#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[২]
‘মৃ-ত্যু’ শব্দটার ওজন ঠিক কতখানি আপনজন হারানোর ব্যথায় ব্যথিত মানুষ ছাড়া কেউ পরিমাপ করতে পারে না। এই একটা শব্দে কারো এক জনমের লালিত দেহের সমাপ্তি। সমাপ্তি তার প্রাণে জন্ম নেওয়া প্রতিটি মূল্যবান কিংবা মূল্যহীন অনুভূতি, আকাঙ্খা, স্বপ্ন ও সম্পর্কের। মৃ’ত্যু শুধু মৃ’ত ব্যক্তির জীবনের সমাপ্তিই ঘটায় না, তার সঙ্গে জড়িত জীবিত প্রাণের মাঝেও দগদগে ঘা সৃষ্টি করে। বদলে দেয় অনেকের জীবনের সমীকরণ।
শুভ্রা আপার জানাযা সম্পন্ন হয়েছে পরদিন জোহরের পর। মসজিদের মাইকে এলান হয়নি। দলে দলে লোক আসেনি। আমাদের এলাকার বড়ো মসজিদের ইমাম সাহেব আপার জানাযা পড়তে রাজি হননি। তিনি আ’ত্ম’হ’ত্যাকারীদের জানাযা পড়েন না। তাই পরিচিত কিছু মানুষ নিয়ে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। আপার জানাযায় রাশেদ ভাই, ভাইয়া ও মামারা উপস্থিত ছিলেন। বাবা ছিলেন না। তিনি এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আপার সংবাদটা পেয়ে বড়ো রকমের কোনো ক্ষতি হোক কেউই চাইনি। বাবা যতই বলুক আপার মুখ দেখবেন না, আমরা সবাই জানি আপা হচ্ছে বাবার কলিজার সবচেয়ে বড়ো অংশটা। অথচ বাবা জানেনই না উনার দ্বিতীয় সন্তান, উনার এত বছরের গর্ব ও আদরের কন্যা আজ পৃথিবীর মাটিতে সমাহিত হয়েছে। মিলিয়ে গেছে কালো গহ্বরে।
রাশেদ ভাই আপাকে কবরের ভেতর শুইয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। উনার হাতে, নখে, সাদা পাঞ্জাবিতে মাটি লেগে আছে। চোখ টকটকে লাল। আমি চোখ মুছে উনার কাছে যেতেই রাশেদ ভাই বললেন,
“তোমার আপা আঁধারে খুব ভয় পেতো। রাতের বেলাতেও সে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতো। কত যে ঝ’গড়া করেছি তা নিয়ে। আজ কি করে ওই নির্জন বাঁশঝাড়ের ভেতর শুয়ে আছে? আমি আজ থেকে কার সাথে ঝ’গড়া করব অনু?”
“আপনি আপার ওপর রাগ জমিয়ে রাখবেন না, রাশেদ ভাই।”
আমার অনুরোধ শুনে রাশেদ ভাই চোখের জল সামলে উত্তর দিলেন,
“তাকে আমি ভালোবেসেছি। রাগ বা ঘৃ’ণা করার প্রশ্নই আসে না। মানুষটাই তো নেই। শুধু যেটা জমিয়ে রাখলাম তা হলো অভিমান। জানা হলো না আমার কমতিটা কোথায় ছিল? কেন সে আমায় নরক য’ন্ত্র’ণা দিয়ে পালিয়ে গেল?”
