বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-০৬

0
714

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৬]

আজ অনেকদিন পর মায়ের হাতে মা’র খেলাম। রুটি বেলার বেলুন, পায়ের জুতো, হ্যাঙ্গার, দরজার কোণায় রাখা ঝাড়ুটাও বাদ যায়নি। পিঠে, পেটে, হাতে-পায়ে যেখানে পেরেছে মে’রে’ছে। একদম ছোটোবেলার মতো। মায়ের এই একটা দিক আমি ছোটো থেকে ভয় পেতাম। কেউ বিচার দিয়ে গেলে বা কথা না শুনলে মা প্রচুর মা’র’ধোর করত আমাদের তিন ভাইবোনকে। বলাই বাহুল্য সবচেয়ে বেশি মা’র আমিই খেয়েছি। তবে পার্থক্য হলো আমার মাঝে সেই আগের ব্যথার য’ন্ত্র’ণা উপস্থিত থাকলেও ভীতিটা অনুপস্থিত। বরং মায়ের ওপর কেমন করুণা জন্মাচ্ছে।

মেজো চাচির আনা সম্বন্ধটা আমি ভেঙে দিয়েছি। পাত্র ফোনে যোগাযোগ করলে আমি উনাকে আমার ব্যপারে সব ইনফরমেশন দিয়েছি। এমনকি আদনানের সঙ্গে সম্পর্ক ও অঘোষিত বিচ্ছেদের কথাও বাদ রাখিনি। লোকটি হয়তো হজম করতে পারেনি। এমনিতেই আমার পরিবারের অতীত খুব একটা সুখকর নয়, তারওপর পাত্রীর প্রেমও ছিল। তিনি আমাকে নিয়ে কতদূর কল্পনা করতে পারেন আমি আন্দাজ করতে পারছি। ব্যাস, সকাল সকাল মেজো চাচি ফোন করে মাকে যা নয় তাই বললেন। মেয়ের কেমন বাড়ি বিয়ে হয় সেটাও দেখবেন জানালেন। আসন্ন দিনগুলোতে মেয়ের চরিত্রের স্খলন ও বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করতেও ভোলেননি। অপমানে মায়ের মুখটা চিমসানো কিসমিসের মতো হয়ে গেছিল। সম্বন্ধ ভাঙায় যতটা না দুঃখ পেয়েছে তার চেয়েও বেশি আ’ঘা’ত পেয়েছে মেজো চাচির ধারালো শব্দে। আমাদের তিন ভাই-বোনের জন্য মায়ের জীবনটা কতটা মর্মান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে রাগ মিটিয়েছে আমার ওপর।

ব্যথায় চিৎকার করে কেঁদেছি। পায়ে অবধি ধরেছি। মায়ের সামান্যতম দয়া হয়নি। মনে হচ্ছিল আমার সামনে মা নয়, কোনো এক ভয়ানক পাষাণ দাঁড়িয়ে আছে যার প্রাণে সামান্যতম মায়া নেই। কোনো এক সময় হয়তো মা থেমে গেছিল। আমি ঠিক মনে করতে পারি না। কারণ তার আগেই আমার হুশ-জ্ঞান য’ন্ত্র’ণায় ছটফট করে কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ আমায় কোনো এক ঘোরের জগতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

জ্ঞান ফিরতে ভাইয়ার মুখটা দেখতে পেলাম। আমার দুর্বল চোখের পাতা মুহূর্তেই যারপরনাই বিস্মিত হলো। ভাইয়াকে কে জানালো? মা? ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালাম। মাকে দেখতে পেলাম না।
ভাইয়া আমাকে তাকাতে দেখে বলল,
“এখন কেমন লাগছে?”
আমি মাথা কাত করলাম নড়তে গিয়ে অসহ্য য’ন্ত্র’ণায় কুঁকড়ে উঠলাম।
“উঠিস না।”
ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
“কখন এলে?”
“আধঘন্টা হলো।”
“খবর কে দিলো? মা?”
“হ্যাঁ, ফোন করে জানালো তোকে নাকি মে’রে-টেরে ফেলেছে। আমাকে বলল পুলিশ ডাকতে। হ্যান্ডকাফ পরে হাজতে যাবে। ছুটে এসে দেখি মেঝেতে বেহুশ হয়ে পড়ে আছিস।”
আমি হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“মা কোথায়?”
“উল্টোপাল্টা আচরণ করছে। ঘরে বন্দী করে এসেছি।”
“ঠিক করোনি। যদি কিছু করে বসে?”
সে উত্তর না দিয়ে ভাইয়া পালটা প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে বাড়িতে? তোকে মা’রল কেন এমন করে?”
আমি সত্যিটাই বললাম। শুধু আদনানের কথাটা অস্বস্তিতে এড়িয়ে গেলাম। ভাইয়া সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভালো করেছিস। এখন কিছু মুখে দে। ডাক্তার দেখে মেডিসিন দিয়ে গেছে। কিছু খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।”

