#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৫]
আমার আশঙ্কাই সত্যি হলো। মেজো চাচি পাত্রপক্ষ নিয়ে এসেছেন। শুনলাম পাত্র নাকি চাচির কোন এক দূরাত্মীয় সম্পর্কের বোনের ছেলে হয়। মা আমাকে শাড়ি পরে সেজেগুজে নিতে বলছে বারবার। ইচ্ছের বিরুদ্ধে শাড়ি পরেছি। কিন্তু সাজগোজে একটুও মন টানল না। বারবার মনে হচ্ছে আদনানের পুরো কথাটা কেন শুনলাম না? ওকে একবার জানাব আমাকে দেখতে এসেছে? শুনে কি কিছুই বলবে না?
মেজো চাচি তাড়া দিতেই মা আমাকে সাজগোজ ছাড়াই তাদের সামনে নিয়ে গেলেন। দেখলাম দুজন মধ্যবয়সী মহিলা এবং একজন পুরুষ বসে আছে। পুরুষের বয়সটা তারুণ্য হারিয়েছে। মাথার মাঝখানটায় চুল বিলুপ্তপ্রায়। তাদের সামনে নিয়ে বসালে বুঝলাম সম্মুখের লোকটাই পাত্র। আমার বুক কেঁপে উঠল। মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে মা চোখ লুকালেন। বোধহয় আমাকে এড়াতে চাইলেন।
চাচি মুখ খুলে ছেলের প্রশংসা করলেন। অর্থবিত্তের জৌলুস কথার দ্বারাই প্রকাশ করতে চাইলেন। সব কথাই আমার কাছে তেতো লাগল। তবুও ভদ্রতার খাতিরে মাথা নত রাখলাম। মহিলা দুজন আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করলেন। খেয়ে-দেয়ে তারা চলে গেলেও চাচি রয়ে গেলেন। মায়ের পাশে বসে বললেন,
“ছেলেদের বয়স কোনো ব্যাপার না। অনেক পরিশ্রমী, ক্যারিয়ার গোছাতে গিয়ে বয়সের চিন্তা করেনি। এখন সব গোছানো, শুধু আরাম-আয়েশে দিন কাটাবে।”
মা একপলক আমাকে দেখে ইতস্তত করে বলল,
“তবুও বয়সটা একটু বেশিই হয়ে যায় না? পয়ত্রিশ-ছত্রিশ তো হবেই। অনুর সবে একুশ।”
“এত বাছবিচার করে মেয়ে পার করতে পারবে? এমনিতেই শুভ্রা পুরো বংশের মুখে কালি দিয়ে গেছে। ছেলেটাও বড়োলোক শ্বশুর বাড়ির লোভে পড়ে বউয়ের আঁচল ধরা হয়ে গেল। এতকিছুর পর কোন নিখুঁত পরিবার তোমার মেয়েকে বিনা দ্বিধায় ঘরে তুলবে? তারওপর মা-মেয়ে একা থাকো। কেউ অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মেয়েটার ক্ষতি করে দিলে? শুভ্রার মতো তোমাদেরও গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে? মেয়েও যে বিগড়াবে না তাই বা নিশ্চিত হচ্ছো কী করে? তাছাড়া অনন্যা আমাদেরও মেয়ে। আমরা নিশ্চয়ই তার খারাপ চাইব না?”
মাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল। দুপুরে খাওয়া হয়নি বলে সবে শাড়ি খুলে খেতে বসেছি। মুখটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছি। মেজো চাচি আবার বললেন,
“শোনো, ঢাকনা দেওয়া খাবারের ওপর মাছি ভনভন করে না। যে খাবারের ঢাকনা নাই, অরক্ষিত তাতেই নোংরা মাছি ভনভন করে। তোমাদের অবস্থাটাও তেমনই। মাথার ওপর পুরুষ মানুষের ছায়া না থাকলে মানুষ ডরায় না। কাজেই, সময় থাকতে মেয়েটারে পার করো৷”
আমার এসব আলোচনা আর সহ্য হলো না। খাওয়ার রুচি চলে গেল। কোনোমতে পানি দিয়ে ভাত গিলে নিলাম। আমাদের ওপর দিয়ে যখন একের পর এক ঝড়-ঝঞ্ঝা গেছে মেজো চাচি বা তার পরিবারের কারোই কোনো ভালো-মন্দ তৎপরতা দেখলাম না। একটু ভরসাও না। কী খেয়ে আছি একদিন ফোন করেও জানতে চাননি। অথচ বিয়ের বেলায় মনে হলো তিনি ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের ভালোটা কেউই বোঝে না। কথাগুলো গিলে নিলাম।
খানিক বাদেই চাচি চলে গেলেন। আমাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে মোটামুটি মায়ের ব্রেইন ওয়াশ করে গেছেন বুঝতে অসুবিধা হলো না। কারণ মা বারবার ছেলের বয়স নিয়ে সাফাই গাইছে।
“তোর ছোটো খালার স্বামী তার চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের বড়ো। দেখতেও তেমন ভালো নয়। তবুও ভাগ্যে ছিল বলে বিয়েটা হলো। এখন দেখ, ধন-দৌলত, সুনাম, বিত্ত সবদিক দিয়ে ওদের চেয়ে সুখী মানুষ দুটো নেই। সারা বছর ঘুরেফিরে কাটায়। তোর চাচাতো বোনের কথাই ভাব, কালো, বেটে, পেট-মোটা লোকটার সাথে বিয়ে হয়ে গেল। প্রথমে বিয়ে করব না বলে গাইগুই করলেও এখন দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতেই পারে না। উলটে তোর চাচিকে প্রতিমাসে দামী দামী উপহার পাঠায়।”
কথাটা শুনে নিতুর কথা মনে পড়ল। মেয়েটা বিয়ে করবে না বলে কি কান্নাই না করেছিল! বড়োলোক জামাই পাওয়ার লোভে এক প্রকার হাত-পা বেঁধে সতেরো বছরের মেয়েটাকে পরের ঘরে পাঠালো। গতবছর বেড়াতে এসে কাজিনরা ঠাট্টার সুরে যখন সংসারের কথা জিজ্ঞেস করছিল, নিতু মৃদু হেসে বলেছিল,
“এই স্বাধীন, সুন্দর জীবনটা যত পারো উপভোগ করো। নিজেকে সুখী রাখো। কারণ বিয়ের পর নিজের ছাড়াও আরো অনেকের সুখের দায়িত্ব নিতে হয়।”
মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল অর্থবিত্তের সুখ তাদের মানসিক সুখকে কোথাও একটা আড়াল করে দিয়েছে।
মা তার জীবনে দেখা সমস্ত অসম বিয়ের উদাহরণ টানতে শুরু করেছে। বুঝলাম এসবের হাত থেকে নিস্তার নেই। ঠিক করলাম আজ মায়ের ঘরে ঘুমাব না। আগেভাগে খেয়ে ঘরে এসে দরজা দিলাম। একসঙ্গে ঘুমানোর অভ্যাসবশতই কিনা মা আমাকে বেশ কয়েকবার ডেকে গেল। ইচ্ছে করেই সাড়া দিলাম না। আমার একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাইরের একাকিত্ব ঘিরে ধরলেই অন্তরের সুক্ষ্ম স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে সেই রঙিন দিনগুলোর কথা। আমাদের নবীন বরণের কথা…
ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হওয়ার দুমাস বাদে আমাদের নবীন বরনের আয়োজন করা হয়েছে। একটি জাঁকজমকপূর্ণ দিন আজ। শাড়ি পরে সেজেগুজে ক্যাম্পাসে চলে এসেছি। এসে মনে হলো আমিই সবার আগে পৌঁছে গেছি। আশেপাশে পরিচিত বা স্বল্প পরিচিত মুখ কাউকেই দেখলাম না। শাড়িতে অনভ্যস্ত হওয়ায় কুচিগুলো পায়ে বেঁধে যাচ্ছে বারবার। হাঁটতে অস্বস্তি ও ভয় একই সাথে ঘিরে ধরছে। খুলে-টুলে গেলে মান-সম্মান রেখেই পালাতে হবে। ইতুর এতক্ষণে চলে আসার কথা। মেয়েটার সাথে সেই অরিয়েন্টেশন ক্লাস থেকেই একটা সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে। কেউ দেখলে বুঝবেই না আমাদের পরিচয় মোটে মাস দুয়েকের। পুরো অডিটোরিয়ামে চোখ বুলিয়েও ইতুর নাম-নিশান পেলাম না। অথচ আধ ঘণ্টা আগে বলেছে সে নাকি ক্যাম্পাসের কাছাকাছি চলে এসেছে। রাগ সামলে নিলাম। আজকের দিনে শুধুই খুশি থাকব, মজা করব।
হুট করে একটি পুরুষালি কণ্ঠ কানে এসে বিঁধল,
“ফার্স্ট ইয়ার?”
