#বেলা_শেষে। [০১]
বন্ধুমহলে নিজের স্ত্রীকে কাজের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দিলো দিগন্ত। দিগন্তের কথায় একটুও অবাক হয়নি ভূমিকা। দিগন্ত ভূমিকাকে কখনও স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না এটা খুব ভালো করেই জানে। বিয়ের পাঁচ মাসে এইটুকু বুঝে গেছে ভুমিকা। দিগন্তের সব বন্ধুরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ভুমিকার দিকে। ভূমিকা করুন চোখে দিগন্তের দিকে তাকালো। তখন দিগন্তের মুখ ছিলো হাস্যউজ্জল। হেসে হেসে বন্ধুদের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত সে। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে চলে আসলো ভূমিকা। রান্নাঘরে এসে অঝর ধারায় কান্না শুরু করে ভূমিকা।
হাতের উল্টাপিঠে দু চোখের পানি মুছে নেয় ভূমিকা। এখন তার কাঁদলে চলবে না। সে তো কাজের মেয়েই। দিগন্ত তো কোন ভুল বলে নি। উহঃ এখনও কত কাজ করার বাকি দিগন্তের বন্ধুদের জন্যে চা বসাতে হবে। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে চা বানাতে শুরু করে ভুমিকা।
এদিকে দিগন্ত ওর বন্ধুদের সাথে গল্পে মশগুল। হেসে হেসে সবার সাথে গল্প করছে সে। মাহিন, মানে দিগন্তের এক বন্ধু তাকিয়ে আছে রান্নাঘরে থাকা সেই রমনীর দিকে।ঘর্মাক্ত শরীর, মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠে লেপ্টে আছে। লালসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই রমনীর দিকে। দিগন্ত বিষয়টা খেয়াল করলেও তেমন পাত্তা দেয়না। দীর্ঘ দুই মাস পর বন্ধুদের সাথে দেখা। এখন তাদের সাথে বসে গল্প করাই দিগন্তের একমাত্র লক্ষ। সবাই যখন কথা বলায় ব্যাস্ত মাহিন নিঃশব্দে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
মাহিন রান্নাঘরে আসতেই তার চোখ পড়ে ভূমিকা শাড়ির আঁচল গুজে থাকা সেই অবাধ্য স্থানে। লালসার দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ভূমিকা চা বানানো শেষ প্রতিটা কাপে চা ঢেলে নেয়। এরপর একটা ট্রেতে করে চায়ের কাপ নিয়ে পিছনদিকে ঘুরতেই তার সামনে পরে মাহিনের লালসাদৃষ্টি। ওষ্ঠের উপর হাত বুলিয়ে মিটমিট করে হাসছে মাহিন। মাহিনের চাহনি দেখে ভুমিকা ভয়ে কুকড়িয়ে উঠে। শুকনো ডুগ গিলে কাপাকাপা গলায় বলে,
-আ- আপনি এখানে? কিছু লাগবো?? মাহিন হাত দিয়ে তার গলে স্লাইড করে দুপা এগিয়ে ভুমিকার সামনে দাঁড়ায়।ঠোটের কোনে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বলে,
-তোমাকে লাগবে ডার্লিং।
-মা- মানে??
