#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[১০]
সূর্যমুখর ঝলমলে সকালে ভার্সিটি আসাটাই বৃথা গেল। ছাত্রদের দুই গ্রুপের কোন্দলে ডিপার্টমেন্ট এর সব ক্লাস আপাতত বন্ধ আছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আরেকটু আগে খবরটা পেলে ইকরাম ভাইয়ের সঙ্গেই ফিরে যেতাম। এখন তো নিশ্চয়ই উনি অনেকটা দূর চলে গিয়েছেন। ফোন করে আসতে বলতে ইচ্ছে হলো না। এমনিতেই গত একমাস ধরে আমাকে ভার্সিটি পৌঁছে দেওয়া উনার নতুন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা মানুষ কতটা নিরলস খেটে যাচ্ছে বাড়িটার জন্য। তবুও মুখে বিরক্তির ছায়াটুকুও নেই।
ইতু ক্লাস না হওয়াতে খুশি হলো। ঘোরাঘুরির এক্সট্রা সুযোগ পেয়ে হাসিটা কান অবধি প্রশস্ত করল সে। বটতলায় ফুচকার প্লেট নিয়ে বসেছি দুজন। ইতু ফুচকা চিবোতে চিবোতে বলল,
“হাতে অনেক সময়, চল কোথাও ঘুরে আসি। রাজিবও ফ্রি আছে আজ।”
কথাটা শেষ করে ইতু চোখ টিপল। ঠোঁটে ঝোলালো দুষ্টু হাসি। রাজিব তার অঘোষিত বয়ফ্রেন্ড। সরাসরি প্রেমের স্বীকৃতি কেউ না দিলেও প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই যত্নশীল, খুনসুটিময় তাদের সম্পর্ক। বললাম,
“নারে, তোরা যা।”
“তুই গেলে কী সমস্যা?”
“অযথা সময় নষ্ট।”
“বাড়িতে ডজন ডজন বাচ্চা ফেলে এসেছিস মনে হচ্ছে! তাদের খাওয়াতে তোকে ছুটে যেতে হবে।” ইতু ভ্রু কুচকে বলল কথাটা। ওর বাহুতে চাপড় মে’রে হেসে দিলাম।
“বাজে কথা বলিস কেন? মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা তো তোকে বলেছিই। সবসময় কেউ একজন চোখে চোখে রাখা ভালো।”
“বাড়িতে আর মানুষ নেই?”
“তাদের আর কত প্রেশার দেব বল? থাকছি, খাচ্ছি এটা তো কম না। আবার মায়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব কী করে দেই?”
ইতু খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
“এভাবে কী দেখছিস?”
“তুই কত ম্যাচিওর হয়ে গেছিসরে, অনন্যা! সবার খেয়াল রাখা শিখে গেছিস। আগের সেই বেখেয়ালি মেয়েটাকে খুব মিস করছি।”
“আমিও।” বুক চিড়ে একটা প্রলম্বিত শ্বাস নির্গত হলো।
ইতু এ বিষয়ে আর কিছু বলল না। আনমনে তেতুলের টকে চুমুক দিয়েই চোখ বুজে, ঠোঁট বিকৃত করে ফেললাম। টক কিংবা ফুচকা কোনোটাই খুব একটা পছন্দ নয় আমার। ইতুর জোরাজুরিতেই একটু-আকটু খাওয়া হয়। সে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। আমাকে আরেকবার জোরাজুরি করে শেষমেষ পর্যদুস্ত হয়ে চলে গেল রাজিবের সঙ্গে। আমি পিচঢালা পথের ধার ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর এগোতেই কাঙ্ক্ষিত লোকাল বাসের দেখা পেলাম।
___________
“এত কমে বেদানা আর কোনো দোকানে পাইবেন না ভাই। আর দশটা টেকা বাড়াইয়া দেন, নইলে লসে পইড়া যামু। আবদার করতাছি।”
“আপনি আমার আত্মীয় বা কাছের মানুষ নন যে আবদার রাখব। সঠিক দামই দিয়েছি।”
নির্বিকার চিত্তে কথাটা বলে বাজারের ব্যাগটা হাতে তুলে গটগট করে হাটতে লাগল শ্রাবণ। ঘামে তার টিশার্ট পিঠের সঙ্গে লেগে গেছে। আমি পিছু পিছু গুটি গুটি পায়ে এগোলাম। জনসমাগম ঠেলে, বাজারের বাইরে এসে বললাম,
“দিয়েই দিতে দশটা টাকা। বুড়ো মানুষ রোদে পুড়ে ফলমূল বিক্রি করে…”
শ্রাবণ হাঁটতে হাঁটতে একবার আমার দিকে ফিরল। মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো,
“ব্যবসায়ীদের আবেগ মাখানো কথায় সবসময় অসহায়ত্ব থাকে না। ওসব ছ’লচা’তুরী মাত্র। সায় দিলে নিজেরই ক্ষতি। তার যেমন লভ্যাংশ পাওয়ার চিন্তা, আমারও পকেটের টাকা যথাযথ ব্যবহারের চিন্তা বুঝলে?”