এই প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে? আমার চোখ আবারো ভিজে উঠল। রাশেদ ভাইয়ের পরিবার আমাদের ওপর কত নোংরা বিশেষ উপাধি দিয়ে, ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গেছেন। আর এই মানুষটার চোখে আমি অভিমান ও ঠকে যাওয়ার য’ন্ত্র’ণা ছাড়া কিছুই খুঁজে পাই না। হায় আপা, আপারে! রাশেদ ভাই যাওয়ার আগে বলে গেলেন পরিস্থিতি যেমনই হোক, তিনি আমাদের ভাই হয়েই থাকবেন। আপার একটা ভুলের জন্য আমাদের সঙ্গে উনার সম্পর্ক বিগড়াবে না।
আমার বড়ো ভাইয়ার নাম তুষার। বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বেশ ধীরস্থির একজন মানুষ। পেশায় একজন ব্যাংক কর্মচারী। তিন বছর আগে ভাইয়া চাকরি পাওয়ার পর প্রেমের অবসান ঘটিয়ে পিয়াসা ভাবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ভাইয়ার চাকরি পাওয়ার পেছনে পিয়াসা ভাবীর পরিবারেরই রেফারেন্স আছে অবশ্য। ভাবীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ওপরে। আমাদের সবকিছু নিয়েই উনারা নাক সিটকান। তবে ভাইয়াকে জামাই হিসেবে উনাদের বেশ পছন্দ। ভাবীর বাবার ভাষ্যমতে তিনি ভাইয়ার ভেতর বড়ো কিছু করার সম্ভাবনা দেখতে পান। শুধু সঠিক গাইডলাইন দরকার। যেটা ভাবীর পরিবার দেবেন। সেজন্যই অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আপার এমন একটা কাণ্ড শুনে উনারাও বাড়ি বয়ে এসে বেশ মুখ ছড়িয়ে কথা শোনালেন। আমার মা যেন একজন জড়মানবী। মানুষের কথা শুনে শুনে এখন মুখে আর কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভেতরটা হা’হা’কার করে ওঠে। এ কেমন পা’ষ’ণ্ড সময় যাচ্ছে আমাদের! এর শেষ কোথায়? কিন্তু তখনো বুঝিনি সামনে আরো কত ধাক্কা, কত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন অতিবাহিত হতে চলেছে।
ভাবীর পরিবার নাকি ভাবীকে এই বাড়িতে রাখতে চান না। এমনিতেই টানাটানির সংসার। আবার বাড়ির পরিবেশও নাকি অসুস্থ। এতে ভাবীর মানসিক অবস্থা খারাপ হবে। তাছাড়া আপার জন্য তাদেরও নাকি সম্মানহানি হয়েছে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন। ভাবীর মতামতও তার পরিবারের অনুকূলে। সিদ্ধান্ত শুনে চোখের সামনে যেন আরেকটি নিশ্চিত ভাঙনের আভাস পেলাম।
ভাইয়া শ্বশুর বাড়ির সবাইকে অনেক বোঝাল। মাথা নুইয়ে অনুরোধ পর্যন্ত করল। ভাবীর পরিবার একটু নরম হলেও এবার ভাবী বেঁকে বসল। সে এ বাড়িতে আর থাকবে না। আমাদের হাজারটা দোষ। আমাদের সাথে নাকি টেকা যায় না। সেদিনই ভাবী বাড়ি ছাড়ল। ভাইয়া কেমন অসহায় হয়ে গেল। বাবা হসপিটালে, মা পাগলপ্রায়, এমন অবস্থায় ভাবীর চলে যাওয়ার ধাক্কাটা যেন একটু বেশিই জোরে লাগল। ভাইয়া মুষড়ে পড়ল। আমার খুব মায়া হলো। যে পুরো পরিবারের একমাত্র ভরসা তাকে ভরসা দেওয়ার কেউ নেই। আমি ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললাম,
“চিন্তা কোরো না ভাইয়া। ভাবীর রাগ পড়লেই ফিরে আসবে।”
ভাইয়া আমার আশ্বাসে মাথা ঝাকালো। কিন্তু আমি জানি, মন থেকে সে একদমই শান্ত নেই। ভাইয়া মাথা তুলে তাকাল। আমার এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“সকাল থেকে কিছু খাসনি, অনু?”
আমি কান্না গিলতে চেষ্টা করি। দুদিন ধরে বাড়ির কেউই খায়নি। চুলায় আগুন জ্ব’লেনি। বড়ো মামা রাতে জোর করে একটুকরো রুটি আমার মুখে গুজে দিয়েছিলেন। গলা দিয়ে নামেনি। ভাইয়া বলল,
“তুই মায়ের কাছে থাক। আমি বাইরে থেকে খাবার কিনে আনি। খেয়ে হাসপাতালে যাব।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই ভাইয়া বেরিয়ে গেল। আরেকটি দিনের আলো ফুরাচ্ছে। ধীরে ধীরে চারিদিক আবছা হয়ে উঠছে। আরেকটি নির্ঘুম রাত নেমে এলো বুঝি! দিনগুলো একের পর এক ঘটনার ভেতর দিয়ে দ্রুত চলে যায়। সেসব নিয়ে দুঃখ বিলাস করতে রাতটা ফেলে যায়। আমি বাড়ির সবগুলো আলো জ্বেলে দিলাম। মায়ের ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দিলাম। হুট করে আলোর তীব্রতা সইতে না পেরে মা দুর্বল হাতটা চোখের ওপর ধরলেন।
“আলো নিভিয়ে দে।” মায়ের নিস্তরঙ্গ স্বর। গত দুদিনে আজই মা এমন শান্ত স্বরে কথা বললেন। আমি সাহস পেয়ে এগিয়ে মায়ের পাশে বসলাম। বললাম,
“একটু চোখে-মুখে পানি দিয়ে নাও, মা। ভাইয়া খাবার আনতে গেছে। খেয়েই বাবার কাছে যাব আমরা।”
মা উঠল না। আমার দিকে তাকালও না। বালিশে অবিন্যস্তভাবে পড়ে রইল। আমি দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে নিজের রুমে ঢুকলাম। এতক্ষণে ফোনের কথা মাথায় এলো। ওয়্যারড্রোব থেকে ফোনটা বের করলাম। সেই যে ইতুর কল কে’টে ফোনটা বন্ধ করেছিলাম আর খোলা হয়নি। পাওয়ার অন করে আগে ওয়াই-ফাই অন করলাম। ওয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার সব চেক করলাম। পরিচিত, স্বল্পপরিচিত অনেক মানুষ নক দিয়েছে। বন্ধুরা সমবেদনা জানিয়েছে। অথচ কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির থেকে কোনো ফোন বা ম্যাসেজ নেই। আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম, পেলাম না। হৃদয়ে সুক্ষ্ম জ্বা’লাপো’ড়া টের পাচ্ছি। সংকোচ ভুলে ইতুকে ফোন দিলাম। ইতু ফোন রিসিভ করেই উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“অনন্যারে, তুই কেমন আছিস? বাড়ির সব ঠিক আছে তো?”