-কামওন ডার্লিং এত ভয় কেন পাচ্ছো। শুনো আমি জানি তুৃমি কাজের মেয়ে নও। কাজের মেয়ে কখনও এত দামি শাড়ি পরে না। তোমাকে একটা অফার দিচ্ছি, আমাকে বিয়ে করবে। মাহিন তোমাকে কাজের মেয়ে করে রেখেছে আমি তোমাকে রাজরানি করে রাখবো।আর না হলে আমাকে একটা দিন দাও তোমাকে এত টাকা দিবো। সারাজিবন বসে খেতে পারবে। মাহিনের কথা বলা শেষ হতে না হতেই ভূমিকা ওর গালে চড় বসিয়ে দেয়। চড়টা এত জোরে দিয়েছে যে সেই শব্দটা দিগন্ত ওর তার বন্ধুরাও শুনতে পেয়েছে। মাহিন এক গালে হাত রেখে ক্রোধান্বিত হয়ে ভূুমিকার দিকে তাকাতেই, ভুমিকা মাহিনের আরেক গালে চড় বসিয়ে দেয়। তারপর চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
-আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে খারাপ প্রস্তাব দেওয়ার। শুনুন আমরা গরীব হতে পারি তবে এটাও গরীব নয় যে নিজের সম্মান বিক্রি করে দিবো। আমাদের সম্মানটাই সম্বল। এটা নিয়েই গর্ব করে বেঁচে থাকি আমরা।আর আপনি আমার সম্মান বিক্রি করার কথা বলছেন।
-কি হচ্ছে এখানে?? দিগন্তের কথায় ভূমিকা ও মাহিন দুজনেই পিছনে তাকায়।দিগন্তকে দেখে মাহিন গালে হাত দিয়ে দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-কাজের লোক দিয়ে এভাবে অপমান করাবি। আগে জানলে কখনোও আসতাম না। মাহিনের কথা শুনে দিগন্ত ভূুমিকার দিকে তাকালো। ভূমিকা অসহায় মুখ নিয়ে দিগন্তের মুখ পানে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ভূুমিকার শরীর হাত পা কাঁপছে।
-কি হয়েছে ভূমি?? দিগন্তের শান্ত বাক্য শ্রবণ করেই এক টুকরো আশার আলো খুজে পায় ভুমিকা। মনে মনে এক অদ্ভুত সাহসের সুচনা হতে থাকে। তখনি মাহিন বলে উঠে,
-ওই মেয়েটা কি বলবে দিগন্ত, আমি বলছি।দিগন্ত মাথা ঘুড়িয়ে মাহিনের দিকে তাকায়। তখন মাহিন বলে,
-একটা কাজের মেয়ের কথা শুনে তুমি আমার জার্জ করবি?? কাজের মেয়ে হয়ে আমার গায়ে হাত তুলল আর তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস। মাহিনের বাকি বন্ধুরা তাকিয়ে আছে দিগন্তের মুখের দিকে। তারা মাহিন কে ভালো করেই চেনে। ওর ওভার এক্টিন সম্পর্কে সবাই অবগত। তাই তো সবার দিগন্তের মতামতের অপেক্ষা করছে। দিগন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে ভূুমিকার দিকে। আচ্ছা ফাজিল মেয়েতো। মুখে কি সুপারগ্লু লগিয়ে রেখেছে নাকি। স্টুপিড মেয়ে একটা। দিগন্ত বুঝতে পারছে ভূমিকা এখন কিছু বলতে পারবে না। তাই সে নিজেই বলে উঠলো,
-মাহিন, ভুমির কাছে ক্ষমা চা। ভূমিকা চোখ বড়বড় করে দিগন্তের দিকে তাকালো। ভূমিকা ভাবতেও পারেনি দিগন্ত এমন একটা কথা বলবে।
-হোয়াট, আমি ক্ষমা চাইবো তাও আমার একটা কাজের মেয়ের কাছে। ইম্পসিবল।
-পসিবল, সব ই পসিবল মাহিন। ভালোই ভালোই ক্ষমা চেয়ে নি। আমরা সবাই জানি তুই কিছু একটা করছোস। আর তুই তো ভালো করেই জানিস দিগন্ত কোন মেয়ের অস্মান করে না। হোক সেটা কাজের মেয়ে । [তপু]
তপুর মুখে কাজের মেয়ে শব্দটা শুনে ভূমিকা ছলছল দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে তাকালো। দিগন্ত ভূমিকার চাহনি উপেক্ষা করে মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-এখনো দাঁড়িয়ে আছিস যে, ক্ষমা চাইতে বললাম না তোকে।
-সামান্য একটা কাজের মেয়ের জন্যে আমাকে অপমান করছিস। আগেই বলতে পারতি আসতাম না তোর বাসায়। বলেই ভূমিকার দিকে ক্রোধান্বিতা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাহিন। তারপর হনহন করে বেড়িয়ে যায় দিগন্তের বাসা থেকে। তপু, ইভান সবাই এক এক করে প্রস্থান করে।
নিজের রুমে ফ্লোরে বসে কাঁদছে ভূমিকা। এতটা অপমান সে আগে কখনও হয়নি।হ্যা দিগন্ত তাকে স্ত্রী হিসাবে মানে না। তাই বলে কাজের লোকের পরিচয় দিবে। স্ত্রী পরিচায়টা দিলে কি এমন ক্ষতি হতো। তাহলে তো মাহিন এত খারাপ কথাগুলো বলতে পারতো না। ওকে বাজে প্রস্তাব দিতে পারতো না। উল্টে দিগন্তের বউ হিসাবে ওকে সবাই সম্মান করতো। দিগন্ত কি সত্যিই তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় টেরই পায়না ভূমিকা। এদিকে ডিনারের সময় ভূমিকাকে ড্রাইনিং রুমে দেখতে না পেয়ে ভূমিকার রুমে আসে দিগন্ত। আজ সারাদিনের কাজে ভীড়ে ঠিক মতো খাওয়া হয়নি ভূমিকার। তার উপর মাহিনের বাজে ব্যবহার। দিগন্ত ঠিক করলো সে মাহিনের হয়ে ভূমিকার কাছে মাফ চাইআে। রুমে এসে ভূমিকাকে এভাবে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে দেখে দিগন্তর রাগ হয় বেশ। আচ্ছা ফাজিল মেয়েতো। বিছানা থাকতে ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এই মেয়ের কোন কান্ডঞ্জান নাই নাকি। ডিনার না করেই ঘুমিয়ে আছে। এই ভূমি, ভূমি,,,
দু-বার ডাক দিতেই চোখ আখি খুলে ভূমিকা। টেনেটুনে শাড়ি ঠিক করে সোজা হয়ে বসে। তারপর গম্ভীর গলায় বলে,
-কিছু লাগবে আপনার??