আমি ভাইয়ার মুখের দিকে ভালোমতো তাকালাম। চোখের নিচে জমে থাকা কালিটা আরো গাঢ় হয়েছে মনে হচ্ছে। চুল-দাড়ি অনেকদিন কাটে না। মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। বিষন্ন মুখটা দেখে স্পষ্ট বলা যায় ভাইয়া সুখে নেই। এত কিসের অশান্তি ভাইয়ার মনে? উঠতে উঠতে বললাম,
“তুমি খেয়ে যাবে তো? রান্না করা হয়নি…”
“যাচ্ছি না কোথাও। শুয়ে থাক। ভাত ফুটিয়ে ডিম ভেজে নেব।”
“যাবে না? ভাবীকে নিয়ে আসবে আবার?”
ভাইয়া তাচ্ছিল্য করে বলল,
“সে আমাকে ছাড়াই ভালো আছে। আমাদের ফ্যামিলির মানুষদের তার কাছে দম বন্ধকর লাগে, ইনক্লুডিং মি।”
ভাইয়া দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি দেখলাম এক হেরে যাওয়া প্রেমিকের প্রস্থান।

রাত নামতেই শরীরের ব্যথা বাড়ল। তাপমাত্রাও বাড়ছে। মাথার যেন কেউ ইট বেঁধে দিয়েছে। তুলতেই পারছি না। মা সারাদিনে একবারও আমার রুমে আসেনি। কণ্ঠও শুনতে পাইনি। মাঝে রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ ভেসে এসেছিল। এরপর আবারো সুনসান নিরবতা। বাড়িতে তিনজন মানুষ থেকেও কেউ নেই। সকলে আপন আপন পৃথিবীতে বিষন্নতা কুড়াতে ব্যস্ত।

দেহের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে শীত লাগতে শুরু করেছে। কাঁথা ভেঙে গায়ে জড়াতে আলসেমি লাগছে। ফোন বাজছে। তুলতে ইচ্ছে করল না। পর পর দুইবার বেজে কেটে গেল। তৃতীয়বার বাজলে বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিলাম। ক্ষীণ দৃষ্টিতে দেখলাম আদনানের নামটা জ্বলজ্বল করছে।
“হঠাৎ কী মনে করে?”
“দেখলাম ব্লক করেছো কিনা।”
“সে তো প্রথম কলেই বুঝেছো। বাকি দুবার কী জন্য করলে?”
“রিসিভ করো কিনা দেখতে।”
“আমি কী তোমার হেয়ালির পাত্রী আদনান?”
“কী জানি? আমরা দুজনই হয়তো হেয়ালির শিকার, নিয়তির হেয়ালি।”
“কবে যাচ্ছো?”
“তিনদিন পর, এই শুক্রবারে।”