ঠোঁট উলটে বললাম,
“খুব হিসেব করে চলো দেখছি।”
শ্রাবণ এ কথায় চলার গতি থামিয়ে দিলো। আমাকেও থামতে হলো। সে আমার দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলল,
“কিপটে ভাবছো নাকি?”
থতমত খেয়ে গেলাম। আমি আসলে তাই ভাবছিলাম। ভাবার কারণও আছে অবশ্য। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে লোকাল বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে ফিরছিলাম। পাঁচ মিনিটের পথ বাকি থাকতে শ্রাবণও উঠল। বাসে তখন তিল ধারণের জায়গা ছিল না। গরমে, চাপাচাপিতে আমারই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে যে শ্রাবণ জায়গা করে উঠে গেল! অথচ সেখান থেকে কুড়ি টাকায় একটা রিক্সা নেওয়া যেত। দশ টাকা বাঁচাতে শ্রাবণ বাসে চড়েছিল! ভাবতেই ফাঁপড় লাগছিল কেন জানি। পরে ভাবলাম হয়তো টাকা ছিল না সাথে। কিন্তু নামার পর দুজনে একসাথে গলির পথ ধরলে বাজারের সামনে থেমে তো ঠিকই ফলমূল কিনল। মনের কথা চেপে শ্রাবণের কথা অস্বীকার করে বললাম,
“না না, আসলে আমিও কয়েকদিন বাজার করেছিলাম। প্রতিবারই কোনো না কোনোভাবে ঠকে গিয়েছি। তাই তোমার বাজার করার স্কিল দেখে বললাম আরকি।”
শ্রাবণ আবার হাঁটতে শুরু করে বলল,
“কিপ্টেমি নিয়ে আমার পরিবারের একটু বদনাম আছে জানি। তবে আমি মানুষটা মিতব্যয়ী, বুঝলে? দরকারে যেমন টাকা খরচ করি, অদরকারে তা সঞ্চয় করতেও ভুলি না।”
“তাহলে তো তুমি কোনোদিন প্রেমিকাকে ফুলও দেবে না।”
শ্রাবণ স্থান-কাল তুচ্ছ করে উচ্চস্বরে হাসল। আশেপাশের কিছু মানুষ ঘুরে তাকালো আমাদের দিকে। একটু লজ্জা পেলাম। বললাম,
“হাসছো যে?”
“প্রেমিকাকে গিফট দেওয়া লস প্রজেক্ট। সে আমার কপালে থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে আমি শুধু মিতব্যয়ী নয়, কিপ্টেমিও করব। শুধু ফুল বা গিফটে নয়, প্রেমের বেলাতেও। তবে বউকে অবশ্যই দেব। কারণ সে আমার কপালেই আছে। তার খুশিটা অদরকারি নয়।”
এ বিষয়ে কথা বাড়াতে সংকোচ হলো। বাকিটা পথ চুপচাপ এগোলাম। বাড়ির সামনে এসে বিদায় জানিয়ে এগোতেই শ্রাবণ পিছু ডাকল,
“অনন্যা শোনো?”
“হু?”
শ্রাবণ তার ফলমূলের প্যাকেট থেকে দুটি বেদানা বের করে আমার হাতে দিলো। বারন করে বললাম,
“আরেহ! এসব কেন?”