“আছি। আদনানের কোনো খোঁজ জানিস? তোকে নক করেছিল আমার ব্যাপারে? আমি ফোন বন্ধ রেখেছিলাম।”
“না তো। কাল থেকে আদনানকে ক্যাম্পাসে দেখিনি।”
“আচ্ছা, রাখছি।”
“শোন, তুই কয়েকদিন ক্যাম্পাসে আসিস না।”
“কেন?”
ইতু বোধহয় ইতস্তত করল। একটু সময় নিয়ে বলল,
“আসলে তুই এখন ডিপার্টমেন্ট এর হট টপিক। এখন এলে এরা তোকে কথার বা’ণে ছি’ড়ে ফেলবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমি তোকে জানাব।”
আর কিছু শুনতে ইচ্ছে হলো না। ক্যাম্পাসে যাওয়া নিয়ে মাথা ব্যথা নেই আমার। সমস্ত চিন্তা গিয়ে একত্রিত হচ্ছে আদনানের কাছে। আদনান আমার সহপাঠী। আমরা একইসাথে বোটানি ডিপার্টমেন্ট-এ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। তবে সহপাঠীর বাইরেও আমাদের একটি বিশেষ হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক রয়েছে। বছর দেড়েক আগে আমাদের নবীন বরণের দিন আদনানের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। বলাই বাহুল্য প্রথম সাক্ষাতেই আমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করি। সেই পছন্দকে ভালোবাসায় রূপান্তর করতে যা যা প্রয়োজন আদনান গত এক বছরে তাই তাই করেছে। অবশেষে আমরা রিলেশনশিপে আছি গত চারমাস যাবত। আমার একুশ বছরের জীবনে ভালোবাসার হরেক রঙ সে নিজ দায়িত্বে ছড়িয়েছে। কিন্তু গত দুদিনে আদনান আমার সঙ্গে যোগাযোগের নূন্যতম চেষ্টাটুকুও করেনি শুনে আরেকবার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। হৃদয়ের কাছের মানুষের একটু সঙ্গ, আদুরে বাক্য অনেক অব্যক্ত ব্যথার উপশম দেয়, যা গত দুদিনে আমার পরিবারের কারো কপালেই জোটেনি। অদৃষ্টের ওপর করুণা হলো। বিষাদময় সন্ধ্যায় উড়ে আসা বাতাস যেন কানে কানে বলে যাচ্ছে সে আর আমায় চায় না।
ভাইয়ার ডাক পেলাম। খাবার নিয়ে চলে এসেছে। দ্রুত চোখে-মুখে পানি দিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হলাম। ভাইয়া আমাকে খাবার বাড়তে বলে মাকে আনতে গেল। আমি রান্নাঘর থেকে থালা এনে সবে খাবারের প্যাকেট খুলেছি এমন সময় ভাইয়ার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে বড়ো মামার নামটা জ্বলজ্বল করছে। বড়ো মামা বাবার সাথে হাসপাতালে আছেন। কোনো দরকার হলো কিনা! ভেবে আমিই কলটা রিসিভ করলাম।
খাবার যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে রইল। কারো গলা দিয়ে একফোঁটা পানি অবধি নামল না। অথচ চোখ দিয়ে গড়ালো এক সমুদ্র জল। মেয়ের প্রতি তীব্র অভিমানে, অপমানে বাবা আমাদের সবাইকে শা’স্তি দিয়ে চলে গেছেন। আমাদের মাথার ওপরের ছায়াটাও আজ সরে গেছে। আরেকটা কালো রাত আমাদের সীমাহীন য’ন্ত্র’ণায় পি’ষ্ট করতে দা’নবের হাসি দিলো।
চলবে…