-এখানে এভাবে ঘুমিয়ে আছো কেন?? রুমে এত বড় বিছানা থাকতে ফ্লোরে শুয়ে আছো কেন??
-কাজের লোকেদের এত নরম বিছানায় মানায় না।তাদের জন্যে ফ্লোরটাই ঠিক আছে। দিগন্ত বুঝতে পারলো ভূমিকা তার উপর রেগে আছে। সকলের সামনে কাজের লোকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বলে ভূমিকার মান বেড়েছে। ঠোট কামড়িয়ে উপর দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিলে দিগন্ত তারপর বলল,
-ডিনার করে নাও।
-আপনি মেয়ের খুব সম্মান করেন তাইনা। শুধু আমার বেলায়তেই কেন নয়??
-মেয়ে হিসাবে তোমাকে যথেষ্ট সম্মান করি ভূমি। বাট স্ত্রী সম্মান আমার থেকে কখনো এক্সপেক্ট করো না।
-কিন্তু কেন?? মানছি বিয়েতে আপনার মত ছিলো না। আমার দোষটা কোথায়??
-তোমাকে আগেই বলেছি আমি তোমাকে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না। বন্ধুদের সামনে তোমাকে নিজের স্ত্রী বলে স্বীকার করলে সেটা অবশ্যই মিমির কান পর্যন্ত পৌঁছাতো। একথা মিমি শুনলে ও হয়তো সুইসাইড ও করতো পারে। আর আমি কোন অবস্থায় মিমিকে হারাতে পারবো না। কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ায় দিগন্ত। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ডিনার করে বিছানায় ঘুমাও। আমাকে বের হতে হবে। আর হ্যাঁ কোন অবস্থাতেই বাহিরে বের হবে না। ভূমিকা মাথা নাড়িয়ে দিগন্তের কথার সম্মতি জানায়। অতঃপর দিগন্ত চলে যায়।
দিগন্তের চলে যাওয়ার পর ভূমিকা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় চলে আসে। রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে ওই অন্ধকার আকাশের দিকে। যেখানে একটা চাঁদকে ঘিরে লক্ষ কোটি তারার মেলা। চাঁদের জ্যোৎস্না চারিদিকে সব কিছু ঝলঝল করছে। এই জ্যোৎস্নাময় রাতে একা দাড়িয়ে ভাবতে থাকে সেদিনের কথা। সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো। ভূমিকা বউ সেজেছিল বর এসেছিল, ভূমিকা মনে ছিলে ওর স্বামিকে নিয়ে নানা কল্পনা জল্পনা। চারিদিকে সকলের হৈচৈ। ভূমিকার বাড়িতে সবাই বর দেখার মেলা বসিয়েছিলো। বিয়ের আসরে যখন সবাই ভূমিকাকে কবুল বলার জন্যে তাড়া দিচ্ছিলে তখন ওর হবু বরের বাবা বলে উঠলেন,
-বিয়ে বন্ধকরুন। এই বিয়ে হবে না। চারিদিকে স্তব্ধ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে।এই পিনপতন নিরবতায় মাঝে ভূমিকা খেয়াল করলো তার হবু বরের বাবার পাশে তার বাবা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। ভূমিকা ছলছল দৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকালো। ভুমিকার বাবার দু- চোখ পানিতে ছলছল করছে। কিন্তু কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না ভুমিকা।খুব খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে ভূমিকার সাথে। কারন বাবারা সহজে কাদে না।
চলবে,,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।