আমি চমকে তাকালাম। হাত দুই দূরত্বের লোকটি আমাকেই প্রশ্ন করেছে। কপালের মাঝে জিজ্ঞাসা সূচক ভাজ। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ক্যাম্পাসে র্যাগিং নেই বললেও সিনিয়র-জুনিয়র সম্মানের একটা রেষারেষি চলে। সেদিন শুনেছি সামান্য সালাম দেওয়া নিয়ে আমাদের এক ক্লাসমেটকে খুব হেনস্তা করেছে ইমিডিয়েট সিনিয়ররা। যদিও আমি বা ইতু এ ধরনের পরিস্থিতির মাঝে পড়িনি। সম্মুখের ব্যক্তিটি সিনিয়র কিনা তা বুঝলাম না। মৃদু স্বরে বললাম,
“জি।”
“কোন ডিপার্টমেন্ট?”
“জি? বোটানি।”
আমতা আমতা করে উত্তর দেওয়া মাত্রই লোকটা কেমন সহজ হয়ে গেল। প্রশস্ত এক হাসি দিয়ে বলল,
“আমরা তাহলে ক্লাসমেট।”
কেন জানি সঙ্গে সঙ্গে নাকের ডগায় রাগ ছুঁয়ে গেল। ভ্রু কুচকে বললাম,
“তাহলে এমন সিনিয়রদের মতো জেরা করছিলেন কেন?”
লোকটার হাসি এবার আরো খানিকটা প্রশস্ত হয়ে দাঁত বেরিয়ে এলো। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“সিনিয়র ভেবে ভয় পেয়েছিলেন না কি?”
“মোটেও না।”
নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। লোকটা শব্দ করে হেসে বলল,
“আমি আদনান। এডমিশনের পর আজই প্রথম এলাম। কিছুই চিনতে, বুঝতে পারছিলাম না বলে এদিক-ওদিক ঘুরছিলাম। আপনাকে শাড়িতে সেজেগুজে দেখে ভাবলাম নবীন হবেন।”
কথার মাঝে খেয়াল করলাম লোকটাও পাঞ্জাবিতে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে। বেশ সৌম্যদর্শন। এরই মাঝে ইতু চলে এলো। আদনানের সঙ্গে সে দ্রুতই মিশে গেল। অনুষ্ঠান শুরু হলে ভাগ্যক্রমে আমরা পাশাপাশিই বসি। এক সময় আদনান কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার নামটা জানা হলো না?”
“অনন্যা।”
“ক্লাসমেটদের আপনি করে বলাটা কী উচিৎ হবে?”
আদনানের কথায় সে মুহূর্তে আমি হেসে ফেলি। মাথা নেড়ে বলি,
“একদমই উচিৎ হবে না।”
সেই থেকে আমাদের ভালোলাগার শুরু। কখন যে ভালোবাসা তার ব্যথাহীন দাঁত দিয়ে দংশন করেছিল টেরই পাইনি। সেই দংশনের ব্যথা এখন ঠিকই টের পাচ্ছি। কাঁপনি অনুভব করতেই কল্পনার জাল ছিন্ন হলো। ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। আদনান কল করেছে। যেন কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা চাওয়া মাত্রই পেয়ে গেলাম। এক মুহূর্তও দেরি না করে কল রিসিভ করলাম।
“তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
“কী ভাবছিলে?”
“ওই যে নবীন বরনের দিন আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হলো, সেটাই।”
“তুমি আমায় সিনিয়র ভেবে ভড়কে গেছিলে। মুখটা দেখার মতো হয়েছিল।”
আদনান হেসে ফেলল। আমারও ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ঠাঁই পেয়ে গেছে। বললাম,
“মনে আছে তোমার?”
“সবটা।”
“তবুও কেন এত দূরত্ব?”
প্রত্যুত্তরে আদনান নিশ্চুপ। চোখটা আবারো সিক্ত হচ্ছে। মহা জ্বালা! কিছুতেই চোখের জল ঠেকাতে পারি না। বললাম,
“ফোন কেন দিলে?”
“সত্যি বলব?”
“মিথ্যাটা আশা করি না।”
“তোমার কণ্ঠটা শুনতে ইচ্ছে করছিল।”
ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা ছোট্টো বাক্যটা একদম হৃদয়ে গেঁথে গেল। বললাম,
“তোমার এটুকু ইচ্ছেতে আমার বেশ কয়েক রাতের ঘুম হারাম হলো।”
আদনান চুপ। আমি বললাম,
“আজ আমায় দেখতে এসেছিল জানো? পাত্র পয়ত্রিশোর্ধ্ব, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি।”
“কী বলছো!”
আদনানের কণ্ঠে বিস্ময়ের আভাস পেলাম। তাচ্ছিল্যের সাথে বললাম,
“অবাক হচ্ছো? আমি কেন জানি কিছুতেই আর অবাক হতে পারি না।”
“বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
“নাহ, দেখাদেখি হলো আরকি।”
“বিয়েটা কোরো না।”
“কেন?”
“হিউজ এইজ ডিফারেন্স। ম্যান্টালিটি ম্যাচ নাও করতে পারে। তাছাড়া সামনে তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। নিজেকে এতটা হেলা কোরো না প্লিজ!”
“তুমি হেলা করোনি?”
চোখ মুছে প্রশ্নটা করলাম। আদনান অনেকটা সময় চুপ রইল। ভারী নিশ্বাসের শব্দ ভেঙে অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল,
“আমি কী করব অনন্যা? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মায়ের বাইপাস সার্জারি হলো কিছুদিন আগে। আমার প্রতি মায়ের কিরূপ অন্ধ ভালোবাসা তুমি তো জানো। মাকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু এটাও সত্যি যে তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। আবার বাস্তব পরিস্থিতি ভুলে যা হবে দেখা যাবে ভাবনা নিয়ে তোমায় কাছে টেনে অপূর্ণতার কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। এমন পরিস্থিতি কেন এলো আমাদের মাঝে? খুব তো সুখে ছিলাম আমরা।”
আদনানের অসহায়ত্ব এই প্রথম টের পেলাম। কিন্তু এর যথাযথ উত্তর যে আমারও নেই। স্বার্থপরের মতো আদনানকে সব ছেড়ে ছুড়ে আসতে বলতে পারছি না। সে আসতে পারবেও না। নিজেকে সামলে বললাম,
“তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দোয়া ছাড়া কিছুই করতে পারব না। ভালো থেকো। আমাদের যোগাযোগ না হওয়াই মঙ্গল।”
“আর কথা হবে না?”
“হওয়া উচিৎ না।”
দৃঢ় গলায় উত্তর দিলাম। কিন্তু তবুও হৃদয়ে বিঁধতে থাকা সুক্ষ্ম ব্যথাটা এড়াতে পারলাম না।
চলবে…