বেড়াজাল পর্ব-১৯+২০

0
573

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #১৯

হালকা ঠান্ডার আমেজ। মৃদু বাতাস বইছে বাইরে আর তার দাপটেই নড়ছে রুমের জানালার পর্দা গুলো। এইসব কোনদিকেই খেয়াল নেই রুমের ভিতরের দুটি মানুষের তারা নিজেদের মতো মত্ত একে অপরে।
কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর সিয়াম চন্দ্রাকে ছেড়ে তার কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। দুজনের শ্বাসের গতিই অস্বাভাবিক।

সিয়াম চন্দ্রার মুখটা আলতো হাতে তুলে চোখের কোনের জলটুকু মুছে বললো ” শান্ত হও চন্দ্র। এই দিনটা একদিননা একদিন আসারই ছিলো। তোমার এখন আমাকে ভালো লাগলেও কিছু বছর ঠিকই বোঝা মনে হবে…”
চন্দ্রা কথা শেষ করতে দিল না তার আগেই রিনরিনে কণ্ঠে বলে উঠলো ” আমার এটা ক্ষণিকের আবেগ বা ভালোলাগা নয় সিয়াম যে কিছুদিন পর সেটা শেষ হয়ে যাবে। আমি ভালোবাসি তোমায়। তুমি থাকলেও আমার না থাকলেও আমার। তোমার জায়গা আমি দ্বিতীয় কাউকে দিতে পারবো না সিয়াম। প্লিজ আমার থেকে দূরে সরে যেও না। তুমি আমায় ভালো থাকতে বলছো কিন্তু ভালো থাকার দায়িত্ত্ব নিতে চাইছো না এমন কেনো সিয়াম..? কি দোষ আমার বলো..? এইটুকুই যে আমি প্রথমে তোমায় মানতে চাইনি..? নাকি আমার তোমার প্রতি ভালোবাসা ধীরে ধীরে জন্মেছে..? আচ্ছা আচ্ছা তুমি কি আগের দিনের ডায়রির কথাটা নিয়ে রেগে আছো..?তুমি বিশ্বাস করো আমি ওভাবে রিয়্যাক্ট করতে চাইনি খুব টেনশনে ছিলাম তাই ওসব বলে দিয়েছি।” বলেই আবার আগের মত কাঁদতে শুরু করলো চন্দ্রা। এবার তার কান্নার সাথে শরীরও থর করে কাঁপতে লাগলো। চন্দ্রা নিজের অজান্তেই টেবিলের পাশে থাকা কাঁটা চামচ চেপে ধরলো হাত থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়া শুরু হলো। চন্দ্রার মুখ বিকৃত হতে দেখে সিয়ামের নজর গেলো চন্দ্রার হাতের দিকে। সিয়ামের বুকটা এবার কেঁপে উঠলো। কি করছে কি মেয়েটা তার জন্য নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে..?
সিয়াম এক ঝটকায় চন্দ্রার হাত থেকে চামচটা কেরে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ” প্লিজ স্টপ চন্দ্র। হোয়াট আর ইউ ডুইং..?”
বলেই সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো শক্ত করে। চন্দ্রাও পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো সিয়ামকে। কিন্তু কান্না থামালো না।”
সিয়াম কিছুক্ষন মাথায় হাত বুলানোর পরও দেখলো চন্দ্রার কান্না থামলো না উল্টে হিচকি ওঠা শুরু হয়ে গেলো।
সিয়াম আর থাকতে না পেরে চন্দ্রাকে বললো ” প্লিজ স্টপ ক্রাইং চন্দ্র। আমি কোথাও যাচ্ছি না তোমায় ছেড়ে এমনকি তুমি বললেও না। তুমি ভাবলে কীকরে যেই মানুষটা সারাজীবন তোমায় আগলে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে সে তোমায় এতো সহজে ছেড়ে দেবে..?”
চন্দ্রার কিছুটা সময় লাগলো বুঝতে। কথাটা মাথায় পৌঁছাতেই ঝট করে সিয়ামের বুক থেকে মাথা তুলে “মানে কি বলতে চাইছো..? তাহলে ঐ ডিভোর্স পেপারের মানে..?”
সিয়াম মুখে এবার একটা তির্যক হাসি খেলে গেলো।
–খুলেই দেখেছোকি কি আছে অতে..?
চন্দ্রা এবার কথার উপর কথা না বলে পাশ থেকে ঝট করে সেই খামটা তুলে নিলো। তার চোখের জল পড়ার দরুণ খামটা কিছুটা ভিজে গেছে। তোয়াক্কা করলো না চন্দ্রা একটানে ছিঁড়ে ফেললো খামটা। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো শুধু একটা সাদা কাগজ। চন্দ্রা হতভম্ভ কাগজটার এপিঠ ওপিঠ খুঁজেই এক বর্ণ লেখা দেখতে পেলো না সে।
এবার সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে আগে থেকেই চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে এই ব্যাপারটাতে খুব মজা পেয়েছে সে।
চন্দ্রা এবার খানিক রাগ দেখিয়ে বললো ” এসব কি আর ডিভোর্স পেপার কই..?”
সিয়ামের হাসিটা এবার একটু চওড়া হলো। ওভাবেই বললো “কই ডিভোর্স পেপার আমি তো কোনো ডিভোর্স পেপার দিইনি তোমায় ওইটা তো শুধু তোমার রিয়াকশন দখার জন্য মজা করেছিলাম।”
চন্দ্রা হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না নিজের মনেই নিজেকে দু চারটে কথা শোনালো। কি এমন হতো তার আগে খামটা খুলে দেখলে। মানুষটা কিভাবে বকা বানিয়ে তার মনের কথা বের করে নিল।

চন্দ্রার এবার ভারী অভিমান হলো সে খামটা টেবিলে রেখে বালকানির সামনের বেতের মোড়াটায় গিয়ে বসে আকাশের দিকে চেয়ে রইল তার কথা বলার ইচ্ছে নেই এখন।
সিয়াম বুঝলো তার প্রিয়তমা এখন তার উপর অভিমান করেছে। সিয়ামও ধীরে ধীরে চন্দ্রার কাছে গিয়ে চন্দ্রার এক হাত নিজের হাতে নিতেই চন্দ্রা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সিয়ামের শক্তির সাথে পারে না উঠে চেঁচিয়ে উঠলো “ছাড়ুন ছাড়ুন আমায় বাজে লোক একটা। একদম ধরবেন না আমায়। জানেন আমার আজ কেমন ফিল হচ্ছিল.? মনে হচ্ছিল দম আটকে যাবে। আর আপনি..? আমি তো আজ নিজের মনের কথা বলবো বলেই এসেছিলাম এরকমটা না করলেও হতো।” বলেই ছলছল দৃষ্টি নিয়ে চন্দ্রা আকাশের দিকে চেয়ে রইল।
সিয়াম বুঝলো ওই অভিমানী চোখের ভাষা। চন্দ্রার চিবুকত ধরে নিজের দিকে ঘোরাতেই টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো চন্দ্রার চোখ দিয়ে।
সিয়াম সেটা হাত পেতে নিজের তালুতে নিলো। চন্দ্রা অবাক হয়ে সেই দিকে তাকালো।
সিয়াম জলটা নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে মুছে নিয়ে বললো ” আর কক্ষনও এই অমূল্য সম্পদ নষ্ট করবে না। যতক্ষণ আমি পাশে থাকবো ততক্ষণ তো নাই।”
” হ্যাঁ আমি জানি তুমি আজ মনের কথা বলতে। তোমার চোখ পরে আমি টা অনেক আগেই বুঝেছি। কিন্তু সেই প্রকাশে তো এত ব্যাকুলতা থাকতো না, আর না থাকতো আমায় এতো হারিয়ে ফেলার ভয়। আমি দেখতে চেয়েছিলাম তোমার মনের ব্যাকুলতা। আর ডায়রির কথা বলছো সেটা আমি একবারও খুলে দেখিনি ব্যাগের পাশে পড়ে ছিলো তাই তুলে ব্যাগে রাখতে গিয়েছিলাম। ”