চুপ রইলাম কিছুক্ষণ। বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা হৃদয়টা ভয়াবহ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বললাম,
“আমাকে মিস করবে, আদনান?”
আদনান শব্দ করে একটা নিশ্বাস ছাড়ল। ফোনের এপার থেকে সে নিশ্বাসের উত্তাপ টের পেলাম না, অনুমান করতেও ইচ্ছে হলো না। আদনান বলল,
“সেসব বাদ দাও, সম্বন্ধটার কী খবর? কতদূর এগোলো?”
“ভেঙে দিয়েছি।”
“কীভাবে?” আদনানের কন্ঠ কিছুটা উঁচু শোনালো।
“তোমার আমার প্রেমের কথা বলে দিয়েছি। আমরা দুজন দুজনকে কতভাবে ভালোবেসেছি সব বলে দিয়েছি।”
“তোমার কী হয়েছে অনন্যা? কন্ঠটা এমন জড়ানো লাগছে কেন?”
“জ্বর এসেছে।”
“মেডিসিন নাওনি?”
“মেডিসিন তো তোমার কাছে। সেবার যখন তোমার জ্বর এলো, আমার থেকে কীভাবে মেডিসিন নিয়েছিলে ভুলে গেছো?”
“ভুলিনি।”
“তাহলে দাও।”
“অনু তুমি জ্বরের ঘোরে ঢুকে যাচ্ছো। আমরা কাল কথা বলি?”
“ফোন রাখবে না। খবরদার, আমাকে চুমু না দিয়ে তুমি ফোন কাটবে না।”
“জ্বর কমে গেলে পরে তুমিই কষ্ট পাবে।”
“আমি তো সব সময়ই কষ্ট পাচ্ছি আদনান। তুমি আমাকে কেন বোঝো না? সেদিন তোমার সামনে থেকে চলে আসার সময় কেন আমার পথ আগলে দাঁড়ালে না? একটাবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে আমি সব ভুলে যেতাম। আবারও তোমার বুকে মুখ গুজে দিতাম।”
“তাহলে কষ্টটা আরো বিস্তৃত হতো। আমি যে নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না।”
“আমাকে ভালোবাসো?”
“র’ক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকে তা আমি তোমাকে পেয়েই বুঝেছি, অনন্যা।”
“কিন্তু সেই ভালোবাসা র’ক্তের সম্পর্কের কাছেই হেরে গেল। তুমি একটা কাপুরুষ, মেরুদন্ডহীন। ভীতুর মতো আমার হাত ছেড়ে দিয়েছো।”
আদনান হেসে বলল,
“এই কাপুরুষের থেকে এখনো চুমু চাও?”
“কক্ষনো চাই না।”
_____________

আদনান চলে গেছে আজ দুদিন হলো। চলে যাওয়ার আগে আমাকে হাজারবার অনুনয় করেছে দেখা করতে। আমি নাকচ করে দিয়েছি। এয়ারপোর্টে যাওয়ার ঘন্টা তিনেক আগে ম্যাসেজ করে বলেছিল,
“ভেবে নাও একজন মৃ-ত ব্যক্তিকে শেষ দেখা দেখতে আসছো। তবুও এসো অনন্যা। মৃ-ত দেহটিকে নাহয় বিদায় দিয়ে যাও, প্লিজ!”

আমি যাইনি। উলটে ম্যাসেজ করে বলেছিলাম,
“প্রিয় মানুষের শেষযাত্রা খুবই বেদনাদায়ক আদনান। আমি সেই স্মৃতি নিজের সঞ্চয়ের খাতায় জমাতে চাই না। আমার দুর্দশা গাঁথা জীবনে আরেকটু দুঃখ নাইবা যোগ করলে।”

এরপর আর কোনো রিপ্লাই আসেনি। আমিও দেইনি। সেই রাতে জ্বরের ঘোরে বলা কিছু লাগামছাড়া কথাই ছিল আমাদের শেষ কথা বলা। এরপর আদনান প্রতিদিন ফোন দিয়েছে। আমি রিসিভ করিনি। ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়েছি। কত দ্রুতই অতীত হয়ে গেল সব! আদনানকে ঘিরে আমার ভাবনারাও এভাবেই হয়তো অতীত হয়ে যাবে। আদনানকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছেটা আমার মনের ভেতর এতদিন ঘাপটি মে’রে ছিল। সে দেশের মাটি ছাড়তেই টের পেলাম কেমন শূন্য লাগছে। ইচ্ছেটা তার সঙ্গে চলে গেছে বলেই হয়তো। ভাবলাম এবার বুঝি হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। জীবনটা গুছাতে হবে। কিন্তু কে জানত, আসন্ন ভবিষ্যতে আমাদের জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে