#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৩]
বাবার চলে যাওয়ার এক মাস হলো। আমাদের সুখী পরিবারটি একেবারে ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। ভাইয়া বিমর্ষচিত্তে অফিস যায়, বাড়ি ফিরে ঘরেই থাকে সারাদিন। মাঝে বেশ কয়েকবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল ভাবীকে ফেরাতে। প্রতিবারই লজ্জিত, অপমানে কুণ্ঠিত মুখে ফিরে এসেছে। মা প্রায় অপ্রকৃতস্থের মতো হয়ে গেছেন। খুব বেশি কথা বলেন না। বললেও তাতে আদরের লেশমাত্র থাকে না। মাঝে মাঝে আমাদের সহ্যও করতে পারে না। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলেন। এই তো সেদিন ভাত খেতে জোর করলাম বলে ভাতের প্লেটটা আমায় গায়ে ছুড়ে মা’র’ল। হিসহিসিয়ে গা’লা’গাল করে কাঁদতে লাগল। আমি কিছুই করতে পারি না। শুধু আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদা ছাড়া। বিধাতা এই একটি গুণ আমায় ভরপুর দিয়েছেন, অফুরন্ত কাঁদার গুণ। বন্ধু, আত্মীয় বা কাজিন মহলে এ নিয়ে কত ঠাট্টা-তামাসার শিকারই না হয়েছি! পান থেকে চুন খসলেই বিনা নোটিসে চোখ ভিজে যেত। এমন হড়বড় করে কান্নার স্বভাব দেখে আপা আমায় কাঁদুনে বুড়ি বলে ডাকত। হাহ! আপারে, তুমি আমাকে দেওয়া নামের স্বার্থকতা ধরে রাখতে এভাবে কান্নার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে গেলে!
ইদানীং খেয়াল করে দেখি আমি অনেকটা শুকিয়ে গেছি। জামাকাপড় কেমন ঢিলেঢালা লাগে। শুধু আমিই না, মা ও ভাইয়াও শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। ঠিকমতো খাওয়া-ঘুম না হওয়ায় শরীরও যেন ওজন ধরে রাখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।
আমিই এখন ঘরের কর্ত্রী বনে গেছি। সব কাজকর্ম একাই করছি। দুবেলা রান্না করে তিনবেলা খাচ্ছি। আত্মীয়স্বজন আসে, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে হা-হুতাশ করে, সহানুভূতি দেখায়, এরপর যে যার মতো চলেও যায়। আমরা আবারো একাই আমাদের জীবনের ভার বইতে থাকি।
স্ফিত, রক্তিম, ভেজা চোখদুটি দেখতে হবে বলে আয়নার সামনেও যেতে ইচ্ছে করে না আর। কতদিন নিজের যত্ন নেওয়া হয় না! অথচ মাসখানেক আগেও নিজেকে ঝকঝকে, চকচকে রাখতে কত কসরতই না করতাম। মুখে একটা ছোটো স্পট পড়লেও চেষ্টা করতাম সেটা ঢেকেঢুকে আদনানের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি আমার সুখের পালে হাওয়া দিতো। বাবার মৃ-ত্যুর পর আদনান ফোন করেছিল। দরজা আটকে, ফোন রিসিভ করে দিন দুনিয়া ভুলে কাঁদতে বসেছিলাম, একটু হৃদয়ের ভার কমাতে। বিপরীতে আদনান হু হা করে ফোন রেখে দিলো। আমি বুঝলাম সম্পর্কের তাল কেটে গেছে। কিন্তু এই অমোঘ সত্যিটা কিছুইতেই মানতে পারলাম না। আদনানের যত্ন, হৃদয় উজার করা ভালোবাসা ও ছোটো ছোটো পাগলামির স্মৃতিগুলো আমার দিন রাত তাড়া করে বেড়ায়। আদনান নিজে থেকে আমায় কল দেয় না। আমি দিলেও সচরাচর রিসিভ করে না। আজও না থাকতে পেরে কল দিয়ে বসলাম। বেজে বেজে কেটে গেল। আমি থামলাম না। কল দিয়েই গেলাম। একসময় বালিশে মুখ চেপে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।
এই দুঃসহ রাতগুলোর সমাপ্তি কোথায়? যে চলে যেতে চায় তাকে আটকে রাখব কোন আশ্বাসে? আমাদের সম্পর্কটা এখন ভাসমান। কোনো পাল নেই, মাঝি নেই, বৈঠা নেই। দায়বদ্ধতা বা হৃদয়ের জোরটাও দুর্বল। যেদিকে স্রোত সেদিকেই সম্পর্কটা উদ্দেশ্যহীনভাবে বইছে। এমনিতেই জীবনে কষ্টের অভাব নেই। আর এই ভাসমান সম্পর্ক আঁকড়ে বাঁচা মানে নিজেই নিজের কষ্টের কারণ হওয়া। সারারাত ভেবে ঠিক করলাম একটা পরিণতিতে এবার পৌঁছাতে হবে। কাঁদতে কাঁদতে মাথা য’ন্ত্র’ণা নিয়ে কখন যেন ঘুমিয়েও গেলাম। পরদিন সবে রান্না চড়িয়েছি এমন সময় আদনান কলব্যাক করল। আমার হৃদয়টা ছলাৎ করে ওঠে। যেমনটা প্রতিবার করত। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম। রিসিভ করতেই আদনান ছোটো করে বলল,
“ফোন করেছিলেন অনন্যা? আমি খেয়াল করিনি।”
ওর নির্লিপ্ত ভাব প্রকাশে আমার ভীষণ রাগ হলো। সব ভেঙেচুরে দিতে ইচ্ছে হলো। আদনান সামনে থাকলে এক্ষুণি ওর বুকের কাছটায় খা’ম’চে ধরতাম, কা’ম’ড়ে দিতাম। জোর করে ভালোবাসিয়ে এভাবে কেন দূরে সরে যাচ্ছে সে? তবুও ওই কণ্ঠটার মায়া ছাড়তে পারি না বলে বে’হা’য়ার মতো সব উপেক্ষা হজম করে নেই। সে আমায় এড়িয়ে চলতে চায় জেনেও নিজের আত্মসম্মান ধরে রাখতে পারি না। আমার মেরুদণ্ড নিশ্চয়ই আমাকে ধিক্কার দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? ভাষাহীন কণ্ঠে ক্ষীণ শব্দ জুগিয়ে জানতে চাইলাম,
“এতসবের মাঝে আমার দোষটা কোথায়, আদনান?”
“মানে?”
“তুমি জানো আমি কি বলতে চাইছি।”
আদনান চুপ রইলো। আমি আবার বললাম,
“তুমি আমায় এড়িয়ে চলছো এ কথা কি অস্বীকার করতে পারবে?”
আদনানের লম্বা একটা শ্বাসের শব্দ ভেসে এলো। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে রইলাম উত্তরের আশায়। নিরবতা ভেঙে সে বলল,
“আসলে অনন্যা, আমি সবকিছু ঠিক হজম করতে পারছি না। বন্ধুবান্ধুবদের এড়িয়ে চলছি, ক্যাম্পাসেও ঠিকমতো যেতে পারছি না। তোমার আর তোমার বাড়িকে ঘিরে করা সমস্ত প্রশ্নে বিব্রত হচ্ছি। তুমি তো জানো আমার বড়ো ভাবী আমাদের সম্পর্কের কথা জানে। সব জেনে ভাবীও স্পষ্ট বলে দিয়েছে তোমাকে আমার বউ হিসেবে বাড়ির কেউ মানবে না।”
“তুমি আমার জন্য পরিবারের সঙ্গে একটু স্ট্রাগল করতে পারবে না? আমি তো কোনো দোষ করিনি।”
“বোকার মতো কথা বোলো না অনন্যা। তুমি আমাদের বাড়ির পরিস্থিতি জানো। বাবা-মায়ের মতের বাইরে এ বাড়িতে আমিও কেউ নই।”
হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম,
“আর আমাদের ভালোবাসা? সেটা এতটাই ঠুনকো ছিল, আদনান? আমার হাত ধরে তোমার বৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। তোমার বুকে মাথা রেখে আমার এক জনম পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ডিপার্টমেন্ট এর বেস্ট কাপল হয়ে উঠেছিলাম আমরা। অন্যদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। একে অপরের প্রতি নিবেদিত হয়ে আদর্শ প্রেমিক-প্রেমিকার খেতাব জুটিয়ে নিয়েছিলাম। সবটাই মিথ্যা?”
আদনান অসহায় গলায় বলল,
“কিছুই মিথ্যা নয়, অনন্যা। আমাদের ভালোবাসাটা যেমন সত্যি তেমন এটাও সত্যি যে তোমাকে আমার পরিবার মেনে নেবে না। আর আমিও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারব না। আবেগের চেয়েও আমায় বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।”
আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম,
“যে ভালোবাসা কোনোরকম প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম ছাড়াই বাস্তবতার মাঝে হারিয়ে যায় তাকে আর যাই হোক প্রকৃত ভালোবাসা বলা যায় না। সেখানে হৃদয়ের নির্মল সমর্পণ কোনোকালেই ছিল না।”
“আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছো?”
আমি অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“কেন করব না তার একটা কারণ দেখাতে পারো? গত একটা মাস আমার কেমন গিয়েছে খোঁজ নিয়েছো? জানতে চেয়েছো আমি ভালো আছি কিনা? যখন শত উপেক্ষা সহ্য করেও তোমায় কণ্ঠ শোনার আশায়, একটু সহানুভূতি পাওয়ার আশায় আমি পাগলের মতো ফোন করে যেতাম তুমি রিসিভ করতে না। পরে কলব্যাক করে শুধু হু হা করে রেখে দিয়েছো।”
“ফোন রিসিভ করলেই তুমি কাঁদো। আমি সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাই না। নিজেকে অসহায় লাগে। কী করব ভেবে না পেয়ে দিশেহারা লাগে। আমিও ভালো নেই অনন্যা।”
“তাহলে তুমি এখন কী করতে চাইছো? এভাবে তো চলতে পারে না।”
আদনান এবার অনেকটা সময় নিল। আমিও চোখ মুছে নিজেকে প্রস্তুত করলাম একটা পরিণতি টানব বলে। এক সময় আদনান বলল,
“আমাদের সময় নেওয়া উচিৎ।”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম,
“ভালো থেকো আদনান। জীবন যেদিকেই প্রবাহিত হোক, তুমি যেমনই হও না কেন, তোমার সাথে কাটানো সময়টুকুকে আমি কখনো ঘৃণা করব না। আমার জীবনে প্রথম প্রেমের মা’তাল হাওয়া এনেছো তুমি। প্রথম বিরহও তোমারই কৃপা। সেজন্য সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
আদনান কিছু বলতে চাইছিল। আমার শোনার ইচ্ছে ফুরিয়েছে। ফোন কেটে মোবাইল সুইচ অফ করে রাখলাম। ওই কণ্ঠের মায়া কাটাতে হবে। আজ এবং এখন থেকেই আমার সেই প্রচেষ্টার শুরু।
_______________
দুদিন পরের কথা। ভাইয়া অফিস থেকে ফিরল মিষ্টি নিয়ে। চোখেমুখে একটা খুশির জেল্লা খেলা করছে। অনেকদিন বাদে ভাইয়ার হাসিমুখ দেখে আমিও মৃদু হাসি টানলাম ঠোঁটে। বললাম,
“কোনো খুশির খবর আছে, ভাইয়া?”
“আছেরে অনু। আগে মিষ্টিমুখ কর তো দেখি।”
ভাইয়া নিজের হাতে আমার মুখে মিষ্টি গুজে দিলো। মুখে মিষ্টি নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। অনেকদিন পর ভাইয়ার হাসি মুখ দেখে কি যে ভালো লাগল আমার! ভাইয়া ছুটে গেল মায়ের কাছে। মাকেও জোর করে মিষ্টি খাওয়ালো। জানালো আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসছে। খবরটা শুনে হুট করেই একরাশ খুশি নেমে এলো আমাদের বিষন্ন বাড়িটায়। নতুন অতিথি! আমার ভাইয়ার একটা বাচ্চা আসছে! অনেক অনেক দুঃসংবাদের পর একটা সুসংবাদ আমাদের মন ভরিয়ে দিলো। উৎসাহিত হয়ে বললাম,
“ভাবীকে নিয়ে এলে না কেন, ভাইয়া?”
ভাইয়ার মুখটায় হঠাৎ আঁধার নেমে এলো। অনেকটা সময় আঁতিপাঁতি করে কথা খুঁজল মনে হলো। এরপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আসলে প্রথম বাচ্চা তো! তাই পিয়াসা আর তার মা চাইছে বাচ্চা ওদের বাড়িতেই হোক। এই সময় একটু বেশি যত্ন প্রয়োজন, বুঝিসই তো।”
ভাইয়ার অস্থির মুখটা দেখে মনে হলো ভাইয়া পুরো কথা জানায়নি। পুরোটা জানলাম একদিন বাদে। ভাইয়া নিজের জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে জানালো আপাতত ভাইয়া ভাবীর কাছেই থাকবে। অর্থাৎ ভাবীর বাপের বাড়ি। ভাবীর এখন মন ভালো থাকা চাই। বাচ্চার বাবা হিসেবে ভাইয়ার এ সময় সঙ্গে থাকা প্রয়োজন। আমাকে বলল,
“তুই চিন্তা করিস না, অনু। আমি দুদিন পর পরই আসব। বাজার করে দিয়ে যাব। তুই নিজের ও মায়ের খেয়াল রাখবি। কোনো দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানাবি।”
বিপরীতে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু মনে হলো ভাইয়া বোধহয় ভাবীর সঙ্গে সম্পর্ক বাঁচাতে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ভাবী তো আমাদের সঙ্গে থাকতে চায় না। সেদিন আমার পরিবার আরেকবার সংকুচিত হয়ে গেল। সংসার হয়ে গেল শুধুই মা-মেয়ের। আমার সর্বহারা মা আরেকবার সন্তান হারানোর শোকে স্তব্ধ মুখে ছেলের গমন পথে চেয়ে রইলো।
আমি নির্বাক হয়ে দুজন প্রেমিককে অবলোকন করলাম। আদনান, যে কিনা পরিবারের জন্য, সম্মানের জন্য আমার হাত ছেড়ে দিলো। অন্যদিকে ভাইয়া, যে ভালোবাসার মানুষটির পাশে থাকতে, ভরসা দিতে পরিবার ছেড়ে গেল। অথচ উভয়ের সিদ্ধান্তই আমার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলল।
চলবে…
[কপি নিষেধ]