চন্দ্রার এবার বেশ খারাপ লাগলো। মাথাটা নীচু করে বললো “সরি। আমিই বুঝতে ভুল করেছিলাম।”
সিয়াম এবার মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো “এসব শুকনো সরি টরিতে আমার পোষাবে না বুঝলে।”
চন্দ্রা অবাক হয়ে বললো “তাহলে কি চাই..?”
সিয়াম এবার বাঁকা হাসি দিয়ে নিজের মুখটা চন্দ্রার কানের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বললো “ক্যান আই কিস ইউ অ্যাগেন..?” চন্দ্রার এবার বলার ভাষা রইলো না লজ্জায় গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠলো। সিয়াম নিশ্চুপতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে নিজের হাতটা চন্দ্রার শাড়ির ফাঁকে কোমরে গলিয়ে দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এলো। এবার ডুব দিলো সেই অনন্ত নেশায়। হাতের বিচরণ হলো অবাধ্য। চন্দ্রা এবার থর থর করে কাঁপতে শুরু করলো। সিয়াম আরেকটু জড়িয়ে নিলো তার সাথে।
চন্দ্রার গা থেকে আসা মিষ্টি মনমাতানো সুবাসটা কখন থেকে টানছিল ওকে। তারপর আবার ওই লাল টকটকে ঠোঁট। নিজের স্ত্রীকে এই রূপে দেখে ঘায়েল হয়েছে সে কখন। এতোক্ষণ যে সে নিজেকে এই কাজ থেকে বিরত রেখেছিল এটা তার নিজের কাছেই আশ্চর্যজনক।

দুজনেই যখন দুজনাতে মত্ত ছিলো ওমনি সিয়ামের ফোন বেজে উঠলো সশব্দে বেজে উঠলো। সিয়াম বিরক্ত হয়ে হাতড়িয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। কয়েক সেকেন্ড আবার বেজে উঠলো ফোনটা। সিয়াম এবার ভারী বিরক্ত চন্দ্রার বেশ মজা লাগলো সে মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে। সিয়াম চন্দ্রার এইরাম মিটি হাসি দেখে চোখ ছোটো করে ফোন নিতে নিতে বললো “এর শোধ আমি পরে তুলবই চন্দ্র দেখে নিও। তখন সুনামি আসলেও তোমায় আমি ছাড়বো না তারপর দেখবো এই হাসি তোমার কই থাকে।” চন্দ্রার হাসি মিনিটেই থেমে গেলো গাল গুলো আবার লাল হয়ে উঠলো।

ফোন ধরতেই সিয়ামের মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। উত্তেজিত হয়ে হসপিটালের নাম জিজ্ঞেস করলো। এবার চন্দ্রাও চিন্তায় পড়ল। হলোটা কি মানুষটাকে এভাবে কোনোদিন আগে উত্তেজিত হতে দেখেনি চন্দ্রা।
সিয়াম ফোন রাখতেই চন্দ্রা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে সিয়াম..? কোনো প্রবলেম..?”
সিয়াম ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বললো ” খুব বড়ো প্রবলেম চন্দ্র সিয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করতে চেয়েছে। এখন হসপিটালে ভর্তি। ভাগ্যিস সিরাজ সঠিক সময়ে দেখেছিল নইলে আমার বোনটা আজ..” বলতে বলতে সিয়ামের গলার স্বর কেঁপে উঠলো।
চন্দ্রাও হতভম্ভ সে ভাবেইনি এমন কিছু। সিয়ার ব্যপারটা তার একদম মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। আসলেই এই সময়ে মেয়েটাকে এক মুহুর্ত যেখানে একা ছাড়া উচিত না সে বেমালুম ভুলে গেলো তার কথা।
এসব ভাবতে ভাবতেই সিয়াম তারা লাগলো চন্দ্রাকে চন্দ্রা উঠে চেঞ্জ করে নিলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেকআপ তুলে ফেললো। কারন ঐভাবে হসপিটালে গেলে খারাপ দেখাবে।

___________________________________

সিয়াম চন্দ্রা হাসপাতালে গিয়েই দেখলো সেখানে সিরাজ আর ইন্দ্রা আগে থেকেই বসে আছে। সিয়াম তাড়াতাড়ি গিয়ে সিরাজকে সিয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। সিরাজ জানালো এখন ঠিক আছে চিন্তার কিছু নেই। সিয়াম সস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।
চন্দ্রা আগেভাগে ইন্দ্রাকে দেখে অবাক হলেও এই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলো।
সিয়াকে পরের দিন ছেড়ে দেওয়া হলো। সবাই বাড়ি নিয়ে আসলো তাকে কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলো না এমনটা করার কারণ।

সিয়াকে রুমে শুইয়ে দিয়ে পাশে ইন্দ্রাকে বসিয়ে চন্দ্রা সিয়ামের রুমে এসে দেখলো সিয়াম একমনে কি ভেবে যাচ্ছে। চন্দ্রা বোধহয় সিয়ামের মনের ভিতরটা পড়তে পারলো। সিয়াম যে ভিতরে ভিতরে ভীষণ অনুতপ্ত তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। চন্দ্রার এবার বেশি খারাপ লাগলো সে সিয়ামকে এইসব আগে জানালে হয়তো এতদূর যেত না ব্যাপারটা।

চন্দ্রা সিয়ামের কাছে গিয়ে মুখোমুখি বসলো। সিয়াম চন্দ্রাকে দেখে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বললো “কিছু বলবে..?”
চন্দ্রা উপরনিচ মাথা নাড়লো কিন্তু কিছু বললো না।
সিয়াম এবার মুখ খুললো “আমার কাছে ইতস্তত করো না চন্দ্র মনে যা আছে খুলে বলো।”
চন্দ্রা এবার কিছুটা সময় নিয়ে সিয়ামকে সিয়ার ব্যাপারে সব খুলে বললো। সিয়াম সবটা শুনেও আগের মতই বসে রইলো কোনো রিয়াকশন দিলো না। চন্দ্রা এবার বেশ অবাক হলো সে ভেবেছিল সবটা শুনে সিয়াম হয়তো আজ প্রথমবার তাকে বকবে কিন্তু তার সব ভাবনা মিথ্যে করে দিয়ে সিয়াম শুধুই সবটা শুনলো।

কেটে গেলো নীরবতায় কুড়ি মিনিট। সিয়াম এবার বললো “তোমার দোষ নেই চন্দ্র। দোষ তো আমার আমি নিজের কাজে এতটাই ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিলাম কদিন খেয়াল দিতে পারিনি বোনের দিকে। আমি একটু খেয়াল করলেই আজ এই দিনটা আসতো না।”

চন্দ্রার এবার ভীষণ খারাপ লাগছে একদিকে সিয়ামের জন্য তো অন্য দিকে সিয়ার জন্য। চন্দ্রার এরম বেজার মুখ দেখে সিয়াম বললো ” চিন্তা করো না চন্দ্র। আমি ব্যবস্থা করে নিয়েছি সিয়ার, ওকে আবার নতুন করে জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেটা একজনই পারবে।”
বলেই সিয়াম ফোন তুলে কাকে যেনো কল করে কথা বলতে বলতে বেলকনির দিকে চলে গেলো। চন্দ্রা তাকিয়ে রইলো মানুষটার দিকে।

#চলবে..?

গল্পঃ #বেড়াজাল
লেখিকা: #চন্দ্রাবতী
পর্ব – #২০

সকাল থেকেই চারিদিক পরিবেশ যেনো থম মেরে আছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই বাড়িতে যে যার মতো নিজের কাজ করে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
চন্দ্রাকে দরকারে তার কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়েছে। সিয়ামেরও বাড়ি ফিরতে বেশ কিছু সময় আছে। বাড়িতে আছে বলতে ইন্দ্রা সিয়া ও সিরাজ। সিয়াম ইচ্ছে করেই সিরাজকে আজ যেতে বারণ করেছে। তাই সিরাজ আজ ঘরেই আছে।

ইন্দ্রা সিয়াকে তার ঘরে বসিয়ে রান্নাঘরে গেলো সিয়ার জন্য স্যুপ বানাতে। পুরো স্যুপ বানিয়ে যেই সেটা নামতে যাবে ওমনি পিছন থেকে টুংটাং আওয়াজ পেয়ে পিছনে তাকাতেই সিরাজকে দেখলো ইন্দ্রা। সিরাজও ইন্দ্রাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে হাতের বোতলটা তুলে বললো “জল ভরতে এসেছিলাম। তোমায় ডিস্টার্ব করে থাকলে সরি।”
ইন্দ্রা হালকা হেসে বললো “না না আপনারই কিচেন সরি বলছেন কেনো। নিয়ে নিন জল ।”
সিরাজ সেই শুনে জল ভরতে লাগলো বোতলে। ইন্দ্রা একপলক সিরাজের দিকে তাকালো। একটা স্লিভলেস কলার দেওয়া ব্ল্যাক টিশার্ট পরা পরনে ট্রাউজার। যার ফলে তার মাসাল গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ইন্দ্রা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছুদিন ধরে তার মনের অনুভুতি সে নিজেই বুঝতে ব্যার্থ। কি চলছে আসলে তার মনে..? এই মানুষটার থেকে সে যতই দূরে থাকতে চায় মায়ায় পড়বে না বলে ততই জানো ভাগ্য তাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে চলে আসে। ইন্দ্রা চায় না তার মতো একজন অভাগী কারোর জীবনে যাক।
এসব ভাবতে ভাবতেই সিরাজের কিছু কথা কানে প্রবেশ করলো “ইন্দ্রা স্যুপটা নাবাও এবার ধরে যাবে যে তলাটা।”
ইন্দ্রার ধ্যান ফিরলো এবার। তাড়াহুড়ো করে স্যুপটা নামতে কিছুটা গিয়ে হাতে পড়লো। ইন্দ্রা এবার একটু জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো “আহঃ” বলে।
সিরাজ পিছন ফিরে এই অবস্থা দেখতেই তাড়াতাড়ি করে ইন্দ্রার হাতটা নিয়ে বেসিনের কল খুলে জলের সামনে ধরলো। ইন্দ্রা মুখটা বিকৃত করে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ ভালই জ্বলছে তার হাতটা। সিরাজ ইন্দ্রার। মুখ দেখে হাতে জল দিতে দিতেই বললো “একটু সাবধানে কাজ করলে কি হয়..? সবসময় এমন তাড়াহুড়ো করলে হয়..?”
ইন্দ্রা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে সিরাজের দিকে চাইলো বেশ উদ্বিগ্ন লাগছে তাকে। যেনো স্যুপটা ইন্দ্রার না তার হাতেই পড়েছে।
ইন্দ্রার তাকিয়ে থাকা থেকে তার দৃষ্টিতে চোখ রাখলো সিরাজ। কিছুক্ষন দুজনেই অপলক তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড ইন্দ্রা ব্যতিব্যস্ত হয়ে সিরাজের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে স্যুপের বাটিটা অন্যহাতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে।

সিরাজ চেয়ে রইলো ইন্দ্রার যাওযার পানে। না আর পারা যাচ্ছে না। তার মনের এই খাপছাড়া অনুভুতি ইন্দ্রাকে দেখলেই তার সীমাহীন খুশি অন্যকিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিরাজ আর বেশি না ভেবে জলের বোতলটা নিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

ইন্দ্রা সিয়ার রুমে গিয়ে দেখলো সিয়া নেই। ইন্দ্রা চিন্তায় এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো সিয়াকে। শেষে ব্যালকানিতে গিয়ে নীচে তাকাতেই নিচের বাগানে দেখতে পেলো সিয়াকে। ইন্দ্রার মনে হলো এই সময় টুকু সিয়াকে একা ছাড়াই ঠিক হবে। তাই সেও আর ডাকলো না।

_______________________________

সিয়া আনমনে বসে ফুলগুলো দেখছিল। এখন মাথায় তার শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে পুরানোদিনের জমানো স্মৃতি। একসাথে ঘুরতে যাওয়া একসাথে খাওয়াদাওয়া আতিফের জন্য সিয়ার হাত পুড়িয়ে রান্না শেখার স্মৃতি আরও কত কি। আচ্ছা মানুষ এতো সহজে কিভাবে বদলে যেতে পারে..? তার কি এইসব কথা একটিবারও মনে পরছে না..?কি দিব্যি আছে সে।
সে তো জানতো সিয়ার একমাত্র প্রশান্তির জায়গা শুধুমাত্র আতিফ। তাও সে সব যেনে বুঝে কেনো এসব করলো।
সুইটি বেগম এইসব শোনার পর সিয়াকে দেখতে তো যায়নি বরং উল্টে সিয়া আসার পর গালিগালাজ করেছে তাকে। সিয়াম সিরাজের জন্য খুব বেশি কিছু বলতে পারেনি ঠিকই কিন্তু যা বলেছেন ওটাই যথেষ্ট ছিল সিয়ার জন্যে। তিনি জানিয়েছেন সিয়ার বিয়ে তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততো তাড়াতাড়ি দেবেন। সিয়ারও আর উত্তর দিতে ইচ্ছে হয়নি এখন শুধুই তার মনে হচ্ছে সময় যেখানে নিয়ে যাবে সেও সেই স্রোতেই গা ভাসিয়ে দেবে।
এই সব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই পাশে পরে থাকা জলের পাইপটা হাতে নিল সিয়া গাছে জল দেওয়ার জন্য। সিয়া গাছ গুলোতে জল দিতে দিতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। হটাৎ কারোর চিল্লানোর আওয়াজ পেয়ে সিয়া ভরকে তাকালো সামনের দিকে। হাতের পাইপটা তাড়াহুড়ো করে ফেলে দিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো সামনে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। দেখতে বেশ সুদর্শন ফরমাল ড্রেসআপ।
সিয়া এবার অনুতপ্ত গলায় বলে উঠলো “সরি বুঝতে পারিনি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি কি কাউকে খুঁজছেন..?”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এবার ভ্রু কুঁচকে সিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো “হ্যাঁ খুঁজছি তো অবশ্যই। কিন্তু আপনি আমার যা অবস্থা করলেন তাতে তার সাথে আর এই অবস্থায় দেখা করতে পারবো বলে মনে হয় না।”
সিয়ার এবার খারাপ লাগলো। সে আবার বললো “অ্যাগেন সরি। আপনি আসুন আমার সাথে আমি আপনার ফ্রেশ হওয়ার ব্যাবস্থা করছি। তবে আপনি কার সাথে দেখা করতে এসেছেন বললে ভালো হতো।”
ওপর পাশের ছেলেটি বলল “আমি সিয়ামের সাথে দেখা করতে এসেছি আমি ওর বন্ধু। আর আপনাকে এতো হাইপার হতে হবে না আমি না হয় অন্যদিন আসবো।”
সিয়া এবার তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো ” না সেরাম কিছুই না। আপনি আসুন না ভিতরে আমি বলছি toh সমস্যা হবে না। ভাইয়ার জামা নিয়ে আপাতত চেঞ্জ করে নিন।”
অপরদিকে মানুষটা কি ভাবলো কে জানে তারপর ছোট্ট করে উত্তর দিলো “ওকে”
সিয়া তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলো “আপনার নাম..?”
পাশের ছেলেটার মুখে বোধহয় মুচকি হাসি দেখা গেলো। ওভাবেই উত্তর দিলো “অপূর্ব”
সিয়া শুধু ঠোঁট গোল করে বললো “ওও”
.
.
.
সিয়া অপূর্বকে সিয়ামের ঘরের বাথরুম দেখিয়ে সামনে থেকে সিয়ামের জামা বের করে দিলো একটা।
অপূর্ব ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই সিয়া বললো “আপনি আসুন ডাইনিং রুমে কফি খান। ভাইয়া তো এখনও আসেনি কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসতে পারে।”
অপূর্ব টাই করলো। ডাইনিং রুমে গিয়ে বসতেই সিয়া তাকে কফি দিলো। সিয়া ওয়েট করতে বলে চলে যেতেই অপূর্ব পিছন থেকে ডেকে উঠলো “শুনুন..!” সিয়া পিছনে ঘুরে বললো কিছু বলবেন..?
অপূর্ব ইতস্তত করে বললো “আপনি যদি ফ্রি থাকেন তাহলে একটু বসবেন এখানে না মানে যতক্ষন না আপনার ভাই আসছে।” সিয়া কি ভেবে আর না করলো না চুপচাপ গিয়ে বসলো অপূর্বের উল্টো দিকের সোফায়।
অপূর্বের মুখের হাসিটা কি সামান্য বাড়লো..? কে জানে।
কিছুক্ষনের নীরবতা কাটিয়ে অপূর্বই সিয়াকে প্রশ্ন করলো এক এক করে যেমন সে কি করছে কোথায় জব করে ইত্যাদি। সিয়া খানিক বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বললো না তেমন চুপচাপ পরিমাণ মতো উত্তর দিতে থাকলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সিয়াম চলে এলো। সিয়ামকে দেখে অপূর্ব উঠে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। সিয়ামও এতদিন পর বন্ধুকে দেখতে পেয়ে তাকে আলিঙ্গন করলো।
তারপর দুজনের আড্ডা বসলো। সিয়ার আর ভালো লাগলো না তাই সে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