“অসুস্থ মানুষের জন্য কিনেছি। আর তোমাকেও এই মুহূর্তে আমার অসুস্থই লাগছে। প্রথমদিন তো চিনতেই সময় লেগেছে। ভেবেছিলাম কোনো যক্ষা রোগী বোধহয়। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কোরো। আসছি।”
বেদানা দুটো চলে গেল আবির-নিবিড়ের দখলে। দুটোতে বল বানিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করে এরপর খাওয়ার বদলে ফেলে ছড়িয়ে, নষ্ট করতে লাগল। ভাবলাম ঠিকমতো খোসা ছাড়িয়ে খেতে পারছে না। তাই বললাম,
“আমি খাইয়ে দেই এসো।”
বলে আবিরের বেদানাটা হাতে নিতেই সে কেঁদে ফেলল। বোকাটা হয়তো ভাবল আমি বুঝি কেড়ে নিচ্ছি। ইকরাম ভাই বসার ঘরেই উপস্থিত ছিলেন। আবিরের কাণ্ড দেখে স্মিত হেসে কান্না থামাতে এগিয়ে আসতে নিলেই ছোটো মামী ঘর থেকে ছুটে এসে বলল,
“কী হলো? আবির কাঁদছে কেন?”
আবির আমার হাতের দিকে দেখালো। আমি বললাম,
“আবির খেতে পারছে না। নষ্ট করছে। তাই ভাবলাম…”
ছোটো মামী বাকিটা শুনল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে আবির নিবিড়কে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“খাওয়ার অভাব পড়েছে তোদের। ঘরের জিনিস নষ্ট না করে পরের জিনিস কেন নষ্ট করবি? লজ্জা-শরম হয়নি গায়ে? তোর বাবা ফোন করুক আজ।”
মনে হলো বুকের ভেতর সুক্ষ্ম কিছু একটা বিঁ’ধল। ছোটো মামীর ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা ধরতে অসুবিধা হলো না। চোখ ছলছল করে উঠল। লজ্জা-শরম আছে কিনা! ইকরাম ভাই করুণ চোখে চেয়ে ছিলেন। হয়তো একজন আশ্রিতের অনুভূতিটা স্পষ্ট জানেন বলেই। আমি মাথা নত করে নিলাম, দৃষ্টি লুকাতে। ছোটো মামীর কথা বোধহয় মা শুনতে পেয়েছে। প্রায় ছুটে এসে আমায় জিজ্ঞেস করল,
“বেদানা তুই এনেছিস?”
“শ্রাবণ দিয়েছে।” ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলাম।
মা সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে তা নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগল,
“এত বড়ো হয়েছিস এখনো অন্যের ঘাড়ে খেতে লজ্জা করে না? অকালকুষ্মাণ্ড পেটে ধরেছি। ভিক্ষে করে খাওয়া ছাড়া কোনো পথ রাখবি না তোরা।”
আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। অতি ক্ষুদ্র একটা কাজের প্রতিক্রিয়া এতটা বড়ো হবে ভাবতে পারিনি। দুপুরে আর খেতে ইচ্ছে হলো না। সারাদিন রুম ছেড়ে বেরও হলাম না। সন্ধ্যায় ভাইয়ার ডাকে আর না বেরিয়ে পারলাম না। শ্রাবণ পড়াতে এসেছে। চোখাচোখি হলেও ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। বসার ঘরে তুষার ভাইয়া, ইকরাম ভাই, নানাজান সবাই উপস্থিত ছিল। টেবিলে মিষ্টি ও ফল দেখে ভ্রু কুচকে এলো। কারণ ফলের মধ্যে বেদানার পরিমাণই বেশি। বড়ো মামী জিজ্ঞেস করলেন,
“হঠাৎ এত ফল-মিষ্টি?”
ভাইয়া বলল,
“মিষ্টি আমি এনেছি। আর ফল এনেছে ইকরাম।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ইকরাম ভাই বললেন,
“তুষারের চাকরি হয়েছে। ও মিষ্টি কিনল বলে আমিও ফল কিনে নিলাম।”
ভাইয়ার চাকরি হয়েছে! সংবাদটা শুনে মা ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলল। যেন অনেকদিন পর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর একটা অবলম্বন পেয়েছে। আমার চোখের জল তো বিনা নোটিসেই ঝরে যায়। ভাইয়া ইতস্তত করে নানাজানকে বলল,
“আমার নতুন অফিসটা তো দূরে হয়ে যাবে। তাই মা আর অনুকে নিয়ে অফিসের কাছাকাছি একটা বাড়িতে উঠতে চাইছিলাম নানাজান।”
নানাজান সে কথায় মুচকি হাসলেন। মা হঠাৎ বলে বসল,
“অনুর বিয়েটা এ বাড়ি থেকে দিয়ে তারপর যাব।”
চলবে…
#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[১১]
শেষরাতে পিয়াসা ভাবীর লেবার পেইন শুরু হয়েছে। ভোরে তাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। খবরটা পাওয়া মাত্রই ভাইয়া ঘুমচোখে ছুটে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আমাদের বলে গেল বাচ্চার খবর পেলেই জানাবে। এরপর থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি এবং মা। কাঙ্ক্ষিত সংবাদটি এলো সকাল আটটায়। ভাবী একটি ছেলের জন্ম দিয়েছে। তবে ভাইয়া এখনো অবধি দেখতে পারেনি। প্রসবের পর বাচ্চাটির নাকি শ্বাস গ্রহণে জটিলতা দেখা দিয়েছে৷ তাই তাকে চব্বিশ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সেখানে ভাবীর ভাইয়াকে এলাও করেনি। এ নিয়ে ভাইয়া আক্ষেপ করার সুযোগ পেল না। বরং উৎকন্ঠায় আছে বাচ্চাটার শারীরিক অবস্থা নিয়ে। খানিক পর পরই কল করছে আর অস্থিরতা প্রকাশ করছে। বাবা হওয়ার খুশিটা মিইয়ে গেছে বাচ্চাটির সুস্থতার কাছে। তারসঙ্গে পিয়াসা ভাবীর জেদ তো রয়েছেই। নিজ সন্তানের মুখটা অবধি দেখতে দিচ্ছে না। আজকে ভাইয়ার চাকরিতে জয়েনিং ডেট ছিল। ভাইয়া সেসবের তোয়াক্কা করল না। বলল,
“বাবুকে কী দেওয়া যায় বলতো, অনু? প্রথমবার খালি হাতে বাবুকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
আমি হাসলাম। বাবা হওয়ার সংবাদেই ভাইয়ার কথা এলোমেলো হয়ে গেছে। বাচ্চাটিকে কোলে নিলে নির্ঘাত কেঁদে ফেলবে। বাচ্চা ও বাবা একসঙ্গে কাঁদলে দৃশ্যটা কেমন দেখাবে? আমার খুব লোভ জাগল দেখার। বললাম,
“আমি আসি ভাইয়া? দুজনে কিছু একটা কিনে নেব নাহয়।”
“তুই আসবি? এখন আসিস না। আগে ওদের সঙ্গে কথা বলি। পিয়াসার রাগ কমুক। এরপর তোদের আনব। জানিসই তো এ সময় মেয়েদের মুড ঠিক থাকে না। তাই জেদ করছে। রাগ পড়ে গেলে দেখবি নিজে থেকেই ডাকবে তোদের। বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে ডিভোর্স-টিভোর্স সব ভুলে যাবে দেখিস।”
ভাইয়ার আকাঙ্ক্ষা জড়ানো কথার বিপরীতে আশ্বাসের বাণী শোনাতে পারলাম না। মনে মনে চাইলাম তাই হোক। সংসারটা জোরা লাগুক। অন্তত বাচ্চাটার জন্য। একটু পর ভাইয়া আবারো ফোন দিলো। বলল,
“অনু, শিশির নামটা কেমন?”
“বাবুর জন্য?”
ভাইয়া সাগ্রহে বলল,
“হ্যাঁ, তুষারের সঙ্গে মিলিয়ে শিশির। বাবুকে এই নামটাই দেব।”
“খুব সুন্দর নাম। তুমি বাবুকে দেখেছো?”
“নারে। ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছে ছানাটা। কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছি। একদম বিড়াল ছানার ডাকের মতো শোনায়। পিয়াসার পরিবার বলেছে অবস্থার উন্নতি হলে আমায় যেতে দেবে ওর কাছে।”
“তাহলে বাড়িতে চলে এসো। খেয়ে-দেয়ে যাবে নাহয়।”
“নাহ, থাকি। যদি কোনো দরকার হয়!”
ভাইয়ার এলোমেলো আচরণগুলো কেন জানি খুব ভালো লাগছিল। একটি সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের মতো ভাইয়ারও নতুন সত্ত্বার জন্ম হলো। পিতৃসত্ত্বা। বাচ্চা যেমন পৃথিবী চিনবে ভাইয়াও তেমন বাচ্চার প্রতি নিজের দায়িত্ব, মমত্ব শিখবে। একটা ছোট্টো বাবু আমাদের কোলজুড়ে খেলবে। তার ছোটো ছোটো হাত-পা নাড়িয়ে, মাড়ি বের করে হাসবে। ভাবতেই সুখের অশ্রুরা ভিড় করছিল চোখে।
দুপুর নাগাদ নানাজান তার রুমে ডেকে পাঠালো আমায়। রুমে প্রবেশ করতেই আতরের ঘ্রাণ ধাক্কা দিলো নাকে। লম্বা শ্বাস নিলাম। দেখলাম মা-ও নানাজানের পাশে বসে আছে। আমাকে দেখে উঠে চলে গেল। একটু অবাক হলাম। কী এমন ব্যাপারে ডাকা হলো বুঝতে পারলাম না। নানাজানের সঙ্গে সালাম বিনিময় করলাম।
“এখানে এসে বসুন আপু।”
নানাজানের পাশে চেয়ার টেনে বসলাম।
“আপনার শরীর ভালো নানাজান?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আমার বাগানে এমন ফুটফুটে সুবাসিত ফুলেরা আছে। সেই ফুলেদের সুবাসেই ভালো হয়ে যাই।”
আমি কথা না বলে স্মিত হাসলাম। নানাজান বললেন,
“তুষার বাবা হয়ে গেল।”
“হ্যাঁ।”
“একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বাবা-মায়ের পরিচয় বহন করা মানুষের দায়িত্ব কিংবা ভালোবাসার ক্ষমতা উভয়ই বেশি থাকতে হয়। সন্তানকে সযত্নে এই দুনিয়াবি জীবনের জন্য তৈরি করতে হয়।”
নানাজান একটু থামলেন। আমি সপ্রশ্নে তাকিয়ে রইলাম। এসব কথা বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তবে কোনো প্রশ্ন করলাম না। নানাজান আমার দৃষ্টি বুঝে আবার বললেন,
“বাবা-মায়ের সবচেয়ে বড়ো আমানত হচ্ছে কন্যা সন্তান। তাকে সঠিক আমানতদারের হাতে তুলে দেওয়া বাবা-মায়ের প্রধান দায়িত্ব। আপনার প্রতি সেই দায়িত্ব পালনের আগেই আপনার আব্বার ইহকালের সমাপ্তি ঘটেছে। আপনার মায়ের বর্তমান মানসিক স্থিরতা সম্পর্কেও আপনার স্পষ্ট জ্ঞান আছে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “আছে।”
“শুভ্রা ব্যা ভি চার করেছিল। যা নিঃসন্দেহে পাপ। তারচেয়েও বড়ো পাপ করেছে আত্ম হ ত্যা করে। এরপর থেকে আপনাদের জীবনে স্থিরতা বিনষ্ট হয়েছে। এমন অবস্থায় আপনারা ভাই-বোন উভয়ই দিশেহারা। সন্তানের উছিলায় তুষারের সংসারটা যদি বেঁচে যায় আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপনার সুরক্ষা, ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। আপনার মা তা নিয়ে চিন্তিত। তিনি আপনার বিবাহের দায়িত্ব আমার ওপর সোপর্দ করেছেন। কিন্তু মেয়ের অনুমতি ছাড়া বিবাহ দেওয়া যাবে না। আমি তা সমর্থন করি না।”
মাথা নিচু করে ফেললাম। নানাজান কী বলতে চাইছে বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। মা গতকাল রাতে হুট করে বিয়ের কথা বলায় বিষয়টা ততটা গুরুত্ব দেইনি। মা মাঝে মাঝেই বিয়ে নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু এবার যে সত্যিই উদ্যোগ নিয়ে নানাজানকে ধরবে বুঝতে পারিনি। কী বলা উচিৎ? আমি কী আসলেই বিয়ে করতে প্রস্তুত? আমি কী পারব অন্য কাউকে গ্রহণ করতে? আদনানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে পারব? ভালোবাসা শব্দটায় যে এখন আমার তীব্র ভয়। নিঃস্ব হওয়ার ভয়। আদনান আমাকে যে ভালোবাসার সন্ধান দিয়ে আবার কেড়ে নিয়েছে তা আমি আজও মন থেকে মুছতে পারিনি। পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। স্মৃতি নামের ক্ষমতা হৃদয়ের সেই আকুল করা প্রেমকে নিশ্চিহ্ন করতে দেবে না। আজও ওর নামটা হৃদয়ে এক সুক্ষ্ম য’ন্ত্র’ণার উদ্রেক করে।
নানাজান আমাকে মৌন দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“অতীত বদলানো যাবে না, তা ভেবে ভবিষ্যতকেও হেলা করা যাবে না। জীবন প্রবহমান নদীর চেয়েও উত্তাল। সেই উত্তাল স্রোতে গা না ভাসিয়ে বরং হাল ধরতে শিখতে হবে। শ’য়’তানের কু’মন্ত্রণায় সায় না দিয়ে নিজেকে হেফাজত করতে হবে। পাপ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।”
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তা আড়াল করে নত দৃষ্টিতেই বললাম,
“আমার কোনো আপত্তি নেই নানাজান।”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার ওপর জোর করে কিছু চাপাতে চাই না আপু। আপনার কোনো পছন্দ থাকলে নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন। আমি প্রস্তাব পাঠাবো।”
পর্দা নড়ে উঠল। খেয়াল করলাম একজোড়া রুক্ষ, শুষ্ক পা এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। তার টাখনুর ওপরের শুভ্র রঙের পাজামা। ইকরাম ভাই নানাজানের কাছে এসেছে। চোখ ফিরিয়ে বললাম,
“কোনো পছন্দ নেই।”
“নানাজান যদি পছন্দ করে আপত্তি আছে?”
“নাহ।”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
আমি আর সেখানে বসলাম না। ছুটে চলে এলাম নিজের রুমে।
______________
রাত হয়ে গেল অথচ ভাইয়ার কোনো খোঁজ নেই। চিন্তায় মা-মেয়ে সারাদিন খাওয়ার কথা ভুলে গেছি। ভাইয়া সকালে লাগাতার ফোনের পর ফোন দিয়ে অস্থির করে তুলেছে এরপর সারাদিন আর একবারও কল করেনি। ফোন করলে রিসিভও করেনি। মায়ের প্রেশার বেড়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আ’ত’ঙ্ক বাড়তে লাগল। বাবুটা ঠিক আছে তো? ভাবী আবার ভাইয়াকে কোনোভাবে দুঃখ দিলো নাতো? কেন যে হাসপাতালের ঠিকানা জানলাম না? মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো। বড়ো মামা, ইরকাম ভাই বাড়ি ফিরল রাত আটটার পর। আমি ছুটে গেলাম ইকরাম ভাইয়ের কাছে। তিনি সবে পাঞ্জাবি খুলছিল গা থেকে। আমি দরজায় গিয়ে থেমে গেলাম। তিনি লজ্জিত হয়ে তড়িঘড়ি করে পাঞ্জাবি গায়ে চড়ালেন। বললেন,
“কী হয়েছে, অনন্যা? কোনো কারণে বিক্ষিপ্ত?”
“তুষার ভাইয়া সকালে হাসপাতালে বেরিয়েছিল। এখনো ফেরেনি। ফোনও ধরছে না।”
“বাবু হয়েছে, শ্বশুর বাড়িতে আছে হয়তো?”
“উহু, শুনেছি বাবুর অবস্থা খুব বেশি ভালো না। চব্বিশঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারা ভাইয়াকে বাবুর কাছেই যেতে দেয়নি। ভাইয়ার একবার খোঁজ এনে দিন প্লিজ!”
ইকরাম ভাই মানিব্যাগ, মোবাইল পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন,
“আগে বলবে না? আমি এক্ষুনি বেরোচ্ছি।”
ধারা খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিল। ইকরাম ভাইকে বেরোতে দেখে বলল,
“ওমা! না খেয়ে কই যাচ্ছেন?”
“পরে খাব, তোমরা খেয়ে নাও।”
ইকরাম ভাই জুতো পরে সিড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার আগে একটুর জন্য থামলেন।
“খালাকে চিন্তা করতে বারন কোরো। আমি তুষারকে নিয়েই ফিরব।”
ইকরাম ভাই তুষার ভাইয়াকে নিয়ে ফিরল রাত বারোটায়। ভাইয়া বসার ঘরে পা দিয়েই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার বাবুটাকে ওরা চোখের দেখাও দেখতে দিলো না, মা। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। আমার পিতৃত্ব কেড়ে নিয়ে ও চলে গেছে। আমার বাবুটা অভিমান করে চলে গেছে। আমি আজ চিরতরে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।”
ইকরাম ভাই মাথা নত করে দ্রুত বসার ঘর ত্যাগ করল। আমার সন্তানহারা মা কী বলে আরেক সন্তানহারা পিতাকে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পেল না হয়তো। ভাইয়াকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি বাক্যহারা হয়ে তাদের অবলোকন করলাম। চারপাশ কেমন ঘোলা হয়ে এলো। নড়ার শক্তি পেলাম না। আরেকবার ধৈর্য ধরার শক্তি দাও আল্লাহ!
চলবে…