। তারপরেই হবে ভূমিকা আর রাতুলের পারফরমেন্স। ভূমিকা শাড়ি চেঞ্জ করে একটা লেহেঙ্গা পড়ে নেয়। তার সাথে সিম্পল কিছু জুয়েলারি পরে রেডি হয়ে স্টেজের পাশে এসে দাঁড়ায়। দলীয় নৃত্যটা করা হয়েছে রবি ঠাকুরের মন মোর মেঘেরও সঙ্গী গানের সাথে। গানটা যেমন অসাধারণ তেমনি অসাধারণ ভাবে নাচের প্রতিটা স্টেপ তুলে ধরা হয়েছে। ভূমিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দলীয় নৃত্য দেখছে।
দলীয় নৃত্য পরিবেশন শেষ হলে, ভূমিকা আর রাতুলের নাম এনাউজমেন্ট করা হয়। পরপর দু-বার নাম ডাকার পর ভূমিকা রাতুলকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সে রাতুলকে তার আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না। এদিকে বারবার ভূমিকার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। ভূমিকা স্টেজে উঠে দাঁড়ালো আর অপেক্ষা করতে লাগলো রাতুলের জন্যে। প্রায় মিনিট দশেক স্টেজে দাঁড়িয়ে রইলো ভূমিকা কিন্তু রাতুলের দেখা মিলল না। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভূমিকার দিকে। ভূমিকার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে এখন। এবং লজ্জাও লাগছে। এই রাতুলটাও না এই সময়ে আবার কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো। একবার শুধু সামনে পাই তারপর দেখাবো ওকে মজা। ভূমিকার ভাবনার ছেদ ঘটলো দিগন্তের কথায়,
-রাতুল নেই তুমি স্টেজ থেকে নেমে এসো আর না হলে একা কোন ডান্স পারফরমেন্স করো।
দিগন্তের কথায় স্মিত হাসলো ভূমিকা, কেন হাসলো সেটা জানা নেই তার।তারপর দিগন্তের দিকে ভালো করে লক্ষ করলো। মিমি দিগন্তের এক হাত জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বড় করে শ্বাস নিলো ভূমিকা, তারপর মাথা নিচু করে স্টেজ থেকে নামে আসলো। স্টেজ থেকে নেমে দু- পা সামনে আসতেই আরাভ এসে ভূমিকার একটা হাত ধরলো। আরাভ ভূমিকার হাত ধরেছে দেখেই ভূমিকার গা জ্বলে যাচ্ছে। রাগে কটমট করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে আরাভ বলল,
-হাত ধরার জন্যে সরি। চলুন পারফরমেন্স করবেন??
-মানে??
ভূমিকার কথার জবাব দিলো না আরাভ। ভূমিকাকে টেনে নিয়ে সোজা স্টেজে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দু-হাতে স্টিক নিয়ে বলল,
-সেদিনের স্টেপগুলোই তো।
-হুম। বলেই দিগন্তের দিকে তাকালো ভূমিকা। দিগন্ত বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভূমিকা তার নজর নামিয়ে সামনে তাকালো।
তারপর দুজনে মিলে কাঠি দিয়ে কাপল ডান্স করতে লাগলো। এদিকে স্টেজের উপর আরাভকে দেখে সকলে শকড্। পাচ বছর এই কলেজে পড়াশুনা করেছে আরাভ। কখনো কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেনি ওকে। আর এখন কিনা সে একটা মেয়ের সাথে ডান্স করছে। আরাভের সাথে ভূমিকাকে ডান্স করতে দেখে দিগন্তের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। তবুও ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। আজহার মাওদুদ তার নাতির ডান্স পারফরমেন্স দেখে মুখ টিপে টিপে আসছে। এতক্ষণ একটা টেনশনের মধ্যে থাকলেও এখন তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। ভূমিকা আর আরাভের ডান্স শেষ হলে ভূমিকা দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে আসে। আরাভ সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চারিদিকে সবার করতালি আর উল্লাস দেখে মৃদু হাসে আরাভ। তারপর সেও নেমে আসে।
ভূমিকা দৌড়ে স্টেজ থেকে অনেকটা দূরে চলে যায়।পুকুরের কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর পুকুরের পানিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে,
-যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে কি পাড়তো না এই লজ্জার হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে। কেন অন্য একজনকে এসে সাহায্যের হাত বাড়াতে হলো। দু-চোখ বন্ধকরে নিলো ভূমিকা। আর তখনি দিগন্ত আর মিমি দুজনের হাসিমুখ দেখতে পায় সে। চট করে চোখ খুলে ভূমিকা আর মনে মনে বলে, আমি একটু বেশীই ভাবছি, গত পাচ মাসে যেটা হয়নি সেটা আধো হওয়ার সম্ভবনা নেই।
আন্টি আমার বেলুনটা একটু এনে দাওনা। একটা ছোট বাচ্চা ভূমিকার লেহেঙ্গা টেনে বলল।ভূমিকা নিচের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে দেখেই মৃদু হাসলো। তারপর বাচ্চাটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-তোমার বেলুন কোথায়??
-উপরে একটা আংকেল নিয়ে গেছে। বলছে তুমি না গেলে সে আমাকে বেলুন দিবে না।
বাচ্চাটার কথা শুনে ভূমিকা কাপাল কুচকালো। আমি না গেলে বেলুন দিবে না। কিন্তু কেন?? কে নিয়েছে বেলুন? ব্যপারটা সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে।
-আচ্ছা কোথায় নিয়ে গেছে তোমার বেলুন? বাচ্চাটি তার হাতের ইশারায় তিনতালার একটা রুম দেখিয়ে দিলো। অতঃপর ভূমিকা চলে যায় বেলুন আনতে।
রুমের ভেতরে ডুকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুতেই দেখতে পেল না সে। দরজা খুলার পরে একটু আলো পেয়েছে। এখানে তো অন্দকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছি না। দরজাটা পুরো খুলে দিলো ভূমিকা। কারন সেখানে সামান্যতম আলো আছে সেখানে অন্ধকার কিছুতেই জিততে পারে না।
-আরে বেবী আসো আসো। আমি তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি। পুরুষনালী ভয়েজ শুনে থমকে দাঁড়ায় ভূমিকা। কারন এটা তার পরিচিতি কন্ঠ। ভূমিকা শক্ত গলায় বলল,
-মাহিন আপনি???
-চিনতে পেরেছো তাহলে। রুমের লাইট অন করে দিলো মাহিন। তারপর এসে দরজাটা লক করে দিলো। ভূমিকা মাহিনকে আটকাতে ব্যস্ত।
-কি করছেন আপনি দরজা কেন আটকাচ্ছেন??
-সেদিন যেটা অসমাপ্ত ছিলো আজ সেটার সমাপ্তি হবে।বলেই পৈশাচিক হাসি হাসলো মাহিন। মাহিনের কথা শুনে বুকটা ছেদ করে উঠলো ভূমিকার। তবে কি হেরে যাবে সে। না সব কিছু এভাবে শেষ হতে পারে। আমি হারবো না। দুর্বল নই আমি। আমি কিছুতেই হারতে পারিনা। ভূমিকার চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। যেখানে সব মেয়েরা নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্যে অপর মানুষটার হাতে পায়ে ধরে আকুতি মিনতি করতে থাকে। সেখানে ভূমিকা নিজেকে তৈরী করছে লড়াই করার জন্যে। তবে কি ভূমিকা পারবে নিজের সম্মান রক্ষা করতে। নাকি এই পুরুষ শাসিত সমাজের কাছে হেরে যাবে সে।
চলবে,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।