কিছুক্ষন পর চন্দ্রাও এসে পড়ল। সিয়াম চন্দ্রার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল অপূর্বের। চন্দ্রা সালাম করলো অপূর্ব সালামের উত্তর দিয়ে বলল “এবার বুঝেছি ভাবী আমার বন্ধুটার একসময় এতো পাগলামির কারণ। আপনি আসলেই পুতুলের মত দেখতে।” বলেই ফিক করে হেসে সিয়ামের দিকে তাকাতেই দেখলো সিয়াম চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্রার মাথার উপর দিয়ে গেলো কথাটা। তাই সে আবার অপূর্বকে জিজ্ঞেস করলো “মনে কি বলতে চাইছেন ভাইয়া একটু পরিষ্কার করে বলবেন আমি বুঝলাম না ঠিক।”
অপূর্ব মুখ খোলার আগেই সিয়াম তারা লাগলো চন্দ্রাকে ফ্রেশ হয়ে কিছু নাস্তা নিয়ে আসার জন্যে। চন্দ্রা যেতে না চাইলেও চন্দ্রাকে জোর করে পাঠালো সিয়াম।
চন্দ্রা যেতেই সিয়াম অপূর্বের পিঠে কিল মেরে বললো “এক্ষুনি দিচ্ছিলি তো, প্রেমটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে। আর খবরদার যদি আগের কোনো কথা তুলেছিস চন্দ্রার সামনে তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না দেখিস।”
অপূর্ব শব্দ করে হাসলো সিয়ামের কথা শুনে। যদিও কিছুটা আসলেই সত্যি সিয়ামের ভয়ঙ্কর রূপ দেখলে আসলেই সিয়ামের থেকে খারাপ তখন কাউকে মনে হয় না।

#চলবে..?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে